ভাঙা চুড়ি
চার এবং শেষ
– কি রে মা এসে ধরেই তোকে দেখছি মন মরা হয়ে বসে থাকিস রাশেদের সাথে কিছু হয়েছে?
,
আমি আজ তিন দিন হয়েছি সিলেট এসেছি। আমার ফোন অফ করে রাখা। তাই ছোট খালার ফোনে বাবা ফোন করে বলেছিল রাশেদ নাকি এসেছিল। কেন এসেছিল রাশেদ বলেনি।
,
ছোট খালার কথা শুনে ভিষণ কান্না পেলো। খালা আমাকে বললো,
– কি হয়েছে আশফি তোর? আমাকে বল মা?
খালার কথা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে সব বললাম। খালা সব কিছু শুনে অবাক হয়ে বললেন,
– ছি রাশেদ একটা অমানুষ। তোর মতো মেয়ে কে বুঝতে পারলো না। এখানে কিছু দিন থাকতে লাগ দ্যাখ ও কি করে। তোর শ্বশুর জানে এই গুলো?
– না খালা আমি চাই নি ও সবার কাছে ছোট হয়ে যাক। কিন্তু আমি আর পারছি না।তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
– আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভুল তো এটাই। আমরা আমাদের স্বামীকে মাথায় তুলে যতো রাখতে চাই ওরা ততো পেয়ে বসে।
– খালা আমি কি করবো তুমি বলে দাও।
– ধৈর্য ধর মা। আর কিছু দিন অপেক্ষা কর। রাশেদ যদি না আসে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এখন চল খাবি। এসে ধরে দেখছি কিছু ভালো করে খাচ্ছিস না।
,
এক রকম জোর করে খেতে গেলাম। খেতে বসলে মনে পরে আচ্ছা রাশেদ এখন খাচ্ছে তো? ও যেমন অগোছালো কি করছে কি জানি? ও কি আমার কথা ভাবছে? নাকি ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে রাত শেষ করছে?
,
আমি যতোই চাই ওকে ভুলে থাকতে চাই ও ততো আমার সৃতি তে এসে উঁকি মারে। আমার এখনো মনে পরে বিয়ের কিছু দিন পর একদিন আমার হাতের একটা চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল তাই দেখে আমি অন্য টা খুলে রেখেছিলাম।
শ্বাশুড়ি হঠাৎ করে আমার হাত খালি দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
— বউমা! তোমার হাত খালি কেন? জানো মা বিয়ের পর মেয়েদের খালি হাতে থাকতে নেই। স্বামীর অমঙ্গল হয়।
আমি উওরে বললাম,
– মা! একটা চুড়ি ভেঙে গেছে তাই খুলে রেখেছি।
,
শ্বাশুড়ি মনে হলো অবাক করা কোনো কথা শুনলেন সে রকম ভাব করে ছেলে কে ডেকে বললেন,
,
— রাশু? তুই দেখিসনা বউমার হাত খালি। নতুন বউ মানুষ দেখলে খারাপ বলবে। আজই ওকে সাথে নিয়ে চুড়ি কিনে আনবি।
,
রাশেদ কিছু না বলে আমাকে তৈরি হতে বললো।আমি ভিষণ খুশি। বিয়ের পর এই প্রথম ওর সাথে বাইরে যাচ্ছি। আমি সুন্দর করে বোরকা পরে তৈরি হলাম। ও আমাকে এভাবে দেখে খুব বিরক্ত হলো।বললো,
,
— এটা কি পরেছো? এভাবে কেউ বাইরে যায়। যাও ওটা খুলে আসো?
