মেঘকন্যা☁️
Part_04,05
Writer_NOVA
Part_04
রাতে……
ঘুমের ঘোরে মনে হলো আমার ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিশ্বাস পরছে।সাথে অনেক শীত করছে।বেশ অস্বস্তি লাগছে।ফট করেই ঘুমটা ভেঙে গেল।তাকিয়ে দেখি রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার।লাইটের আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না।তাই সবসময় রুমটাকে অন্ধকার করেই ঘুমাই।ডিম লাইটের আলোতেও ঘুম আসে না।একটু নড়াচড়া করে ডান কাত থেকে বাম কাত হতে নিলেই টের পেলাম, কেউ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে রেখেছে। তখনও মাথায় কিছু আসেনি।কেউ এভাবে কোল-বালিশের মতো জরিয়ে ধরে রাখলে ঘুমানো যায় নাকি।
আমি নড়াচড়া করা শুরু করলাম।তখন কেউ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো—-
বউ,বেশি নড়াচড়া করো না।আমাকে ঘুমাতে দেও।
আমিঃ আচ্ছা। (আনমনে)
আনমনে “আচ্ছা” বলার পর আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো।আমি তো একা ঘুমিয়ে ছিলাম।দরজা,জানালা সব বন্ধ। তাহলে আমার সাথে কে? ভয়ে হাত-পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেল।আমার দুটো হাতের ওপর দিয়ে সে এক হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।হাত দুটো ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু শুধু শুধু শক্তি ব্যয় ছাড়া আর কিছু হলো না।আমাকে নড়াচড়া করতে দেখে সে আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।তার হাত-পা গুলো হিম করা ঠান্ডা হয়ে আসছে।কোনমতে এক হাত অতিকষ্টে তার বাহু ডোর থেকে ছুটিয়ে আমি অন্ধকারে হাতড়ে নিজের মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম।
এবার সে বিরক্তির সুরে বললো—
বুঝতাছি না তোমার সমস্যা কি বউ? শান্তিতে কি একটু ঘুমাতেও দিবে না।দিনে তো তোমার চিন্তায় একটু ঘুমাতে পারি না।অন্ততপক্ষে রাতে একটু ঘুমাতে দেও।
আমি ততক্ষণে ভয়ে দরদর করে ঘামছি।হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে ফ্লাশ লাইট জ্বালাতেই আমি আৎকে উঠি। আমার সাথে কেউ নেই।
আমিঃ এটা কি হলো? আমি স্পষ্ট একজন পুরুষের কন্ঠ পেলাম।আমার মনে আছে কেউ আমায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে ছিলো।এখন কোথায় গেলো।আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।মনে হয় এমনটাই হবে।দরজা,জানালা সব বন্ধ ভেতরে কেউ আসবে কি করে? আচ্ছা, কোন জ্বীন নয়তো? বাপ– রে🥶। আমি তো শুনেছিলাম রুম অন্ধকার করে ঘুমালে রাতে জ্বীন আসে।আল্লাহ বাঁচাও।গত ২ দিন ধরে কি হচ্ছে আমার সাথে। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যলিমিন।লা ইলাহা ইল্লা আনতা —
ভয়ে ভয়ে রুমে লাইট জ্বালিয়ে দরজা,জানালা চেক করলাম।না,সব বন্ধ। পুরো রুমে কেউ নেই। লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম।কাঁথা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে তার ভেতরেও ঠকঠক করে কাঁপছি। আমি সিউর এখন আমার রুমে জ্বীন আছে।সারা রুমে হিম শীতল একটা বাতাস বইছে।
🌨️🌨️🌨️
