ভুলবশত♥
PART_10,11
FABIYAH_MOMO🍁
কফির মগ ভেঙ্গে বেহালভাবে পড়ে আছে ফ্লোরে। আমি চোখ নিচু করে কফির ভাঙা মগে তাকিয়ে আছি। যার বাড়িতে এক কাপ চায়ের আদিখ্যেতায় এসেছি সে আমাকে নতুন ভঙ্গিতে চমকে দিয়েছে। সাগ্রত আপনমনে ওয়ারড্রবের সাথে ঠেস দিয়ে কফি খাচ্ছে। আমি ওর দিকে না তাকালেও বলতে পারি সাগ্রত আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। আমার শরীরের লোমস্তর উত্তপ্ত মস্তিষ্কের তালে বারবার জেগে উঠছে। আমার হাত কাপাকাপি করলেও ওড়নায় মুঠো চেপে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছি। সাগ্রত বলে উঠলো-
–আমি জানি তুমি এটাই ভাবছো আমি তোমার ব্যাপারে সব খবর নিলাম কি করে। দেখো আমি কে বা কেন এসব করছি তা জেনে তোমার কোনো লাভ হবেনা। কাজেই জানাতেও চাচ্ছি না। তুমি আমাকে সন্দেহ করবে এটাই স্বাভাবিক। বাট আমি তোমায় বলতে চাই এটুকুই তোমার অতীত কে ছিলো কেন হয়েছিলো ওগুলো দ্বারা আমার কোনো যায় আসে না। জাস্ট লিসেন, আমি তোমাকে চাই। কোনো এক স্পেশাল কাজে আমি এখানে এসেছি। দ্যাটস ইট!
আমি ধাক্কা খেয়ে আর কিছু বলার সিচুয়েশনে নেই। ওড়নায় হাত মুচড়ে মাথা হেট করে রুম থেকে চলে যাচ্ছি। রহস্য রহস্য করতে যেয়ে আমি ভুলভুলাইয়ায় ফেসে গেছি। ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে সাগ্রতের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। সাগ্রত অস্থিরচিত্তের মতো হাতের মগটা ওয়ারড্রবের উপর রেখে আমার হাতের কবজি টেনে ধরলো। বিরস কন্ঠে বলে উঠলো-
–তুমি চলে যাচ্ছো কেন? সরি! আমি ওভাবে বলতে চাই নি।। দেখো বিশ্বাস করো! আমি জুয়েলের মতো না!! প্লিজ স্নেহময়ী!
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাতের কবজি ছোটানোর জন্য জোড়াজুড়ি করছি। সাগ্রত আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে। আকুতি স্বরে বলে উঠে-
–প্লিজ প্লিজ যাওয়ার দরকার নেই! শোনো দেখো আমি জুয়েলের ব্যাপারে কথাগুলো বলতে চাইনি। প্লিজ স্নেহময়ী! আমায় বিশ্বাস করো! স্নেহময়ী আমি জানি কারোর ব্যক্তিগত তথ্য জানা অপরাধ! প্লিজ আমি ইচ্ছা করে জানার চেষ্টা করিনি! আমার ইনফরমেশন জানতে হয়েছে! বিলিভ মি!
আমি হাত ছাড়ানো থামিয়ে দিলাম। সাগ্রত বলল, ওর ইনফরমেশন জানতে হয়েছে। কেন জানতে হয়েছে? প্রশ্নের উত্তর জানা অতীব প্রয়োজন! আমি মাথা ওর দিকে উঠিয়ে চোখে চোখ রেখে বলিষ্ঠ গলায় বলে উঠলাম-
–কি জন্য জানতে হয়েছে! কেন জানতে হয়েছে! একটা এতিম মেয়ের ব্যাপারে জেনে কত টাকা বেতন পেলেন!! কেন! কেন! জানতে চাচ্ছেন! কি লাভ হলো জেনে? খুশী হলেন স্নেহা মেয়েটা ভার্জিন বলে? এটাই জানার জন্য ইনফরমেশন কালেক্ট করেছেন! কি হলো জবান বন্ধ কেন? বলুন! বলুন না কেন! জুয়েল যা করতে পারলো না, আপনি তা করবেন? বলুন! বলুন মিস্টার তাশরীফ সাগ্রত! বলুন!
