রঙ চা☕
পর্বঃ০১,০২
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
কলিংবেল বাজতেই প্রায়াণ উঠে দরজা খুলে। ছোট্ট ছিপছিপে শ্যামবর্ণের একটা মুখ, চোখভর্তি তার মায়া,মুখে হাসি জড়ানো। মিহি কণ্ঠে বললো,
———প্রেমা নেই ভাইয়া?
প্রায়াণ মুগ্ধ নয়নে নিশুতির দিকে তাকিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে ইশারা করে। নিশুতি কপাল কুঁচকে বলে,
———আংকেল বাসায়?
প্রায়াণ মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাকায়।
নিশুতি বলে,
———-তাহলে আর ভেতরে যাবো না। এই ট্রে টা ধরুন তো। প্রেমাকে দিয়ে দিবেন।
প্রায়াণ ট্রে টা ধরে। তাতে ৫ কাপ রং চা।
নিশুতি বলে,
———বড় ভাইয়া তো বাসায় নেই বোধহয় তাই ৫ কাপ দিলাম। আন্টিকে বলবেন,আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ওকে?
প্রায়াণ ঘাড় অব্দি মাথা কাত করে অস্ফুটস্বরে বলে,
———-ওকে।
নিশুতি চোখ বড় বড় করে বলে,
———-আপনি দেখি কথাও বলতে জানেন! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বোবা!
প্রায়াণ কি জবাব দিবে ভেবে পায় না। প্রায়াণ কে আবার থম মেরে যেতে দেখে নিশুতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। মানুষকে কনফিউশনে ফেলে দিতে তার ভীষণ ভালো লাগে।
নিশুতি চলে যায়। প্রায়াণ পা দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে যায়।
.
.
জালাল শেখ আর মিনু শেখের ছোট ছেলে প্রায়াণ,বড় ছেলে প্রত্যুষ। আরও দুটি মেয়ে আছে তাদের। বড় মেয়ে প্রেমা,ছোট মেয়ে পিউ। এই চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।
.
মিনু শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। প্রায়াণকে আওয়াজ লাগান তিনি।
———প্রায়ু…কে এসেছে বাবা?
প্রায়াণ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
———-পাশের বাসা থেকে একটা মেয়ে চা দিয়ে গেলো।
পিউ চায়ের কথা শুনে নড়েচড়ে উঠে। চা আবার তার খুব বেশিই প্রিয় কিনা!
উল্লাসিত কণ্ঠে বলে,
———-আমি কিন্তু দুই কাপ খাবো।
প্রেমা মাঝখান দিয়ে বলে,
———খাইস। এমনিতেও প্রায়াণ ভাইয়া রঙ চা খায় না!!
প্রায়াণ টি-টেবিলের উপর ট্রে রেখে সবার আগে আগে এক কাপ চা তুলে নেয়। প্রেমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
——–আগে খাইনি,এখন খাবো।
মিনু,পিউ,প্রেমা তিনজনই বেশ অবাক হয়। মিনু ভ্রু কুঁচকে বলে-
———-মাইরাও তোকে রঙ চা খাওয়াতে পারিনি কখনো। আর আজকে নিজে থেকেই খাচ্ছিস! ব্যাপার কি আব্বাজান?
প্রায়াণ লজ্জা পায়। মুচকি হেসে সোফার উপর বসে।
জালাল শেখ রুমে ঢোকেন। মিনু বলে,
———চা খাও। শীতের সন্ধ্যায় রঙ চা খাওয়ার মজাই আলাদা।
.
.