মেঘার কান্ড দেখে সোফায় মুখ গোমরা করে দুই হাত গালে দিয়ে বসে আছে মেঘপুত্র। কোথায় ভেবেছিলো বেচারা আজ সারারাত বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে।সেই ভাবনায় এক বালতি পানি ফেলে মেঘা নিজেও ঘুমাবেনা আর ওকেও ঘুমাতে দিবে না।অন্ধকার ছাড়া সেও ঘুমাতে পারে না।আর তার গুণধর বউ লাইট জ্বালিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
মেঘপুত্রঃ আল্লাহ, আমি এখন কোথায় যাবো? ভাগ্যিস ঠিক সময়ে অদৃশ্য হয়ে সোফায় চলে এসেছি। নয়তো আমার জ্বীনের ভয় পাওয়া বউ আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যেতো।ধূর,আজও আমাকে সোফায় ঘুমাতে হবে।বিয়ের পর নাকি বউ ছাড়া ঘুমাবো🥺।বলেন তো এটা কি সহ্য হয়।মাথার মধ্যে যত্তসব ফালতু চিন্তা নিয়ে ঘুরে এই মেয়েটা।কে বলবে? সে যে মেঘপুত্রের বউ মেঘকন্যা।আজ আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কি আর করবো এখন? জেগে জেগে বউ পাহারা দেই।
সারারাত ভয়ে আর ঘুম আসেনি।এই মনে হয় কেউ আমাকে ধরতে আসছে,নয়তো কাঁথা ধরে টান দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথায় আছে বনের বাঘে খায় না তো মনের বাঘে খায়। আমার ঠিক সেম দশা হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অনেক দিন পর আজ সূর্যদয় দেখবো।তারপর ইশরাকের(নফল)নামাজ পরে আম্মিকে রান্নায় সাহায্য করবো।সূর্য উঠতে এখনো ঢেঢ় সময় বাকি।মসজিদে এখনো জামাআত শুরু হয়নি।হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।
আমিঃ রাতে কি আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম নাকি সত্যি ছিলো সেটা। আমাকে বারবার বউ বলছিলো। তাহলে কি যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল সে— ধূর কি ভাবছি।সে আসবে কোথা থেকে? সে তো আমার মুখও দেখিনি।আমার তো মনে হচ্ছে না আমি ভুল কিছু দেখেছি। কেউ শক্ত করে আমায় ধরে ছিলো।তার হাত-পা গা হিম করা ঠান্ডা ছিলো।এগুলো স্বপ্ন বা মনের ভুল কিছু তেই হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোন জ্বীনের কাজ।আমাকে ভয় দেখানোর জন্য। আমাকে এর পেছনের রহস্য খুঁজে বের করতে হবে।এক্ষেত্রে আমাকে একজনি সাহায্য করতে পারে। আর সে হলো আয়িশ।এই আয়িশ ব্যাটার দুই দিন ধরে কোন খোঁজ নেই কেন?অসুস্থ হয়ে পরলো নাকি।নাহ্ বিকালে একবার ওর বাসায় যেতেই হয়।
হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কেউ জাপটে ধরে তার মুখ আমার চুলে গুঁজে দিলো। তার গরম নিশ্বাস আমার কানে বারি খাচ্ছে। লো ভয়েজে কানের কাছে তার ঠোঁট এনে বললো।
—- ছোট মাথাটাকে এত প্রেসার কেন দেও বলতো।কি দরকার আছে এতো ভাবার? যা হচ্ছে তা হতে দেও।সবসময় মনে রেখো আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।কি জানি বলছিলে তুমি? ওহ মনে পরেছে।তোমার সাথে এরকম অদ্ভুত কাজগুলো তোমার সাথে জ্বীনে করছে।তাও ভয় দেখানোর জন্য। কোন জ্বীনের এতবড় সাহস আছে নাকি আমার বউকে ভয় দেখাবে।
ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে আসছে।আবারো সেই হিম শীতল স্পর্শ। এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম।ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই।
— আল্লাহ হাফেজ বউ।নিজের খেয়াল রেখো।আর এত ভয় পেয়ো না।আমার বউকে এতো ভয় পেলে চলবে না।নামাজে দেরী হয়ে যাচ্ছে।
