আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৪ক,পর্বঃ৪খ
Ipshita_Shikdar (samia)
পর্বঃ৪ক
❤
—- ম-মানে? তুমি আমাদের বিয়েকে অস্বীকার করছো ইপশু… ওহ! বুঝেছি তুমি আমার সাথে মজা করছো, তাই না?
—- নট এট অল!
—- তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করলো? তুমি তো তখন সব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলে। আমি তো তোমায় জোর করিনি বরং তুমিই আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে।
—- হুম, করেছিলাম বাধ্য এই বিয়ে করতে তবে তোমায় নিজের করে পাওয়ার জন্য নয়। এই বিয়ে ভাঙলে তোমার তো কিছু হতো না। বরং মানসম্মান আমার পরিবারের যেতো, আমার চরিত্র প্রশ্ন উঠতো, আমার বংশমর্যাদায় দাগ লাগতো। যা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারতাম না… এমনিতেও তোমার জন্য পরিবারের সাথে কম ঝামেলা করিনি বা কম কষ্ট দেইনি তাই তাদের আর ভুগতে দিতে পারতাম না। বিকজ ভুল মানুষকে আমি ভালোবেসেছি তারা নয়। শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তোমায় বিয়ে করেছি নাথিং ইলজ!
—- ওহ! রেয়ালি নাইস জোক বাট আমার হাসি আসছে না তো। স্টপ লায়িং ইপশু তুমি যদি শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে আমাকে বিয়ে করতে চেতে তবে সেই মুহূর্তে করলে কেনো? কারণ আমি তো তোমাকে এমনিতেও বিয়ে করতামই।
—- হাহ! যেই ছেলে এতো বছরের সম্পর্কে ধোঁকা দিতে তার জবানের ঠিক থাকবে সেই নিশ্চয়তা কে দিবে? তুমি তো চাইলেই বিয়ের দিন বা তার আগে বলতে পারতে আমাকে বিয়ে করবে না ইশাকে করবে তখন! সবটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কারণ একজন বিশ্বাসভঙ্গকারীকে আবার বিশ্বাস করা এট লিস্ট মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক আমি ঘুমোতে যাচ্ছি…
বলে আমি বেডরুমে চলে আসলাম। একটা কাঁথা দ্বারা নিজেকে সম্পূর্ণ মুড়িয়ে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। হ্যাঁ। কাব্যকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি এবং জানি সে আমাকে ধোঁকা দিবে না। তবুও নিজের ভালোবাসা ও স্বামীর সাথে কেউ অন্য এক নারীকে মেনে নেয়া কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেখানে আজকের রাতেও সে…
এদিকে কাব্যও ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। কষ্টে আজ হৃদয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মনের কথাগুলো বলার মতো কেউ পাশে নাই। আর কাকেই বা কি বলবে সে যেখানে নিজেই বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত! কোনদিকে যাবে তার জীবন! দুটো মানুষ একই ছাদের নিচে থেকেও বিরহ ব্যথায় কাতর হয়ে নিজেদের প্রথম দেখা এবং মধুময় অতিতটা ভেবে উঠলো…
অতিত,
আজ ভার্সিটিতে প্রথম দিন বলে নিলা ও আমি একসাথে যাবো প্লান করেছি। তাই একা এসেছি ওর সাথে… আজ যেহেতু ফাস্ট ক্লাস তাই একটু আগেই এসেছি। মূলত সম্পূর্ণ কলেজটা ঘুরে দেখতেই সময়ের আগে আসা। ভার্সিটিতে ঢুকছি সেই মুহূর্তে পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো। তাকিয়ে দেখি চারজন ছেলে এবং দুজন মেয়ে বাইকের উপর বসে আছে। কিন্তু তারা আমাদের ডাকছে কেনো! ভাবতেই ব্যস্ত ছিলাম তখন তারা আরেকদফা ডেকে উঠলো।
—- এই যে নীল পরীরা!
—- জ-জী আমরা?
—- আরে হ্যাঁ! হ্যাঁ! তোমাদেরই বলছি! তাড়াতাড়ি এখানে আসো নাহলে শাস্তি দ্বিগুণ কঠিন হবে বলে দিচ্ছি…
—- শ-শাস্তি! কিসের শাস্তি দিবেন আপনারা আমাদের? আমরা তো কোনো ভুল করিনি!
