আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৭

আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৭
রিলেশন_সিরিজ
Ipshita_Shikdar (samia)

কাব্য ইপশির এই কথার মাঝে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে মুচকি হাসলো এবং ইপশির পেটে নিজের মুখটা আরও ভালোভাবে গুঁজে দিলো। ইপশিও আপনমনে কাব্য চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো হঠাৎ পেটে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে ফেললো।

— কী হলো সামি বেবি? এমন কাপাকাপি করছো যে…

কাব্যর প্রশ্নের উত্তরে ইপশি কি বলবে ভেবে না পেয়ে চোখবন্ধ করে চুপ করে থাকলো। কারণ জীবনের প্রথম পুরুষের ছোঁয়ায় যে একরাশ লজ্জানুভূতি ও প্রেমানুভূতির সংমিশ্রিত রূপ তাকে ঘিরে ধরেছে। যা দেখে কাব্য দুষ্টু হাসলো এবং বললো,

— আমরা বিয়ে করছি কবে? কাল বা পরশু নাকি নববর্ষের পরে করলে ভালো হবে? তোমার সুবিধা মতো ডেটেই আমরা বিয়ে করবো।

ইপশি অবাক হয়ে বললো,

— ব-বিয়ে মানে কিসের বিয়ে এখন আবার? তোমার মাস্টার্স শেষ হতে তো অনেকদিন বাকি, তাহলে এতো কাছাকাছি সময় বলছো কেনো? তাছাড়া বাবামাকে বলতে হবে, আমার বাড়িতে প্রস্তাব দিতে হবে, রাজি করাতে হবে আরও কত কি!

— আরে সেই বিয়ে তো পড়ে করবো এখন জাস্ট রেজিস্ট্রেশন করবো। যাতে তোমার উপর ধর্মমতে না হোক এটলিস্ট আইনগত অধিকারটা পাই।

— নাহ, আমি এই বিয়ে নামক কাগজের খেলা খেলবো না যখন বিয়ে করার সবাইকে জানিয়েই করবো। এসব বিয়ের পরিণতি খুব খারাপ হয়। রেজিস্ট্রেশন পেপার নামক ছোট্ট কাগজের মাধ্যমে মেয়েদের শরীর নিজের ভোগের সামগ্রী করে নেয়। তারপর তার বিশ্বাস ও সরলতার সুযোগ নিয়ে এই কাগজি বিয়ের নাম নিয়ে ইচ্ছেমতো তাকে ভোগ করার পর ব্যবহারকৃত টিস্যুর মতো ফেলে দেয়া হয়।

ইপশির কথাটা যেনো কাব্যর বুকে ছুড়ির মতো লাগলো। এতোটা আঘাত লাগলো যে চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো… ছেলে বলেই হয়তো সহ্য করতে পারছে মেয়ে হলে হয়তো কেঁদেই ফেলতো। কোল থেকে উঠে বসে রাগান্বিত হয়ে বললো,

— ইপশি তুমি এগুলো বলতে পারলে? এতোটা অবিশ্বাস করো আমায়… এতোটা খারাপ ভাবো আমায়? আমি জাস্ট তোমাকে কোনোভাবে হারাতে চাই না তাই বলছি। আচ্ছা, তোমার অবিশ্বাস হলে তুমি রেজিস্ট্রেশন পেপার নিজের কাছে রেখো। তবুও আমার তোমাকে চাই।

ইপশি নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বললো,

— সম্পর্ককে যেমন অবিশ্বাস ও সন্দেহ ধ্বংস করে দেয় তেমনই অন্ধবিশ্বাস প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন ধ্বংস করে। তাই বিশ্বাস যতটা কল্যাণকর তার চাইতে হাজারগুণ বেশি ধ্বংসাত্মক অন্ধবিশ্বাস।

— মানে?