রাতের বেলা সবাই ভাত খাওয়া শেষ করে একসাথে গোল হয়ে বসে বিছানার উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে। প্রত্যুষ ও আছে এবার। কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে এসেছে সে।
আড্ডার টপিক প্রত্যুষের বিয়ে।
মিনু শেখ জালাল শেখের উদ্দেশ্যে বলে,
————তোমার তো কত বন্ধু আছে। দেখো না,কোথাও একটা ভালো মেয়ে পাও কীনা! মেয়ে বড়লোক ঘরের হতে হবে না। শুধু নামাজ কালাম জানা আর সংসারের সব কাজ জানা হলেই চলবে।
পিউ ফোড়ন কাটে।
———-আর হালকা নাঁচ গান ও জানতে হবে। মাঝে মাঝে বিকেলে আমরা সাউন্ড বক্স ছেড়ে তিনজনে নাঁচবো। কী প্রেমা আপু ঠিক বলছি না?
প্রেমা হাসে। পিউর চুল টেনে বলে,
———সব কিছুতেই তোর নাঁচ গান!!
মিনু শেখ দুজনকে ধমকে উঠেন।
———আহ!! চুপ কর তো তোরা!
জালাল শেখ প্রত্যুষের দিকে তাকিয়ে বলেন,
———–তোর কেমন মেয়ে পছন্দ?
প্রত্যুষ জবাব দেয় না। তার এই টপিক টা মোটেও ভালো লাগছে না। কী এমন বয়স হয়েছে তার যে এখনি বিয়ে দেওয়ার জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে!!
প্রত্যুষ চুপ করে আড্ডা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। জালাল শেখ গর্জে উঠেন।
———-দেখলা মিনু!! তোমার ছেলে কখনো বাপের কথা গুরুত্ব দেয় না। কেমনে বেয়াদবের মতো উঠে চলে গেলো।
মিনু শেখ পালটা ধমক দেন জালাল শেখ কে। গরম গলায় বলেন,
———-নিজের বিয়ের কথা শুনতে লজ্জা লাগছিল বোধহয় তাই চলে গেছে। এত ফ্যাচ ফ্যাচ করো ক্যান তুমি??
জালাল শেখ বউয়ের ধমকে ভেজা বিড়াল হয়ে যান। প্রেমা পিউ মুখ টিপে টিপে হাসে।
এতক্ষণ কোনো কথা না বললেও প্রায়াণ এবার বলে,
———–আব্বু,ভাইয়ের কথা বাদ দাও না। আমার কথা শুনো। আমার কেমন মেয়ে পছন্দ শুনো….
যার গায়ের রঙ থাকবে শ্যামবর্ণ, চোখভর্তি তার মায়া থাকতেই হবে আর মুখ টা যেন হয় হাসি হাসি। এরকম একটা মেয়ে আমি বিয়ে করবো…
প্রেমা কনুই দিয়ে প্রায়াণ কে গুতো মেরে উঠে। প্রায়াণ মায়ের দিকে তাকায়। মিনু শেখ গরম চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। জালাল শেখ গলা খাকারি দিয়ে উঠেন।
———তোর বিয়ের কথা চলছে নাকি প্রত্যুষের?? যা এখান থেকে….
প্রায়াণ হাসি দিয়ে উঠে পড়ে।রুম থেকে বের হতে বের হতে বলে,
———আমার কিন্তু এমন মেয়েই চাই। আগে থেকেই বলে রাখলাম।
.
.
.
রাতের বেলা প্রায়াণের রুমে কম্বল দিতে এসে দেখে প্রায়াণ কাগজে কিছু লেখালেখি করছে।
প্রেমা কপাল কুঁচকে বলে,
———–রাত বাজে ১২ টা!! এখন আবার কি পড়তে বসলা?
প্রায়াণ কাগজের ভেতর মুখ গুঁজেই বলে,
———–পড়তে বসি নাই। লিখতেছি কিছু। তুই যা।
প্রেমা মুখ ভেংচি কাটে। সেটা প্রায়াণ আদৌও দেখে কীনা কে জানে! কেননা তার নজর কাগজের ভেতরেই নিবদ্ধ।
প্রেমা রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই প্রায়াণ আবার ডেকে উঠে। প্রেমা দাঁড়ায়। প্রায়াণ হাতের ইশারায় তাকে কাছে আসতে বলে।
প্রেমা প্রায়াণের কাছে আসলে প্রায়াণ বলে,
———-পাশের বাসার ঐ মেয়েটার নাম কি রে??
