তোমাতে রহিব বিলীন,পর্ব-০১

তোমাতে রহিব বিলীন,পর্ব-০১
লেখনীতে- Ifra Chowdhury

বন্ধুদের সাথে বাজি ধরতে গিয়ে খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেলাম। প্রেম নামক বিষয়টাতে আমার প্রথম থেকেই এলার্জি জাতীয় রোগ রয়েছে। অথচ, সেই আমাকে বাজি ধরতে হলো প্রেম নিয়েই। তার উপর ক্যাম্পাসের যাকে আমি সবথেকে বেশি সহ্য করতে পারি না তার সাথেই নাকি প্রেম করে আমাকে বাজিতে জিততে হবে!

এমন বন্ধু জীবনে থাকলে আর প্রকাশ্য শত্রুর প্রয়োজন হয় না। অসম্ভব! এই বাজি আমি জিততে পারবো না। আবার যদি হেরে যাই তাতেও পঁচানি খেতে হবে বন্ধুদের কাছ থেকে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সোহার কন্ঠ কানে এলো। আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি ও আমায় ক্যাম্পাসের গোল চত্ত্বরের দিকে ইশারা করে কিছু একটা দেখাতে চাচ্ছে। তবে ওর ইশারায় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুটা এগিয়ে যেতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। পরাগ ভাইয়ার সাথে কিছু পোলাপানের ঝামেলা চলছে গোল চত্ত্বরে।

আমি সোহার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ও প্রিয়র পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। খুব বেশি রাগ হচ্ছিলো সোহার উপর। যে লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারি না, বারবার তার সামনেই আমাকে পড়তে হয় তাও আবার এই বন্ধুদের জন্য।
আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে আসলাম।

ক্লাসরুমে গিয়ে বসার সাথে সাথেই পরাগ ভাইয়া হনহন করে রুমে ঢুকলেন। তারপর চেঁচিয়ে বললেন,
‘এরপর অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টের কেউ তোমাদের কাউকে ডিস্টার্ব করলে সরাসরি আমায় জানাবে বুঝলে?’

আমি উনার কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। রুহিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী ব্যাপার রুহি? উনি এমন চেঁচাচ্ছেন কেন? আর কে কাকে ডিস্টার্ব করেছে?’

রুহি আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই আমি পরাগ ভাইয়ের নজরে পড়ে গেলাম। উনি আমাকে ইশারা করে বললেন,
‘এই মেয়ে সমস্যা কী তোমার? দেখছো না আমি সবার সাথে কথা বলছি? এর মাঝে তুমি অন্যজনের সাথে ফিসফিস করছো কেনো?’

আমি উনার এমন ব্যবহারে তাজ্জব বনে গেলাম। উনি এমন ভাবে আমার সাথে কথা বললেন যেনো আমায় চিনতেই পারেননি। অথচ ক্লাসরুমের বাহিরে উনার সাথে আমার সাপে নেউলে সম্পর্ক।

আমি থতমত কন্ঠে বললাম,
‘সরি ভাইয়া।’

উনি কিছু না বলে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এমন অপমানিত হওয়ার পর আমার রাগে, কষ্টে কান্না চলে আসলো। প্রিয় আমায় সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। এরপর ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টের পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিলো। তাই সামনে পিছনে না তাকিয়েই আনমনে হাঁটছিলাম। এমন সময় সেই কাটখোট্টা কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

‘আরে মিস লঙ্কাবতী? হঠাৎ রেড জোন এড়িয়ায় ঢুকে পড়লে যে? কোনো দরকার?’