ইপশি কাব্যর মাথা আবার নিজের কোলে রেখে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগলো,

— শোনো কাব্য আমি তোমাকে বিশ্বাস করি তবে অন্ধবিশ্বাস নয়। আর আমি তা কাউকেই করিনা নিজের জন্মদাত্রীকেও না। আমি জানি তুমি নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখবে তবে শয়তান তো সারাক্ষণ কুবুদ্ধি দিয়ে যাবে হয়তো তখন মনের ভুলেই এগিয়ে আসবে তুমি আর ঐ কাগজের টুকরার দায়ে আমিও হয়তো মানা করতে পারবো না… হয়তো কি পারবো না কারণ তোমাকে সন্তুষ্ট রাখা আমার দায়িত্ব। তখন যদি কোনো এক্সিডেন্ট হয়ে যায় আই মিন যদি আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই তাহলে? আই নো তুমি মেনে নিবে এবং খুব দ্রুত বিয়ে করে নিবে সবাইকে মানিয়ে যাতে পরিবার কেন কোনো কাকপক্ষীও টের না পায় কিন্তু ভাগ্য বা প্রকৃতি বলেও একটা কথা আছে! আল্লাহ না করুক তোমার কিছু হয়ে গেলো বা বাইরে লিক হয়ে গেলো এই ব্যপারটা তাহলে তুমি যতোই প্রমাণ দেখাও সমাজের কাছে সে জারজ বলেই জ্ঞাত হবে। তার চেয়ে বরং তোমার মাস্টার্স শেষ করতে মাত্র কয়েক মাস তাই একটু অপেক্ষা করা ভালো হয় না? জানি না বুঝাতে পেরেছি কিনা কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।

ইপশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে তার অঙ্গভঙ্গিমার দ্বারা বোঝার চেষ্টা করলো তার মাথায় কি চলছে। কিন্তু তাকে অবাক করে কাব্য তার পেটে আরও নিবিড়ভাবে নিজের মুখ গুঁজে শান্ত গলায় বললো,

— জানতাম না তো আমার ছোট্ট মায়াবতী এতোটা বুঝদার… তোমার যুক্তি অনু্যায়ী তো অন্যকোনো মেয়ে হলে এতক্ষণে ঝগড়া শুরু করে দিতো অথবা আমাকে ছেড়ে চলে যেতো কিন্তু তুমি আমার রাগারাগিতেও নিজেকে শান্ত রেখে কি সুন্দর বুঝালে। এভাবেই সারাজীবন আমায় সঙ্গ দিয়ো নাহলে আমি…

কাব্য কে বলতে না দিয়েই ইপশি বলে উঠলো,

— সারাজীবন সঙ্গ দিবো যদি মাঝপথে ভাগ্যের জোরে ছেড়েও চলে যাও কসম আল্লাহর কিয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো শুধুই তোমার এবং প্রতিটি দোঁয়ায় চাওয়া হবে পরকালে তোমার সঙ্গ।

এভাবেই শুরু হয় একে অপরের হাতে হাত রেখে পথচলা। তাদের সম্পর্কটা খুনিশুটি ও ভালোবাসাময় মুহূর্তের দ্বারা দিনেদিনে যেনো গভীরতর হচ্ছিলো। দুজনার সম্পর্কের বিদ্যমান বিশ্বাস অর্থাৎ মূল খুঁটি মজবুত ছিলো তাই সব বাধা পেড়িয়ে ভালোই চলছিলো। ইপশি প্রায়শয়ই কাব্যর বাড়ি যেতো নিলা ও অন্যান্য বান্ধুবীদের নিয়ে। মাঝেমাঝে একাও যেতো। তবে অবাককর বিষয় হলো কাব্যর বাবামা একই শহরে থাকা সত্ত্বেও সে একা অন্য বাড়িতে থাকতো। ইপশি কখনো জিজ্ঞেস করলেও সে এড়িয়ে যেতো তাই তাকেও আর ঘাটতো না।