প্রেমা সন্দিহান দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
———সন্দেহ।
প্রায়াণ নাক মুখ কুঁচকে বলে,
———সন্দেহ নাম?
———উহু না রে বাবা। মেয়ের নাম তো নিশুতি.. আমি বললাম,আমি সন্দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছি।
প্রায়াণ স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে,
——–নিশুতি! বাহ নাম টা তো দারুণ।
——–হুম। আর মেয়েটাও বেশ দারুণ। কিন্তু কপাল পোড়া।
———কেন?
প্রেমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
———-মা নেই। সৎ মা বাসায়। ঘরের সমস্ত কাজ মেয়েটাকে করায়। তবুও কত অত্যাচার করে। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই মেয়েটাকে মারধোর করে।
প্রায়াণের হুট করেই রাগ উঠে যায় মাথায়। রাগে তার রগ কাঁপতে থাকে।
প্রায়াণ গম্ভীর গলায় বলে,
———ওর বাবা নেই?
———আছে তো। কিন্তু সে তো বউয়ের কথা উঠে,বউয়ের কথায় বসে। মেয়ের দিকে খেয়াল করার সময় আছে নাকি তার!!
প্রায়াণ নিচু গলায় একটা গালি দিয়ে বসে নিশুতির বাবা নামক প্রাণি টাকে।
প্রেমা বলে চলে-
———তবে একজন আছে ওদের বাসায় যে নিশুতিকে খুব সাপোর্ট করে। ইফতি,নিশুতির ভাই। সৎ ভাই কিন্তু একদম আপন ভাইয়ের মতো নিশুতির চেয়ে ৪ বছরের ছোট সে। তবুও নিশুতিকে খুব সাপোর্ট করে ছেলেটা। এই তো কয়েকদিনের আগের ঘটনা। নিশুতির হাত থেকে ভুল করে একটা কাঁচের গ্লাস পড়ে ভেঙে পড়ে যায়। মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে গেছিল একদম। ঐ ডাইনি মহিলা মেরেই ফেলতো ওকে। পরে ইফতি গ্লাস ভাঙার দায় নিজের উপর নিয়ে নেয় বিধায় নিশুতি মাইর খাওয়া থেকে বেঁচে যায়।
প্রায়াণের শরীর রাগে তিরতির করে কাঁপতে থাকে। তার এত কেন রাগ হচ্ছে সে নিজেও তার কারন খুঁজে পায় না।
প্রেমা কে বলে,
———মেয়েটা এখানে পড়ে আছে কেন! বিয়ে করে নিয়ে অন্যের ঘরে চলে গেলেই তো পারে। এত কষ্ট সহ্য করা লাগতো না।
প্রেমা মৃদু হেসে বলে,
———-অন্যের ঘরে তো এর থেকেও বেশি অশান্তি থাকতে পারে। তাইনা? যাইহোক,মেয়েটার ডাক্তার হওয়ার খুব শখ। মেধাও ভালো। এস এস সি তে এ প্লাস পেয়েছে।
———-ওহ! এখন কিসে পড়ে?
———-এবার ইন্টার পরীক্ষা দিলো। সামনে রেজাল্ট দিবে। আমি মাঝে মাঝে যাই ওদের বাসায়। তখন অনেক গল্প করি দুজনে।
প্রায়াণ গোমড়া মুখে বললো,
———ভালো।
প্রেমা হাই তুলতে তুলতে বলে,
———এবার যাই ভাইয়া? ঘুম পাচ্ছে।
প্রায়াণ নিচু গলায় বলে,
———-যা।
———-গুড নাইট ভাইয়া।
প্রেমা উঠে চলে যায়।
প্রায়াণ চুপ করে বসে থাকে।বারবার নিশুতির মুখ টা ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। মেয়েটা কত যন্ত্রণায় আছে!! অথচ দেখলে মনেই হয় না..!
