ভুলবশত♥
PART_03
FABIYAH_MOMO🍁
–মাথার রাইট সাইড কানের ওখানে চারটা স্টিচের দাগ আছে মিস স্নেহা মাহমুদ। ডিপলি কাটার দাগ। ক্যান ইউ এক্সপ্লেন?
–হোয়াট!
–জ্বী। ছেলেটার বডিতে এমন কিছুই স্টিচের দাগ পাওয়া গেছে।
–একটা কথা বলুন তো। আপনি পেটের সাইডে অপারেশন করবেন। এপেনডিক্সের অপারেশন। সে জায়গা আপনি ছেলেটার ফুল বডি চেক করেছেন? ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না ডক্টর?
একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে আমি চুপচাপ বসে আছি। আঙ্কেল চশমাটা টেবিল থেকে নিয়ে চোখে পড়লেন। একটু কেশে গলা পরিস্কার করে বললেন-
–আমি ইচ্ছে করে চেক করিনি মিস স্নেহা। পেশেন্টের ফিজিক্যালি চেকআপ করতে যেয়ে নার্স আমাকে ইনফর্ম করেছে। সেটা আমি চেক করে আপনাকে বলেছি। আই থিংক ছেলেটা ডিফেন্সের লোক। ডিফেন্স ইয়াংম্যানরা এমন স্টিচের দাগ শরীরে নিয়ে বেড়ায়।
মাথায় বহু রকমের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সাগ্রত নামের ছেলেটা মাত্র পচিঁশ বৎসরের হবে। ও এই কমতি বয়সেই সেলাইয়ের দাগ নিয়ে চলবে!! উহু…বিষয়টা অন্যকিছু। অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি আঙ্কেলকে কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললাম-
–আমি তাহলে উঠি আঙ্কেল। পরে দরকার পড়লে আমি আবার আসবো। থ্যাকিউ।।
–মাচ্ প্লেজার।
কেবিন থেকে বেরিয়ে ছেলেটার কেবিনের কাছে গেলাম। ফুপি ছোট কাপে করে চা খাচ্ছেন। স্বাধীন ছেলেটা সিগারেট খাচ্ছে। একটু আগে ঝগড়ার কি হলো তা বুঝে উঠতে পারছিনা। আমি ফুপির কাছে গিয়ে বললাম-
–ফুপি সাগ্রতের কি জ্ঞান ফিরেছে? দেখা করা যাবে?
ফুপি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো আমার কথা শুনে স্বাধীন ধেই ধেই করে এলো। পা নামিয়ে সোজা হয়ে চোখ শক্ত করে বলল-
–এই মেয়ে তুমি ওকে নাম ধরে ডাকছো কেন? তোমার বয়সে বড় । কমসে কম পাচঁ বছরের বড় হবে। ভাই বলে ডাকো।
ফুপি স্বাধীনের কথায় আবার ঝগড়া বাধাতে চেয়েছিলো। আমি ফুপিকে চুপ করতে বলে স্বাধীনকে কড়া করে বললাম-
–অন্যের উঠানে আপনার খেই তুলতে হবেনা মিস্টার। আপনি আপনার মতো থাকুন। আমি যা ইচ্ছা তা ডাকবো। আগ বাড়িয়ে কথা বলবেন না।
স্বাধীনকে পাল্টা জবাবের সুযোগ না দিয়ে আমি সাগ্রতের রুমে দরজা ঠেলে দ্রুত ঢুকলাম। কেমন নিরব। টুট..টুট অনবরত শব্দ হচ্ছে। পালস রেট নরমাল। হাতে একটা স্যালাইনের নল ঢুকানো। গায়ে হালকা আকাশী নীল পোশাক। ছেলেটার কাছে যেয়ে মুখের উপর কয়েকবার হাত নাড়িয়ে দেখলাম জেগেছে কিনা। নাহ্ জেগে নেই। তারমানে বেহুঁশ। একটা চেয়ার টেনে পাশে বসলাম। খুটিয়ে খুটিয়ে তাকে দেখতে লাগলাম। আঙ্কেলের মতে, তাশরীফ সাগ্রত ডিফেন্সের লোক। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে গুন্ডা-মাস্তানের পার্টি। সারাদিন কোপাকোপি, মারামারি, খুনাখুনি। তাইতো সাগ্রতের সেলাইয়ের দাগ অনেক। বলতে হবে ছেলেটা সুন্দর। কপালের বামকোনে একটা ছোট কাটার দাগ আছে। কিন্তু দাগটা তাকে সুদর্শন করতে সাহায্য করছে। সে সুন্দর। ভারী সুন্দর। হঠাৎ সে বেহুঁশের মধ্যে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ঠোট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা আস্তে বলছে। বেহুঁশের মধ্যেই ভ্রু কুচকে অস্পষ্ট কথা বলছে। আমি শোনার জন্য তার কাছে কিছুটা গেলাম। চোখ ছোট করে বোঝার চেষ্টা করছি। সে বলছে-
–ও আমাকে..কেয়ার…করেনা…কেয়ার করেনা…আমাকে.. কেয়ার করেনা…কেকেয়োয়ার কররেনা..