ঠাস করে এক চড় গালে পড়লো আমার! গাল ধরে অন্যদিকে হেলে গেছি। মনে হলো বামপাশের দাত গুড়িয়ে ডানপাশে চলে এসেছে। প্রচণ্ডরূপে ব্যাথা পেয়েছি। সাগ্রতের দিকে কান্না চেপে তাকালাম। আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো অন্যগালে আরেক ঘা পড়লো! উল্টে পেছনে থাকা টি টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সাগ্রতের রাগ আকাশচুম্বির পদার্থের মতো টগবগ করছে। আমি উল্টে পড়ে ঘাড়ে ব্যথা পেলাম। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলে সাগ্রত ছটফট করতে লাগলো।। আমি ঘাড়ে হাত দিয়ে চোখ কুচকে আছি, ফ্লোরে কোনো রকমে বসে আছি। কানে শব্দ এলো। কেউ অস্থির হয়ে বলছে-
–স্নেহময়ী ব্যাথা পেয়েছো সরি! স্নেহময়ী তাকাও আমার দিকে! স্নেহময়ী লুক প্লিজ! স্নেহময়ী আমি ইচ্ছে করে থাপ্পড় দেইনি! তাকাও ! তাকাও আমার দিকে!
আমার গালে হাত রেখে কথাগুলো বলছে সাগ্রত। ও ফ্লোরে হাটুগুজে আমার দিকে ঝুকে আছে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি ঘাড়ে হাত দিয়ে ঠোঁটে কামড়ে চোখ ভীষন কুচকে আছি। শরীরের ২০৬টা হাড্ডি ভাঙার মতো কষ্ট যন্ত্রণা হচ্ছে! মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। ঝাপসা দেখছি। ঘাড়ে অসার ব্যথা অনুভব করছি।। একটু পর কি হলো বুঝলাম না আমি আর কিছুর উপর কাবু করতে পারলাম না। শরীরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে আমি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। অবচেতনের আগ মূহুর্তে কানে একবার আসলো, সাগ্রত চেচিয়ে “স্নেহময়ী!!” বলে উঠলো। আর কিছু মনে নেই, চেতনাশূন্য দেহ নিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি….
–স্নেহময়ী!! স্নেহময়ী! প্লিজ! তুমি সেন্সলেস হলে? স্নেহময়ী!!! আমার ভুল হয়ে গেছে!! আমি ইচ্ছে করে চড় দেইনি স্নেহময়ী!!
আমার চোখের সামনে আমার স্নেহময়ী সেন্সলেস হয়ে গেল। আমার বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠলো! কেউ আমার কলিজাটায় ছিদ্র করে ফালিফালি করে দিয়েছে! কি কষ্ট হচ্ছে আমার! আমার সহ্য হচ্ছে না! আমার হাতদুটোয় আমি মানুষ শেষ করি, কিন্তু স্নেহময়ী? ওকে কেন মারলাম? ওর তো দোষ নেই!! সত্য কথাই তো বলছিলো! কেন ওর ব্যাপারে জানতে গিয়েছি!! ওকে তো এনাউন্স করে বলিও নি ‘ভালোবাসি স্নেহময়ী! আমার আদরশূন্য জীবনে আমি আকাশপূর্ন ভালোবাসি!আমি একটা বড্ড উন্মাদের মতো ভালোবাসি!’