প্রায়াণ এর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
.
.
এত রাতে ছাদে কারো অবয়ব দেখে নিশুতি ভয়ে কেঁপে উঠে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
——–কে?? কে ওখানে!!
প্রায়াণ কিছুক্ষণ আগেই এসেছিল ছাদে। সিগারেট খেতে। রাতে ভাত খাওয়ার পর তার একটা সিগারেট না হলে চলে না।
প্রায়াণ ও এভাবে নিশুতিকে এখানে দেখবে, তাও এত রাতে!! কল্পনাতেও ভাবেনি।
প্রায়াণ নিচু গলায় বলে,
——–আমি, প্রায়াণ।
নিশুতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
———-ওহ! প্রেমার ভাই? তা ভাইয়া আপনি এখানে।
প্রায়াণ কোনোমতে বলে,
———-এমনিতেই আসছিলাম। একটু হাটাহাটি করার জন্য!
নিশুতি মুচকি হেসে বলে,
———–হাটাহাটির জন্য নাকি সিগারেট খাওয়ার জন্য ভাইয়া?
প্রায়াণ থতমত খায়। কেমনে বুঝলো মেয়েটা!!
নিশুতি আবার বলে,
———-আমি বুঝতে পারছি আপনি কেন এসেছেন। যাকগে,সে সব। আপনি ওদিক টায় খান গিয়ে। আমি আবার এসবের গন্ধ সহ্য করতে পারিনা। আর এখন আমার এখানে কাজ আছে।
প্রায়াণ কপাল কুঁচকে বলে,
———–এত রাতে ছাদে কি কাজ তোমার!
নিশুতি আবারো মুচকি হাসে। প্রায়াণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটার হাসি দেখে।
নিশুতি হাতে তুরি মারতেই ছাদের স্টোর রুমের ভেতর থেকে একটা কুকুর বেরিয়ে আসে। ছোট্ট বাচ্চা কুকুর।
নিশুতি কুকুর টাকে কোলে নিয়ে বলে,
———৩ মাস আগে থেকেই ওকে পালি আমি। আম্মু বাসায় জায়গা দেয় না তাই ছাদে ঘর করে দিয়েছি ওর। ওখানেই থাকে। আমি আসি প্রতিদিন ওকে,এই সময়টায় খাবার দিতে।
নিশুতি কুকুর টাকে কোল থেকে নিচে নামিয়ে দেয়। কুকুর টাক নিশুতির গা ঘেঁষে দাড়ায়। শীতে কাঁপছে বোধহয়।
নিশুতি পলিথিনে করে নিয়ে আসা ভাত তরকারির অবশিষ্ট একটা ভাঙা প্লেটে বেড়ে দেয়। কুকুর টা গপ গপ করে গিলতে থাকে।
নিশুতি মুগ্ধ নয়নে কুকুর টার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর প্রায়াণ নিশুতির দিকে….
দুজনেই চুপচাপ।
নিরবতা ভাঙে প্রায়াণ।
বলে,
———-নাম কী ওর?
———-স্নুপি।
———–স্নুপি??
———–হুম।
————বাহ! সুন্দর তো।
———–হুম।
স্নুপির খাওয়া শেষ হয়। নিশুতি একটা চাদর নিয়ে এসেছে সাথে করে। সেটা খুব সুন্দর করে জড়িয়ে দেয় স্নুপির গায়ে। তারপর কোলে করে স্টোর রুমে নিয়ে যায়। স্টোর রুমের ভেতরে এক কোণায় কার্টন, তুলা,আর টুকরো কাপর দিয়ে একটা জায়গা করা। প্রায়াণ ভাবে এটাই বোধহয় স্নুপির ঘর।
নিশুতি সেখানে শুইয়ে দেয় স্নুপিকে। স্নুপি গুটি মেরে শুয়ে থাকে।
নিশুতি নিচু গলায় বলে,
———গুড নাইট স্নুপি। সকালে দেখা হবে আবার। কেমন?