—- আরে বেবিজ এটা ভুলের শাস্তি না তো এটা সিনিয়ারদের দেয়া শাস্তি যাকে সাধারণ ভাষায় বলে র্যাগিং। আমরা তোমাদের র্যাগিং করবো অর্থাৎ আমরা যা বলবো সেটাই করতে হবে নয়তো শাস্তি আরও কঠোরপ্রকৃতির হবে।
—- র-র্যাগিং!
—- হ্যাঁ গো পাখি র্যাগিং। এখন ফাস্ট আসো দুজন এখানে। আচ্ছা তোমরা যেহেতু একদম বার্বিডল হয়ে আসছো দেন সারা ভার্সিটির সামনে হিজাব খুলে বেবিডলে ডান্স করবে এখন, বুঝলে?
—- আ-আমরা তো পারি না…
—- নো এক্সকিউজ স্টার্ট দ্য ডান্স অর ইলজ সারা ভার্সিটি ওড়না ছাড়া রাউন্ড দিতে হবে! তার চাইতে ভালো আমাদেরই দেখাও…
বলেই হুহা করে হাসতে লাগলো। এতক্ষণে নিলা এবং ওই ছেলেগুলোর কথা শুনে মেজাজটা খারাপ কেন নিকৃষ্ট হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কুচিকুচি করে বসিলার পানিতে ভাসিয়ে দিতে। নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে ফেললাম,
—- যাবো না আমি কি করবেন! আর নিলা তুইও যাবি না… চুপচাপ দাঁড়ায় থাক দেখি কত দম পোলার!
—- ক-কিন্তু ইপশু উনারা যদি…
—- সেটাই তো নিলা বেবি দেখি উনারা কি করে? আই মিন লেটস সি এরা কামড় দেয়ার কুকুর নাকি ঘেউঘেউ করার কুকুর!
—- তোমরা এই ভার্সিটিতে নতুন তাই চিনছো না আমাদের! সো দেরি না করে স্টার্ট দ্য ডান্স ফাস্ট এন্ড তোমাদের সমস্যা কোথায় সবার সামনে নাচতে? দেখতে তো মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েই লাগছে তোমাদের জন্য তো নাচানাচি, ছেলেদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি, ছেলে ফাঁসানো রেগুলার ব্যপার!
—- জানেন তো আপু যে যেমন আশাপাশের মানুষকেও তেমনই ভাবে। আপনার ফ্যামিলি হয়তো এসব চিপ শিক্ষা দিয়ে থাকে আমার পরিবার আমাকে দেয়নি। আপনি তো মেয়ে নামেরই কলঙ্ক… আপনার সামনে দুজন মেয়েকে অপদস্থ করা হচ্ছে আপনি প্রতিবাদ করবেন কি উল্টো তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন? ছিহ!
আমি কথাটা বলে শেষ করা মাত্রই একজন সুদর্শন ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছি। ধুর! আমি আ*** মতো এই সময়ে এসব ভাবিছি কেন!
—- কিরে নিউকামার্স আসতে না আসতেই র্যাগিং শুরু করে দিয়েছিস! কিন্তু সবার তো এখন ইজি এন্ড ফান মুডে হওয়ার কথা তাহলে তোরা এমন এংরি আর সিরিয়াস কেনো?