একি কি করলাম???তাড়াহুড়ো করে স্নেহময়ীকে কোলে তুলে নিলাম। ওর ঘাড়ের পিছনে হাত দিতেই তরল কিছু আমার হাত লাগছিলো। আমি ঘাড়ের ওখান থেকে আমার হাত প্রসারিত করে দেখলাম! লাল রক্ত! স্নেহময়ীর ঘাড় থেকে রক্ত পড়ছে! মাথা আরো কয়েক ধাপ এলোমেলো হয়ে গেল। কোলে তুলে রুমের এদিক-ওদিক পাগলের মতো রাস্তা খুজতেছি!! কোনো উপায়ন্তর পাচ্ছিনা! আমি স্নেহময়ীকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলাম। আমার বালিশ ওর মাথার নিচে দিতেই বলপ্রিন্টের সাদা বালিশের কভারটা রক্তে মেখে যাচ্ছে। স্বাধীনকে কল করলাম! কানে ফোন নিয়ে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এড বক্স বের করছি। রিং হচ্ছে ফোন ধরছে না! মেজাজটা হাইপার লাগে কিনা! স্বাধীনকে কাজের সময় কল দিলে পাওয়া যায় না!! আজ স্বাধীনের একদিন কি দুইদিন!! চাকরি নট করে দিবো বেয়াদবের! একহাতে ফাস্ট এড বক্স খুলতে পারছিনা। ফোন কানে বাম কাধের সাথে ঠেসে নিলাম। দুহাতে বক্স খুলে তুলে ছিড়ে স্নেহময়ীর চুল সরিয়ে ঘাড়ে বুলিয়ে দিচ্ছি। সাদা তুলো লাল রক্তে ভিজে যাচ্ছে। একটা মুছে আরেকটা লাগাই একহাত দিয়ে ঘাড় উচু করে তুলেতে মেডিসিন নিয়ে জায়গা পরিস্কার করি। স্বাধীন এখনো ফোন ধরছেনা! রাগে আমার মাথা গরম হচ্ছে! স্বাধীনকে সামনে পেলে কুপিয়ে ছাড়তাম! স্নেহময়ীর ঘাড়ের ইনজুরি চেক করার জন্য কাত করে নিলাম। পিঠের পেছনের চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের আঘাত এনালাইসিস করলাম! টি টেবিলের কোণার সাথে লেগে কেটে গিয়েছে। রক্ত পড়ছে সেখান থেকেই। কাধ সোজা করে হাতে ফোন নিয়ে আবার স্বাধীনকে ডায়াল করলাম! বক্স থেকে তুলার বড় খন্ড ছিড়ে স্নেহময়ীর ঘাড়ে চেপে স্বাধীনের কল রিসিভে আকুল হয়ে আছি! ওপাশ থেকে স্বাধীন কল ধরলো, শান্ত গলায় বলে উঠলো-
–সরি স্যার…বাজার করতে গিয়েছিলাম। ঘরে বাজার শেষ…
স্বাধীন কথাটুকু শেষ না করতেই আগুনের ঝলকার মতো সাগ্রত বলে উঠলো-
–সরি মাই হ্যাল ইডিয়েট! কোথায় ছিলে ! কল করছি কতক্ষণ ধরে ইডিয়েট! আজকের পর থেকে আমায় স্যার স্যার করবে না! ইউ আর রাস্টিগেটেড স্বাধীন! শুনেছো?রাস্টিগেটেড! কাল অফিসে এসে লেটার নিয়ে যাবে! গো টু হ্যাল!
-চলবে🍁
-Fabiyah_Momo🍁
#ভুলবশত♥
#PART_11
#FABIYAH_MOMO🍁
আমি যখন চোখ খুলার সময় পেলাম তখন কারো চিৎকার ফটফটানির আওয়াজ পাচ্ছিলাম, অস্পষ্ট ঝাপসা চোখে বুঝতে পারি সে আমাকে পাজকোলে নিয়ে বসে আছে, আমার ঘাড়ের পেছনে তার হাত, অপর হাতটি দ্রুতগতিতে গোলজাতীয় কিছুকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বারবার অস্থির সুরে বলে উঠছে,
–প্লিজ চোখ খুলা রাখো! প্লিজ স্নেহময়ী! চোখ বন্ধ করো না! চোখ খুলা রাখো স্নেহময়ী! এইযে…এইতো আমরা পৌছে গেছি!!আর পাচঁমিনিট!! পাচঁমিনিট!!