“কেয়ার করেনা”–অনবরত একটি কথা বারবার বলছে। ভ্রুকুচকে কথাটা বলছে। কে কেয়ার করেনা? ছেলেটার ফ্যামিলি কেয়ার করেনা? নাকি প্রেমিকা? চেহারা দেখলে যে কেউ বলবে, “এমন সুন্দর ছেলের গফ নেই? ইম্পসিবল!” এই ছেলের অন্ততপক্ষে চার-পাচঁটা রানিং গফ থাকা উচিত। আর ক্রাশ পার্টি শত-হাজার। ক্রাশ খাওয়া মেয়েদের নজরে পড়লে বলবে, ” কি হট!সস দিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে! উফ..ক্রাশ!”। ছেলেটা ডানে-বামে মাথা হেলিয়ে “কেয়ার করেনা” বলেই যাচ্ছে। উদ্ভট আচরন করছে বেহুঁশের ঘোরে। আমি ছেলেটার হাত ঝাকিয়ে উঠাতে চেষ্টা করছি। এবার উঠুক!দুতিনবার ঝাকাতেই সে ধীরে চোখ খুলে নিলো। ইনোসেন্ট বাচ্চার নবজাতক চোখের মতো টুকটুক করে তাকালো। তাও চোখ ছোট করে আছে। চোখে ঝাপসা দেখছে নাকি? ও বলে উঠলো-
–তুমি আছো? তুমি সত্যি এসেছো? প্লিজ যেও না!!আমি আর কক্ষনো তোমায় হারাবো না!
আবোলতাবোল কি বলছে! আমাকে ও অন্য কেউ ভাবছে? হয়তো। হয়তো ও আমাকে অন্য কেউ ভেবেই কথাগুলো বলছে। কারন, আমি ওকে চিনি না। ফাস্ট টাইম মুখোমুখি হয়ে দেখা করছি। তাও সে বেডে অসুস্থ হয়ে আর আমি চেয়ারে বসে। আমি শান্ত গলায় বলে উঠলাম-
–সরি, আপনি আমায় ভুল মানুষ ভাবছেন। আমি সে না যাকে আপনি চাচ্ছেন। আমি..
সাগ্রত যেন হুশে ফিরলো। স্যালাইনের নল ঢুকানো হাতটা নিয়ে মাথা ধরতেই চোখ কুচকে স্থির হয়ে গেল।
–আপনার কি খারাপ লাগছে? আমি কি ডক্টর ডাকবো?দাড়ান… নার্স! নার্স…এক্ষুনি আসুন! সাগ্রতের জ্ঞান ফিরেছে !
