ভুলবশত♥
PART_12,13
FABIYAH_MOMO🍁
সাগ্রত হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালো। ভূত দেখলে যেমন মুখের ভাব হয় তেমন করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। রাত বারোটায় আমি মরার মতো ঘুমিয়ে থাকবো ঠিক এমনটাই ভেবেছে হয়তো। সাগ্রত এখনো আমার দিকে ঝুকে স্থির পানে তাকিয়ে আছে, আমি সাগ্রতের দিকে কপালকুচকে তাকালাম। ও নড়েচড়ে মাথা হালকা ঝাকিয়ে বেডের পাশে রাখা স্টিলের টুলে মাথা নুয়ে বসলো। আমি বুঝলাম সাগ্রত আমার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছেনা। চড় দেওয়ার ঘোর অপরাধে আসামীর মতো বসে আছে। আমি দারোগা আর ও আসামী। শরীরের অবষাদ অনেকটা কেটেছে তাই আর দেরি না করে বেডে দুহাতের তালুতে ভর করে ধীরেসুস্থে উঠে বসার চেষ্টা করলেও বসতে ব্যর্থ হই। পা দুটো আড়াআড়ি করে আসন সিস্টেমে বসার ইচ্ছে ছিলো আমার। সাগ্রত আড়চোখে সম্পূর্ন কারনামা খেয়াল করছে জানি। একটু কেশে গলা ঝেরে বলে উঠি-
–আপনি আমায় চড় কেন দিয়েছেন? অধিকার কোত্থেকে পেলেন? কে দিয়েছে আপনাকে অধিকার? কিসের দাপট আপনার! আপনি আমায় চড় মারবেন! চুমু দিবেন! কেন এসব করছেন? কি চাই মিস্টার সাগ্রত পরিস্কার কন্ঠে বলা যাবে??
সাগ্রত স্নেহার কথায় চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের তালুতে আঙ্গুলের তর্জমা করছে সাগ্রত, কথা গুছিয়ে বলতে চেষ্টা চালাচ্ছে শত। কিন্তু কথা গুছিয়ে বলা তো দূর! শব্দ তৈরি করে বাক্য গঠনেই গুলিয়ে ফেলছে সব। স্নেহা কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের জবাব না পেয়ে বিরক্ত হলো। আবারো গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে সাগ্রতকে বলে উঠলো-
–আপনি কিছু বলবেন সাগ্রত সাহেব! কিছু কি বলার জন্য আছে!!
সাগ্রত তবুও কিছু বলছেনা। এতে স্নেহা ক্ষেপে উঠলো। রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো-
–আমায় কি মেরে ফেলতে এসেছেন তাশরীফ সাগ্রত! স্পেশাল টাস্ক হিসেবে আমার লাশের চার টুকরা করে নদীতে ভাসাতে চাচ্ছেন! কে পাঠিয়েছে আপনাকে? আমার নানাবাড়ির কেউ…তাইনা??? ছোট মামা পাঠিয়েছে না??