হনহন গতিতে বাতাসের মতো ছুটছে যন্ত্রটি। প্লেনের মতো স্পিডে এগুচ্ছে গাড়িটি। হ্যাঁ আমি গাড়িতে আছি। চার চাকার কোনো এক গাড়িতে। সাগ্রত আমার গালে হাত রেখে বুকে চেপে বসে আছে। মাথা উঠাতে পারছিনা। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। কেমন নড়াচড়া বিহীন শরীর নিয়ে আছি!! এক ফোটা শক্তি নামক বলয় আমি পাচ্ছিনা! মাথা অনেকবার উঠাতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থতার সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ডরূপে ব্যথা করছিলো। সাথে মনে হচ্ছিলো আমার নিজের শরীরে নিজের কোনো ক্ষমতা নেই। সাগ্রত ড্রাইভ করতে গেলে পাজকোলে নেয়া হাতের বাধন ঢিলে হয়ে আসে। আমার যখনই মনে হয় আমি ঢলে পড়ে যাবো সাগ্রত তখনই আমাকে পুনরায় চেপে ধরে শক্ত করে বুকে নেয়। সাগ্রত কাউকে যেনো বলে উঠলো-
–আপনারা আর পাচটা মিনিট অপেক্ষা করুন! পাচমিনিট! আমি এক্ষুনি এই মূহুর্তেই আসছি! প্লিজ! পর্যাপ্ত পরিমাণে সার্ভিস সিস্টেম রেডি রাখুন! হ্যাঁ, আমার! বাট রিলেটিভ না! প্লিজ এসব ডিটেলস বাদ! প্লিজ রাইট ডাউন স্নেহা মাহমুদ! Tasrif Shagroto’s……
………………………………………………….
চোখের ঝাপসা ভাব আরো বাড়তে লাগল। কত যে চেষ্টা করছি চোখের মনি দিয়ে পরিস্কার করে সব দেখার…কত যে আপ্রাণ চেষ্টা করছি সাগ্রতের ফোনের আলাপে কথা শোনার…কিন্তু সবই বৃথা বৃথা বৃথা হচ্ছিলো! বৃথা হচ্ছিলো! মাথার গুমোট আরো গুলিয়ে এলো! আমার চোখের পাতা ধীরে ধীরে নামতে লাগলো! আরেকদফা চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়তে লাগলাম আমি। শুনতে পেলাম না সাগ্রতের কথার শেষটুকু…।আমার চোখের উপর পাতলা চামড়ার আচ্ছাদন পড়লো। চোখ বন্ধ হতেই খাচায় বন্দী ছটফট পাখির মতো গলার স্বর ছুটিয়ে বলে উঠলো-
–প্লিজ প্লিজ চোখ বন্ধ করো না! আমার দোহাই!! প্লিজ স্নেহময়ী এই অধমটার উপর রহম করো! চোখ বন্ধ করো না! তাকাও!! তাকাও না স্নেহময়ী!! প্লিজ স্নেহময়ী! চোখ খোলো! প্লিজ প্লিজ কথা শোনো!!!
সাগ্রতের কথা স্নেহার কানে পৌছিয়েছে বলে মনে হলো না। সে ঘাড়ের চরম আঘাতে বেহুঁশ হয়ে সাগ্রতের বুকেই মাথা রেখে অবচেতন ঘুমে তলিয়ে পড়লো। স্নেহার ঘাড়ের চোটে সাগ্রতের ধূসর রঙের টিশার্ট মেখে গেছে। বাম পাশটা টিশার্ট ঠিক রক্তে মাখামাখি।। সাগ্রত যে হাতে স্নেহাকে আগলে রেখেছে সে হাত রক্তে ভরে যাচ্ছে। স্নেহার গোলাপি কামিজ রক্তে লালচে হয়ে গেছে। সাগ্রত গাড়ি চালিয়ে দ্রুত হসপিটালে আনলো স্নেহাকে। গাড়ি হসপিটালের সামনে থামতেই সাদা পোশাকের চার-পাচটা নার্স এগিয়ে আসলো! গাড়ির দরজা খুলে সাগ্রতকে বের হতে হেল্প করলো। সাগ্রত স্নেহাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই স্ট্রেচার নিয়ে একদল ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এলো। সাগ্রত স্নেহাকে স্ট্রেচারে শোয়াতেই ওয়ার্ড বয় দৌড় লাগালো হসপিটালে জরুরী ভিত্তিতে ইর্মান্জেন্সি স্পেশাল