এরপর কেটে যায় প্রায় একবছর আর কাব্যও নিজের মাস্টার্স শেষ করে নেয়। এরমাঝে ইপশির পরিবার তার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাই কাব্য আর দেরি না করে তার বাসায় প্রস্তাব পাঠায় তবে তাদের সম্পর্কের কথা জানায় না। ইপশির পরিবার রহমান বাড়ির প্রস্তাবে অস্বীকার করে এবং জানায় ইপশির বিয়ে তার খালাতো ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই ঠিক করা। এ কথা শুনে যেনো কাব্যর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তাই ইপশিকে কল করে।

— হ্যালো! আসসালামুয়ালাইকুম কাব্য।

কাব্য উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,
— ওয়ায়ালাইকুম আসসালাম ইপশু। তবে তুমি তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে আসো। ওয়েট! তুমি তো ভার্সিটিতে, রাইট? তাহলে আমিই এসে পিক করছি।

— কাব্য ইজ এভ্রিথিং ওকেহ? আচ্ছা, আমার তোমাকে নিতে আসতে হবে না। আমি নিলার সাথে একটা রিকশা নিয়ে এখনই তোমার বাড়ি আসছি। তুমি মাথা ঠান্ডা করো!

ইপশি নিলাকে নিয়ে কাব্য বাড়িতে যেতে দেখলো সারা বাড়ি নিস্তব্ধ… এমন কি বেডরুমেও কেউ নেই। সে জানে কাব্য এখন কোথায় তাই চোখের ইশারায় নিলাকে বেডরুমে বসতে বলে দৌড়ে ছাদে গেলো। যেতেই দেখলো কাব্য একদম নিস্তেজ হয়ে বসে আছে আকাশপানে তাকিয়ে। ইপশি কাব্যকে এভাবে দেখে আঁৎকে উঠলো এবং দৌড়ে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে কাব্য? এমন করছো কেনো তুমি?

— কেনো এমন করলে ইপশি? তুমি তো সব জানতে তাহলে আমাকেও তো জানাতে পারতে। এতোটা কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যখানে সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

— কাব্য কি জানতাম আমি কিছু বুঝতে পারছিনা তোমার কথার। তোমার না আজ আমার বাড়ি প্রস্তাব পাঠানোর কথা ছিলো তাহলে সেখানে কিছু হয়েছে নাকি? সোজাসাপ্টা উত্তর দিবে।

— তোমার পরিবার মানা করে দিয়েছে আমার প্রস্তাবে। কারণ তোমার নাকি বিয়ে ঠিক তোমার খালাতো ভাইয়ের সাথে।

— হোয়াট! কেউ আমাকে একবারও জানালো না। আর কাব্য এসব সেন্টি কথা বলবে না। ইউ নো আই কান্ট লিভ ইউ এট এনি কোস্ট। উপরওয়ালার কসম কেটে তোমার হয়ে থাকতে না পারলেও তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। সো ডোন্ট বি দিস!

— তাহলে চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি কাউকে না জানিয়ে দেন তারা না মানলেও কোনো ঝামেলা হবে না।

— অসম্ভব! আমি তোমার জন্য আমার পরিবারকে হারাতে পারবো না কখনোই। একবছরের ভালোবাসার জন্য একুশ বছরের ভালোবাসাকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। তাছাড়া শরিয়ত মোতাবেক বাবামার অসম্মতি ও অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন বিবাহ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না এবং এই বিবাহ হয় অভিশপ্ত ও অশান্তিজনক। কিছু জায়গায় তো শুনেছি কেউ এমন বিবাহ করলে বাবামাকে রাজি করিয়ে আবার বিয়ে করা উত্তম। আর পরিবারের মানসম্মানেরও একটা ব্যপার আছে। আই কান্ট ডিস্ট্রোয় এভ্রিং ফর আওয়ার রিলেশন।

কাব্য নিজেকে ইপশির বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— ওহ! তারমানে আমাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছো তাহলে সোজাসুজি বললেই হয়। এতো ঘুরিয়ে বা প্যাঁচিয়ে বলার কোনো দরকার নেই তো।

