স্বপ্নবিলাসী,পর্ব :-০১
Writing by Nishan_Bunarjee
স্বামীর জায়গায় নিজের দেবরকে স্বামী হিসেবে দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক হল অহনা। বিয়ে হয়েছে একজনের সাথে অথচ বাসরঘরে ভিন্ন কেউ।
সৌমিক কে বরের সাজে দেখে অহনা প্রথম প্রথম নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলনা।
-কি ব্যাপার সৌমিক তুমি বরের সাজে? ভাইয়া কোথায় তোমার?
সৌমিক বিছানার উপর বসে মাথা নিচু করে বলল, ভাইয়াকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না ভাবী!
অহনা হাসলো। রীতিমতো হাসলো।
-বাসর রাতে মজা হয় জানতাম। কিন্তু সেটা তো ভাবী বা ননদেরা মিলে করে! তোমাকে সাজে না।
– মজা করছিনা ভাবী!
– ও, তাই। তো আমি কার সাথে বিয়ে করেছি, কার সাথে এসেছি এখানে? ভুতের সাথে?
– না ভাবী। বিয়েটা ভাইয়ার সাথে না হয়ে আমার সাথে হয়েছে। আসলে পরিস্থিতি টা….
সৌমিকের কথা আঁটকে দিয়ে অহনা বলল, অনেক মজা হয়েছে সৌমিক এখন তোমার ভাইয়াকে বল আসতে।
– ভাবী, মজা করছি না ভাবী।
-সৌমিক অনেক হয়েছে, কি বলছ এসব?
অহনার ধমকে অনেকটা ঘাবড়ে গেলো সৌমিক। বলল, আসলে ভাবী পরিস্থিতি টা এমন হয়েছে যে না চেয়েও আপনাকে আমার বিয়ে করতে হয়েছে ভাবী।
এর পরপরই মাথায় যেন বাজ পড়লো অহনার। একটা মেয়ে এসব কখনো কল্পনাও করতে পারে না। অহনা খুবই সহজ সরল মেয়ে। সে প্রাথমিক অবস্থায় ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। কি করবে তার কোনো জ্ঞান নেই অহনার। ভয়ে সে চিৎকার দিয়ে উঠে।
-প্লিজ ভাবী চিল্লাচিল্লি করবেন না। আমি জানি আপনি এটার জন্য প্রস্তুত নন। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো উপায় ছিল না। আপনি চুপ করেন আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
অত্যন্ত বিনম্র ভাবে অহনার দেবর সৌমিক অহনাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এমতাবস্থায় যেকোনো নারীকে বোঝানোটা প্রায় অসম্ভব। অহনার চিৎকার শুনে তার শ্বশুর শাশুড়ী দৌড়ে এসে রুমের দরজার কড়া নাড়তে লাগলেন। সৌমিক কে দরজা খোলার জন্য বললেন।
– সৌমিক কি হয়েছে? বউমা চিৎকার দিল কেন?
– জানোই তো মা ভাবীর জন্য এটা স্বাভাবিক নয়। আমি বুঝিয়ে বলছি ভাবীকে তোমরা যাও।
– সব বুঝিয়ে বল ওকে। আর যেন চিৎকার না করে।
– হুম যাও তোমরা।
সৌমিক তার বাবা মাকে বলে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিল তাদের রুমে। কিন্তু অহনা এদিকে ভয়ে কাঁপছে। সে ঘটনার আগাগোড়া কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি এখনো। সৌমিক অহনার চেহারার হাবভাব দেখে অহনার ভয়ের পরিমাণ আঁচ করতে পারছিল। সে অহনার কাছে এসে বসতে বসতে বলল,
– প্লিজ ভাবী আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সব বলছি। আপনি একটু শান্ত হোন প্লিজ।
– তুমি দূরে সর। আর তোমার ভাইয়া কোথায়? সত্যি টা বল আমাকে
সৌমিক পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, ভাবী আপনি পানি পান করেন আমি বলছি।
অহনা পানি খেল। সৌমিক বলতে শুরু করলো, ভাবী, আপনার বিয়ে আমার সাথে হয়েছে। আসলে আমার ভাইয়া মদ, গাঁজা ইত্যাদির নেশা করে। নেশা করে সে কোথায় পড়ে থাকে তার ঠিক নেই। আজও ভাই নেশা করে কোথাও পড়ে রয়েছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাই নি আমরা। তাই বাধ্য হয়ে ভাইয়ার জায়গায় আমাকে এই বিয়েটা করতে হয়েছে।
– তোমরা সবাই আমার সাথে প্রতারণা করতে পারলে!! আমার বাবাকে এক্ষুনি ফোন দাও। উনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
– আপনার বাবা মা এই বিষয়ে জানেন। উনাকে জানিয়েই বিয়েটা হয়েছে।
এখন অহনা আরও অবাক হলো। তার বাবা মা কিভাবে এতে রাজি হয়ে গেলেন! অহনা কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলনা।
– মিথ্যা বলছ তুমি। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমার মা বাবা এটা করতে পারেন না! বাবা মা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আমার জন্য উনারা জীবন দিতে পারেন। কিভাবে বললে তাঁরা এভাবে করবে আমার সাথে!