কক্ষে নেওয়ার জন্যে। সাগ্রত স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে স্ট্রেচার ধরে হুড়মুড় করে যেতে লাগলো। স্নেহার রক্তে স্ট্রেচারে বিছানো সাদা চাদর রক্তিম হয়ে উঠলো! সাগ্রত বিনা শব্দে চোখের পানি ছেড়ে দিলো! বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার! কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য সে দেখছে! কিভয়ানক! অদ্ভুত লোম দাড়ানো দৃশ্য! কখনো স্নেহময়ীকে নিয়ে এমন অবস্থায় দেখবে? রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে এতোটা ক্ষত নিজের হবে? ইর্মান্জেন্সি কক্ষের ভেতরে স্ট্রেচার নিয়ে গেল ওয়ার্ড বয়! পেছন পেছন আসলো নার্সগুলো! ডাক্তার ভেতরে আগেই পেশেন্টের অপেক্ষায় ছিলো, পেশেন্ট স্ট্রেচারে করে ভেতরে যেতেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো! সাগ্রত হতাশ মুখে রুমের পাশে সারি সারি চেয়ারের কোনো একটায় ধপ করে বসে পড়লো। মুখ দু’হাত দিয়ে ঢেকে, হাটুর কাছে মাথা নুয়ে বসলো। ভেতরে স্নেহার ট্রিটমেন্ট চলছে। রাগের বশে চড় দেওয়ার ভুলটা এতোবড় কঠিন আকার ধারন করবে সাগ্রত তা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। সাগ্রত নিজেকে হাজারটা গালি দিলো! নিজেকে পচা নর্দমার নোংরা জন্তুর মতো দাবী করলো! একটা বিবেকবান মানুষ কখনো রাগ দেখিয়ে কাজ হাসিল করতে পারে?? কেন করলাম? কেন??ওর বলা সামান্য কথা হজম করতে পারি না!! লাইফ পার্টনার বানাতে চাই? আমি একটা অধম! পশুর চেয়েও অধম! নির্ঘাত আমি ওর যোগ্য না! কোনো দিক দিয়েই যোগ্য না! স্নেহময়ী আমাকে রাগ দেখিয়ে কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক! তাই বলে আমিও ওর সাথে রাগ দেখাবো?? কি করলাম আমি!! কি অপকর্ম করে ফেললাম!!
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে শব্দ জড়ানো এসির ঠান্ডা রুমে আবিষ্কার করি। শব্দটা আসছিলো পালস রেট মেশিন থেকে। আমার বামহাতে স্যালাইন বসানো ছিলো, ডান হাতে ক্লিপ বসানো তার। লম্বা তারটা পালস রেট মেশিনের জোড়া বেধে আছে। আমি শরীরে খুবই দূর্বলতা অনুভব করছি। কোনোপ্রকার শক্তি নেই। সোফায় কেউ নিউজপেপার মেলে পড়ছে। মুখ খুলে আওয়াজ করে ডাকতে পারছিলাম না, কে বসে আছে? চিনি না!! একজন ভদ্রমহিলা, পাতলা এপ্রন পড়নে মাথায় নার্স ক্যাপ। আমাকে নড়চড় করতে দেখে ভদ্রমহিলা পেপার টেবিলে রেখে কাছে চলে আসলো। আমার বেডে বসে মাথায় হাতের উল্টো পিঠ রেখে বলে উঠলো-
–কেমন আছো? এখন কেমন লাগছে?
উপস্থিত প্রশ্নের উত্তরে আমি জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুললাম না। মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম ‘আমি বেটার ফিল করছি’। ভদ্রমহিলা স্মিত করে মিষ্টি হাসি দিলো। হাসিটা উনার সুন্দর, ভদ্রমহিলা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। উনি বলে উঠলো-
–বাইরে যে ছেলেটা বসে আছে হাসবেন্ড হয়?