— উফ! আরে বাবা আমি বলেছি নাকি যে তোমায় ছেড়ে পরিবারের পছন্দমতো পাত্রের গলায় মালা পড়াবো। আমি শুধুমাত্র বলেছি আমি তোমার জন্য আমার পরিবারকে হারাতে কিংবা কষ্ট পেতে দিতে পারবো না। কারণ আমি তখন এটা করতাম যখন তারা আমাকে ভ্যালিড কোনো কারণ দেখাতো তোমাকে রিজেক্ট করার। আর আমার পরিবারের জন্যও তোমাকে হারাতে পারবো না। কারণ এটা আমি তখন করতাম যখন আমি জানতাম আমার পরিবার মেনে কখনোই সম্পর্কটা উইদাউট এনি রিজন মেনে নিবে না অর গুণ্ডামি ও জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিবে অন্যত্র। আই কান্ট এফোর্ড টু লস ইউ বোথ বিকজ আই ওয়ান্ট বোথ অফ ইন মাই লাইফ। আই নো মাই ফ্যামিলি, হয়তো সময় সাপেক্ষ তবে আই ক্যান রিয়েলি হ্যান্ডেল মাই ফ্যামিলি বিকজ দে লাভ মি এ লট। আর যদি না পারি তখন নাহয় কিছু একটা পদক্ষেপ নিবো…

কাব্য এবার আহত দৃষ্টিতে নিজের প্রেয়সীর দিকে তাকায় যা দেখে তার প্রেয়সী ভেঙচি কাটে। সেও উত্তরে মুচকি হাসি উপহার স্বরূপ দেয়।

— সরি ইপশু! আমি আবার তোমার কথা না বুঝেই রাগ দেখিয়ে ফেলেছি। আর তুমি কি শান্ত হয়ে বুঝিয়ে দিলে এতোটা হৃদমোহিনী কেন তুমি বলো তো?

— জীবনসঙ্গীর রাগ সহ্য করা কোনো বিশেষ ব্যপার নয় আমাদের ধর্মও এই শিক্ষা দেয় যে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একজন তা সহ্য করবে এবং শান্ত থেকে বোঝানোর প্রচেষ্টা করবে অথবা নিশ্চুপ থাকবে। তবে তা অবশ্যই সীমা লঙ্ঘন হওয়া পর্যন্তই অবশ্য একেকজনের সীমারেখা একেকরকম হয়। সম্পর্কটাকে দাঁড়িপাল্লার মতো সামলাতে হবে অর্থাৎ, একপাশে যদি ভর কম থাকে অপরপাশে অবশ্যই ভর বেশি দিতে হবে নাহলে সম্পর্ক ও দাঁড়িপাল্লার সমতা নষ্ট হতে দুই সেকেন্ডই যথেষ্ট। তাই এসব আজাইরা ক্রেডিট দেয়া বাদ দাও তবে আমি চিন্তিত এই বিয়ে নিয়ে!

— হুম, তবে তোমার এই খালাতো ভাইটা কে? ওয়েট আ মিনিট! পাত্র আরাভ নয়তো? আমি আগে থেকেই জানতাম এই ছেলের নজর তোমার উপর দ্যাটস হোয়াই আই ডোন্ট লাইক হিম।

— আরাভ? নাহ, সে কিছুতেই হতে পারে না পাত্র। আমাদের সম্পর্ক তো ফ্রেন্ডশিপ এবং আমি তাকে আমার ভাইয়ের মতো ভাবি আর সেও… আম্মুর কোনো কাজিনের ছেলে হবে হয়তো কারণ তাদের মাঝে অনেকেই বিদেশে ওয়েল সেটেল্ড তাই সবার খুব পছন্দের।

— আই ডোন্ট নো এনিথিং, তুমি জাস্ট যেভাবে সম্ভব এই বিয়ের ঝামেলা শেষ করো! অর ইলজ আমি নিজেকে কিছু করে ফেলবো!