– যখন মানসম্মানের কথা আসে ভাবী তখন একটা মানুষ অসহায় হয়ে যায়। হয়তো তখন সে মরে গিয়েও তাঁর মানসম্মান রক্ষার পথটাই বেছে নেবে। আপনার বাবাও মানসম্মান রক্ষার্থে মনে পাথর রেখে এসব করেছেন। আমি মিথ্যে বলছিনা ভাবী। আপনি ফোন করে কথা বলে দেখতে পারেন আপনার বাবার সাথে।
অহনা তার বাবার নাম্বারে ফোন করলো। দুয়েকবার ফোন দেয়ার পরও ওপর পাশ থেকে কেউ রিসিভ করল না। তার কিছুক্ষণ পর থেকে ফোন অফ দেখাচ্ছে। অহনা ভীষণ ভেঙে পড়লো। অসহ্য মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলো সে। সৌমিক আবারো অহনার ব্যথিত মনের হালত আঁচ করে নিল।
– কান্না করেননা ভাবী। জানি আপনি ভাবছেন যে আপনার জন্মদাতা মা-বাবা কিভাবে এটা করতে পারেন। কিন্তু সত্য এটাই। আমিও চাইনি এভাবে আপনাকে বিয়ে করে নিতে। কিন্তু আমার বাবা মা বলল যে এতে দুটি পরিবারের ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পাবে তাই আমি না করতে পারিনি ভাবী।
অহনা নিজেকে ভীষণ অসহায় খুঁজে পেল পানিবিহীন মাছের মতো। নিজের জীবনের এতো উথাল-পাতাল হতে দেখে অজান্তেই গাল বেয়ে অশ্রুসজল বিন্দু বিন্দু আকারে মেঝেতে পড়তে লাগলো। সৌমিকও অহনার চোখের জলটুকু দেখে ভীষণ আহত হলো। অহনাকে কিভাবে, কি করে স্বান্তনা দিবে সৌমিক বুঝতে পারছিল না।
– ভাবী বুঝতে পারছি আপনার ব্যথা। কিন্তু সত্যি তখন আমার কাছে যা ভালো লেগেছে তাই করেছি।
অহনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– তুমি বুঝতে পারবেনা সৌমিক। যদি বুঝতে তাহলে এভাবে করতেনা আমার সাথে। আমার জীবন নিয়ে এভাবে খেলতে না।
– ভাবী আমি এতদূরের চিন্তা ভাবনা করিনি। আমার ভুল এটাই। আপনি আজ রাতটা কাটান কাল সকাল হতেই আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে আপনার বাবার বাড়িতে আমি নিজে নিয়ে যাবো।
অহনা চুপচাপ। সৌমিক একটা বালিশ নিয়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম উড়ে গেল অহনার। নির্ঘুম অহনা আহত মনে এটাই ভাবছে যে সবকিছু জেনেও তার বাবা মা কিভাবে এটা করলো! আমার বাবা-মা তো আমাকে খুব ভালোবাসতো তাহলে নিজের মেয়ের জীবনটা ধ্বংস করতে একটুও বাঁধলো না!
গরিব ঘরের মেয়েদের মধ্যে একটা মিল আছে। তারা স্বপ্ন দেখে। মনের মধ্যে অনেক অনেক স্বপ্ন আঁকে ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে। বিয়ে হবে, সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। স্বামীর আদর-ভালোবাসা পাবে। নিয়তি তাদের সাথে খুব কঠিন খেলা খেলে। বুঝিয়ে দেয় স্বপ্ন দেখতে নেই। স্বপ্ন দেখাটা যে বড় ধরনের অপরাধ। এইসব ভেবে সারারাত অহনা ঘুমোতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করলে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে ভেবেছিল বিয়ের পরের জীবনটা সুখের হবে। চেয়েছিল নিজের একটা ছোট্ট সংসার হবে। কিন্তু তার স্বপ্ন এখন একটা দুঃস্বপ্নতে পরিণত হয়ে গেছে। সৌমিক ভেবেছিল অহনা একটা নারী, তার কষ্ট গুছিয়ে দেবে। কিন্তু পুরুষ পারেনা একটা নারীর কষ্ট পরিমাণ করতে। অহনা শুধু আঁধার দেখতে পাচ্ছে। চারিদিকে এখন শুধু জনশূন্য মরুভূমি।
সকাল হতেই সৌমিক তার বাবা মা আর অহনাকে নিয়ে তার বাবা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সৌমিক আর অহনাকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন অহনার বাবা মা। না জানিয়ে হুট করে এভাবে অহনা চলে আসাতে একপ্রকার দ্বিধায় পড়ে গেলেন উনারা। এখন মেয়েকে কি জবাব দিবেন? কিভাবে মেয়েকে মুখ দেখাবেন? অহনাকে না জানিয়ে এতকিছু করা মোটেও ঠিক হয়নি।
অহনা তার মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অহনার বাবা মা মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারছেননা।
– মা, তোমরা কি জানতে আমার সাথে সৌমিকের বিয়ে হচ্ছে?