মাথা তুলে তাকালো সাগ্রত। স্নেহা কথার বুলেট আরেক ছবক দিতে যেয়ে সাগ্রতের অসহায়ভাবে চাহনির দিকে আটকে গেলো। স্নেহা মুখ দিয়ে বাকি কথাগুলো বলার জন্য ঠোট নড়ালেও সাগ্রতের চাহনির জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। কিচ্ছু বলতে পারলো না। ঘটনাচক্রে সাগ্রত হুড়মুড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে স্নেহার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। স্নেহা সাগ্রতের হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ার উপর চমকে উঠলো। ঘাড়ে সামান্য ব্যাথাও পেলো, অস্ফুট সুরে ‘আহহ্’ করে উঠলো। ব্যাথার আওয়াজ সাগ্রতের কানে পৌছালো না, সাগ্রত স্নেহাকে শক্ত করে চেপে নিঃশব্দে ফুপিয়ে উঠলো। স্নেহা সাগ্রতের দিকে ঘাড় বেকিয়ে মাথা নিচু করে তাকাতে পারছেনা। রাত বারোটায় ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়াও রুমে আরেকটি শব্দ যোগ হয়েছে। সেটা হালকা স্বরের ফুপিয়ে কাদার আওয়াজ। স্নেহা সাগ্রতের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে উঠলো-
–আপনি কাদছেন? কাদার মতো কিছু কি আছে? আপনাকে ছোট মামা পাঠিয়েছে আমাকে মারার জন্য কথা তো ঠিক বললাম। মেরে দিয়ে চলে যান। এতিম মানুষ আমি। আমার কেউ নেই। কেউ কেস- মামলা করবেনা।
সাগ্রত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত কেবিনের জানালার কাছে গেলো। মুখ লুকিয়ে জানালার বাইরের দিকে ঘুরে দাড়ালো। স্নেহা উৎকন্ঠাবোধ করলেও সাগ্রতের হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে মুখ লুকানো ব্যাপারটায় নজর কাড়লো। সাগ্রত সাবধানতার সাথে হাত দিয়ে চোখ মুছে ফেললো। স্নেহা সাগ্রতের দিকে ধ্যানমগ্নে তাকিয়ে আছে। স্নেহা তার প্রশ্নের জবাব স্ব স্ব ভঙ্গিমায় পায়নি। সাগ্রত বহু কথা লুকাচ্ছে আচঁ করতে পারছে স্নেহা। সে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো-
–শুনুন? একটু এখানে আসবেন? কথা আছে।
সাগ্রত নাক টেনে মাথায় হাত দিয়ে পেছনের দিকে চুলগুলো ঠেলে দিলো। স্নেহার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো স্নেহা তাকে নরমভাবে কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আশায় কাছে আসতে আদেশ করছে। সাগ্রত আর মানা করলো না, স্নেহার কাছে যেয়ে টুলে হাত দিয়ে বসতে নিলো। স্নেহা চটপটে সুরে বলে উঠলো-
–এই টুলে বসছেন কেন? এখানে আসুন। বেডে বসুন।
সাগ্রত টুলে বসতে যেয়ে থমকে গেল…স্নেহার দিকে একপলক তাকালো। তারপর স্নেহার কথানুযায়ী বেডে বসলো। স্নেহা তাকে বসার জন্য বেডের একটু বাপাশে চেপে বসলো। ডানপাশে ঠিক করে বসতে ইশারা করলো। দুজনেই বেডে চুপচাপ বসে আছে। নিরবতার মূহুর্ত চলছে। কেউ আগ বারিয়ে একটি প্রশ্ন করছে না। উভয়ই চুপটি মেরে বসে আছে। যেন মনের মধ্যে জবাবের আদানপ্রদান ঘটছে। এরই মাঝে চুপচাপ পরিবেশ তৈরি করে দুজনে বসে আছে। স্নেহার চন্ঞ্চল মনে আকুপাকু করছে ঝট করে কথারমালা বুনে সাগ্রতকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য! আর সাগ্রত সেই কথারমালা গলায় নিয়ে একের পর এক সব উত্তরেরমালা স্নেহার দিকে উপহার দিয়ে দিবে। স্নেহা খানিকটা সময় বাদে বলে উঠলো-
–কাদছিলেন কেন? দেহের সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমান কি বেড়ে গিয়েছিলো? শুধুশুধু কাদার মানে হয়? আমাকে মারতে এসে নিজেই কেদেঁ দেন!! আরে চিল ম্যান! আমাকে মারলে কষ্ট পাওয়ার কেউ নেই। সব মরে গেছে। মা ছিলো তাও বাবার বন্ধুর হাত ধরে ভেগে গেছে। সো..খুন করে পাচঁ টুকরা করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দিবেন। গেম ফিনিশ!!