আমি না-সূচকে মাথাটা হালকা করে নাড়লাম। ভদ্রমহিলা আমার জবাবে বেশ অবাক হলো, কিছুটা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো-
–ছেলেটা খুব টেনশনে ছিলো, মনে হচ্ছিলো হাসবেন্ড। যাইহোক আমি ড্রেসিং করে দিয়েছি। এখন আর পেইন করবেনা। রেস্টে থাকো।
ভদ্রমহিলা বাইরে চলে গেল। আমি আস্তে আস্তে শরীরের সর্বস্ব জুড়ে একটুআকটু শক্তি পাচ্ছি। হাতটা নাড়াতে পারছি। বাম হাত উঠিয়ে দেখি স্যালাইনের স্বচ্ছ নলের শেষ প্রান্ত আমার হাতের নীল রগের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্যালাইনের ব্যাগে চোখ পড়লো, দেখি স্যালাইনের ব্যাগে তরল পর্দাথ অর্ধভর্তি হয়ে আছে। তার মানে বাকি অর্ধেক স্যালাইনের অংশ সূচালো পথে আমার শরীরে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পর একটা নার্স এসে সব চেক করতে লাগলো, আমি সাগ্রতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবো-করবো করে করতে পারছিনা। জড়তা কাজ করছে। বাইরে বসে থাকা ছেলেটা তাশরীফ সাগ্রত ছাড়া কেউ হবেনা বুঝে আমার শেষ। সাগ্রত আমাকে ব্যাথা দিয়েছে! হাসপাতালের রোগী বানাতে একমাত্র সাগ্রত দায়ী! নার্স আমার স্যালাইনের ব্যাগে স্পিড লেভেল নিয়ে চেক করছে। কিভাবে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর পাবো, কি রকম প্রশ্ন করলে জানতে পারবো, কেমন করে কথা উঠালে সাগ্রতের ব্যাপারে জানবো….আমি তখন মাথার মধ্যে প্রশ্নের প্যাঁচ ঘুরাচ্ছি। নার্স প্রায় কাজ শেষ করে চলে যেতে নেবে আমি কাচুমাচু করে বলে উঠি-
–আচ্ছা শুনুন!! আমাকে এখানে নিয়ে আসা ছেলেটা কোথায়? ও কি বাইরে? বাইরে থাকলে একটু ভেতরে আসতে বলবেন??
নার্স মাথা ঘুরিয়ে হাটা থামিয়ে বলে উঠলো-
–আপনি কি তাশরীফ সাগ্রতের কথা বলছেন? সে তো দশ মিনিট আগেই চলে গেছে। আপনার সেন্স ফিরেছে নিউজ শুনেই মিস্টার সাগ্রত চলে গিয়েছে।
নার্সের কথার জবাবে আমি আরেকটু হলে অকেজো শরীরে ক’দফা ধাক্কার সম্মুখীন হতাম! বেশি হলে সেই ধাক্কায় জ্ঞান হারাতাম। কিন্তু অসুস্থ দূর্বল শরীরে আমি কোনোটাই করতে পারলাম না। স্থির দৃষ্টিতে নার্সের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নার্স চলে গেল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম… সাগ্রত আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করালো! ট্রিটমেন্টের সিচুয়েশন করে দিলো! আবার আমাকেই রাগ দেখিয়ে চড় দিলো! আমাকে নিয়ে কোন্ হট্টখেলায় সাগ্রত মত্ত? আমার চোখে চোখ মেলাতে সে কি হিমশিম খাচ্ছে? চড় দিয়ে চোটের অপরাধে আমাকে দূরদূর করার চেষ্টা করছে নাতো?? নাহ্! যদি দূর দূর করার মতলব থেকে থাকে আমি সেই মতলব নস্যাৎ করবোই ! আমাকে নিয়ে সাগ্রত আসলে পেয়েছে কি! খেলার পুতুল?? চাবি ঘুরালে ওর কথা শুনতে হবে.. মানতে হবে.. আবার কাজও করতে হবে!! নো নেভার! আমি যখন হালকা চেতন অবস্থায় ছিলাম ওর পাগলামির বিহেবিয়ার দেখেছিলাম! ও আমাকে নিশ্চিতরূপে পছন্দ করে! মন থেকেই পছন্দ করে! পছন্দ করলে আমাকে দূরে ঠেলতেও পারবেনা! দূরে সে নিজেও যেতে পারবেনা! নো মিনস বিগ নো! সাগ্রতের টানিং পয়েন্ট টানা অতীব জরুরী! সাগ্রতের মনে আসলে চলছে কি জানা খুব বেশি জরুরী!