আমি আবারও খুব রেগে গেলাম সেই সাথে খুব অবাকও হলাম,
‘রেড জোন এড়িয়া মানে?’ বিড়বিড় করে নিজের মনেই প্রশ্ন আওড়ালাম।

চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম ডিপার্টমেন্টের একদম শেষ প্রান্তের কদম গাছটার কাছাকাছি চলে এসেছি আমি। এর আগে এদিকটায় একবার এসেছিলাম। এসেই শুনেছিলাম এটা পরাগ ভাইয়ার আড্ডাখানা এরপর আর আসা হয়নি। আসলে যে লোকটাকে আমি সহ্যই করতে পারি না তার আড্ডাখানায় আসার বিন্দু মাত্রা ইচ্ছেও আমার নেই। আজ হঠাৎ আনমনে হাঁটার ফলে চলে এসেছি এখানে। কিন্তু তাই বলে এতো বাজেভাবে কথাখানা বলবেন উনি?
আমি মাথানিচু করে সেখান থেকে প্রস্থান করতে চাইলাম। কিন্তু লাভ হলো না, উনি আবার প্রশ্ন করলেন,

‘কী ব্যাপার! আজ মিস লঙ্কাবতী এতো চুপচাপ? কিছু হয়েছে?’

ইচ্ছে করছিলো উনার মুখের উপর জবাব দিতে। কিন্তু দিলাম না। উনি একটু আগে আমার সাথে যে ব্যবহার করলেন, তারপর উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। এর শোধ আমি পরে নিবো। আগে বাজি জিতে নিই। এখন আমার মূল উদ্দেশ্য বন্ধুদের দেওয়া বাজিতে জয় লাভ করা।

____________

চড়া মেজাজে বাসায় আসলাম। এসেই দেখলাম আপা ড্রইংরুমে বসে তার বরের সাথে কথা বলছে। আমি ওর পাশেই ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আপা আমার এমন কান্ডে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে। অবাক হওয়ারই কথা। যেই আপাকে ভার্সিটি থেকে ফিরে জড়িয়ে না ধরলে আমি শান্তি পাই না, আজ তার সাথে একটাও কথা বলিনি। আপা কয়েকবার দরজায় করাঘাত করলো, কিন্তু লাভ হলো না। আমি এখন লম্বা শাওয়ার না নেওয়া অবধি কারো সাথেই ভালো মেজাজে কথা বলতে পারবো না। তাই চুপচাপ শাওয়ার নিতে চলে গেলাম। এদিকে আপা বাসায় তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেললো। আব্বু, আম্মু, চাচ্চু, কাকিমা সবাইকে ডেকে আমার রুমের সামনে জড়ো করে ফেলেছে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আমি দরজা খুললাম। সাথে সাথেই আপা আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। ওর সাথে আমার বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশিই তাই হয়তো আমায় এতো বেশি ভালোবাসে৷

কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আপা বললো,
‘এই স্মিহা, কী হয়েছে? তুই আমায় জড়িয়ে না ধরেই এভাবে রুমে চলে গেলি? আমি তোর অপেক্ষায় ড্রইংরুমে বসে ছিলাম। আর এতোক্ষণ কী করলি? তুই ঠিক আছিস তো?’

আমি বললাম,
‘আরে আপা, কাঁদছো কেন? আমি ঠিক আছি। আর খুব গরম লাগছিলো তাই তাড়াতাড়ি রুমে এসে শাওয়ার নিলাম। দেখছো না?’

আব্বু আর চাচ্চু আপাকে ধমক দিয়ে বললেন,
‘নিহা, শান্তি হয়েছো তো তোর? এই নে, তোর বোনকে তোর কাছে দিয়ে গেলাম। বাপ রে! মেয়েটা কিছুক্ষণের জন্য রুমের দরজা লাগিয়েছে আর তুই বাসায় হুলস্থূল বাঁধিয়ে ফেলেছিস। সত্যিই! তুই পারিস বটে।’

আম্মু বললেন,
‘কিছুদিন পর যে জামাই দেশে ফিরে তোকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যাবে, তখন থাকবি কীভাবে বোনকে ছেড়ে?’

আপা কড়া গলায় বললেন,
‘আমি যেখানে থাকবো আমার বোনও সেখানে থাকবে। প্র‍য়োজনে তোমাদের জামাইকে এনে ঘরজামাই রাখবো। হুহ!’

