তোমার রাঙা উঠানে,part:3,4
writer:Alo Rahman
part:3
.
.
.
দুপুরবেলা।ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় ভেজা চুল এলিয়ে বসে আছি।বারান্দায় রোদ পরেছে।আমি রোদেই বসে আছি।আমার কোলের উপরে একটা বই।মাঝে মাঝে বইটার পাতা উল্টাচ্ছি।যদিও আমি বইটা পড়ছি না।একটা বই সাথে নিয়ে বসে থাকার অনেক সুবিধা।কেউ আসলে পড়ার ভান করা যায়।তার সাথে কথায় যোগ দিতে হয় না।
শুভ্র ভাই নিঃশব্দে এসে আমার পাশে বসলেন।শুভ্র ভাই ঘরে ঢুকতেই আমি টের পেয়েছি।কিন্তু সেটা শুভ্র ভাইকে বুঝতে দিতে চাইছি না।এমনভাবে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছি যেন আমি উনাকে দেখতে পাই নি।উনি বলে উঠলেন,
“তুই কি বিয়েতে রাজি?”
.
আমি না শোনার ভান করে বসে আছি।মানে ভাবখানা এমন,যেন আমি খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছি।আশেপাশের কিছুই আমার কানে ঢুকছে না।
শুভ্র ভাই বললেন,
“উত্তর দিচ্ছিস না কেন?তোকে কিছু জিঙ্গেস করছি আমি।”
.
আমি এবারও কথা বললাম না।শুভ্র ভাই এবার আমার থেকে বইটা টেনে নিয়ে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আরেহ,এটা কি করলেন আপনি?আমার বইটা ফেলে দিলেন কেন?”
.
শুভ্র ভাই আমাকে বারান্দার রেলিং এর সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“অভিনয় করিস আমার সাথে?আমি খুব ভালো করে জানি যে তুই পড়ছিলি না।আমার কথার উত্তর দিলি না কেন?”
.
আমি কাঁদোকাঁদো মুখে বললাম,
“শুভ্র ভাই,আমাকে ছাড়ুন।আমার লাগছে।”
.
শুভ্র ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।শীতল গলায় বললেন,
“তুই বিয়েতে রাজি কিনা বল।”
.
“এখনো রাজি হই নি।তবে ছেলেকে দেখার পর রাজি হয়ে যাব।”
.
“মানে!?তুই নিশ্চিত যে ছেলেটাকে তোর পছন্দ হবে?”
.
“পছন্দ হবে না কেন?ফুল বাবা নিজে পছন্দ করেছেন।আমি ফুল বাবাকে ভরসা করি।উনি নিশ্চয়ই খারাপ কোনো ছেলেকে পছন্দ করেন নি।”
.
“উফ!আলো তুই বুঝতে পারছিস না।বাবার পছন্দ আর তোর পছন্দ তো এক নাও হতে পারে।তোর যদি ছেলেটাকে পছন্দ না হয়?”
.
“হবে।”
.
শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর ঘর থেকে চলে গেলেন।শুভ্র ভাই যেতেই ফুল মা আমার কাছে এলেন।
বললেন,
“কিরে,আলো?শুভ্রকে যেতে দেখলাম।ও কি বলল তোকে?”
.
“কিছু না,ফুল মা।শুভ্র ভাই আমাকে বিয়ের জন্য শুভকামনা জানাতে এসেছিল।”
.
“ওহ!আচ্ছা নিচে চল,খাবি না?”
.
“তুমি যাও।আমি আসছি।”
.
ফুল মা আমার হাত ধরে বললেন,
“আলো,ওরা ফোন করেছিল।”
.
“ওরা কারা?”
.
“আরেহ বাবা,ছেলের বাড়ি থেকে।ছেলেটা কাল তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছে।তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”
.
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম,
“না,ফুল মা।”
.
ফুল মা হাসলেন।আমাকে আদর করে বললেন,
“তুই সত্যি আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে।তাড়াতাড়ি খেতে আয়।”
.
আমি ফুল মার সাথে নিচে গেলাম।দাদীমনির পাশে বসে চুপচাপ খেতে লাগলাম।ফুল বাবা আমার দিকে একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আলো মা,এই যে ছেলের ছবি।তুই দেখে নিস।”
.
আমি মৃদু হেসে ছবিটা নিলাম।দাদীমনি বললেন,
“ভালো করে দেখিস,বুবু।ছেলে কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে।”
.