আমার চেচিয়ে ডাকাতে নার্স তো আসলোই সাথে হুড়মুড়িয়ে স্বাধীন ভেতরে ঢুকলো। নার্স আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো-
–আপনি উঠুন। পেশেন্টের সিচুয়েশন চেক করতে হবে প্লিজ।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। নার্স সাগ্রতকে নরমাল ভাবে কথাবার্তা জিজ্ঞেস করছে। শরীরের কোথাও পেইন হচ্ছে কিনা, পেটের সাইডে চেক করছে, পালস রেটের টুট টুট মেশিনের স্ক্রিনে দেখছে। স্বাধীন আমাকে তীব্র গলায় বলল-
–আপনি বাইরে যান মিস স্নেহা! আপনার এখানে কোনো কর্ম নেই। সো গেট আউট ফর্ম হেয়ার প্লিজ! আই ওয়ান্ট টু টক টু মাই ব্রো! লিভ আজ্ এলোন!
আমার মাথা খারাপ হয়ে আসলো। বারবার লোকটা আমাকে কাটিয়ে দিচ্ছে। সমস্যা কি তার! আমি তার কোন চুলায় আগুন দিয়েছি আমার সাথেই খ্যাক খ্যাক করতে চলে আসে! যত্তসব থার্ড ক্লাস পাব্লিক! রাগীমুখেই হনহন করে কেবিনের বাইরে চলে গেলাম।আসার পর থেকেই লোকটা আমাকে কথা শুনাচ্ছে!
স্নেহা বাইরে চলে গেল। সাগ্রত আড়চোখে ব্যাপারটা বুঝে স্বাধীনকে চোখ বন্ধ করে কি যেন ইশারা করলো।। স্বাধীন ইশারা পেয়ে মাথাটা হ্যা সূচকে ধীরগতিতে নাড়িয়ে বলে উঠলো-
–নার্স?একটু উনার সাথে কথা বলতে চাই। আমাদের একা ছেড়ে বাইরে অপেক্ষা করুন।
নার্স তর্ক না করে বাইরে চলে গেল। স্বাধীন নার্সের দরজা লাগিয়ে বাইরের যাওয়ার আগপর্যন্ত তাকিয়ে ছিলো। নার্স যেই গেল ওমনেই সাগ্রত স্বর নামিয়ে চেচিয়ে বলল-
–কতক্ষন ধরে ও কেবিনে! আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি ইডিয়ট, আন্সার মি! স্নেহা কতক্ষণ ধরে পাশে বসে ছিলো!
স্বাধীন অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছেনা। ভুলটা যে তার তা সে জানে। কিন্তু স্বাধীন মেয়েটার কথার উপর কথা বলে পেরে উঠতে পারেনি। ফলাফল তর্কবিদ্যায় ফেল! সাগ্রত ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো-
–আমি বেহঁশ থাকলে বকবক করতে থাকি জানো না! কথা বলো স্বাধীন! ও কতক্ষন ধরে কেবিনে বসে আছে!
স্বাধীন কাচুমাচু করে বলে উঠলো-
–অনেকক্ষন ধরে।
–থাটিয়ে দুটা থাপ্পর দেওয়া উচিত তোমাকে! তুমি আমার সাথে থেকেও এখনো কিচ্ছু করতে পারো না! শিট ! তোমার মতো আস্তা গাধাকে সাথে রাখাই আমার ভুল !
–সরি স্যার।
–শাট আপ ! কিসের সরি? ও যদি সব জেনে যায় আমি সাকসেস হবো? ইউ স্যা -সরি ! সরি মাই ফুট ইডিয়ট!
–স্যার ও কিছু জানতে পারে নি।
–আই কান্ট বিলিভ ইউ স্বাধীন! আই কান্ট ! আমাকে চেক করেছে কোন ডক্টর? তাকে এক্ষুনি ডাকো! নাও !
–আমি আনছি স্যার।
সাগ্রত প্রচুর ক্ষেপে আছে। যাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র রিস্ক নিতে চায় না, সে যদি বায় চান্স সব জেনে যায়? না না…কক্ষনো সম্ভব হতে দেবেনা! কক্ষনো না! সাগ্রতের টেনশন হচ্ছে। ডক্টর কি তার বডি দেখেছে? দেখলে কি কাউকে জানিয়েছে? পেটের সাইডে অপারেশন করতে যেয়ে পুরো বডি চেক করাটা এক ধরনের অসভ্যতা হবে! সাগ্রত ভাবতে পারছেনা তার এতটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীন ডক্টর নিয়ে আসলো। ডক্টর অনেকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছেন। হুট করে পেশেন্ট কেন ডাক পাঠালো? ডক্টর বদিউজ্জামান সাগ্রতকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো-
–আর ইউ ফিলিং ওকে মিষ্টার সাগ্রত? ফিলিং বেটার??