—- আরে বেবি বলিস না এই মেয়েটা আমাদের অনেককিছু শুনিয়েছ। আমরা তো জাস্ট একটা ছোট্ট ফান টাস্ক।দিয়েছিলাম সেজন্য আমাদের কুকুর বলেছে আবার আমাকে বলে আমার ফ্যামিলি নাকি চিপ আমি নাকি মেয়ে নামের কলঙ্ক।
ছেলেটির প্রশ্নে সেই মেয়েটি ন্যাকা কান্না করে বলা কথাগুলো শুনে ছেলেটি যা বলে তা শুনে আমি স্পিচলেস।
—- এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না আমাদের কুকুরের সাথে তুলনা করছো! বেয়াদব মেয়ে একটা! ছোট্ট একটা টাস্কই তো দিয়েছিলো তার জন্য এতোকিছু! সিনিয়ারদের সাথে কি করে কথা বলতে হয় সেই সেন্সটুকুও নেই…
কাব্য এটুকু বলেই ইপশির দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। ইশ! এটা তো সেই বিয়ে বাড়িতে দেখা মেয়েটাই যার জন্য আমি বিগত একটা সপ্তাহ ঠিকভাবে ঘুমুতে পারিনি। কিন্তু মেয়েটি ওদের যা যা বলেছে তার জন্য তো শাস্তি পেতেই হবে আফটার অল ফ্রেন্ডশিপ কামস ফাস্ট।
—- কাব্য কি ভাবছিস? এই মেয়েটা শুধুশুধু আমাদের এতোগুল কথা শুনালো আর তুই কিনা ওকে কিছু বলছিস না!
—- আরে দোস্ত আমি ভাবছি মেয়েটাকে কি শাস্তি দেয়া যায়! ইয়াপ, পেয়ে গিয়েছি তুমি এখন ভার্সিটির সামনের পুকুর থেকে এখনই ডুব দিয়ে আসবে। গো ফাস্ট বেবি অর ইলজ আমি যা করবো তা তোমার জন্য অবশ্যই আনন্দদায়ক হবে না।
ইপশি ছেলেটির কথাবার্তায় অবাক হয়ে গিয়েছে। ছেলেটি আমার হাত ধরে টানতে টানতে পুকুরের কাছে নিয়ে যেতে থাকে। আমি কিছু বলতেও পারছি না শুধু নিজেকে তার হাতের বন্ধন থেকে ছুটানোর প্রচেষ্টা করছি। কারণ আমার হাইড্রো ফোভিয়া থাকায় জলাশয়ের নাম আমি ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। একসময় ছেলেটি আমাকে ঠাস করে পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, পানির অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মাঝেই চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলবো এমন সময় কেউ পুকুর থেকে টেনে তুললো…
আধোআধো চোখে দেখলাম কাব্য আমায় কোলে তুলে পুকুরের পাশের বেঞ্চিতে শুয়িয়ে দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নিলা এসে আমাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। আমি তখনও কেশে যাচ্ছি সেটা দেখে নিলা আমার জন্য পানি আনতে গেলো। এর মধ্যেই খেয়াল করলাম ছেলেটির বন্ধুবান্ধব আমার দেখে মিটিমিটি হাসছে। অন্যসময় হলে হয়তো বেশকিছু কথা শুনিয়ে দিতাম কিন্তু এখন শরীরে নড়াচড়া করার শক্তিও নেই তার উপর এই অসহ্য কাশি! নিলা পানির বোতল আনতেই এক ঢুকে পুরো বোতল খালি করে ফেললাম। জেকে শান্ত করে আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম সবাই আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে, আর সেই দৃষ্টি অনুসরণ করতেই স্তব্ধ হয়ে পড়লাম। আজ সকালে সখ করে হিজাবের সাথে সাদা রংয়ের সুতি গোলজামা পড়ে এসেছিলাম, সেটা ভিজে এখন শরীরের ভাজ বোঝা যাচ্ছে। সবাই আমাকে এভাবে দেখছে ভাবতেই লজ্জা, ভয়, ঘৃণায় চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে আসলো। জড়সড় হয়ে বসে কাঁধে ঝুলানো ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।
কাব্য ভেবেছিলো ইপশি সাঁতার পারে কিন্তু যখন দেখলো সে ডুবে যাচ্ছে অজানা ভয়ে তার বুক কেপে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে ইপশিকে উঠিয়ে নিয়ে আসলো। “ধুর! মেয়েটার কি অবস্থা হয়েছে আরেকটু হলে তো… যদি কোনো অঘটন হয়ে যেতো তখন কি করতাম আমি? নাহ, আমি একটু বেশিই করে ফেলেছি।” এসব ভাবনার মাঝে খেয়াল করলো তার সামনে থাকা মেয়েটির চোখজোড়া অশ্রুতে ছলছল করছে এবং ওড়না আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছুক্ষণ ভেবেই বুঝতে পারলো এর কারণ। “শিট! আমি কি করে পারলাম একজন মেয়ের সাথে এমনটা করতে সেটাও যেই মেয়েকে কিনা আমি পছন্দ করি… মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাকে অনেক বাজে ভাবছে। আই নিড টু টক টু হার…”
কাব্য এগিয়ে ইপশির কাঁধে হাত রাখতেই সে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো এবং তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। যে দৃষ্টিতে বিদ্যমান ছিলো শুধুই একরাশ ঘৃণা ও ক্ষোভ। যা দেখে কাব্য মনে মনে ভাবলো, “যার মনে ভালোবাসার বীজরোপণ করতে চাই তার মনে ঘৃণার বীজরোপণ করে ফেললাম না তো!”