রাত সাড়ে নয়টা। ছিমছাম ঘন জঙ্গলের কোনো এক অন্ধকারময় জায়গায় গাড়ি থামিয়েছে সাগ্রত। ঝিঝিপোকার ডাকে পরিবেশ মুখরিত। অন্ধকার পরিবেশটা সাগ্রতের খুব পরিচিত। যেন চিরচেনা পুরোনো দিনের জায়গায় এসেছে সাগ্রত। গাড়ির সামনের দিকে ফ্রন্ট লাইটের কাছে পিঠ লাগিয়ে মাটিতে বসে আছে সাগ্রত। হাতে জলন্ত বেনসন। ঠোঁটে বসিয়ে নির্লিপ্ত মনে টেনে নিচ্ছে সাগ্রত, নাকে মুখে ধোয়া ছেড়ে জোৎস্নার আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে আনমনে। শত দুঃখ, শত বেদনা সে সিগারেটের নিকোটিনে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে। চেষ্টা করতে বেদনা মুছতে। পারছে না…পারছেনা…পারছেনা…। চোখ বন্ধ করলে স্নেহার কথা মনে পড়ে! সিগারেট সাময়িক যন্ত্রণাটা মিইয়ে দিতে পারছেনা।
সাগ্রত চোখ বন্ধ করলো! সিগারেটে টান দিতেই স্নেহার রক্তাক্ত পাজকোলে নেওয়ার দৃশ্য চোখে ভাসলো। সাগ্রত হড়কে উঠলো! সিগারেটে টান দেওয়া ভুলে সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেললো। তাড়াহুড়ো করে হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালো সাগ্রত! গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে বসলো। জোরে শ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মনস্থির করলো হসপিটালে যাওয়ার! স্নেহাকে একা ফেলে চলে আসার ভুলটা বড্ড হিচড়ে দিচ্ছে মনে! সাগ্রত অকপট মনে গাড়ি ফুল স্পিডে চালিয়ে দিচ্ছে!!
গাড়ি চালিয়ে হসপিটালে আসতেই ঘড়িতে বাজলো একটা। গাড়ি থেকে নেমে কানের ব্লুটুথ খুলে পকেটে রাখলো সাগ্রত। সেন্স ফিরলেও এতোক্ষনে ঘুমিয়ে যাবে স্নেহা। এমন নীতি ভেবে ভেতরে ঢুকলো সাগ্রত। লিফটের দরজা খুলতেই একশোবার করে ভাবছে স্নেহার ঘুমন্ত ফেস কিভাবে ট্যাকেল করবে!! স্নেহাকে দেখলে হার্ট ফেল করতে ইচ্ছে করে!! সাগ্রত বুকের বাম পাশে হাতের তালু দিয়ে ঘষে নিলো!! রক্ত শুকিয়ে চটচটে আকার ধারন করেছে টিশার্টের বামদিকটা!! স্নেহাকে পনের মিনিটের জন্য বুকের বক্ষস্থলের ধকধক বাম দিকটায় রাখতে পেরেছিলো সাগ্রত। কঠোর সেই শ্বাসরুদ্ধকর মূহুর্তটা মনে মনে ভেবে শিউরে উঠলো গা তার!! রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। খুবই কম শব্দ করে দরজা খুলতে সক্ষম হলো। সাগ্রত দেখলো তার স্নেহময়ী বেডের দুপাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। গলায় মোটা করে সাদা ব্যান্ডেজ পাকানো। হাতের স্যালাইন খুলে ফেলায় নল ঢুকানো জায়গাটা লাল বর্ন হয়ে আছে। ইচ্ছে করলো হাতটা নিয়ে ঠোট ছুয়িয়ে দেওয়ার!! সাগ্রত পা ফেলে আস্তেধীরে কাছে গেলো স্নেহার!! স্নেহার বেডের পাশে স্টিলের চকচকে টুল পেতে বসে পড়লো। স্নেহার মুখের দিকে ঝুকে বসলো। স্নেহার ছোটখাট বেবি চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো!! স্নেহার কপালে ঠোট বসিয়ে দিতেই কেউ অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো-
–আমি আপনার ওয়াইফ না মিস্টার তাশরীফ সাগ্রত! এভাবে কেয়ার করলে চলবে না মোটেও!! ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু দিয়ে ক্রাইম করেছেন! ক্রাইম পেট্রোলের কাছে জবানবন্দি দিবেন! বুঝে নিয়েন!!
-চলবে🍁
-Fabiyah_Momo🍁