সাগ্রত আমার দিকে হা মেরে চোয়াল ইয়া লম্বা ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে এমনে তাকানোর মানে কি ভাই? ডরাই মুই!! তবে সত্য এটাই আমাকে মেরে দিলে দুনিয়াবী সব বন্ধন আর চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এরপর মৃত্যুর পরবর্তী জগতে যেয়ে নানা কর্মের জবাবদিহি করবো, প্রায়শ্চিত্ত করবো। সাগ্রত এখনো হাবার মতো হা করে তাকিয়ে আছে। কেবিনে মশা মাছির উপদ্রব বেশি হলে এখনই তার মুখে দুতিনটা মশা মাছি যেয়ে বিশ্রাম করে আসতো। আমি সাগ্রতের থুতনিতে হাত দিয়ে চোয়াল বন্ধ করে দিলাম। সাগ্রত ধ্যান কাটিয়ে চমকে উঠলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা ঠিক করে বসলো। আবারো পিনপতন নিরবতা বিরাজ করতে লাগলো। কিছু সময় পরে সাগ্রত আহত সুরে বলে উঠলো-
–স্নেহময়ী আমি তোমাকে খুন করতে এসে নিজেই খুন হয়েছি। আমার দ্বারা খুন সম্ভব না। আমি খুন করতে পারবো না। আমি খুন করতে পারি না! ভুলে গিয়েছি!
ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা হাসি দিলাম। হাসির কারন শুধু সাগ্রতের কথা। পেটভর্তি অবস্থায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ভাই পোলাও কোরমা দেই? খান? তখন সে পেটের জমজমাটে হাত দিয়ে স্মরন করে বলবে, না ভাই খাওয়া ভুলে গিয়েছি। উটকো জবাবে মানুষের মাথা কত ডিগ্রিতে গোলচক্কর দিবে বলতে পারছি। কেননা আমার মাথাটা এখন চক্করের কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়েছে। সাগ্রতকে সহজ গলায় বলে উঠলাম-
–আমার ফিগার দেখে মন বদলে গেছে ঠিক না? সমস্যা নেই। আমাকে টুকরো করার আগে মনের ইচ্ছা পূর্ণ করে নিয়েন, মরার পর আমাকে খুবলে যদি জঙ্গলি কুকুরও খায় তাতেও ক্ষতি নেই। হয়তো আমার অভাগী কপালে এসবই লিখা ছিলো, নাকোচ করার অধিকার তো কারোরই নেই। আমি আর কি জিনিস….মনের সব খোরাক পূরন করে নিয়েন কেমন?
আমার কথাগুলো অনেকের কাছে পাগলের কথা বলে আখ্যায়িত হতে পারে। কিন্তু মৃত্যু যখন এতো কাছে এসে বসে বসে বলছে, তোকে আমরা নিতে এসেছি। তখন আর কি করার থাকে? আমারও ঠিক সেরূপ বিবেচনা মনের মধ্যে কাজ করছে। আমি ভেবেছিলাম সাগ্রত আমাকে ফের দুটো থাপ্পর বসিয়ে ছাড়বে। কিন্তু হলো বিপরীত। সাগ্রত চুপ করে বসে আছে। ব্যথিত হরিণের ন্যায় মনটা ছোট করে নুয়ে আছে। আমার মন সাগ্রতের মুখে কথা শোনার জন্য আকুলিবিকুল করছে। সাগ্রতের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব হচ্ছে। নাটক, সিনেমার মতো এটাই কি সেই ‘মহব্বত’ নামক টানের অনুভূতি নাকি নিছক অন্যকিছু? আমার মতো অভিজ্ঞতাহীন মেয়ের পক্ষে ধারনা করা মুশকিল। সাগ্রতের টিশার্ট চেন্জ করা হয়নি। কাজেই ওর দিকে তাকালে যে কেউ বলবে, সাগ্রতের বুক চিড়ে রক্ত পড়েছে। অবশ্য রক্ত শুকিয়ে কালচে রঙ ধারন করেছে। আমি জানি টিশার্ট থেকে রক্তের নিশান শক্ত করে লেগে থাকবে। সাগ্রত আমার অপেক্ষার প্রহর কেটে দিয়ে মুখ নিঃসৃত করে কিছু বলে উঠলো-