এর মধ্যেই ইপশি বলে উঠে,
—- মানুষ যে এতো নিকৃষ্ট হতে পারে তা আপনাকে না দেখলে জানতাম না। আপনার চাইতে তো আপনার বন্ধুরা শুধু বলেছিলো হিজাব খুলে সবার সামনে আইটেম সংয়ে নাচতে আপনি তো সোজা আমায়… যাই হোক কিছু বলার নাই শুধু বলবো আজ আমি যেই পরিস্থিতিতে কাল হতে পারে আপনার মা কিংবা বোন। যদিও দোঁয়া করবো তা যাতে নাহয়।
ইপশির কথায় অবাক হয়ে যায় কারণ তার ফ্রেন্ডসার্কেল নিউকামার্সের সাথে ছোট ছোট ফাজলামি করে সেটা তার জানা তবে এটা… লজ্জায় কাব্যর মাথা নত হয়ে যায় তারপরও কিছু বলতে নিবে, তার আগেই একজন ছেলে দৌড়ে এসে ইপশিকে প্রশ্ন করা শুরু করে।
—- ইপশু! নিলা বললো তুই নাকি পুকুরে পড়ে গিয়েছিস… একটু সাবধান থাকবি না? ধুর! আমারই দোষ কেনো যে তোকে একা ছাড়লাম, বড় ভাইয়া বা সানিফ ভাই জানলে আমার বারোটা বাজায় ফেলবে। যাই হোক পড়ে গিয়েছিলি কি করে?
—- উফফ! আরাভ লুক এট মি! আই এম টোটাল্লি ফাইন নাও। আর আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি নাকি একদল রাস্তার কুকুর পিছনে লেগেছিলো।
কথাটা যে কাব্যকে উদ্দেশ্য করে বলা তা সে বুঝতে পারলেও রিয়েক্ট করলো না। কারণ তার এখন নিজেকে এটারই যোগ্য মনে হচ্ছে।
—- যাকগে চল তোকে তোর বাড়ি দিয়ে আসি আজ আর ক্লাস করা লাগবে না। মামনি আর খালু জিজ্ঞেস করলে বলিস আজ ফাস্ট ডে তাই ক্লাস হয় নাই…
বলেই ছেলেটা ইপশির হাত ধরে নিয়ে গেলো কারণ অসুস্থতা এবং দুর্বলতার কারণে একা হাঁটতেও পারছে না। অন্যদিকে কাব্যর ইপশিকে অন্যের সাথে দেখে রাগে মন চাচ্ছে ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পাশের গাছে ঠাস করে এক ঘুসি মারলো। তবে এতে গাছের কিছু হলো না বরং তারই হাত কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো।
চলবে…
#রিলেশন_সিরিজ
#আমার_অপ্রিয়_আমি
#Ipshita_Shikdar (samia)
#পর্বঃ৪খ
❤
কাব্যর হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখে তার বন্ধুরা এগিয়ে গেলো কিন্তু কাব্যর চোখের দিকে তাকাতেই তারা পিছিয়ে গেলে। কারণ তার চোখজোড়া রাগে লাল হয়ে আছে। কাব্য তাদের রেগে অনেক শাঁসিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “আজ যদি তোরা আমার বন্ধু না হতি তোদের নিশ্চিত মৃত্যু হতো আমার হাতে…”
কাব্যর পিছন পিছন নিহামও গেলো। কারণ নিহাম জানে কাব্যর রাগ উঠলে সে এতো স্পিডে গাড়ি চালায় যে মুহূর্তেই অঘটন ঘটে যেতে পারে তাই কাব্যর পাশের সিটে বসে পড়লো। তার কাজে কাব্য একটু ভ্রু কুচকালেও আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। এই দুজন ছোটবেলা থেকেই বেস্টফ্রেন্ড আর বাকিরা কলেজ টাইম ফ্রেন্ড। তাই তাদের মধ্যকার বন্ডিংটাও অনেক মজবুত। বলার আগেই সব বুঝে যায়…
কাব্য উচ্চ বেগে গাড়ি ড্রাইভ করছিলো এমন সময় নিহাম বলে উঠলো,
—- মেয়েটা কে? এটাই কি ওই বিয়ে বাড়ির মেয়ে যার জন্য এক সপ্তাহ ধরে ঘুমুতে পারিস না, বাসা থেকে বের হস না, সারাটা সময় খিটখিটে মেজাজে থাকিস!