আপার এমন কথায় সবাই হেসে উঠলো। আব্বু আমাদের দু’বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘পাগলী মেয়ে দু’টো আমার। সবসময় এমন হাসিখুশি থাক তোরা।’

দুপুরের খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখি আপা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কী ব্যাপার আপা? কিছু বলবে?’

‘তোর কী হয়েছে সত্যি করে বল্ তো? তখন যে মিথ্যে বলেছিস, সেটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছি।’

আমি আপার পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরিয়ে বললাম,
‘তুমি আমায় এতো বেশি ভালোবাসো কেন বলো তো?’

‘কারণ তোকে আমি ছোট থেকে এই নিজ হাতে বড় করেছি। তোর ভালো মন্দ আমি আম্মুর থেকেও বেশি বুঝি, জানিস?’

‘উম, জানি তো। তাই তো আমিও তোমায় আমার সবটা বলি। জানো আপা আজ কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি এতোক্ষণ ধরে। কিছু না হলে তো আমার মিষ্টি বোনটার মুখটা এতো ফ্যাকাশে থাকতো না। বল্ সোনা কী হয়েছে?’

‘জানো আপা, প্রিয়রা আমায় চ্যালেঞ্জ করেছে আমার মতো একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া, রাগী মেয়ের কপালে নাকি প্রেম ভালোবাসা কিছুই নেই। তো আমিও বলেছি এসব না হলেও কিছু যায় আসে না। তো ওরা বললো আমি নাকি ভয়ে এসব বলছি। আসলে আমার দ্বারা নাকি প্রেম হবেই না। তারপর আমি রেগে গিয়ে বলেছি এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ওদের প্রেম করিয়ে দেখিয়ে দেবো।
তারপর ওরা আমার সাথে যা করলো, তা আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবো না।

‘কী করেছে?’

‘ওরা আমায় বলেছে, ঐ কাঠখোট্টা পরাগ ভাইয়ার সাথে প্রেম করে দেখাতে। তাহলেই নাকি ওরা মানবে আমি ভীতু নই। তুমি বলো আপা, তোমার বোন কি ভীতু?’

আপা আমার কথা শুনে হেসেই কূল পাচ্ছে না। আপার হাসি দেখে আমি আরো চটে গেলাম। মেজাজ দেখিয়ে বললাম,
‘তুমিও ওদের দলে তাই তো? এই ভালোবাসো তুমি আমাকে?’

আপা হাসি কিছুটা থামিয়ে বললো,
‘আরে, যার সাথে তোর দা-কুমড়োর মতো সম্পর্ক তার সাথেই কিনা তুই অবশেষে প্রেম করবি? তার উপর তুই প্রেম বিদ্বেষী একটা মেয়ে। এলেম আছে বটে প্রিয়দের। তোকে একদম বাজেভাবে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।’

‘ছিঃ আপা, তুমি আমার বোন হয়ে ওদের পক্ষে কথা বলছো? তোমাকে বিষয়টা বলাই আমার ভুল হয়েছে। আজ থেকে আড়ি তোমার সাথে।’

‘আহা সোনা রাগ করিস না। আসলে আমি হাসি থামাতে পারছি না। যাই তোর দুলাভাইকে খবরটা দিয়ে আসি।’

‘আপা, আপা…’

আপা আমার কথা না শুনেই হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ধ্যাৎ! রাগে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ঐ পরাগ ব্যাটার সাথে প্রেম করার পরই আমার রাগটা কমবে, এর আগে না। কিন্তু ব্যাটাকে ফাঁসাবো কীভাবে? আমার কাছে তো উনার নাম্বারই নেই। তাহলে ‘মিশন অফ দ্যা প্রেম’ শুরু করবো কীভাবে? তার উপর প্রেম করার জন্য কী কী বিষয় প্রয়োজন, সেটাও তো বুঝতে পারছি না!

অনেকক্ষণ ভাবার পর মাথায় আইডিয়া আসলো গুগলে সার্চ করে দেখবো। ল্যাপটপ অন করতেই মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রাগটা আরো শতগুণ বেড়ে গেলো।
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here