আবারো কানের সামনে নিচুস্বরে কেউ কথাটা বললো।বাতাসে তার কথাগুলো বারি খাচ্ছে। বুকের ভেতর কেউ মনে হচ্ছে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।কি মিষ্টি কন্ঠ!! কোন ছেলের ভয়েজ যে এত মধুর হতে পারে তা আমার কোন ধারণা ছিলো না। সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। দৌড়ে রুমে গিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলাম।বুকে হাত দিয়ে জোর শ্বাস ছারতে লাগলাম।
মেঘপুত্রঃ পাগলী একটা।এতো ভিতু কেন মেয়েটা? শক্তি ফিরে পেলেও মানুষের মতো চালচলন কিছুই বদলানি।রাতে তো আমার ঘুম হারাম করেছে।আল্লাহ জানে কত রাত এরকম লাইটের আলোতে ঘুটঘুট করে তাকিয়ে থাকতে হবে। এই রে মসজিদে নামাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি এখন ভাগি।
মেঘপুত্র মুচকি হাসতে হাসতে বাতাসের বেগে মসজিদে চলে গেল।আর মেঘকন্যা ভয়ে কিচেনে মায়ের কাছে ছুটলো।
🌨️🌨️🌨️
সাওদা বিনতে মেঘা,দেখতে সত্যি অপূর্ব সুন্দরী। কারো নজর একবার তার ওপর পরলে তার অন্য কোন দিকে নজর পরবে না।তার গায়ের রংটা শুভ্র মেঘের মতো। দুধের মধ্যে কয়েক ফোঁটা নীল মেশালে যে রংটা হবে সেটাই তার গায়ের রং। এতটা সাদা যে হাতে থাকা নীল রগ-গুলোও স্পষ্ট দেখা যায়।
তবে তার গায়ের রংটা একেক সময় একেক বর্ণ ধারণ করে। চাঁদের ওপর নির্ভর করে রং পাল্টায়।পূর্ণিমা,আমাবস্যার মাঝেও কয়েক বার ভিন্ন ভিন্ন রং হয়।চোখ দুটো টানা টানা,নাকটাও চোখা। হাটু অব্দি হালকা লাল ঘন চুল।হাত-পায়ের নখ ও চোখ দুটো হালকা আকাশি কালার।বয়স বেশি নয়।মাত্র ২২ বছর।অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো মেঘা মানুষের ভিড়ে গেলেই তার গায়ের রং, চোখ, চুল যাবতীয় অঙ্গ-পতঙ্গ সাধারণ মানুষের মতো হয়ে যায়।প্রথম প্রথম তার বাবা-মা ও সে অবাক হলেও এখন বিষয়টা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে।
বাবা মোহাম্মদ আবিদ ইসলাম পেশায় সরকারি চাকুরিজীবী। অনেক বড় পদে আছেন তিনি।মা জাওদা ইসলাম গৃহিণী। আবিদ ইসলাম ও জাওদা ইসলাম ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন।বিয়ের চার বছরেও তাদের কোন সন্তান হয়নি।ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন আবিদ ইসলাম কখনো বাবা হতে পারবেন না।এই খবরটা শুনে জাওদা ইসলাম তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়নি।সব বাঁধন থেকে তাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন আবিদ ইসলাম। কিন্তু সে তার স্বামীকে ফেলে কোথাও যায়নি।তারা নিজেদের জন্য একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিলো।তার আগেই তারা মেঘাকে নিজেদের বাসার দরজার সামনে পান।
সেদিন ছিলো উজ্জ্বল পূর্ণিমা।চারিদিকে দিনের মতো ফর্সা চাঁদের আলো। আজও বিছানার দুই দিকে দুজন ঘুরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে ।হঠাৎ জাওদা ইসলাম একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পান।প্রথমে ভুল ভেবে পাত্তা দেন না।কিন্তু কিছু সময় পর আবার কান্নার আওয়াজ পান।
জাওদাঃ কি গো ঘুমিয়ে গেছো?
আবিদঃ কি হয়েছে?
জাওদাঃ তুমি কি কোন বাচ্চার কান্নার শব্দ পাচ্ছো?