নিহামের কথা শুনে কাব্য দ্রুত গাড়ি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,
—- তুই কিভাবে জানলি আমি কোনো মেয়েকে পছন্দ করি… আর ভার্সিটির ওই মেয়েই সে তাই বা কি করে বুঝলি! আমি তো তোকে বলি নাই কিছু নাকি।
—- কাম অন ব্রো তোর মনের কথা আমি বুঝবো না তা কি করে হয়। তাছাড়া যেই ছেলে সবসময় হাসিঠাট্টায় আর মজমাস্তিতে মেতে থাকে সে হঠাৎ বিয়ে থেকে এসে এমন চুপচাপ, খিটখিটে, গম্ভীর হয়ে গেলে যে কেউই খেয়াল করবে। এখন ফুল স্টোরি বল!
—- রাত্রি আপুর বিয়ের জন্য গাজিপুরের রেজর্ট বুক করা হয়েছিলো এন্ড সেখানেই ওই মেয়ে মানে সামির সাথে দেখা হয়।
—- সামি? মেয়েটার নাম যে ইপশি বললো হয়তো ভালো নাম। যাকগে তারপর ডিটেইলস বল!
কাব্য বলতে শুরু করলো,
—- রাত্রি আপুর যেহেতু ডেস্টিনেশন ওয়েডিং সেহেতু উনার শশুরবাড়ির লোকও সেখানেই থাকছিলো। এঙ্গেজমেন্টের দিন আমি গেস্টদের দেখভাল করতে ব্যস্ত ছিলাম এমন সময় হঠাৎ সব লাইট অফ হয়ে গেলো আমি কি হচ্ছে দেখার জন্য পিছনে ঘুরতেই থমকে গেলাম। এক ফালি স্পট লাইটের মাঝে চারপাঁচ জন মেয়ে নাচতে নাচতে বরকে নিয়ে আসছে। মিথ্যে বলবো না প্রতিটি মেয়েই অপসরীর মতো সুন্দর ছিলো এমন কি ইপশির চাইতে বেশি। তবুও চোখজোড়া আটকে যায় লাল পাড়ের হলুদ রংয়ের শাড়ি পড়া মেয়েটির দিকে। লাফালাফিতে মেয়েটার মুখশ্রী এলোচুল দ্বারা ঢেকে গিয়েছিলো যার জন্য তাকে দেখার আরও কৌতুহল কাজ করছিলো। আচমকা মেয়েটা নিজের একহাত দিয়ে মুখের উপরে থাকা চুলগুলো সরাতেই দেখি সে যে এক শ্যামবতী। কাজল কালো চোখে তার দুষ্টুমি খেলা করছে, টকটকে লাল লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, হাত জোড়ার মাঝে দোলা খাচ্ছে রঙিন চুড়ি সবমিলিয়ে দেখতে অমায়িক না লাগলেও বেশ মানিয়েছিলো তাকে… যা আমার মন কাড়তে হয়তো যথেষ্ট ছিলো।
সবাই আসার পর শুরু হলো ছেলেমেয়েদের একসাথে নাচানাচি এবং হইচই। কিন্তু মেয়েটাকে এর মাঝে কয়েকজনের ডাকাডাকির পরও আসতে দেখলাম না। অবশ্য আচারণে বুঝতে পারছিলাম সে কমফোর্টেবল নয় এসবে… প্রায় যতদিন সেখানে ছিলাম বিয়ের জন্য ততদিন মেয়েটাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করতাম। তার আচার আচারণে বুঝতে পারতাম সে ভিষণ মুডি, রাগ নাকের আগায় থাকে, ছেলেদের কিংবা অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে অপছন্দই করে তাই মেয়েটার সাথে কথা বলার প্রয়াশও করিনি। অবশ্য প্রয়োজনও মনে করিনি বিকজ আই ওয়াজেন্ট টেকিং দিস ফিলিংস সিরিয়াসলি। তবে আমি জানি না কেনো যেনো সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করতো।
—- আর সেই মুগ্ধতাতেই এতো ফেঁসেছিস যে ভালোই বেসে ফেলেছিস। সেটাও এতোটা যে তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারছিস না।
কাব্য চোখজোড়া বদ্ধ করে নেশাযুক্ত স্বরে বলে উঠলো,
—- “তাহাতে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে ভুলে গিয়েছি,
তাহাতে মগ্ন হয়ে নিজেকে নিঃস্ব করেছি,
তাহাতে মেতে ওঠে নিজেকে নিশ্চুপ করেছি,
এতোটাই তাহার মাঝে ব্যস্ত হয়েছি যে,
এখন রাতদিন আমার দোয়ায় আছে শুধুই সে।”
—- ওরে আমার প্রেমিক পুরুষ! কাব্য তুই তো প্রেমে পড়ে পুরো কবি হয়ে গেছিস। কিন্তু তোমার প্রেমের নৌকা তো মাঝ নদীতে ডুবে যাওয়ার পথে এখন সেই প্রেম তরীর মাঝি হিসেবে তুই কি করবি?