— আমি ছোট বেলা থেকে এভাবে বাইরে যাই।খুলতে পারবো না।
,
সেদিন রাশেদের মুখে আমি চরম বিরক্তি দেখেছিলাম। সারা পথ আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনি।এমন একটা ভাব করেছে কেমন যেন ময়লা আবর্জনার সাথে পথ চলছে। গায়ে লাগলে নোংরা হয়ে যাবে।
,
একটা দোকানে যেয়ে আমার কিছু চুড়ি পছন্দ হলো। কিন্তু চুড়ি গুলোর অনেক দাম শুনে অন্য চুড়ি পছন্দ করেছিলাম। আর টুকটাক কিছু কিনে নিয়ে চলে এসেছিলাম। কারণ বোবা মানুষদের সাথে কোথাও যেয়ে শান্তি নেই। আচ্ছা ও এমন কেন? একবার বলতে পারতো চলো তোমাকে নিয়ে আজ রাতের চাঁদ দেখবো। তুমি ফুসকায় বেশি ঝাল মিশিয়ে খেয়ে পানি পানি করবে আমি দুষ্টমি করে তোমায় বকবো।তুমি বাইরের কনকনে শীতে আইসক্রিম খেতে চাইবে আমি মিষ্টি করে ধমক দিয়ে বলবো,
,
— এবার যদি ঠান্ডা লাগে ঔষধ বন্ধ।
,
নাহ রাশেদ কখনও বলেনি।আমার ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য ওর কাছে ছিল না।
।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। আমি একদিন বসে বসে গল্পর বই পড়ছি।এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। খালা রান্না নিয়ে বিজি আমাকে বললো,
— দেখতো মা কে এসেছে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমার সামনে কুরিয়ার একটা ছেলে দাঁড়ানো। আমাকে দেখে বললো,
— এখানে আশফি নামে কেউ থাকে?
— আমি আশফি কিন্তু কেন?
— ম্যাম আপনার জন্য একটা পার্সেল আছে এই নিন।
আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। আমার নামে পার্সেল কে দিলো।ওটা আমি হাতে নিতেই ছেলেটা একটা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে চলে গেলো।
,
আমি ভিতরে যেতেই খালা বললো কি ওটা। আর কে এসেছিল? আমি সব বললাম। খালা বললো খোল ওটা কি আছে ওতে বের কর।প্যাকেট টা খুলতেই কিছু চুড়ি বেরিয়ে এলো।এতো সেই চুড়ি যেটা আমি পছন্দ করেছিলাম।। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট। তাতে লেখা “আজ রাতে আমি আসছি।চুড়ি গুলো তোমার জন্য।”
,
আমার বুঝতে বাকি নেই এটা কার কাজ।আমি খুশিতে খালাকে জড়িয়ে ধরলাম, কেঁদেই যাচ্ছি। খালা বললো,,
–ওরে পাগলি আমায় ছাড়। অনেক কাজ বাকি নতুন জামাই আসছে। রান্না করতে হবে যে।
এই বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো।
,
রাশেদ আমার মুখোমুখি বসে আছে আধা ঘণ্টা ধরে।কেউ কোনো কথা বলতে পারছি না।এমন সময় রাশেদ আমার পাশে এসে বসে বললো,
— চুড়ি গুলো পরোনি কেন?
–পরবো না।
–কেনো?
–আমি তো সেকেলে তাই।
–তুমি আর কি কি?
–গেঁয়ো কারো মন বুঝি না।পছন্দ বুঝতে পারিনা।
–হা হা আমি তো আমার সেকেলে বউকে নিতে এসেছি।
–আমি যাবোনা।
–না গেলে তুলে নিয়ে যাবো।
,
এই বলেই আমাকে কোলে তুলে নিলো।আমি লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে বললাম,,
–ছাড়ো, খালা দেখে ফেলবে।
–দেখবে না।খালা এখন এ ঘরে আসবে না।
,
ওর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে চুড়ি গুলো এনে দিয়ে বললাম,
–আমাকে পরিয়ে দাও।,
,
রাশেদ আমার হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিচ্ছে। আমার চোখে পানি আসছে বার বার। চোখ দুটি ও অনেক অবুঝ কখন কাঁদতে হয় বোঝে না।
,,,
সমাপ্ত
লেখা অধরা জেরিন