–তুমি জানো তুমি উন্মাদের মতো কথা বলছো? আমি তোমাকে কেন খুন করতে পারছিনা সেটা এখনো বুঝতে পারছো না? আমি একজন সিরিয়াল কিলার। মানুষ খুন করি। ভালো মানুষ না। তোমাকে আমি খুন করতে পারছিনা। তবুও তুমি ক্লিয়ারলি বুঝতে পারছো না? চার মাস আগে, ১১ই ফেব্রুয়ারি তুমি সিএনজিতে সাফার সাথে ভার্সিটি যাচ্ছিলে। তোমাকে শাপলা চত্বরে গান দিয়ে শ্যূট করতে টার্গেট দিয়েছিলাম.. তুমি জানো?(বুকের বাপাশে হাতের তালু বসিয়ে)এই হার্টবিটের সার্ডেন ফাস্ট হওয়াটা আমাকে নাভার্স বানিয়ে ছেড়েছে! আমি টার্গেট মিস করি! লাইফে ফাস্ট টাইম তাশরীফ সাগ্রত তার কিলিং শট মিস করে!! ফর দ্যা ফাস্ট টাইম! কার জন্য বলো তো? কার জন্য? স্নেহময়ী তোমার জন্য!আমি আমার শুটিং গ্যাংয়ে সবচেয়ে প্রোফেশনাল এন্ড পাক্কা শ্যূটার! আমি আমার সকল ডিলে বাজিমাত করে এসেছি! কেউ আমাকে ধরতে পারেনি! পুলিশ র্যাব কেউ না! সবাইকে আমি ধূলো দিয়ে চলি! কিন্তু…তোমার কাছেই আমি হেরে বসি! জানো? সাগ্রত যে ডিলে হাত দেয় সেটা কমপ্লিট করে ছাড়ে! বাট তোমাকে বিগত দুমাস ধরে মারতে পারছিনা! আমি কেন তোমায় খুন করতে পারছিনা এখনো কি না বুঝার আছে বলো ?
-চলবে
-Fabiyah_Momo🍁
#ভুলবশত♥
#PART_13
#FABIYAH_MOMO🍁
রাত দুইটার ঘরে ঘড়ির কাটা ছুয়ে বসেছে। আমার চোখে ঘুমের তলব নেই। ঘুম যেন উড়াল দিয়ে অতল সাগরে উবে গেছে। বেডে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। চোখ দুটো আটকে গেছে জানালার বাইরে কালো চাদরে ঢাকা সামাহীন আকাশের দিকে। আকাশে আজ চাদের জোৎস্না নেই। রুমের অন্ধকার বাইরের অন্ধকারের সাথে মিশে রয়েছে। মানুষ হত্যা করা পাক্কা হাতের সিরিয়াল কিলার আমার ঠিক সামনের সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। অন্ধকারের ঘণত্ব বেশি বিধায় রুমের মধ্যে কিছুই দৃশ্যমান নয়। সাগ্রতকে স্পষ্ট চোখে দেখাও সম্ভব নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের দোটানায় দুইজন মানুষ রুমের দুদিকটায় শুয়ে-বসে আছে। আমার মামা জাকারিয়া মাসুদ। বয়সে মায়ের বড় এবং ছোট্ট ব্যবসায় নিজের দুইছেলে এবং পরিবারের সব অনটন সামলায়। মা ছিলো নানাভাইয়ের সবচেয়ে আদরের মুখ্যমণি। নানাভাইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনা সাত বাজার হাতিয়ে চলা এক মেয়েকে বিয়ে করেন আমার মামা। মামার করা এই সামান্য ভুলেই নানাভাই তার সবচেয়ে আলোচিত সম্পত্তির ভাগীদার মায়ের নামে দিয়ে দেয়। শুরু হয় রেষারেষি। আমি তখন পাচ বছরে পর্দাপন করেছি, বাবা হার্ট স্ট্রোক করে মারা যান। বাবা যাওয়ার পর আমি নানার সাথে থাকলে মা এদিক দিয়ে বাবার বন্ধু জামিল আঙ্কেলের সাথে সম্পর্ক বাধান। একদিন স্কুল থেকে এসে শুনি মা একটা চিঠি ছেড়ে তার সব কাপড় নিয়ে