আবিদঃ এত রাতে বাচ্চা আসবে কি করে? আশে পাশে কোন বাড়িও নেই। এমনটাও নয় যে আমাদের বাড়িতে কোন ভাড়াটে থাকে।তুমি ভুল শুনেছো।ঘুমিয়ে পরো তো দেখি।
জাওদাঃ আমি ভুল শুনিনি।কিছু সময় ধরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।
আবিদঃ অনেক সময় এমন হয়।দুষ্ট জ্বীনেরা ভয় দেখানোর জন্য বাচ্চা সেজে কান্না করে। তুমি সেদিকে কান না দিয়ে ঘুমাও।রাত অনেক হয়েছে।
জাওদাঃ চলো না দেখে আসি।
আবিদঃ তুমি কি পাগল হলে জাওদা।রাত পৌনে ১ টা বাজে।এই সময় বাইরে যাবো??
জাওদাঃ প্লিজ এমন করো না। একবার দেখে আসি।আমার মন বলছে নিশ্চয়ই কোন বাচ্চা কাঁদছে।
আবিদঃ বাচ্চা নিয়ে সারাদিন চিন্তা করতে করতে তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে জাওদা।
জাওদাঃ তুমি কথা বাড়িয়ো না।একবার দেখেই চলে আসবো।চলো প্লিজ।
আবিদঃ তোমার বাচ্চাদের মতো জেদ করা এখনো গেলো না জাওদা।ঠিক আছে চলো।
দুজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই শুভ্র মেঘের মতো দেখতে একটা ফুটফুটে বাচ্চা দেখতে পেলো।জাওদা ও আবিদ ইসলামকে দেখেই বাচ্চাটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বাচ্চাটার সারা শরীর থেকে সাদা আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সেই আলোর আভা সোজা আকাশে উঠে গেছে। চাঁদের পাশে কয়েক টুকরো শুভ্র মেঘের ওপর আলোটা ঠেকেছে।
জাওদা ইসলাম খুশি হয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না।তারপর থেকে বাচ্চাটা তাদের কাছে থাকে।আবিদ ইসলাম বাচ্চাটাকে তার নিজের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলে জাওদা ইসলাম তা করতে দেয়নি।সে বলেছে,আল্লাহ তাদের জন্য বাচ্চাটাকে উপহার পাঠিয়েছে।কেউ যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য সেখানকার বাসা বিক্রি করে ঢাকার গুলশানে এসে নিজেদের বাড়ি করে।
সারাদিন তেমন কোন অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হইনি মেঘা।তাই রাত ও সকালের কথা পুরো ভুলেই গিয়েছে।বিকালে তৈরি হয়ে আয়িশের বাসায় গেলো সে।কিন্তু গিয়ে যা দেখলো তাতে হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যাথা হয়ে গেলো।
(চলবে)
#মেঘকন্যা☁️
#Part_05
#Writer_NOVA
আয়িশের ফ্লাটের দরজাটা হালকা করে ধরতেই খুলে গেলো।কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।বেশ পুরোনো দেখতে একটা বাসার দোতালার ফ্ল্যাটে আয়িশ একা থাকে। বাইরের থেকে বাড়িটা দেখতে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হলেও ভেতরটা চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ভরপুর।দুটো রুম ও একটা বড় ড্রয়িং রুম ও কিচেন নিয়ে আয়িশের ফ্ল্যাট। খুব সুন্দর ও গোছানো।আমি ভেতরে ঢুকে আশেপাশে ওকে খুঁজতে লাগলাম।বেশ কয়েক বার লো ভয়েজে ওর নাম ধরে ডাকলাম।কিন্তু কেউ সারা দিলো না।
আমিঃ আয়িশ,আয়িশ। কোথায় তুই? বাসায় কি কেউ আছে নাকি এমনি ভুলে দরজা খুলে চলে গেছে ছেলেটা। যা মন ভুলো। আয়িশ ঐ ছেমড়া?