–আমার কথা ছাড়ুন ডক্টর! আপনার সাথে জরুরী কথা আছে। আই হোপ এভ্রি কোয়েশ্চ্যানের এ্যান্সার আপনি দিবেন!
ডক্টর বদিউজ্জান কিছুটা অবাক হয়ে বলে উঠলো-
–ওকে,
–আপনার ফাস্ট কোয়েশ্চ্যান! দ্যা গার্ল ইউ নো, নেম মেবি স্নেহা। তাকে কি বলেছেন? দেখুন “কেন, কারন” এসব বলার টাইম আমার নেই। সো পলাইটলি আন্সার দিলে গুড!
–মিস্টার সাগ্রত, আমি স্নেহা মাহমুদকে আপনার স্টিচের ব্যাপারে সব বলেছি। আপনার বডিতে যতগুলো স্টিচ পড়েছে সব বিষয়ে।
সাগ্রত স্যালাইনের নল ঢুকানো হাত দিয়ে বেডে মুষ্ঠিযোগে ঘুষি মারলো। ঘুষি মারা জায়গাটা বিছানায় গর্ত মতোন হলো। সাগ্রত মুখ খুলে তার জিজ্ঞাসা চালালো-
–নেক্সট কোয়াশ্চ্যান! স্টিচের কথাটা শুনে ও কেমন রিয়েক্ট করেছে? ভেবে বলবেন! ও কেমন লুক দিয়েছে, গুড অর ডাউট?
–ডাউট। বাট এন্ডে ও গুড লুক দিয়েছে।
–ওকে! ইউর লাস্ট কোয়েশ্চ্যান ! আর কি কি বলেছেন অল হিস্টোরি বলুন! স্পিক আপ!
–আপনার এ্যাজ, ফিগার এন্ড সাম ইনফরমেশন বলেছি।
–কি বলেছেন!
–বলেছি আপনার স্টিচের দাগ দেখে মনে হয় ডিফেন্সের লোক। আপনি ডিফেন্সে আছেন।
সাগ্রত চাপাকন্ঠে কেবিনের সিলিংয়ে তাকিয়ে শব্দ করে বলে উঠলো-
–ওহ্ গড!
সাগ্রত ডক্টরকে আর কিছু বললো না। কপালে ক্লিপ বসানো হাতটা উঠিয়ে দিয়ে আনমনে চোখ বন্ধ করে নিলো। স্বাধীন ডক্টরকে আলাদা ভাবে কোনায় নিয়ে গেলো। রুমের এককোনায় দাড়িয়ে পকেট থেকে কাগজের চেক বের করে বলে উঠলো-
–কত লাগবে? এমাউন্ট কত বসালে আপনি আর কোনো ইনফরমেশন লিক করবেন না বলুন।। যত চান তত পাবেন।
ডক্টর আকাশের চাদঁ পাওয়ার মতো খুশি হলো। খুশিতে গদগদ করে বলে উঠলো-
–ওয়ান ল্যাক।
স্বাধীন প্রাপ্ত কথা শুনেই চেকে সাইন করে দিলো। চেকবুক থেকে চেক ছিড়ে ডক্টরের হাতে দিলো। ডক্টর বদিউজ্জামান দাত বের করে হাসি দিয়ে চেকটা দেখছেন। মন ফুরফুরে, উতফুল্ল হয়ে আছে। তবুও খচখচ মনে জিজ্ঞেস করে বসলেন-
–ছেলে কি মাফিয়া না নেতা? অর্থ-সৌর্ন্দয্য-যশ-সামর্থ্য সবই দেখি আছে। হু ইজ হি?