মা বাবা দুজনেই চুপচাপ। বলার ভাষা তাঁদের কাছে নেই।
– জানবেন না কেন, তোমাদেরকে তো সব জানিয়েই করা হয়েছে। কিন্তু তোমরা একবারও আমার কথা ভাবলেনা! আমার যে জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো সেটার কি?
অহনার মা কেঁদে ফেললেন। আঁচলে মুখ লুকানোর চেষ্টা করলেন। অহনার বাবা বললেন,
– জানি মা তোর মনের ব্যথা। কিন্তু নিরুপায় ছিলাম মা। আমিও তো একজন বাবা। তোর একটা ছোটো বোন আছে। তারও তো বিয়ে করাতে হবে। কাল যদি বরযাত্রা ফিরিয়ে দিতাম তাহলে এই গরীবের মেয়েকে কে বিয়ে করতো বল! মানসম্মান কি থাকতো আমাদের?
– কিন্তু বাবা, আমার জীবন নষ্ট করে দিবে তুমি?
– ক্ষমা করে দে মা! আমার কাছে আর পথ ছিলনা রে!
অহনার শ্বশুর শাশুড়ী দীর্ঘক্ষণ অহনার কথা শুনছিলেন। অহনার শাশুড়ী এগিয়ে এসে অহনাকে বললেন,
– দেখ বউমা, তোমার বাবা মায়ের মানসম্মানের কথা ভেবেই কিন্তু আমরা এই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছি। নইলে আমরা পারতাম বিয়ে টা না করতে। কিন্তু এতে তোমার বাবা মায়ের মানসম্মান থাকতো না। আর তোমার বিয়ে আমার ছোট ছেলে সৌমিকের সাথে হয়েছে সেটা কি আদৌও আমাদের ছাড়া অন্য কেউ জানে? সবাই জানে আমার বড় ছেলে বিশালের সাথে হয়েছে। তাই বিশাল ফিরুক সব ঠিক হয়ে যাবে।
অহনা গরম মেজাজে বলল,
– আপনার মদখোর ছেলের জন্য একটা ভালো সুশীল মেয়ে পেয়েছেন। উপর থেকে ভালো যৌতুকও পেয়েছেন। বিয়েতে আপনারা রাজি হবেন না কেন। আর আপনার বড় ছেলে ফিরুক তার মানে কি? আমার বিয়ে তো তার সাথে হয়নি!
অহনার মুখে এমন কথা আশা করে নি সৌমিকের মা। সৌমিকও জানে অহনা ভুল বলেনি। তার ভাই মদখোর যার দরুন কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইতো না। উপর থেকে অহনার বাবা মা যৌতুকও দিয়েছে ভালো। তাই বিয়েটা যেভাবেই হোক করাতে চেয়েছে তার বাবা মা। সৌমিকের মা একটু রেগে গিয়ে অহনাকে বললেন, তোমার বিয়ে বিশালের সাথে হয়নি তাতে কি? আমার বড় ছেলের জন্য যেহেতু তোমাকে পছন্দ করা হয়েছে তাহলে তার সাথেই তো তোমাকে সংসার করতে হবে।
অহনা চোখে চোখ রেখে বলল, না! এটা আমার দ্বারা অসম্ভব।
সৌমিকের মা এবার অহনার বাবাকে বললেন, সুজন বাবু, আপনার মেয়ে কিন্তু অনেক বড় বড় কথা বলছে। আমরা কিন্তু আপনাদের সাথে এটাই ঠিক করেছিলাম যে বিয়েটা আমার ছোট ছেলে করুক। কিন্তু অহনা আমার বড় ছেলেরই বউ হবে।
অহনার বাবা অহনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
– মা, সবাই জানে বিশাল তোর স্বামী। তাহলে কেন এমনটা করছিস মা?
অহনা সোজাসাপ্টা বলল,
-বাবা সবাই যেটা জানে সেটা তো সত্য না! ঈশ্বর তো জানেন যে বিয়েটা আমার সৌমিকের সাথে হয়েছে। আমি কিভাবে তার সাথে সংসার করবো যার সাথে আমার বিয়ে হয়নি?
অহনার বাবা কিছু বলতে যাবেন তখনই সৌমিকের মা বলে উঠলেন,
– দেখেন সুজন বাবু, আপনার মেয়ে যদি স্বামী হিসেবে আমার বড় ছেলেকে না মানে তাহলে তাকে বউ করে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে পারবোনা আমি।
অহনার বাবা অহনাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু অহনাকে বোঝানো অসম্ভব। সে একটা নারী। আর একটা নারীর পক্ষে যে পুরুষের সাথে বিয়ে হয়নি তাকে স্বামী মেনে কোনো ক্রমেই সম্ভব না।
.
.
চলবে……….