স্নুপি কী বুঝলো কে জানে! কেউ কেউ করে উঠে দুইবার শুধু। নিশুতি মিষ্টি করে হেসে স্নুপির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।
.
.
স্টোর রুম থেকে বের হয়ে নিশুতি বলে,
———ভাইয়া এবার আপনি সিগারেট খেতে পারেন। আমি আসি।
ছাদের গেইটের কাছাকাছি অব্দি যেতেই প্রায়াণ ডাকে নিশুতিকে। নিশুতি পেছন ফিরে তাকায়। প্রায়াণ মৃদু হেসে বলে,
——–গুড নাইট।
নিশুতিও মুখে হাসি এঁকে বলে,
——–আপনাকেও।
এরপর চলে যায়। ছাদে একা প্রায়াণ দাঁড়িয়ে রয়। তার আর এখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে নিশুতিকে আবার ডাকতে। নিশুতির সাথে গল্প করতে….
চলবে……
রঙ চা☕
পর্বঃ০২
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
সকাল সকাল চেঁচামেচির শব্দে প্রায়াণের ঘুম ভেঙে যায়। ভার্সিটি না থাকলে সে সচরাচর সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। তার উপর এখন শীতকাল। এখন তো সকাল সকাল উঠার মানেই হয়না। বোমা মেরেও কেউ প্রায়াণ কে সকাল বেলায় উঠাতে পারবে না। অথচ,এখন নিজে থেকেই উঠতে হচ্ছে!!
প্রায়াণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। চওড়া গলায় ডাকে প্রেমা কে।
————প্রেমা….প্রেমা….এই কুত্তি…!!
প্রেমা চা বানাচ্ছিল। খুন্তি নিয়ে প্রায়াণের রুমে ঢোকে।
———সমস্যা কী তোমার ভাইয়া!! আর আমি কুত্তি? তবে তুমি কি?
প্রায়াণ ভাব নিয়ে বলে,
———-আমি ভালো মানুষ।
———-ওরে! আসছে আমার ভালো মানুষ! তোমার মতো বদ দুনিয়াতে আর একটাও নাই।
প্রায়াণ চোখ গরম করে বলে,
———-বেশি প্যাচাল পারিস না। খাবি কানের তলায় দুইটা।
তোরে যে কামে ডাকছি,সেইটা শোন।
প্রেমা বিরক্তির গলায় বলে,
———-কী?
———–চেঁচামেচি করতেছে কে এই সাত সকালে?
নিশুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
———–আর কোথা থেকে হবে! নিশুতিদের বাসায় হচ্ছে। মনে হচ্ছে,মেয়েটাকে মারছে ওর ডাইনি মা!!
প্রায়াণ কপাল কুঁচকে বলে,
———-সিউর তুই?
———-হুম। ঐ ঘর থেকেই তো শব্দ আসছে চিল্লাচিল্লির।
প্রায়াণ গম্ভীরমুখে বলে,
———–ওহ।
প্রেমা চলে যায়। চায়ের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে তার। প্রায়াণ বিছানার উপরেই বসে থাকে থম মেরে। ক্ষমতা থাকলে এক্ষুনি একবার যেত সে নিশুতিদের বাসায়। তারপর ওর মাকে যে কি করতো….!! প্রায়াণ মনে মনে বিশ্রি গালি দেয় নিশুতির সৎ মাকে।
.
প্রায়াণ ফ্রেশ হয়ে রুম আসতেই শোনে চিল্লাচিল্লি আরো বেশি বেড়ে গেছে। এবার নিশুতির গলাও শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।
প্রায়াণ আর থাকতে পারে না। দরজা খুলে তাদের বাসার। প্রায়াণ দের বাসার পাশের ফ্লাট টাই নিশুতিদের। প্রায়াণ ভাবে একবার কলিংবেল দিক। আবার ভাবে,তাতে ওর মা নিশুতিকে সন্দেহ করতে পারে,ব্যাপার আরো বিগড়ে যেতে পারে।
প্রায়াণ কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না কোনো। কিভাবে নিশুতিকে ঐ জাহান্নাম থেকে বের করা যায় সেটিই চিন্তা করছে বারবার।
.