শুভ্র ভাই হুট করে বলে দিলেন,
“এতই যখন সুন্দর তখন তুমিই বিয়ে করে নাও,দাদীমনি।”
.
দাদীমনি মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
“মরণ!কথার ছিরি দেখ।”
.
ফুল মা আমার প্লেটে মাছ তুলে দিলো।সাথে সাথেই শুভ্র ভাই সেটা ছোঁ মেরে নিজের প্লেটে নিয়ে নিলো।আমি কিছুই বললাম না।কারণ এটা শুভ্র ভাইয়ের ছোট বেলাকার স্বভাব।আমার পাতে দেওয়া মাছ সবসময় উনিই ছিনিয়ে নেন।ফুল মা রেগে গিয়ে বললেন,
“শুভ্র!মেয়েটা কদিন পরে চলে যাবে।এখনও তুই এভাবে কেড়ে নিবি?”
.
ফুল বাবা বললেন,
“সত্যি!আলো চলে গেলে বাড়িটা বেমানান হয়ে যাবে।আমাদের পরিবার অন্ধকার হয়ে যাবে।”
.
শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“তোমরা চাইলে বাড়িটা আলোকিত করে রাখতে পারো।”
.
ফুল মা বললেন,
“মানে?”
.
“মানে,আলো চলে যাবে ভেবে খারাপ লাগছে তোমাদের?”
.
“হ্যাঁ,লাগছে।”
.
“তাহলে এক কাজ করো।তোমরা আলোকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও।আলোর বিয়েও হবে।আর ও এই বাড়ি ছেড়েও যাবে না।”
.
কথা বলা শেষ করে শুভ্র ভাই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল।সবাই শুভ্র ভাইয়ের যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।আমি নিজেও খাওয়া বন্ধ করে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি।
ফুল মা ফুল বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শুভ্র কি বলে গেল?”
.
ফুল বাবা হঠাৎ হেসে উঠে বললেন,
“আরেহ,তুমি তোমার ছেলেকে চেন না?ও মজা করেছে।”
.
ফুল মা বিরবির করে বললেন,
“মজা!ইশ,যদি সত্যিই এমন হতো!”
.
আমি আবার খাওয়ায় মন দিলাম।ফুল বাবা ঠিকই বলেছেন।এটা নিশ্চয়ই মজা করে বলেছেন শুভ্র ভাই।আমার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
.
.
.
.
ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আমাকে ডাকছে।আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম।দেখলাম বিন্তি আমার বিছানায় বসে আছে।নিশ্চয়ই ও ডাকছিল এতক্ষণ।আমি উঠে বসতেই বিন্তি বলল,
“আর কতক্ষণ ঘুমাইবেন,আপা?সেই দুপুর থাইকা ঘুমাইতেছেন।”
.
আমি হাই তুলে বললাম,
“আমার আরও ঘুম পাচ্ছে,বিন্তি।তুই ডাকলি কেন?”
.
“নিচে চলেন।আপনের ফুল বাবা যে আপনের হাতের চা খাইতে বইসা আছে।”
.
“আসছি।যা তুই।”
.
আমি চোখেমুখে পানি ছিটালাম।আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম চোখ এখনও লাল হয়ে আছে।আমি আসলে দুপুরবেলা খুব কান্নাকাটি করেছি।যার কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুঝতে পারি নি।
আমি আরও কিছুক্ষণ চোখে পানি দিলাম।সুন্দর করে চুল বাঁধলাম।নিচে নেমে দেখলাম,ফুল বাবা বসে আছেন।আমি গিয়ে ফুল বাবার হাত জড়িয়ে ধরে পাশে বসে পরলাম।ফুল বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ঘুম হলো?”
.
“হ্যাঁ,হয়েছে।”
.
“ছেলেটার ছবি দেখেছিস?”
.
আমি আসলে ছবিটা দেখি নি।কিন্তু তবুও মিথ্যা বললাম।
“হ্যাঁ,দেখেছি।”
.
“কেমন মনে হলো?”
.
“ভালো।যাই,তোমার চা নিয়ে আসি।”
.