স্বাধীন বিরক্ত হলো। মুখটা ডক্টরের দিকে ঘুরিয়ে ভাব নিয়ে বললো-
–নেতা-মাফিয়া কোনোটাই না। আপনার বেশি কিছু জানা লাগবেনা। টাকা পেয়েছেন… মুখ জিপ আপ!
পাচঁ
আকাশে পূর্নিমার চাদঁ। থালার মতো চাদঁ উঠেছে আজ। চাদেঁর মাধুর্যতা আমায় ঘ্রাস করছেনা। জানালার ধারে বসে থুতনি দুহাতের ওপর রেখে অপূর্ব চাদঁ দেখছি। রাতের আকাশে আমি কথাবার্তা বলি। মনটা উজাড় করে রাতের কাছে জ্ঞাপন করি। আপুকে রুমে এসে পাইনি।এটা নতুন কিছুনা। আগেও আপু অনেকবার বান্ধুবীদের সাথে নাইট স্পেশাল টুগেদার করেছেন। তাই কারোর এখন আপুকে নিয়ে চিন্তা নেই। নীল কি কাগজ বিছানায় ছিলো সম্ভবত আপু নোট ছেড়ে বান্ধুবীদের ওখানে গিয়েছেন। আমি ওটা টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি। পড়িনি। পরে পড়বো। ফুপাজি কাজের অজুহাতে কুমিল্লায় আছেন। ফুপি ওই ছেলেটার কাছে। খালি ফ্ল্যাটে আমি একা জানালা দিয়ে চন্দ্রকিরণ উপভোগ করছি। আচ্ছা বাবা তুমি ভালো আছো? পরপারে কেমন আছো? তুমি কি আমায় দেখছো? আমি কতো অসহায় বাবা। তোমার স্নেহাটা হাসিখুশি নেই। তোমায় প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে মিস করি বাবা। তুমি কেন ওপারে চলে গেলে? ফিরার রাস্তা আমার জন্য হবেনা বাবা? আমি যে একা। তুমি মায়ের কাছে রেখে গেছো মা-তো নেই বাবা। মা-ও তো তোমার চলে গেছে। তুমি ফুপির কাছে রেখে গেছো, ফুপি আমাকে কদর করে বাবা। শুধু টাকাকড়ি দেওয়ার বেলায় কদর করেনা। তোমার মেয়ের কাছে তোমার রেখে যাওয়া টাকাগুলোই আছে। আর কিছু নেই। অনার্সে প্রচুর খরচ। ওতোগুলো টাকা কিভাবে জোগান দিবো? তোমার রেখে যাওয়া টাকাগুলো ফুড়িয়ে আসছে। ফুপি-ফুপাজি ধার নিতে নিতে সব নিয়ে যাচ্ছে। আমার কি হবে? মানুষ টাকা চিনে। মানুষ না। যার টাকা বেশী সে ভালো মানুষ বেশি। যার টাকা নেই তার বেচে থাকার অধিকার নেই।
রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে খাবার খাবো তার ইচ্ছা হচ্ছেনা। নিজের করা রান্না খেতে প্রতিদিন প্রতিবেলায় ভালো লাগেনা। টাইম টু টাইম রান্না করে রেখে দেই। সবাই খায় আমাকে কেউ ডেকে বসায়না। নিজের ইচ্ছে হলে খাই। নাহলে খাওয়া নেই। নিয়মমাফিক আজো রাতে খাবোনা। বিছানা ঠিক করে হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছি। শরীর ঘুমে ঢলে আসছে। কতক্ষণে বিছানায় গা লাগাবো!! আজ মনে হচ্ছে গভীর ঘুম পাবে। বিছানায় যেই শুবো ফুপি বুঝি ওই ফ্ল্যাট থেকে এই ফ্ল্যাটে আসলেন। সোজা আমার রুমের দরজা ধরে বলে উঠলেন-
–স্নেহা রে ঘুমিয়েছিস মা?
–না ফুপি। আসো ভেতরে..