— এই ছেলে একদম ফালতু কথা বলবে না নাহলে খবর করে ফেলবো! আমি আরাভকে কল করে এখানে আসতে বলছি… তাকে সব খুলে বলবো বিকজ আই থিংক হি ক্যান হেল্প আস দ্যা মোস্ট।

— কিন্তু…

— উফফ! তোমায় কতবার বলেছি আমি যে আরাভ শুধুমাত্র আমার কাজিন ব্রাদার নাথিং ইলজ! আর যদি তার জন্য কিছু থাকতোই আমার মনে তাহলে তোমার সাথে আর সম্পর্কে জড়াতাম না। কাব্য তুমি এতো সন্দেহ আর অবিশ্বাস করো কেনো আমায়?

কাব্য মুচকি হেসে ইপশির দু’আঙুলে থুঁতনি উঠিয়ে বললো,

— জানপাখিরে এটা সন্দেহ বা অবিশ্বাস নয় এটা আমার ঈর্ষা তোকে নিয়ে। ভয় হয়রে তোকে হারানোর… তোর আশেপাশেও অন্য পুরুষকে দেখলে বুকের মধ্যখানে ঝড় বয় না রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কারণ তুই যে বক্ষখাঁচায় যতন করে আগলে রাখা মায়াপাখিরে যাকে আমি অন্য শিকারির খাঁচায় বন্দী হওয়ার ভয়ে নিজ কারাগারে বন্দী করে রাখতে চাই সর্বদা।

— ভালোবাসি! বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে! সৃষ্টিকর্তা, তার রাসুল ও পিতামাতার পর তোর বসবাস এই হৃদমাঝে।

তাদের ভালোবাসাময় মুহূর্তগুলোর মাঝে অল্পকিছু সময় নিয়ে আরাভকে কল করে এই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে এখানে আসতে বলে ইপশি। কাব্য, ইপশি ও নিলা যথাসময়ে ড্রইংরুমে উপস্থিত হয়ে আরাভের অপেক্ষা করতে থাকে।

এদিকে আরাভ চিন্তিত হয়ে আমাকে ইপশি তাকে অপরিচিত ঠিকানায় ডাকায়, তবুও মনকে প্রশান্তি দিলো এই ভেবে যে কোনো বান্ধুবীর বাসা থেকে আনতে হয়তো যেতে বলেছে। সঠিকসময়ে পৌঁছে গেলো কাব্যর বাসায় আর যেহেতু দাড়োয়ানকে বলা ছিলো তাই ঢুকতে কোনো ঝামেলা হলো না। বাড়ির ড্রইংরুমে নিলা ও ইপশির এক অচেনা যুবককে বসে থাকতে দেখে তার মন অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। আরাভকে দেখে ইপশি এগিয়ে এসে তাকে সোফায় বসালো এবং তার ঠিক সামনের সোফায় ইপশি ও কাব্য একসাথে বসা।

— আরাভ আসলে আমার তোকে কিছু জানানোর আছে এবং তোর সাহায্যেরও দরকার আছে।

— হুম বল! কি বলবি?

ইপশি আরাভকে নিজের ও কাব্যর সম্পর্কের শুরু থেকে সবটা খুলে বললো। তারপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পাত্র ও বিয়ের খবরও জানালো এবং তা ভাঙার জন্য সাহায্য চাইলো। আরাভ মৃদু হেসে বললো,

— বাহ! তলে তলে এতো দূর! যাই হোক তুই চিন্তা করিস না… আমি সব ঠিক করে দিবো এবং তোর কিছু করাও লাগবে ঐ ছেলে নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দিবে।

— থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ আরাভ! আমি জানতাম এই সময়ে আমায় শুধু তুই-ই সাহায্য করতে পারবি!