কিচেন থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে সেদিকে যেতে লাগলাম।গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভয় পেয়ে গেলাম।কালো হাফ প্যান্ট, কালো টি-শার্ট পড়া একটা লোক মাথায় বাইকের হেলমেট পরে ছুড়ি দিয়ে ট্র-এর মধ্যে কিছু একটা কাটছে।
আমিঃ বা বা গো🥶!!! কে আপনি?(ভয়ে ভয়ে)
আয়িশঃ কি রে তুই কখন এলি?
আমিঃ আআআআয়িশ সত্যি এটা তুই?
আয়িশ মাথার হেলমেট খুললো।হেলমেট পরে থাকার কারণে ফর্সা মুখটা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে।পুরো মুখ ঘেমে-নেয়ে একাকার।
আমিঃ তুই কিচেনে হেলমেট পরে কি করছিস?
আয়িশঃ কথা বলিস না। গরমে আমি অতিষ্ঠ।শালার, বিদ্যুৎ যাওয়ারো সময় পেলো না।
আমিঃ বললি না হেলমেট পরে কিচেনে কি করছিস?
আয়িশঃ পেঁয়াজ কাটছিলাম।
আমিঃ কি-ই-ই-ই 😳!!! তুই হেলমেট পরে পেঁয়াজ কাটছিলি।লাইক সিরিয়াসলি।
আয়িশঃ তো কি করবো?পেঁয়াজের যা ঝাঁঝ। আমার কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।তাই বুদ্ধি করে হেলমেট পরে নিয়েছি। চোখে কোন ঝাঁঝ
লাগে নি।আমার বুদ্ধিটা কেমন হয়েছে??
আমি ওর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে ফ্লোরে হাত-পা ছরিয়ে বসে পরলাম।আল্লাহ, এমন কিছুও যে আমায় দেখতে হবে তা কখনও কল্পনা করি নি।
আয়িশঃ ভেটকাইস না মাল্টি কালার।আমার হাতে এছাড়া কোন উপায় ছিলো না। (মুখ গোমড়া করে)
আমিঃ আমাকে একটু হাসতে দে।আমি ভাবলাম কোন চোর-টোর এসেছে বুঝি।সত্যি তোর দ্বারাই এসব সম্ভব। তুই পারিসও বটে।এসব আজগুবি বুদ্ধি তোর মাথায় আসে কি করে?
আয়িশঃ কাজের বুয়া অসুস্থ। কয়েক দিন আসতে পারবে না।তাই বলে কি না খেয়ে থাকবো নাকি?অনেক খুদা লাগছে।সর,আমাকে কাজ করতে দে।
আমিঃ এত কষ্ট না করে বাইরের থেকে খাবার আনলেই পারতি।
আয়িশঃ টাকা কি গাছে ধরে? কষ্ট আছে উপার্জন করতে।তুই কি বুঝবি?তাছাড়া বাইরে যেতে মন চাইলো না।ইস,আজকে যদি একটা বউ থাকতো।তাহলে এত কষ্ট করতে হতো না।
আমিঃ বিয়ে করে নে।আমরাও অনেক দিন পর কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারবো।
আয়িশঃ তুই করে নে।কতদিন ধরে রোস্ট, পোলাও খাওয়া হয় না।ইচ্ছে মতো খেতে পারবো।
🌨️🌨️🌨️
আয়িশ আমার বিয়ের কথা বলতেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো।সেদিনের কথা মনে পরে গেলো।আমি যদিও বিয়েটা মানি না।তারপরেও মনটা সেটা মানতে সায় দেয় না। বারবার মনে করিয়ে দেয় আমি বিবাহিত।মন খুব জোর দিয়ে বলে,আমার শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছে। আচ্ছা, আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে কখনো যদি সে আমাকে খুঁজতে আসে।তখন কি করবো?আয়িশ আমার মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই আমার হুশ ফিরলো।
আয়িশঃ কিরে মাল্টি কালার।কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি।তা মিস ভাবুকি, কি ভাবলেন এতক্ষণ?আমি যে কতগুলো কথা বলেছি তা কি আপনি শুনতে পেয়েছেন?