আমি সোজা রান্নাঘরে ঢুকলাম।চা বানাচ্ছিলাম।হুট করে শুভ্র ভাই এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন,
“স্বপন সরকার।গায়ের রঙ শ্যামলা,বাবার ফুড প্রোডাক্টের বিজনেস আছে,অনেক বড়লোক,বয়স ৩২,হালকা ভুড়ি আছে,আর হাইট হলো ৫’৭”।আর আমি হলাম ৬’২”।তার মানে আমার চেয়ে কত ইঞ্চি খাটো বল তো?”
.
আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকালাম।উনার হাতে একটা ছবি।উনি ছবিটা আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরে বললেন,
“এই ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েছে,আলো?ছিহ!তোর চয়েস এতো খারাপ হলো কবে থেকে?”
.
আমি ছবিটা হাতে নিয়ে বললাম,
“ছিহ ছিহ করছেন কেন?ভালো করে দেখুন,লোকটার চেহারা কত মায়াবী।”
.
“আচ্ছা!মায়াবী?”
.
“হ্যাঁ,মায়াবী।আর আমার হাইট তো ৫’৩”।আমার জন্য ৫’৭” ই ঠিক আছে।”
.
“খুব না?খুব বিয়ে করার শখ জেগেছে তোর?”
.
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ।”
.
“আলো শোন,এই ছেলের বাপ বিরাট বড়লোক।বড়লোকের ছেলেরা ভালো হয় না।”
.
“কিন্তু এই ছেলে নিশ্চয় ভালো।”
.
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুই দেখি খুব নিশ্চিন্ত!”
.
“তো নিশ্চিন্ত হবো না কেন?আর আপনি এই ছেলের এতো খুঁত কেন বের করছেন বলুন তো?ফুল বাবা তো বলেছে যে ছেলেটা খুব ভালো।”
.
“আমি কোথায় খুঁত বের করছি?আমি তো এমনি বলছিলাম।তুই যাকে খুশি বিয়ে কর,আমার কি?তুই বিদায় হলে আমি বাঁচি।”
.
আমার চা বানানো শেষ।আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললাম,
“ঠিক আছে।আমি ফুল বাবাকে বলবো আমাকে যেন তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেয়।”
.
কথাটা বলেই চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।পিছনে পিছনে শুভ্র ভাইও এলেন।আমি ফুল বাবাকে চা দিয়ে সেখানে বসলাম।ফুল মা হাতে করে একটা নীল শাড়ি নিয়ে এলো।আমার গায়ে শাড়িটা ফেলে বলল,
“আলো,কাল তুই এটা পরে যাস।তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।”
.
শুভ্র ভাই বললেন,
“কাল ও কোথায় যাবে,মা?”
.
“কোথায় আবার?ছেলেটার সাথে দেখা করতে।”
.
“একটু সাজিয়ে পাঠিয়ো,মা।নইলে এই পেত্নিকে উনি নাও পছন্দ করতে পারেন।”
.
“চুপ কর।পেত্নি মানে?আমাদের আলো যথেষ্ট সুন্দরী।”
.
“হ্যাঁ,পেত্নি সুন্দরী।”
.
কথাটা বলে শুভ্র ভাই হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেলেন।আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।উনার চোখে কি কখনো সুন্দর হতে পারবো না আমি?
.
চলবে……
#তোমার রাঙা উঠানে
#writer:Alo Rahman
#part:4
.
.
.
রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে আছি।আমি ঘুমাই নি।তবে ঘুমের ভান করছি।মটকা মেরে পরে আছি বিছানায়।আমাকে একবার একবার করে সবাই ডেকে গেছে।শুধু শুভ্র ভাই ছাড়া।আমি কারোর ডাকেই সাড়া দিচ্ছি না।
আমার যে খেতে ইচ্ছা করছে না ব্যাপারটা তেমন নয়।আমি যাচ্ছি না শুভ্র ভাইয়ের উপর রাগ করে।ঠিক রাগ নয়,বোধহয় অভিমান।বিকালবেলা শুভ্র ভাই আমাকে পেত্নি বলেছিল বলেই আমার মন খারাপ হয়েছে।তাই ঠিক করেছি,শুভ্র ভাইয়ের সামনে আমি একদমই যাব না।
বাইরে সবার কথাবার্তার আওয়াজ কমে আসতেই আমি বিছানায় উঠে বসলাম।নিচে নেমে গিয়ে দেখলাম ফুল মা সবকিছু গুছিয়ে রাখছেন।আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন,
“উঠেছিস?এতক্ষণ যে ডাকলাম,সাড়া দিচ্ছিলি না কেন?”