পালিয়ে গেছে। নানাভাই কতটা মর্মাহত হন আমি জানি। নানাভাই অবষাদে ঢলে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া ভুলেই যান। জীবনের সব কিছু এলোমেলো করে ঘটনার ঠিক ষষ্ঠদিনে অজস্র যন্ত্রণা এবং সমাজের কটু কথা শুনে শেষ দম ছাড়েন। নানী মারা যাওয়ার পর থেকেই মৃত্যুর দিন গুণতেন, কিন্তু শেষমেশ মায়ের কান্ডনামায় নানাভাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্থায়ীভাবে বন্ধ করেন। বড় মামা বিদেশ থাকেন। বছরে একবার খোঁজ খবর রাখতেন। নানা মারা যাওয়ার পর খোঁজ নেওয়া তো দূর! আমরা দেশের মাটিতে কেউ আছি নাকি বিগত দশ বছরের মধ্যে আলাপন নেই। বাবা আমার ভবিষ্যত চিন্তায় যে উইল রেখে গিয়েছিলো তার খবর পেয়ে ছুটে আসেন ফুপি। ফুপির কাছেই বড় হতে থাকি। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় টাকা চাইলেই টাকা দিতে থাকি।কখনো এক মুঠে পাচ হাজার টাকা কখনো বা আড়াই হাজার। গেল বছরের ঘটনা। ক্যাম্পাসের বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরার জন্য রিকশা করে আসছিলাম। পথে কোত্থেকে একটা মাইক্রোবাস আসলো পেছন থেকে ধুম করে ধাক্কা দিয়ে রিকশা উল্টে ফেলে দিলো। ঘটনাস্থলে আমি ছিটকে আরেক রিকশায় নিচে পড়ি, জমজমাট রাস্তায় রিকশা আমার পায়ের উপর দিয়ে তুলে দেয়। রিকশাওয়ালা মামার তৎক্ষণাৎ রাস্তার পাথরে আঘাত পেয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিলো। হাতের কবজিতে হাড় ভেঙ্গেছিলো। আমি পায়ের ব্যথায় কাতরাতে থাকলে আশপাশের মানুষ ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রায় তিন সপ্তাহের কাছাকাছি হাসপাতালে থেকেছি। বাসায় ফিরে ছ’মাস পা উঠিয়ে বেড রেস্টে কাটিয়েছি। সাফা আপু আমাকে সেবা শুশ্রূষা দিতে থাকেন, আমি বহুদিন পর পা দিয়ে হাটতে শুরু করি।
ঘড়িতে আরো একঘন্টা পেরুলো। সাগ্রত ঘুমিয়েছে কিনা জানি না। আমি রাতটুকু ঘুমানোর জন্য এপাশ-ওপাশ করে ফিরতেই পারছিনা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করছি। কাথাটা টেনে গলা পযর্ন্ত আনতেই কেউ নিচু স্বরে নরম করে বলে উঠলো-
–লাইফে কষ্ট আসতে হয়। কষ্ট না আসলে দুঃখ ভোগ করিনা। দুঃখ ভোগ না করলে শক্ত হয়ে উঠিনা। ঠিক না স্নেহময়ী? স্নেহময়ী জানো? আমি ছোট থেকে কারোর আদর পাইনি। আদর কি জিনিস এখনো বুঝি না। বুঝার ইচ্ছাশক্তি নিয়ে প্রতিদিন গভীর রাতে একবাক্য করে ডায়েরি লিখি। আমার একটা ডায়েরি আছে। তাতে দেখবে প্রচুর লিখা। আমি তো তোমাকে মারতে পারবো না স্নেহময়ী। আমার দ্বারা তো আদৌ হবে না। তুমি আমার মতো একটা খুনি ছেলেকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না। আমি তোমাকে জোরপূর্বক কিছুই করতে বলবো না। কেননা, আমি তো সত্য জানি। আমি তো জানি, মেয়েরা খুনি ছেলেদের ভয় পায়। ভয় পেলে ভালোবাসা কখনোই হবেনা। আমি তোমার সাথে আছি মেবি