আমিঃ কিছু না।সর তুই। আমি রান্না করে দিচ্ছি।তুই তো হেলমেট পরে পেঁয়াজ কাটতেই আধা ঘন্টা লাগিয়ে দিলি।
আয়িশঃ সরি ম্যাডাম।আপনাকে কিছু করতে হবে না।আপনি এখন আমার বাসার মেহমান।আপনাকে দিয়ে আমি কোন কাজ করাতে পারি না।
আমিঃ ঢং হচ্ছে। এমন ভাব করছিস যে আমি জীবনের ১ম তোর বাসায় আসলাম।
আয়িশঃ না তা নয়।তবে আজকে আমি রান্না করবো নিয়্যাত করেছি। সো আমি রান্না করবো।তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখ এই আয়িশের কামাল।তুই শুধু আমাকে একটু বলে বলে দিস।
আয়িশ আমার সাথে কথা বলতে বলতে ছুরি দিয়ে আলু কাটতে লাগলো।আমি ওর কাটাকুটি দেখতে লাগলাম।মিটমিট করে হাসছি।আলুর ছিলকা অনেক মোটা করে ফেলে ইয়া মোটা মোটা টুকরো করলো।কাঁচা মরিচ ফালা করতে গিয়ে চৌদ্দ বার ট্রে থেকে ফেলে দিয়েছে। রুই মাছ ভাজার জন্য নিলো।সেগুলোতে মশলা দিতে অবশ্য আমি বলে বলে দিয়েছি।তাই কোন সমস্যা হয়নি।
আমিঃ আয়িশ আমাকে মাছ ভাজতে দে।তুই পারবি না।তেল ছিটে আসবে।
আয়িশঃ এই মাল্টি কালার।তুই আমাকে কি ভাবিস?এই আয়িশ পারে না এমন কোন কাজ পৃথিবীতে নেই। সো,মাল্টি কালার।সরে যাও।আমি পারবো।
আমিঃ আর কিছু পারিস কিনা জানি না।তবে বড় বড় ডায়লগ দিতে পারিস তা জানি।
আমি মুখ গোমরা করে ওর সামনে থেকে সরে দরজার পেছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালাম। আয়িশ ভেবেছে আমি চলে গেছি।কিছু সময় পর দেখলাম ভয়ে আল্লাহকে ডাকছে।মাথায় হেলমেট পরে নিলো।দশ হাত দূর থেকে খুন্তির ওপর মাছ নিয়ে কড়াইয়ের তেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠাস করে গরম তেলে মাছের টুকরোটা ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে।সে কি দৌড়! এক দৌড়ে কিচেন থেকে পালিয়ে,সোজা নিজের রুমে। আমি হাসতে হাসতে দরজার পাশে বসে পরেছি।এতো সাহস দেখিয়ে দশ হাত দূর থেকে মাছ ছেড়ে সে দৌড়িয়েছে।রুমে গিয়ে হাঁপাচ্ছে। আমি হাসতে হাসতে কিচেনে গেলাম।কিছু সময় পর আয়িশ এলো।এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দশ হাত দূর থেকে মাছ উল্টানোর চেষ্টা করতে লাগলো।আমি রেগে ওর কাছ থেকে খুন্তিটা নিয়ে গেলাম।
আয়িশঃ খুন্তি দে। আমি পারবো।
আমিঃ তুই যে কি পারবি তা আমার দেখা হয়ে গেছে। চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাক।আমাকে আমার কাজ করতে দে।(ধমকের সুরে)
আয়িশঃ তোর কথার মধ্যে আজ বউ বউ গন্ধ পাচ্ছি। ঘটনা কি বল তো?তুই দেখছি আগের থেকে সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস।না মানে তোর হাত দেখে বললাম।বিয়ে-শাদি করেছিস নাকি।শুনেছি মেয়েরা নাকি বিয়ের পর সুন্দর হয়ে যায়।
🌨️🌨️🌨️
বুকটা আবারো ধক করে উঠলো। আমি যত বিয়ের ব্যাপরটা ভুলতে চাইছি।ততই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমাকে চুপ করতে দেখে আয়িশ গলা ঝেড়ে বললো।
আয়িশঃ আরে আমি এমনি বললাম মাল্টি কালার ।যাস্ট কিডিং। তুই সিরিয়াসলি নিস না।
আমি ওর কথায় তোয়াক্কা না করে রান্নায় মনোযোগ দিলাম।আয়িশ কিছু সময় পর পর আমার পেছন দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরে রান্না দেখছে।ভয়ে আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
আয়িশঃ জলদী রাঁধিস মাল্টি কালার। দুপুরে কিছু খাইনি।অনেক খুদা লাগছে।
আমিঃ এত বড় বাড়িতে একা থাকিস ভয় করে না।এত বড় ফ্ল্যাটে তুই একা।বাই চান্স তুই অসুস্থ হলেও তো কেউ কিছু টের পাবে না।
আয়িশঃ এসেছি একা যাবোও একা।তাহলে মাঝখানে সময়টুকুতে ভয় পাবো কেন?