.
আমি একটা চেয়ার টেনে বসলাম।বললাম,
“কখন ডেকেছ?শুনতে পাইনি তো।”
.
“তুই তো কখনো এভাবে ঘুমাস না,আলো।দুপুরে এতক্ষণ ঘুমিয়েছিস।আবার সন্ধ্যা থেকে এভাবে ঘুমাচ্ছিস!তোর শরীর খারাপ নয় তো?”
.
হঠাৎ শুভ্র ভাই কোথা থেকে চলে এলো।আমার পাশের চেয়ারে বসেই বলে উঠলেন গা জ্বালানি কথা।
“ওর কিছুই হয়নি,মা।ও আসলে ঢং করছিল।”
.
আমি বিরক্ত চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম।কিন্তু উনার কোনো ভাবান্তর হলো না।ফুল মা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“এসব কি ধরণের কথা,শুভ্র?”
.
“এসব সত্যি কথা,মা।ও মোটেও ঘুমাচ্ছিল না।মটকা মেরে পরেছিল।”
.
আমি হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠলাম,
“হ্যাঁ,আমি তো সবসময় ঢঙই করি।”
.
উনি দাঁত কেলিয়ে বললেন,
“যাক,এতদিনে সত্যি কথাটা স্বীকার করলি তাহলে।”
.
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
.
“আমার বাড়ি,আমি যেখানে খুশি যাব।তোকে বলতে হবে নাকি?”
.
আমি দমে গেলাম।ফুল মা বললেন,
“শুভ্র,তুই এভাবে কথা বলবি না।যা,ঘরে যা।”
.
শুভ্র ভাই উঠে দাঁড়ালেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এই যে ঢঙী কন্যা,আমার ঘরে এক কাপ চা নিয়ে আয়।”
.
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন।ফুল মা বললেন,
“আলো,চা আমি বানাচ্ছি।তুই গিয়ে দিয়ে আয়।”
.
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
“আমি বারবার এতো উপর নিচ করতে পারবো না,ফুল মা।আমার খিদা পেয়েছে।”
.
ফুল মা আমার কথার ধরণে হেসে ফেললেন।খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন,
“ঠিক আছে।তুই খা।আমি বিন্তিকে পাঠাচ্ছি।”
.
খাওয়া শেষ করে আমি ছাদের উপরে গেলাম।ছাদে শুভ্র ভাইকে বসে থাকতে দেখে আমার মাথায় হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি এলো।আমি মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে নিলাম।পা টিপে টিপে শুভ্র ভাইয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।পিছন থেকে খপ করে শুভ্র ভাইয়ের গলা চেপে ধরলাম।তারপর গলাটা বেশ খানিকটা চিকন করে বললাম,
“হিহিহিহি….আমি তোর ঘাড় মটকাবো।”
.
শুভ্র ভাই পিছনে না ঘুরেই বলল,
“কে?”
.
আমি প্রায় নাকের ভেতর থেকে সুর বের করে বললাম,
“আমি পেত্নি।তোর ঘাড় মটকাতে এসেছি।তোর রক্ত শুষে নেব আজ।”
.
“আমার রক্ত কেন শুষে নেবেন,পেত্নি সাহেবা?আমার কি অপরাধ?”
.
“তুই সবসময় আমাকে জ্বালাতন করিস।তাই তোর রক্ত খেয়ে আমি তার শোধ নেব।”
.
শুভ্র ভাই এবার হুট করে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হাত মুচড়ে ধরলেন।হাসতে হাসতে বললেন,
“এই বাড়ির পেত্নি কে সেটা আমি জানি না ভেবেছিস?”
.
আমি এবার ভয়ে ভয়ে বললাম,
“সরি,শুভ্র ভাই।সরি সরি।আমি আর এরকম করবো না।আমাকে ছেড়ে দিন,প্লিজ।”
.
“কেন,পেত্নি সাহেবা?ভয় পাচ্ছেন?”
.
আমি করুণ গলায় বললাম,
“প্লিজ,শুভ্র ভাই।”
.
কিন্তু আমার এই আকুল আবেদন উনার কানে ঢুকলো বলে মনে হয়না।উনি হেসে বললেন,
“এবার আপনার কি হবে,পেত্নি সাহেবা?আপনাকে এখান থেকে তুলে নিচে ফেলে দেই?দেবো?”
.