— আচ্ছা, আমি গেলাম। আমার আসলে ভার্সিটির জরুরি ক্লাস আছে। অনার্স ফোর্থ ইয়ার চাপ তো জানিসই!

কথাটা বলেই আরাভ তাড়া দেখিয়ে হরহর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে বসে উচ্চগতিতে চালাতে লাগলো হঠাৎ একটি নিরিবিলি জায়গায় এসে দ্রুত গতিতে ব্রেক করে সিটে মাথা এলিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। চোখজোড়া দ্বারা অবিরাম ধারায় অশ্রু পড়ছে। বিড়বিড় করে বলছে,

— আল্লাহ কেনো এমন হলো? আমার প্রিয় মানুষটি আজ আমার সম্মুখে তার ভালোবাসার মানুষের প্রকাশ ঘটালো আর আমি আক্রোশ প্রকাশ তো দূরে থাক নিজের দীর্ঘকালীন ভালোবাসা ও চাওয়ার প্রকাশও ঘটাতে পারলাম না। আমি পারবো না তাকে অন্যকারো সাথে দেখতে আমারই হতে হবে তাকে!

পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে বললো,

— ছি! ছি! আরাভ তুই তোর ভালোবাসার মানুষকে তার সুখ থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছিস নিজের জন্য। আর তুই তাকে জোরজবরদস্তি বা ষড়যন্ত্র করে বিয়ে করেও কি লাভ? সে তো কখনোই পারবে না তোকে তার ভালোবাসতে… বেলাশেষে না তুই ভালো থাকবি না অন্যকেউ। তাকে তুই জোরজবরদস্তি করে নিজের করতে পারতি যদি তার হৃদমাঝ শূণ্য থাকতো কিন্তু সেখানে তো অন্যের বসবাস! নাহ, কষ্ট পাওয়ার হলে একজন পাক তাই-ই ভালো। আজই সবাইকে যেয়ে বলবো আমি ইপশিকে বিয়ে করতে চাই না।

আরাভ বাসায় এসে সবাইকে এই বিয়ের জন্য মানা করে দিলো। তার কথা শুনে প্রত্যেকে বেশ অবাক কারণ সে সর্বদাই মানা প্রিয় বস্তুর মতো আগলে রাখে ইপশিকে তাহলে কেনো মানা করছে।

— আরাভ তোর মাথা ঠিক আছে তো? মেয়েটাকে কেনো বিয়ে করবি না… তাছাড়া এতোদিন তো কিছু বললি না?

— মা আমি তাকে নিজের ছোটবোন ভাবি তাই বউ হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর এতোদিন বলিনি কারণ তোমার অনেক খুশি ছিলে বলে সাহস করতে পারিনি।

— তোর খুশিতেই আমি খুশি তাই যেভাবে বলছিস সেভাবেই হবে। আমি তোর খালারে জানায় দেই।

— হুম! আম্মু শুনো ইপশি যাতে জানতে না পারে আমিই পাত্র বা আমার সাথে তার কোনোদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। কারণ এটা জানলে আমাদের মাঝে অস্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

— আচ্ছা।

এভাবে আরাভের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং কাব্যর বাবামা আবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এইবার আর সোজাসুজি মানা করে না ইপশির পরিবার বরং খোঁজখবর নেয়ার জন্য সময় চায়। ইপশির বড় ভাইয়া আবার মানা করে দেয় কারণ তারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে কাব্যর বাবা প্রথম স্ত্রী মাত্র ছয় মাসে তার ননাসের জালায় সংসার ফেলে চলে গিয়েছে। আর কাব্যর মা অর্থাৎ তার দ্বিতীয় স্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটে সংসার করছে। তাই এমন বংশ কিংবা পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার কোনো মানেই হয়না বলে মনে করছে ইপশির পরিবার।