তিনমাস হলো বাট তোমাকে চিনি সাত মাস আগে থেকে। বুঝতে পারছো স্নেহময়ী… শুধু তোমার জন্য আমি নিজের চেহারা দেখালাম, নিজের একচুয়েল পরিচয় দিলাম। আমি তাশরীফ সাগ্রত আজ পযর্ন্ত কাউকে নিজের আসল নাম, পরিচয় কিচ্ছু বলি নি। এমনকি আমার বস পযর্ন্ত আমার নাম জানে না। জানে আমার নাম তাওহিদ ইবনাত। আমি তোমার কাছ থেকে দূরে যাবো যাবো করেও যেতে পারছি না। যখন তোমার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাই মনটা চায় তোমাকে আজীবনের জন্য শত যুগের জন্য নিজের ডোরে বাধি। কিন্তু আমার কর্মের জন্য আমার মা বেচে থাকলে নাক ছিটকিয়ে ছি ছি করতো!! আর সেই জায়গায় তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটা.. ব্যর্থতা! তবুও অপেক্ষা আছি। দিনের একেকটা মূহুর্ত তোমাকে পাওয়ার জন্য আঙ্গুলে টুকে গুণছি। আশা করছি স্নেহময়ী একদিন আসবে!! আমি অবহেলা সহ্য করতে পারি না স্নেহময়ী। খুব যন্ত্রনা হয়। কাদতে চাইলেও কাদতে পারি না। লাইফে লাভ করার সাহস আমার ছিলো না। তোমার জন্য অদম্য সাহস জুগিয়েছি। কি করি স্নেহময়ী? কি করলে আমি অন্য দশটা ছেলের মতো তোমার কাছেও একটুখানি আদর, ভালোবাসার এক্সপেক্ট করতে পারবো? জুয়েলের কাজের জন্য আমি নিজেকে দোষী ভাবি স্নেহময়ী!! কেন্ জুয়েল তোমার মতো মেয়েকে কাছে পেয়েও কাছ করে রাখতে পারলো না!! কাছ করে রাখার জন্য কি তোমার ফিগার ইর্ম্পট্যান্ট? কই? আমি তো তোমার ফিগার দেখে প্রেমে পড়িনি!! তুমি একদিন বাজার থেকে সাফার সাথে সিএনজি করে বাসায় ফিরছিলে। গ্রীষ্মের গরমে তুমি ঘেমে এলোমেলো চুলে ছিলে…আর সাফা! সাফা পরিপাটি পোশাকে, এসির মধ্যে শপিং করতে ব্যস্ত ছিলো, তুমি মাছ মাংসের ভ্যাপসা গরমে হাত বোঝাই বাজার নিয়ে সবজির দোকানে যাচ্ছিলে। চুলের খোপা আধখোলা ছিলো, ফ্যাকাশে ঠোট লিপস্টিক ছাড়া! ভ্রু যুগলের নিচে ক্লান্তিকর দুটো চোখ! গালভরা ঘামের বিন্দুর ছোপ! সাদামাটা সালোয়ার- কামিজ! আমি তো আর্কষনীয় কিছুই তোমাতে খুটিয়ে বের করতে পারিনি!! তবুও তোমাতেই চোখ-মন-প্রাণ সমস্ত শরীর শিহরিত হচ্ছিলো!!জানো, সেদিনের স্নেহাকে দেখে যে ধাক্কা খেয়েছি! ডিরেক্ট প্রেম নামক আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে গেছি!! হাতে গান নিয়ে কতবার টার্গেট করার স্কোপ গুলিয়ে ফেলেছি কাউন্ট করা মুশকিল। শাপলা চত্বরে আমি ঠিক করেই ফেলেছি বুলেটটা তোমার কপালের মাঝ বরাবর নিশানা দিবো! সেই বুলেটটা যদি টার্গেট মিস করে দেয়ালে বিদ্ধ হয়!!! তাহলে বুঝো আমার মনে তুমি কতটা সংক্রামন ছড়িয়েছো!! আমি কি তোমার পা ছুয়ে নিজের ভালোবাসার জিকির করবো? তুমি কি আমায় বিশ্বাস করবে? কসম! মিথ্যা বলছি না স্নেহময়ী! তুমি একবার বললে আমি তোমার সব কথা মানবো! চলে যেতে বললে চলে যাবো! নিজের মুখটা কক্ষনো আর সামনে আনবো না! আই প্রমিস! তাশরীফ সাগ্রত তার ওয়ার্ডস ভুলেনা!