–না ঘুমালে আমার সাথে একটু আয় দেখি। সাগ্রতের খালা বাসায় নেই। অপারেশন করার পর দামড়া ছেলেটা উকি দিতেও বাসায় আসেনি।
–তুমি কার কথা বলছো?
–দেশ স্বাধীন অভদ্র ছেলেকে। কেমন ফটফট করে মুখ চালায় দেখলিনা? পরিবারের শিক্ষা পায়নি দামড়া।
–আহা..বাদ দাও ফুপি। ওই ছেলেটার কি কেউ নেই? পরিবার পরিজন!!
–বললো তো নেই। ছোট বয়সেই নাকি বাবা-মা অক্কা পেয়েছে। তুই চলতো দেখি যেতে যেতে কথা বলা যাবে।
ফুপি গল্পরসিকতা করতে করতে কখন মুখের উপর আবদার করে বসবে বুঝবেননা। এমন ভাবে অবদার করবে, এতে আপনি বাধ্য হবেন ফরমাশ পূরন করতে। আমি প্রতিবার এভাবেই ফেসে যাই। টাকা চাইলে টাকা দেই। পরে একলা মনে আফসোস করি। এটাকেই বলে “ভালোবাসা”। সাগ্রতের রুমে ঢুকতেই ফুপি অন্য কাজের বাহানা দেখিয়ে চলে গেলেন। আমি জানি ফুপি এখন ঘুমাতে গিয়েছেন। উনি ঘুমাবেন। আর আমাকে এখানে নজরদারির চাকরি দিলেন। ছেলেটা চোখ বন্ধ করে বুকের উপর হাত দিয়ে আছে। আমি শালীনতা দেখিয়ে দরজায় নক করলাম। ও চোখ খুলে তাকিয়ে বলল-
–ভেতরে এসো।…..সোফায় কুশন সরিয়ে বসো। তোমায় আন্টি পাঠিয়েছে তাই না?
–জ্বী।
আমি সোফায় বসলাম। ছিমছাম রুম। ব্যাচেলার বাসা বোঝাই যায়। তার উপর থাকেন একা। আমি চোখ ঘুরিয়ে রুম দেখছি সাগ্রত বলে উঠলো-
–ভদ্রমহিলা একটা অপরিচিত ছেলের কাছে নিজের ভাতিজিকে রেখে গেলো। কথাটা কেমন বিশ্রী শুনতে জানো?
আমার চোখ ঘুরানো থমকে গেলো। কথাটা বিশ্রী বলে সে আমার কাছ থেকে প্রশ্ন সূচকে অনেক কিছু বোঝাচ্ছে। অবিবাহিত মেয়েকে কোনো ব্যাচেলার বাসায় পাঠানো ঘোর অপরাধ কিন্তু ফুপি তা বুঝলেও কিছু বলবেনা। কারন তিনি চান একটা ব্যাচেলার ধরিয়ে আমার মতো অপয়াকে বিদায় করতে। আসলে ফুপি পরিস্কার করে কথাটা কখনো আমায় না বললেও আমি নিজের বুদ্ধিতে অনেক কিছুই বুঝি। গতবারো এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন পরে ছেলেটা অসৎ কাজ করতে চেয়েছিলো। আমি ব্লেড দিয়ে হাত কেটে দিয়েছি। সে থ্রেড দিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছে। ভাড়াটিয়া দুজন যারা ছিলো সবাই আমাকে উপস্থিত থু থু করেছে। ফুপি – ফুপাজি কেউ কিছু বলেননি। তবুও বলি তারা ভালোবাসেন। আমি সাগ্রতকে বললাম-
–আমি এতিম তো আমার কেউ নেই। আমি বোঝা হয়ে গিয়েছি তাই আপনার গলায় আমাকে গছাতে ফুপি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সাগ্রত ভেতরে ভেতরে খুব বিচলিত হলো। বাইরে থেকে কিছু প্রকাশ করলো না স্বাভাবিক থাকলো। তার মনটা চাচ্ছে মেয়েটাকে একেবারে নিজের কাছে রেখে দিতে। আজীবনের জন্য নিজের সাথে রাখতে ব্যকুল অধির হয়ে আছে। কিন্তু কোথাও যেন বাধা পেয়ে বসে আছে। সাগ্রত শান্ত গলায় বললো-
–আগে থেকে সবকিছু জানো তবুও তুমি চুপ করে আছো? কারন কি?