প্রায়াণের মনের চিন্তা দূর করে দেয় মিনু শেখ। প্রায়াণ কে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে,
———-আব্বাজান,এখানে দাঁড়িয়ে আছো ক্যান? কোনো সমস্যা আব্বাজান?
প্রায়াণ ভাবে সে না যেতে পারে,তার মাকে তো পাঠাতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
প্রায়াণ বলে,
——–আম্মু এই বাসা থেকে অনেক চিল্লাচিল্লির শব্দ আসতেছে। দেখো না, কি হইছে ভিতরে।
মিনু শেখ সকাল থেকেই শুনতেছেন শব্দ। তবুও এতক্ষণ চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন নিজের ছেলে বলায় আর চুপ করে থাকতে পারেন না।
নাক মুখ কুঁচকে নিচু গলায় বলে,
——–ইফতির মা একটা ডাইনি রে বাবা। সৎ মা হলেও এত অত্যাচার করতে হয় বুঝি!! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দু এক কথা শুনিয়ে দেই ঐ মহিলা কে। আবার ভাবি থাক,আমার এত কিসের ঠ্যাকা!!
প্রায়াণ বিরক্তির গলায় বলে,
——-এসব কথা বাদ দিয়া এখন যাও না মা। দেখো না কি হইছে!!
মিনু শেখ কপাল কুঁচকে ছেলের দিকে তাকান। নিশুতির জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে কেন প্রায়াণ! কিছু কিছু বুঝলেও প্রকাশ করেন না তিনি। স্বাভাবিক গলায় বলে,
——-যাচ্ছি।
.
নিশুতিদের বাসার কলিংবেল বাজতেই ইফতি দরজা খুলে দেয়। মিনু শেখ কে দেখে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
——-আন্টি আমার বোন কে বাঁচান। আম্মু ওকে মেরেই ফেলবে আজ নয়তো।
মিনু শেখ দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোকেন। গিয়ে দেখেন বিছানার এক কোণায় চুপ করে বসে আছে নিশুতি। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। আর তার সৎ মা শারমিন হোসেন শলার ঝাড়ু দিয়ে প্রহার করে যাচ্ছে তাকে। বাম হাতের বাহুতে কয়েকটা শলা ঢুকে গেছে ইতিমধ্যে। বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। রক্তারক্তি অবস্থা….
মিনু শেখ আৎকে উঠেন। শারমিন হোসেন এর হাত থেকে শলার ঝাড়ু কেড়ে নেন তিনি। বাজখাঁই গলায় বলেন,
——–পাগল টাগল হয়েছে গেছেন নাকি ভাবী?? মারতেছেন ক্যান মেয়েটারে এমনে?? মইরা গেলে??
শারমিন হোসেন রাগী গলায় বলেন,
——-মরলে মরুক। মরলেও তো বাইচা যাই। এই ছেড়ি টারে আর সহ্য করবার পারি না আমি।
মিনু শেখ নিশুতির হাত ধরে তাকে টেনে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসে। নিশুতির বাসায় থাকলে এখন শারমিন তাকে আরো মারবে নির্ঘাত।
পেছন পেছন ইফতিও আসে।
নিশুতিকে সোফায় বসান মিনু। পিউ কে বলে ব্যান্ডেএইজ বক্স নিয়ে আসতে। কিন্তু পিউ নিয়ে আসার আগে প্রায়াণই ব্যান্ডএইজ বক্স নিয়ে রুমে ঢোকে। নিশুতির পাশে বসে সে।
হাতের বেশ কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। প্রায়াণ তুলোর মাথায় কফিসল্ট লাগিয়ে নিশুতির হাতের কাটা জায়গা গুলোয় আলতো করে চেঁপে ধরে এক এক করে। নিশুতি কেঁপে কেঁপে উঠে। ভীষণ জ্বলে যাচ্ছে তার।
নিচু গলায় বলে,
——-প্রায়াণ ভাইয়া,আর দিও না। জ্বলছে খুব।
প্রায়াণ নিশুতির মুখের দিকে তাকায়। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে তার। কালকেও মেয়েটার মুখে হাসি জড়ানো ছিল! আর আজ!!