উত্তরে কাব্য শুধু বাকা হাসলো। যা দেখে নিহাম খুব ভালোভাবেই বুঝে নিলো কাব্য যেকোনোভাবে মেয়েটাকে নিজের করবে তাই সেও হেসে দিলো।
বর্তমানে,
দুজন অতিতের কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে টেরই পায়নি। দরজা ধাক্কানোর শব্দে একইসাথে ঘুম ভাঙলো দুজনার। দুজনই উঠে দরজার সামনে এসে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
—- ভাই! বউমনি! উঠেছো কি তোমরা?
ইপশি নতুন বউ এই বাড়িতে তাই জবাব না দেয়াই শ্রেয় মনে করলো। অগত্যা কাব্যই উত্তর দিলো,
—- উঠেছি আমরা! তুই আম্মুকে যেয়ে বলিস আমরা ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই নিচে নামবো।
ইপশি যেনো কাব্যর এই কথাটির অপেক্ষাতেই ছিলো। সে কাব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লাগেজ থেকে একটা নীল পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। তার ভাব দেখে মনে হলো ঘরে সে ছাড়া আর কেউ নেই।
তার কাজে কাব্য মনে মনে ভেবে ওঠে,
—- এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না তোমার ভিজে চুলের পানির ছিটেতে আমার ঘুম ভাঙবে। আমি উঠে এসে তোমায় জড়িয়ে নিবো তোমায় বাহুডোর। আর তুমি লজ্জা পেয়ে দূরে সরে রাগ দেখাবে। এভাবেই খুনিশুটি থেকে মেতে থাকবে সারাটা সকাল। কিন্তু দেখো আজ মেতে আছি আমি শুধুই দীর্ঘশ্বাসে…
গোসল করে বের হয়ে দেখি বেডরুমে কাব্য নেই তাই নিচে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বসে পড়ি। শত হোক শশুরবাড়ি আমার এটা নিজের বাড়ি তো না যে আগের মতো অগোছালো থাকতে পারবো। একবিন্দু কাজল, এক জোড়া কানের ঝুমকো ও একমুঠো চুড়ি দ্বারাই তৈরি হয়ে নিলাম। একবার আয়নাতে দেখে নিলাম নিজেকে। দেখতে ভালো না লাগলেও খারাপ লাগছে না… মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিলাম। আমি বাইরে হিজাব পড়লেও বাসায় তেমন একটা মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলতাম না। তবুও এটা যে শশুরবাড়ি।
রুম থেকে বের হবো ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে এমন সময় রুমের বাম পাশের দরজাটা খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকাতেই থমকে যাই…
কাব্যর বেডরুমের বাম পাশের দরজার দ্বারা সরাসরি তাদের স্টাডিরুমে যাওয়া যায়। ইপশি বেডরুমের ওয়াশরুমে যাওয়ায় কাব্য স্টাডিরুমের ওয়াশরুমে যায়। সেখান থেকে শাওয়ার নিয়ে টাওয়াল জড়িয়ে ঘরে আসে। তার নগ্ন বুকে বিন্দু বিন্দু পানি কণা জমে আছে। ইপশি প্রথমবারের মতো তাক্র এভাবেদেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
কাব্য তার সদ্যস্নাত চুলগুলোর পানি হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বেডরুমে ঢুকছিলো। হঠাৎ সামনে চোখ যেতেই একরাশ মুগ্ধতা জড়িয়ে নেয় তাকে… তখনই খেয়াল করে তার শ্যামবতী পরীটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তাই দুষ্টু হেসে বলে,
—- আমি জানি আমি অনেক সুন্দর তাই বলে আমার দিকে এমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকাতে হবে নাকি! আরে জান আমি তো পুরোটা তোমারই এভাবে চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছো কেনো?