বামহাতটা নিজের বুকের উপর রাখতেই বুঝলাম… হৃদস্পন্দনে বেতালে ধুকপুক ধুকপুক করছে!! সাগ্রতের কথায় আমার কেন হার্টবিট বাড়ছে!! আমি উপেক্ষা করতে পারছিনা! চোখ বন্ধ করলাম! খিচে চোখ বন্ধ করলাম। কাথাটা টেনে মাথার শীর্ষ পযর্ন্ত ঢেকে চোখ বন্ধ করে আছি। হৃদপিন্ড কেমন উপর-নিচ করছে!! শ্বাস বেড়িয়ে আসছে বুঝি! আমাকে করা প্রশ্নের জবাবে সাগ্রত আর বসে রইলো না! ঝট করে অল্প শব্দ করে সোফা থেকে দাড়িয়ে পড়লো!! শব্দটা শুনেই বুঝছি সাগ্রত পা বারিয়ে দিচ্ছে! ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে! ও কি আমার সাথে আবার কিছু করবে??? না!!! কাথার নিচে জবুথবু শুয়ে চুপসে আছি!!আমার কানে একদর কথা ছুড়ে আসলো-
–আমি আর ফিরে আসবো না স্নেহময়ী! আন্সার আমি পেয়ে গেছি! ছোট করে শেষবার বলি ‘ভালোবাসি’।
কি আশ্চর্য! কথা কেন এভাবে বললো?? আমি কি ওর চাকর!! দাসী ভেবেছে!! টাকা দিয়ে কিনা দাসীর মতো পেয়েছে!! যত্তসব! আমি ওকে ভালোবাসি না! না! না! না! না! ভালোবাসি না! শেষ ! উফ! চলে যাক! পারলে জাহাজডুবিতে মরে যাক! তাও যাক!
পাচঁ মিনিটের মতো হলো! রুমে এক্সট্রা একটা সাড়াশব্দ পেলাম না! সাগ্রত কি সত্যি সত্যি চলে গেলো?? কাথা সরিয়ে দেখলাম! সিক্সথ্ সেন্স বলছে রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই! রুম খালি! কেবিন পুরো অন্ধকার! আমি লাইট জ্বালানোর জন্য পায়ের উপর থেকে বামহাতে কাথা সরিয়ে ফ্লোরে পা রাখলাম। সুইচ সোফার ওইদিকটায় দেখেছিলাম। অন্ধকারে সেদিকে পা বারিয়ে এগিয়ে চললাম। লাইট জ্বালাতেই দেখি কেউ নেই! রুমে কেউ নেই! সাগ্রত চলে গিয়েছে! হৃদ স্পন্দন আবারো সংখ্যা বাড়িয়ে হাতুড়ি পেটালো! ধুপধাপ করে হাতুড়ি চলছে বুকে! অসম্ভব ব্যথা অনুভূত হচ্ছিলো! খারাপ লাগছিলো! দুমড়ে চুড়ে মন ভেঙ্গে আসছিলো! হাহাকার করছিলো! আমি কেবিনের দরজা খুলে বাইরেও কিছুক্ষণ খোজাখুজি করলাম! নার্সকে ডেকে খুজতে পাঠালাম! ওয়ার্ড বয়কে বলে ওয়াচ ম্যানকে জিজ্ঞেস করতে বললাম। সবাই আশাভঙ্গ সূচক উত্তর দিলো।
লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে ফিরে গেলাম কেবিনে। বেডে পা তুলে কাথা টেনে শুয়ে পড়লাম। যে চলে যাওয়ার তাকে চলে যাওয়াই উচিত। কিছু মানুষ আসে চলে যাওয়ার জন্য! যাওয়ার আগে রেখে যায় কিছু স্মরণীয় মূহুর্ত! সাগ্রত এসেছিলো….কিছু আবদার নিয়ে এসেছিলো! পূর্ণ করতে যেহেতু করতে পারবো না! তার চলে যাওয়াই উচিত!! চলে যাও তুমি তাশরীফ সাগ্রত…চাই না কোনো প্রেম নামের স্বাগত….
-চলবে🍁
-Fabiyah_Momo♥