প্রায়াণ চোখ সরিয়ে নেয় নিশুতির থেকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না ওর দিকে। রাগ বাড়ছে নিশুতির সৎ মায়ের উপর…
প্রায়াণ ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
——–মেরেছে কেন??
ইফতি কান্না থামিয়ে বলে,
——–স্নুপি কে নাকি মুরগির পিস খাওয়াইছে বোন। আম্মু নাকি মুরগির পিস রাখছিল কিছু নিজের জন্য। সেসব নাকি বোন স্নুপি কে খাওয়াইছে। আর তাই…বোন কে…
ইফতি কেঁদে ফেলে।
নিশুতি নতজানু হয়ে নিচু গলায় বলে,
——-আপনি তো কালকে ছাদেই ছিলেন। আমি কি স্নুপিকে কোনো মাংসের টুকরো দিয়েছিলাম ভাইয়া??
প্রায়াণ মাথা নেড়ে বলে,
——–তুমি কিছু ঝুট ভাত আর তরকারি দিয়েছিলা। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম নিশুতি।
নিশুতি মুখ গোমড়া করে করে বলে,
——-কিন্তু আম্মু বিশ্বাসই করতেছে না।
নিশুতি আঙুল দিয়ে চোখের তলা মুছে।
মিনু শেখ ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
——–তুই আর নিশুতি কাল ছাদে ছিলি? রাতে??
——–হ্যাঁ মা। তবে আমি আগে গিয়েছিলাম। এমনিতেই হাটাহাটি করতে আর নিশুতি ওর পোষা কুকুর কে খাওয়াতে গিয়েছিল। তখনি দেখা হইছে ওর সাথে আমার।
——–ওহ।
ইফতি নিশুতির হাত দুটো ধরে বলে,
——–তোর দোষ না থাকা সত্ত্বেও কত কষ্ট পেলি! বাবা আসুক এবার। আমি বিচার দিবো আম্মুর নামে আপু।
নিশুতি কৃতজ্ঞতার চোখে ইফতির দিকে তাকায়। ইফতি না থাকলে সে এতদিনে হয়তো মরেই যেতো….
আল্লাহর কাছে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে নিশুতি এরকম একটা ভাই দেওয়ার জন্য।
ইফতি মিনু শেখ কে উদ্দেশ্য করে বলে-
——–আন্টি,আপনাদের বাসায় আপুনি থাকুক কিছুক্ষণ। আম্মুর রাগ ঠান্ডা হলে আমি এসে আপুকে নিয়ে যাবোনি?
মিনু শেখ ইফতির মাথায় হাত রেখে বলেন,
——-বয়সে নিশুতির ছোট হলেও কথা আচরণে নিশুতির থেকেও অনেক বড় লাগে তোমাকে। তোমার বোন যতক্ষণ ইচ্ছে আমার বাসায় থাকুক,কোনো সমস্যা নেই।
ইফতি খুশি হয়। প্রায়াণ দের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নিশুতি মুখ ভার করে বসে থাকে। পিউ এসে নিশুতির হাত দুটো ধরে বলে,
——-আপুনি,এত আপসেট হয়ে থাকলে চলে? সব ঠিক হয়ে যাবো। আমাকে একটু পড়াবা? আমার না আজকে কোচিং এ পরীক্ষা।
নিশুতি চোখ মুখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
——–অবশ্যই পড়াবো। বই খাতা নিয়ে এসো যাও।
প্রায়াণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে নিশুতির দিকে। মেয়েটার দুঃখ ভুলে হাসতে টাইম লাগে না!!