কাব্যর কথায় আমার হুশ আসে এবং পুনরায় গম্ভীরতা মিশে যায় মনে। তাই গম্ভীর গলায় বলে ফেলি,
—- অনেক সময় প্রিয় জিনিসগুলো নিজের হয়েও তার উপর অধিকার থাকে না। চোখজোড়ার দ্বারা দেখার প্রশান্তি থাকলেও ধরা ছোঁয়া যায় না। কারণ হৃদমাঝে কাজ করে এক অদ্ভুত দ্বীধা।
কাব্য ইপশির এমন ধাঁধাময় কথার অর্থ বুঝতে পারে তাই এর উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই দরজায় আবার করাঘাতের শব্দ। এবার ইপশি যেয়ে দরজা খুলতেই দেখে তার শাশুড়িমা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
—- আজ তো বউমার এ বাড়িতে প্রথমদিন তাই আমি এসেছি তোদের নিচে নিতে। কারণ জানিসই তো বড় ফুফুই কেমন মানুষ কোনটাতে খুঁত ধরে বসে বলা যায় না।
—- ঠিক আছে আম্মু, তোমার যা ভালো মনে হয় তুমি তা-ই করো।
—- চলো তাহলে বউমা!
মিসেস কণা রহমান ইপশির হাত ধরে নিচে নিয়ে গেলেন। কাব্যকে এতো বছরের সম্পর্ক থাকার পরও কখনো তার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি ইপশির তবে প্রথম দেখায়ও বেশ ভালোই লেগেছে তাকে। নিজের মায়ের মতোই সরল-সোজা ধরনের নারীই লেগেছে কাব্যর মাকে।
সে যাই হোক ইপশিকে নিচে এনে ডাইনিং টেবিলে বসাতেই কাব্যর ফুপিমা তিন্নি বেগম ভেঙচি কেটে বললেন,
—- কি দিনকাল আসছে খোদা! কোথায় বউরা সকাল সকাল উঠে চা, নাস্তা বানাবে, সবাইকে ডেকে তুলে পরিবেশন করবে কিন্তু তা না… একেকজনের ঘুমেরই শেষ হয় না! হুহ!
তার কথায় তার স্বামী বলে উঠলেন,
—- আমাদের বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো প্রতিটা দিন তো কাজের লোকের হাতেই নাস্তা খাই। আর যদি তুমি কোনোদিনি রান্নাও করো, সেদিন ব্রেকফাস্ট করতে হয় লাঞ্চ টাইমে। কারণ তুমি তো দশটার আগে ঘুম থেকে উঠো না।
ফুপার কথায় বাড়িসুদ্ধ লোক হেসে উঠলেও আমার লাভলি ফুপি শাশুড়ি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো যা দেখে উনি কিছুই হয়নি এমন একটা ভান ধরে খাওয়া শুরু করে দিলো। তারপর কেউ আর কিছু বললো না বরং যে যার মতো খেতে লাগলো।
চলবে…