রঙ_বেরঙে,পর্ব-৫ শেষ
সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
ভোরের আলো ফুটে উঠেনি তখনো কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রনব সাহেব।
বাবার লাশ যখন বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তখন প্রণতি নামের মেয়েটা জানেই না তার মাথার উপর থেকে শেষ অস্তিত্বটাও মুছে গেছে।
বাবার লাশের পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল প্রণতি। ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলল তার বাবার মুখের কাপড়। ধীরে ধীরে
প্রণতির সরু সরু আংগুল আলতো স্পর্শ করলো তার বাবার মুখ।
লাশের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল নির্বেদ।প্রণতির হাতের দিকে খেয়াল করতেই দেখতে পেলো
আংগুলে রক্ত জমাট বেধেছে।প্রণতির গায়ে রয়েছে এমন অনেক রক্ত জমাটের অংশ যা প্রকাশ করছে নির্বেদের পুরুষত্ব।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণতি ভাবছিল তার বাবা ঘুমিয়ে আছেন।এই হয়তো কিছুক্ষণ পর সে জেগে উঠবে। উঠে তার সাথে কথা বলবে।
পিয়াল তাকে ধমক দিলে পিয়ালকে বকা দিবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না।কালো চাদরে ঢেকে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।
একজন লোক গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছে।প্রণতিকে ফুলি খালা দাঁড়ায় করাতেই সে বুঝতে পারলো তার বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে।
পথ রোধ করে দাঁড়ালো সে। কিছুতেই নিয়ে যেতে দিবে না।এদিকে পিয়াল তার বোনকে বলল,
“ঘরে যা প্রণতি।বাবাকে নিয়ে যেতে দে।”
প্রণতি দু পাশে ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দিলো,
“বাবাকে নিয়ে যেতে দিবো না।আমিও যাবো।”
প্রণতির জেদে পিয়াল কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিলো।আশেপাশের মানুষে তখন চাপাস্বরে কথা শুরু হয়েছে।
বাবা মারা গেছে এক দিন হয়নি আর ভাই তার প্রতিবন্ধী বোনকে মারতে আসছে।
বাবার লাশ যখন বাড়িতেই। এই মেয়েরে এখন কে দেখবে?
নির্বেদ প্রণতির পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে পিয়ালের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।তাকে নিজের সাথে লেপ্টে নিয়ে জোড় করে জড়িয়ে ধরে রেখে পিয়ালকে ইশারা করলো এগিয়ে যেতে। পিয়ালরা গেট পার হতেই প্রণতি চিৎকার করতে লাগলো।
নির্বেদ প্রণতিকে ততক্ষণ অবধি ছাড়েনি যতক্ষণ না সে শান্ত হয়েছে।
সদ্য পিতা হারানো প্রণতিকে নিজের ছায়ায় নিয়ে নিলো নির্বেদ।
আনিকা কল দিয়ে নির্বেদকে জিজ্ঞেস করলো কখন সে আসবে। নির্বেদ জবাবে তাকে বলল সে আসতে পারবে না কারণ প্রণতিকে পিয়াল মারতে এসেছিল। মেয়েটা এখন এতিম এবং তার দায়িত্ব। একথা শুনে আনিকা গুমরে কেঁদে উঠলো।তার চাপা কান্নার স্বর ফোনের অপর পাশ থেকে শুনতে পাচ্ছে নির্বেদ।
“আমি আসবো আনিকা।তবে আজ নয়। কাল তোমার অপারেশন আছে। তুমি বিশ্রাম নাও।রাখছি।”
পিয়াল ফিরলো গভীর রাতে৷ মদ্যপান করে। তার বাবা থাকাকালীন সময়ে এমন করতে পারেনি। আজ থেকে সে মুক্ত। ফিরে এসেই নিজ ঘরে দরজা লাগালো সে। বাড়িতে তার বোন আছে তাকে সামলানোর দায়িত্ব সে নেয়নি।নিজ ইচ্ছেমতো আছে সে। ফুলি খালা প্রণতিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।
এদিকে আনিকার অনবরত কলে নির্বেদকে বেরিয়ে যেতে হলো মাঝরাতেই। কারণ আনিকার শারিরীক সমস্যা হচ্ছে। আনিকার মা একা একজন মানুষ।স্বামী সন্তান কিংবা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজন তাদের নেই। এদিকে মেয়েকে নিয়ে সে কী করবে ভেবে না পেয়ে কল দিচ্ছিলো তাকে।
নির্বেদ আনিকাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালে দ্রুত তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো কারণ নির্বেদ আসতে চায়নি বলে সে নিজের ক্ষতি পুনরায় করেছে।
ধীরে ধীরে কেটে গেল তিন দিন।এই তিন দিনে নির্বেদ ফিরতে পারেনি প্রণতির কাছে। যেদিন ফিরে এলো সেদিন ফিরে দেখতে পেল প্রণতিকে বেধে রাখা হয়েছে ড্রয়িং রুমের একটা চেয়ারের সাথে।
শুধু তাই নয়, তার মুখে মারের দাগ স্পষ্ট। ফুলি খালা দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরেই। মুখে আঁচল গুজে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তিনি।
নির্বেদের চোখ এবার পড়লো অপর পাশে বসে থাকা পিয়ালের দিকে। তার ঘাড় দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। একজন ডক্টর এসেছে তাকে ট্রিটমেন্ট দিতে।
বুঝতে বাকী রইল না যে প্রণতি তাকে কামড়ে দিয়েছে। আর এজন্যই পিয়াল তাকে বেধে রেখেছে।
পিয়ালের দিকে নির্বেদ এগিয়ে যেতেই তাকে সবটা বলল পিয়াল।
প্রণতি তখন অনবরত কাঁপছে। নির্বেদ দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু কাছাকাছি যেতেই প্রণতি তাকে সজোরে লাথি মারে তার তলপেটের দিকটায়।
আকষ্মিকতায় তাল সামলাতে না পেরে নির্বেদ পড়ে গেল ফ্লোরে। বাম হাতের কনুইতে ব্যথা পেয়েছে সে।
পিয়াল তাকে হাত ধরে তুলে বলল,
“তিন দিন কই ছিলি?তোর দায়িত্ব না?এখন নিয়ে বিদায় হো।”
“আমার দায়িত্ব একার পিয়াল?তোর বোন না?”
