কনে বদল
পার্ট – ৬
Taslima Munni
যাই বলো ভাই,তোমার খেয়াল তো ছিলো না সেটা আমি জানি। তার সাথে অবহেলাও ছিলো।
মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কেবল কষ্ট পেয়েছে। নিজের দিকে একটুও খেয়াল করেনি।
মাহির, ইভা কথা বললেও সারোয়ার সাহেব গম্ভীর ভাবে বসে রইলেন।
– মাহির, তুমি আজকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। আমি নিজে গিয়ে কথা বলবো ডাক্তারের সাথে।আমার বন্ধু, অনেক বড় ডাক্তার। কথা হয়েছে ওর সাথে। সেখানেই যাবো।
– ঠিক আছে, বাবা।
শিখাকে নিয়ে সারোয়ার সাহেব, মাহির ডাক্তারের কাছে গেলো। সবকিছু দেখে ডাক্তার শিখাকে ইমার্জেন্সি হসপিটালাইজড করলো।
পনেরো দিন ধরে শিখা হাসপাতালে ভর্তি। শিখার শ্বশুর, ইভা আছে শিখার সাথে। মাহির প্রতিদিন সকালে একবার দেখে যায়, আবার রাতে ফেরার সময় শিখাকে দেখে যায়।
বন্দি শিখা আরও বেশি বন্দী হয়ে গেছে। চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে ছটফট করছে। এখানে দম আরও বন্ধ হয়ে আসছে।
– ভাবি!
ইভা শিখার শিয়রে বসে আছে। একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো
– কিছু বলবে?
– এখানে আর কতদিন থাকতে হবে?
– এইতো, আর কিছু দিন। তুমি সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
– আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না,তাই না?
শিখা ইভার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
– ছিঃ শিখা! ওসব বাজে কথা একদম বলবে না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
– আমার কি হয়েছে, ভাবি?
– এইযে খাওয়া দাওয়া করোনি,নিজের খেয়াল রাখোনি! এইজন্যই অসুখ করেছে।
– আমাকে এখান থেকে নিচে চলো।বাড়িতে নিয়ে চলো। দেখবে আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো।
– আচ্ছা নিয়ে যাবো। এখন কথা না বলে চুপ করে ঘুমাতে চেষ্টা করো।আমি তোমার পাশেই আছি।
– আমার জন্য কত কষ্ট করছো তুমি।
– আমি তোমার বোন না?
– হা,তুমি আমার বোন।
– তো বোনের জন্য এইটুকু করবো না? আচ্ছা আমার অসুখ হলে বুঝি তুমি আমার জন্য করবে না!! বুঝেছি।
কপট অভিমানের সুরে বললো ইভা।
শিখা ইভার একটা হাত ধরে
– তুমি আমার বোন।সত্যিকারের বোন।
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আমার মা কি জানে আমি এখানে?
– না।তোমার মা অসুস্থ ছিলেন। তাই উনাকে কিছু বলতে বাবা নিষেধ করেছেন। উনি আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠুক তখন বাবা নিজেই বলবেন।
– কি হয়েছে মায়ের?
– তেমন কিছু না। আগের অসুখই, সাথে জ্বর ছিলো। কিন্তু তোমার মা টেনশন করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন আবার এখানেও চলে আসতে চাইবেন। তাই বাবা বলেনি কিছু।
– ভালো করেছেন।
সারোয়ার সাহেবকে শিখা অনেক অনুরোধ করলো তাকে এখান থেকে নিচে যেতে।
শিখা কেমন অস্থির হয়ে গেছে এখান থেকে বের হবার জন্য।।
রাতে মাহির একটু দেরি করে আসলো। কারন শুক্রবার সারাদিন সে শিখার কাছেই থাকে। তাই বৃহস্পতিবার একটু দেরি করেই আসে।
শিখা ঘুমিয়ে আছে। মাহির শিখার পাশে এসে বসলো। ঘুমন্ত শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতর টা হু হু করে উঠলো।
নিজের অজান্তেই মাহির শিখার একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। এই প্রথম মাহির শিখার হাত স্পর্শ করলো। তাও আবার যখন শিখা হাসপাতালের বিছানায়!!
শিখার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার পরে দেখলো মাহির ওর হাত ধরে বসে আছে।
শিখার চোখ ছলছল করছে।
– আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান না!!
– নিয়ে যাবো।আরেকটু সুস্থ হয়ে যাও।তারপর।
– এখানে থাকলে আমি সুস্থ হবো না। দম আটকে মরে যাবো।।
– আচ্ছা নিয়ে যাবো।ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিয়ে যাবো, চিন্তা করো না।
– আপনি অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।
– কিভাবে?
– শুনেছি ভাগ্যবানের বউ মরে। আপনিও ভাগ্যবান হয়ে যাবেন। অবশ্য বউ আর হতে পারলাম কই!