আমিঃ দরজা খুলে রেখেছিলি কেন?
আয়িশঃ কে জানে,খেয়াল নেই তো।কখন দরজা খুলেছি বলতে পারবো না।
আমিঃ আঙ্কেল, আন্টি কোথায় থাকে রে?তুই তো তাদের বিষয়ে আমাদের কিছু বলিস না।এতবড় ফ্ল্যাটে একা না থেকে তাদেরও নিয়ে আয়।তাহলে তো তোর এতো কষ্ট করতে হয় না।
আয়িশের বাবা-মায়ের কথা বলতেই ওর চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো।কপালের রগ ফুলে উঠেছে। কঠিন গলায় বললো।
আয়িশঃ আমি আগেও বলেছি তাদের কথা কখনো জিজ্ঞেস করবি না।আমার কেউ নেই। (রেগে)
আমিঃ তুই তাদের কথা বললে এতো রেগে যাস কেন? এত রাগ ও ঘৃণা কেন তোর, তাদের প্রতি।উনারা তোর বাবা-মা আয়িশ।
আয়িশ কিছু না বলে রুমে চলে গেল। কিছু সময় পর কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ পেলাম।রুমে গিয়ে দেখি কাচের টি-টেবিলেটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে চারিদিকে ছরিয়ে ছিটিয়ে পরে আছে।আমি চুপ করে সেখান থেকে এসে রান্নায় মন দিলাম।একটু পর এমনি ঠান্ডা হয়ে যাবে।আমার ওপর সে কখনি রাগ করে থাকতে পারে না।
পুরো নাম আয়িশ রহমান।বাবা-মা কে বা কোথায় থাকে তা আমি জানি না। আমি কেন কেউ জানে না।বয়সে আমার ৪ বছরের বড়।মানে ২৬ বছর।আমার তিন ক্লাশ ওপরে পড়ে।এখন আপনাদের প্রশ্ন হতে পারে তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব কিভাবে হলো?আমরা একসাথে একটা সেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করতাম।সেখান থেকে পরিচয় ও বন্ধুত্ব।
আয়িশ দেখতে ধবধবে সাদা। চুলগুলো হালকা কালো ও লালের কম্বিনেশন। ঠোঁট দুটো মাত্রাতিরিক্ত লাল।মনে হয় লিপস্টিক দিয়েছে।চোখ দুটো ঘোলাটে। সরু টানা চোখ ও চোখা নাক মিলে অসম্ভব সুন্দর দেখতে।কলেজের মেয়েরা তো আয়িশ বলতেই অজ্ঞান।কিন্তু আয়িশের সামনে আমি ছাড়া কোন মেয়ে ভিড়তে পারে না।আমি মনে মনে আয়িশকে অনেকটা পছন্দ করি।কখনো বলিনি। যদি আমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায় সেই ভয়ে।কিন্তু এখন চিন্তা করেছি না বলেই ভালো করেছি। কারণ আমি বিবাহিত।হ্যাঁ,
এই কথাটা শুনতে তিক্ত হলেও এটাই সত্যি।
🌨️🌨️🌨️
হঠাৎ আয়িশের কথায় আমি ভাবনা থেকে ফিরে এলাম।দুই দিন ধরে আমি নিজের মধ্যে থাকি না।ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যাই।
আয়িশঃ কি রে আজ কি খেতে পারবো?আমি আর সহ্য করতে পারছি না।পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে মাল্টি কালার। আমি আজকে শেষ।
আমিঃ তুই আমাকে মাল্টি কালার কেন বলিস?