“কোনো বোন তার ভাইকে এমন কামড়ে দেয়? গত তিন দিন ধরে সে বাসার জিনিসপত্র ভাংছে। বাবা বাবা করছে। যাকে পাচ্ছে তাকে আঘাত করছে।”
“ওর ডাক্তারকে ডাকছিস না কেন?”
“সময় বুঝে সেও পাল্লা ঝেড়েছে।”
“ওর মানসিক অবস্থাটা বুঝ।ওকে বেধে রাখলে…”
“গিয়েছিলি তো?লাথি দেয়নি?ওকে এভাবেই বেধে রাখতে হবে। ”
এবার ফুলি খালা এগিয়ে এসে বললেন,
“ওরে বাইন্ধা রাইখো না।আমার কাছে দেও। আমি ওরে ঘরে নিয়া যাই।ও ডরাইতাছে। তোমাগো দেইখা।ওরে ঘরে নিয়া যাইতে দেও।”
ফুলি খালার কথায় দুজনে কোনো কান দিলো না।অনেক কথার পর সিদ্ধান্ত নিলো তাকে মেন্টাল আ্যসাইলামে পাঠানো হবে। যা অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল কিন্তু তার বাবা করেনি।আজ যেহেতু বাবা নেই আর তাছাড়া প্রণতির এমন উগ্র আচরণের জন্য তাকে এভাবে রাখা যায় না।
ফুলি খালা এই কথা শুনে বলল,
“পাগলা গারদে পাঠাইবেন কেন?এইটা ওর বাড়ি। ভাইজান ওর নামে দিছে না?
ওরে নিয়া আমি দূরে চইলা যামু।তাও ওরে পাগলা গারদে দিও না।আমার গ্রামে যামুগা ওরে নিয়া।তোমরা ওরে পাগলা গারদে দিও না।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। নির্বেদের পকেটে থাকা ফোনে বার বার কল আসছে।কখন ফিরবে সে আনিকার কাছে?
পিয়াল তখন ব্যস্ত নিজের ব্যবসায়িক কলে।
গেটের বাইরে তখন লাল নীল আলোয় সাইরেন বাজিয়ে এসে থেমেছে সাদা রঙের গাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো গোটা চারেক লোক।প্রণতি কী বুঝলো কে জানে।
উচ্চস্বরে শুধু বাবাকে ডাকতে লাগলো।তার বাবাকে না পেয়ে ফুলি খালাকে ডাকলো।কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ বুজে আসছে ঘুমে। নিভু নিভু চোখে সে দেখলো তার হাতের বাধন খুলে দেওয়া হয়েছে। পায়ের বাধন খুলে তাকে তুলে নিচ্ছে স্ট্রেচারে।
গাড়িতে উঠানোর পূর্বে পায়েল একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলো। কোনো অনুভূতি হলো বলে মনে হলো না তার। নির্বেদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।প্রণতি হাত বাড়িয়ে কখন তার শার্টের কোণা ধরেছিল সে জানে না।গাড়িতে উঠানোর সময় খেয়াল হলো। কিন্তু কর্তব্যরত সেবিকা হাত ছাড়িয়ে নিলো।
নির্বেদ খেয়াল করলো প্রণতিও ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
সাদা গাড়িটা নীল সাদা রঙের আলো জ্বালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল যে পথে এসেছিল।সে দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নির্বেদ।পকেটে এখনো তার ফোন বেজেই চলেছে। সে ফিরবে আনিকার কাছে।
শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়।আর সে পিছনে ফেলে যাচ্ছে রঙহীন এক মেয়ের বেরঙে গল্প।
(সমাপ্ত)