–কারন কিছুই না। আমি সব বুঝলেও বোকা সেজে থাকি। বোকা ভেবে ভুল করলে অপজিট মানুষের লস। সেটা কেমন লস জিজ্ঞাসা করবেননা।
–আচ্ছা না করলাম। বাট গেস তো করতে পারি। আই থিংক, তোমাকে বোকা ভেবে ভুল করলে তারা নিজেরাই বোকা হয়ে যায়। তুমি ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে। সব বোঝো কিন্তু তারা তোমাকে বোঝেনা।
–আমার তা নিয়ে দুঃখ নেই।
–আজব কথা বললে দেখছি। দুঃখ নেই?
–সবচেয়ে বড় দুঃখ দুজনকে হারিয়ে পেয়ে গিয়েছি। আমার আর দুঃখ পাওয়ার বড় মন নেই।
–ওয়েল সেইড। আমি কথা কম বলি। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে অজানা ভালো লাগছে।
–আমাকে পছন্দ করতে আসবেননা। আমার প্রেমিক আছে। আমি তাকে ভালোবাসি। তাই আমাকে পছন্দ করবেননা।
সাগ্রত ঠোট চেপে হাসলো। মনের মধ্যে হাসির বেগ তুমুল হচ্ছে নিজেকে খুব করে হাসা থেকে থেকে বিরত রাখছে। স্নেহা রুমে না থাকলে অপারেশনের সিকনেস ভুলে হুহা করে হাসতো সাগ্রত। মেয়েটা খুব সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। গুছিয়ে মিথ্যা বলার জন্য একটা পুরস্কার দেওয়া উচিত।। সাগ্রত হাসি উড়িয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল-
–কফি খাবে? টেবিলের উপর কফি মেকার আছে। শুধু পানি ঢেলে মেইন সুইচ অন করলেই হবে।
–আমি কফি খাই না। দয়াকরে আপ্যয়ন করতে আসবেন না। আমি দশমিনিট পর চলে যাবো। দারোয়ান চাচা রুহুল মিয়ার ছোট ছেলে আপনাকে দেখভাল করবে। আমি থাকবোনা।
সাগ্রত হকচকিয়ে গেল। অস্থির হয়ে উঠলো। সে চায় না স্নেহা চলে যাক। স্নেহাকে সোফায় বসা অবস্থায় সারারাত দেখতে চায়। আর কিচ্ছু না। চোখের তৃপ্তিতে দেখতে চায়। খারাপ দৃষ্টিতে না। সাগ্রত ক্ষুন্ন গলায় হুড়মুড় করে বলে উঠলো-
–প্লিজ থাকো স্নেহময়ী! যেও না!
আমি অকপট কিছু শুনে কপাল কুচকে কঠিন দৃষ্টি দেই। সাগ্রত থতমত করছেন। আমি পুরোপুরি সবটা বুঝার জন্য শক্ত কন্ঠে বলি-
–আপনি কি বললেন? কি বললেন আমায়?কি হলো জবাব চাচ্ছিনা? আপনি স্নেহময়ী বললেন কেন?
–হোয়াট! কে বলল স্নেহময়ী? আমি তোমাকে স্নেহ মা বলেছি। জোকস এ্যাপার্ট।
–আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকলে থাকতে পারে। বাট আমি আপনার মেয়ের বয়সী না। মা — ডাকবেন না।
–তো কি ডাকবো? মেয়ে-মেয়ে বলে ডাকবো? লো ক্লাস লাগে।
–ডাকাডাকির দরকার নেই। স্নেহা বলে ডাকবেন।
–“স্নেহ মা” ডাকাকে.. তুমি “স্নেহময়ী” –শুনেছো ঠিক? সো আই উইল কল ইউ স্নেহময়ী!
-চলবে
-Fabiyah_Momo🍁