আয়িশঃ তোকে এই কালারটা পরলে অনেক সুন্দর লাগে।অবশ্য আকাশি কালারটায় পুরো মেঘকন্যার মতো।
আমিঃ মেঘকন্যা!!!! (আনমনে)
আয়িশঃ আরে রুপকথার রাজকন্যাদের কথা বলছি।
আমিঃ না তুই অন্য কিছু বলছিস।
আয়িশঃ আমি রাজকন্যা বলেছি।তুই ভুল শুনেছিস।
আমিঃ হতে পারে।এমনি আজকাল আমার প্রচুর হ্যালুসিয়েশন হয়।ভুলভাল দেখি ও শুনি।
আয়িশঃ যাক বাবা বাঁচা গেল। কথা কাটাতে পেরেছি।(বিরবির করে)
আমিঃ কি বিরবির করছিস?(ভ্রু কুঁচকে)
আয়িশঃ কিছু না।আমি ডাইনিং টেবিলে বসলাম তুই খাবার নিয়ে আয়।
আমিঃ আচ্ছা যা।আমার রান্না শেষ।
আমি ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে আয়িশকে প্লেটে খাবার বেড়ে দিলাম।
আয়িশঃ আহা!! কি ঘ্রাণ? নিশ্চয়ই রান্না অনেক মজাদার হবে।তুইও বসে পর।
আমিঃ নাহ্।আমার পেট ভরা।
আয়িশ খাবার খেতে শুরু করলো।আম্মির সাথে কিচেনে কাজ করতে করতে রান্নাটা ভালোয় রপ্ত করতে পেরেছি।
আমিঃ আচ্ছা আয়িশ।তুই যদি কখনো শুনিস আমি তোদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি।তোরা কি বিশ্বাস করবি?
আয়িশ খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো।বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো।
আয়িশঃ আমি জানি তুই এমনটা করবি না।
আমিঃ কেন করতেও তো পারি।
আয়িশঃ তোকে শুধু আমি বিয়ে করবো।তুই আমার ছাড়া অন্য কারো হতেই পারবি না। (আনমনে)
আমিঃ কি-ই-ই-ই???
আয়িশঃ কোথায় কিছু না।বললাম রান্না অনেক ভালো হয়েছে। তোকে এখন পুরো আমার বউ বউ লাগছে।মানে তুই রান্না করে খাবার বেড়ে দিলি।এখন আবার না খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খাওয়া দেখছিস।
আমিঃ খুব ইচ্ছে ছিলো তোর বউ হওয়ার।তোর মতো গুড পার্সনালিটির মানুষ সব মেয়েরা স্বপ্নে দেখে। কিন্তু তুই আমার ভাগ্যে নেই রে।আল্লাহ আমাকে অন্য কারো বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে বানিয়েছেন। নয়তো আমার এভাবে বিয়ে হতো না। (মনে মনে)
আয়িশের খাওয়া শেষ হতেই আমরা কিছু সময় গল্প করলাম।অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি বাসায় যেতে চাইলাম।কিন্তু আয়িশ আমাকে একা ছারলো না।নিজে বাইকে করে বাসায় পৌঁছে দিলো।এতকিছুর মধ্যে আমি কি জন্য আয়িশের বাসায় গিয়েছিলাম তাই ভুলে গেছি।
বাসায় গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা হাই লেভেলের গরম হয়ে গেলো। তাছাড়া রাতে_____
চলবে