এবার আর ইপশি চুপ থাকনি বরং তার সম্পর্কের কথা খুলে বলেছে মা ও ভাবিদের কাছে। সব শুনেও তার বাবা ও ভাইয়েরা দৃঢ়ভাবে নাকোচ করে বিয়ের জন্য। তারপর থেকে ইপশি উদাসীন হয়ে যেতে থাকে, পরিবারের কারো সাথে কথা বলতো না, একবেলা দুনলা খেলে বাকি দিন সেভাবেই কাটতো, শুধুমাত্র কাঁদতো আল্লাহর কাছে জায়নামাজে বসে। ধীরেধীরে চোখের নিচে কালি পড়তে শুরু করে, আরও রোগা হতে শুরু করে, তীব্র অসুস্থতা গ্রাস করতে শুরু করে তাকে। তার মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ভাসিয়ে দিতো। আর ভাইয়েরা বাহিরে শক্ত হয়ে থাকলো মনে মনে অস্থির থাকতো ছোটবোনটার জন্য। তারপরও আশা ছিলো সময়ের সাথে ইপশি কাব্যকে ভুলে যাবে কিন্তু একবছর পেড়িয়ে গেলেও অবস্থার পরিবর্তন হলো না।

তাছাড়া কাব্য ইপশির বাবা, ভাইয়েদের পায়েও পড়ে ইপশিকে পাওয়ার জন্য। কাব্যর বাবা-মাও ছেলের যন্ত্রণায় বারবার এই বাড়ির মুখাপেক্ষী হতো। কারণ ইপশি তার পরিবারকে বলেছিলো তাদের অসম্মতি কাব্যকে বিয়ে না করলেও অন্যকাউকে বিয়ে করবে না। শেষপর্যন্ত নিজের মেয়ের এমতাবস্থা দেখে বুকে পাথর রেখে আল্লাহ ভরসা বলে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো। তার ছয়মাস পরই ইপশির পছন্দমতো ডেস্টিনেশন মেরেজের ব্যবস্থা করে কারণ অনেক তো থাকলো মেয়েটা কষ্ট এবার নাহয় আনন্দে থাকুক।

বর্তমানে,

কারো পদচালনার শব্দে কাব্য নিজের অতিতের সোনালী দিনগুলো ফেলে বাস্তবতায় ফিরে এলো। তাই নিজেকে সামলে তাড়াতাড়ি নিজের চোখজোড়া মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখলো তার ছোট বোন এসেছে।

— ভাই তোকে মা ডেকেছে! মা তোদের বেডরুমে আসবে বাবাকে বিছানা গুছিয়ে দিয়ে। আগামীকাল তো তোদের বৌভাত তাই তার পোশাকআশাক ও অন্যান্য কিছু বিষয়ে কথা বলতে চায় হয়তো। আর বারোটা বাজে তবুও ভাবি যে তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে সেই খেয়াল আছে তোর।

— কিহ! এই মেয়েটার না এসিডিটির সমস্যা আছে তারপরও লেট করে খাবার খাচ্ছে। শিট! আমিও কি গাঁধা সে যে নিজের হাতে ভাত খেতে পছন্দ করে না কি করে ভুলে গেলাম!

বলে কাব্য তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। বেডরুমে এসে দেখে ইপশি কানে এয়ারফোন লাগয়ে চুপচাপ বসে আছে
গান শুনছে হয়তো ভেবে কান থেকে এয়ারফোনটা টান দিয়ে খুলে বললো,

— তুমি খাওনি কেনো? জানো তো না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাও।

— ভালো লাগছে না তাই করবো না আজকের ডিনার।

ইপশি এই কথাটা বলে শেষ করেছে ঠিক তখনই দরজায় কেউ এসে নক করলো। উঠে যেয়ে খুলে দিতেই একজন সারভেন্ট খাবারের ট্রে কাব্যর হাতে ধরিয়ে গেলো। কাব্য হাত ধুয়ে এসে ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,

— হা করো! আমি তোমাকেও খায়িয়ে দিচ্ছি আর নিজেও খেয়ে নিচ্ছি। কি হলো! ফাস্ট খাও কারণ আম্মু আসবে একটু পর কথা বলতে।