.
.
দুপুরের দিকে নিশুতি ছাদে উঠে। সকাল থেকে একবারও ছাদে যায়নি সে। নিশ্চয়ই স্নুপির ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। নিশুতি তার ভাগের কিছু ঝোল মাখানো ভাত নিয়ে এসেছে স্নুপির জন্য। স্টোর রুমে যেতেই অবাক হয় সে।
অবাক হয়ে বলে,
——–প্রায়াণ ভাইয়া আপনি!!
প্রায়াণ নিশুতিকে দেখে মুচকি হাসে। বলে,
——–তুমি তো স্নুপির খবর নাও নি সকাল থেকে। বেচারার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তাই আমিই আসলাম। দেখো কিভাবে গপ গপ করে খাচ্ছে।
নিশুতি নিচু হয়ে বসে। স্নুপি ফ্রাই মাংসের টুকরো গুলো ছিড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। নিশুতি মৃদু হেসে নিজে হাত দিয়ে মাংসের টুকরো গুলো ছিড়ে স্নুপির মুখের দিকে এগিয়ে দেয়। স্নুপি টুপ করে খেয়ে নেয়।
স্নুপির খাওয়া শেষে তাকে আবার তার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় নিশুতি। স্নুপির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় কতক্ষণ। তারপর স্টোর রুম থেকে বের হয়ে আসে। প্রায়াণের দিকে ফিরে বলে,
——–থ্যাংকস ভাইয়া।
প্রায়াণ স্মিত হেসে বলে,
——–স্নুপি কে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,একটা কথা বলবো নিশুতি?
নিশুতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। প্রায়াণ বলে,
——–এখন তো খুব ঠান্ডা পড়েছে। সামনে আরো ঠান্ডা পড়বে। এই ঠান্ডায় স্নুপিকে এভাবে ছাদে রাখা ঠিক না। বাচ্চা কুকুর ও। যদি ঠান্ডা লেগে যায় তখন?? তাই তুমি যদি কিছু মনে না করো,আমি আমার বাসায় স্নুপিকে নিয়ে রাখতে পারি??তোমার যখন ইচ্ছে আমার বাসায় এসে স্নুপিকে দেখে যাইয়ো। আর ওকে খাওয়ানোর দায়িত্বটাও আমাকেই দাও। যদি তুমি চাও আর কী!
নিশুতি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে। লোকটা এত ভালো কেন!!
নিশুতি আবেগী হয়ে বলে,
——-অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাইয়া। সত্যিই আমাকে কিছুটা চিন্তা মুক্ত করলেন। স্নুপিকে নিয়ে আমিও ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। আবার কেউ ওকে চুরি করেও নিয়ে যেতে পারে এখান থেকে।
——–এর মানে তুমি রাজী?
নিশুতি মিষ্টি করে হেসে বলে,
——-রাজী।
প্রায়াণ বিরবির করে বলে,
——–এত হেসো না মেয়ে।।ডায়াবেটিস হয়ে যাবে আমার।
নিশুতি ঠিক শুনতে পায় না। বলে,
——-কিছু বললেন ভাইয়া?
——-না না কিছু না।
——–আচ্ছা ভাইয়া আসি আমি। বাসায় কাজ আছে।
প্রায়াণ কিছু সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
——-আচ্ছা যাও।
নিশুতি চলে যায়। প্রায়াণ ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,
———নিশুতি,যদি সম্ভন হয়,একদিন তোমার সব কষ্ট আমি কমিয়ে দিবো। পাক্কা….
কিছুক্ষণ ছাদে থেকেই সিড়ির দিকে পা বাড়ায় প্রায়াণ। আজকেই স্নুপিকে নিজের বাসায় নিবে সে। সেই ব্যবস্থা করতে হবে তাকে…
চলবে……