– কেন এইসব কথা বলছো? তোমার কিচ্ছু হবে না। আর এই কথাটা দ্বিতীয় বার যেন তোমার মুখে না শুনি।
– আমি খুব অপয়া! যেখানে যাই সবার উপর ঝামেলা হয়ে যাই।আপনার জীবনটা আমার জন্য কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।
– হা এলোমেলো হয়ে গেছে। এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে এলোমেলো জীবন গোছানো দায়িত্ব নিতে হবে তোমার।
শিখা মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো। মুখে কিছুই বললো না।
মাহির শিখার মাথায় হাত রাখে। শিখা অনুভব করে মাহিরের স্পর্শ। মনে হয় স্বপ্নের মতো। কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না শিখার।পাছে স্বপ্ন ভেঙে যায়!!
শুধু টপটপ করে দুই ফোটা পানি চোখ থেকে দু’দিকে গড়িয়ে পড়লো।
মাহির অনেক সময় শিখার পাশে বসে থাকলো।কেন জানি উঠতে ইচ্ছে করছে না মাহিরের।
শিখা কিছুতেই হাসপাতালে থাকতে চাইছে না। সবাইকে অনেক অনুরোধ করলো তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু যখন দেখলো কেউ নিয়ে যাচ্ছেই না,তখন জিদ ধরে বসলো।
কিছুতেই ঔষধ মুখে তুলছে না।এখান থেকে না নিয়ে গেলে ঔষধ খাবে না বলে জিদ ধরে আছে।
– বাবা, শিখাকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না।জিদ ধরে আছে বাড়িতে যাবার জন্য। অস্থির হয়ে গেছে মেয়ে টা।।
– হুম।
গম্ভীরমুখে বললেন সারোয়ার সাহেব।
– দেখি ডাক্তারের সাথে কথা বলে কি বলে।মাহির আসুক।
তখনই মাহির আসলো। ইভা মাহিরকে দেখে
– অইতো মাহির এসে গেছে।
– বাবা, ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।কালকেই রিলিজ দিয়ে দিবে।
– রিলিজ দিলেই তো হবে না। বাড়িতে নিয়ে কি এই চিকিৎসা করা যাবে।
– কিছু করার নেই বাবা,এখানে রাখলে অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হবে না
তাছাড়া শিখা এখানে থাকতেই চাইছে না। ওকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি লাভ?
– এটা ঠিক ই। আচ্ছা যাবার ব্যবস্থা করো।
– আচ্ছা ,আমি এম্বুল্যান্স ঠিক করে রাখবো।
– তুমি কি যাবে আমাদের সাথে?
– না বাবা, আমার আরও আট দশ দিন লাগবে। শেষ হলেই যেতে হবে। এছাড়া যাবার উপায় নেই।
– ঠিক আছে।
পরদিন শিখাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলেন সারোয়ার সাহেব আর ইভা। এম্বুল্যান্সের পিছনের গ্লাস গলিয়ে এই শহরের বড় বড় অট্টালিকার ফাঁকে একটু আকাশ উঁকি দিচ্ছে। শিখা চোখ খুলে সেই আকাশ দেখছে।
যখন শহর থেকে বেরিয়ে এলো তখন আকাশ আরও স্পষ্ট দেখতে পেলো।
এই আকাশ দেখে যেন শিখার মনে একটা স্বস্থি এলো। এই শহরকে বিদায় জানিয়ে শিখা চললো বাড়ির পথে।
মনে হচ্ছে শিখার জন্যেও সেই পথ যেন অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে।
অবশেষে শিখা বাড়ি পৌছালো।
আজ পাঁচ দিন হলো শিখা চলে গেছে বাড়িতে। মাহির ঢাকায় থেকে গেলো।
কিন্তু কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছে না। শিখা যখন হাসপাতালে ছিলো দিনে দুবার দেখা করতে গেছে।
কিন্তু এখন পুরো বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।এই বাসার প্রতিটি জিনিসের শিখার ছোঁয়া আছে। প্রতিটি জিনিস নিজের হাতে সাজিয়েছিলো।
মানুষ নিজের অজান্তেই কারো অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই মানুষটাকে যতই অবহেলা করা হোক, তার উপর যতই বিরক্তি আসুক,ঘৃণা করুক , তার অনুপস্থিতিতে তার অভাবটা অনুভব হয়।
বাড়িতে একটা বিড়াল পুষলেও তার উপর মায়া পড়ে যায়। আর শিখা তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ!!
শিখা নিজের হাতে বিছানা গুছিয়ে রাখতো,মাহিরের জামা-কাপড় ধুয়ে রাখতো।খুব ভোরে উঠে মাহিরের জন্য নাস্তা তৈরি করতো, অফিসে যাবার আগে কাপড় আয়রন করে দিতো।।
কিন্তু এই কদিনে পুরো বাসা দেখে মনে হচ্ছে -এটা একটা গোডাউন! এখানে সেখানে সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পরে টেবিলে নাস্তা তৈরি করা থাকে না।
অফিস থেকে ফেরার পরে কেউ একগ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয় না।
মাহির শিখার অভাব খুব অনুভব করছে। একটা মানুষের চেহারা তার ভেতরের সব সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিতে পারে না।
সুন্দরকে চিনতে হয়,জানতে হয়!!
শিখার অবর্তমানে মাহির এটা ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।
চলবে….