ইপশিও কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগলো। কাব্য একবার নিজে খাচ্ছে তো পরের বার ইপশিকে খাওয়াচ্ছে আর তার প্রিয়তমা তা একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎই খেয়াল করলো কাব্যর ঠোঁটের কোণে ভাত লেগে আছে তাই নিজ দায়িত্বে তা মুছে দিলো হাত দিয়ে। যা দেখে প্রথমে কাব্য অবাক হলেও পরক্ষণেই নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এই হাসি ইপশির চোখের আড়াল হলো না তাই অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

— হাসার কিছু দেখছি না এখানে। কেউ তার হাত দিয়ে এতো কষ্ট করে খায়িয়ে দিচ্ছে আমায় তাই আমি একটু তার ঠোঁটে লাগা খাবার মুছে দিতেই পারি।

— তো আমি কিছু বলেছি নাকি? কথায় আছে না যার মনে যা ফাল দিয়ে উঠে তা।

ইপশি কাব্যর কথার লুকায়িত অর্থ বুঝতে পেরে ভেঙচি কাটলো। আর কাব্য মুখে তৃপ্তিজনক হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,

— তুমি আজও আমাতে হারিয়ে যাও ইপশু। ভালোবাসো তো শুধু আমাকেই হয়তো আগের মতো প্রকাশিত নয় তা লুকায়িত। তাতে কি তোমার ভালোবাসাটাই অনেক!

দুজন খাওয়া শেষ করতেই মিসেস কাব্য রহমান ঘরে ঢুকলেন। তাদের মাঝে বেশকিছু কথা আলোচনা হওয়ার পর মিসেস রহমান ইপশিকে তার বৌভাতের শাড়ি ধরিয়ে বের হয়ে গেলেন। ইপশিও বাথরুমে গেলো ফ্রেশ হতে এবং ড্রেস চেঞ্জ করতে। কাব্য রুমেই চেঞ্জ করে থ্রিকোয়াটার প্যান্ট আর টিশার্ট পড়ে নিলো। ইপশি বের হওয়ার আগেই কাব্য বিছানার একপাশে শুয়ে থাকে। তাই ইপশিও এসে লাইট অফ করে অন্যপাশে ঘুমিয়ে যায়।

হঠাৎ ঘুমের মাঝে টের পায় তার উপর কেউ হাত-পা ফেলে ঘুমিয়ে আছে। চোখজোড়া মৃদু খুলে কাব্যকে ঠিক করে শুয়িয়ে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু একইভাবে হাত-পা দিয়ে দেয় কাব্য ইপশির উপর। এভাবে তিনচার বার ইপশি ঠিক করলেও পাঁচ মিনিট পর একই কাজ করতে থাকে কাব্য। শেষে ইপশি বিরক্ত হয়ে কাব্যকে ডাকতে তার দিকে এগুতেই থমকে যায়। কারণ কাব্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক নিষ্পাপ শিশুর মতো মায়াময় লাগছিলো। কেউ একজন ঠিকই বলেছিলো ঘুমন্ত অবস্থায় শুধু মেয়েদের নয় ছেলেদেরও সৌন্দর্য প্রকৃতরূপে ফুটে ওঠে, যাতে মুগ্ধ হতে বাধ্য তার প্রিয়তমা। ইপশিও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর ঘুম ভাঙাতে পারে না তার প্রিয় মানুষটার। বরং কপালে একটি চুমু এঁকে তার বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। আর বিড়বিড় করে বলে,

— ভালোবাসি, বড্ড বেশি শুধু তোমায়।

কাব্যও মুচকি হেসে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তার প্রিয়তমাকে। হ্যাঁ, কাব্য এতোক্ষণ ঘুমানোর অভিনয় করছিলো। কারণ প্রিয়মানুষটার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য একটু অভিনয় করলে ক্ষতি কি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here