আমি হঠাৎ চিৎকার করে বলতে শুরু করলাম,
“ফুল মা,কোথায় তুমি?আমাকে বাঁচাও।তোমার ছেলে আমাকে মেরে ফেললো।”
.
শুভ্র ভাই এবার আমার হাত ছেড়ে মুখ চেপে ধরলেন।ধমক দিয়ে বললেন,
“চুপ।এখন ফুল মাকে ডাকছিস কেন?বাচ্চামি করার সময় মনে থাকে না?কদিন পরে বিয়ে হবে।আর উনি এখনও ফাজলামি করে বেড়াচ্ছেন।ইডিয়ট।”
.
আমি সুযোগ বুঝে শুভ্র ভাইয়ের হাতে কামড় বসিয়ে দিলাম।সাথে সাথে উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলাম।ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলাম।ইশ!কেন যে শুধু শুধু এরকম করলাম!?কি বিশ্রীভাবে ধরা পরে গেলাম।শিট!
.
.
.
.
আজ আমি খুব সকাল সকাল উঠেছি।আর ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকেছি।আমার উদ্দেশ্য হলো নাস্তা বানানো।বিন্তিকে সরিয়ে দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরোটা ভাজছি।মন দিয়ে কাজটা করছিলাম আমি।কিন্তু এই বাড়িতে আমি কোনো কাজই ঠিক মন দিয়ে করতে পারি না।যখনই কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি,তখনই সেই মনোযোগে কোনো না কোনোভাবে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দেন শুভ্র ভাই।এই মুহূর্তেও তাই হলো।
পরোটা বানানোর সময় আমার মাথায় পিছন থেকে একটা নীল রঙের ওড়না এসে পরলো।আমি প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।ওড়নাটা হাতে নিয়ে পিছনে ঘুরে তাকালাম।কাউকে চোখে পরলো না।ওড়নাটা উল্টেপাল্টে দেখছিলাম।ওড়নার এক কোণায় কিছু একটা বাঁধা আছে দেখতে পেলাম।বাঁধন খুলতেই একটা চিরকুট পেলাম।চিরকুট খুলে দেখলাম তাতে শুভ্র ভাইয়ের লিখা।উনি লিখেছেন-
“হ্যাঁ,ওরনাটা আমিই দিয়েছি।কিন্তু এতো খুশি হওয়ার কোনো দরকার নেই।সেদিন ওড়নাটা ছিড়ে ফেলেছিলাম বলে দিয়ে গেলাম।পেনাল্টি হিসেবে।শুভ্র কখনো কোনো ঋণ রাখে না।”
.
চিরকুট পড়ে মাথা তুলতেই দেখলাম চুলার উপরে দেওয়া পরোটা পুড়ে যাচ্ছে।আমি তাড়াতাড়ি চুলা বন্ধ করে দিলাম।ধুরর!কত শখ করে পরোটা বানাচ্ছিলাম।শুভ্র ভাইয়ের জন্য সেটাও পুড়ে গেল।ভাল্লাগে না!
.
নাস্তার টেবিলে সবাই খুব প্রশংসা করছে আমার।আমি নাকি খুব ভালো পরোটা বানিয়েছি।কিন্তু শুভ্র ভাই কিছু বলছেন না।চুপচাপ খেয়ে চলেছে।
দাদীমনি বললেন,
“আলো,খুব ভালো হয়েছে।আমার নাতজামাই এর ভাগ্য খুব ভালো।তার বউ এতো ভালো রান্না করে তাকে খাওয়াবে।”
.
শুভ্র ভাই এবার মুখ খুললেন।গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
“না,দাদীমনি।তোমার নাতজামাই এর কপাল খুব খারাপ।কারণ তার বউ রান্না করতে গিয়ে সেটা পুড়িয়ে ফেলবে।”
.
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
“একটা পরোটাই তো পুড়েছে।বাকিগুলো তো ঠিকই আছে।”
.
ফুল মা আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন,
“তাই তো।প্রথম প্রথম রান্না করতে গেলে এরকম একটু আধটু হতেই পারে।সমস্যা কি তাতে?”
.
শুভ্র ভাই বললেন,
“মা,আজ একটা পুড়িয়েছে।কাল আরেকটা পোড়াবে।প্রত্যেক দিন একটা একটা করে কতগুলো ক্ষতি হবে তোমার কোনো আইডিয়া আছে?ওর বর বেচারার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।আহারে!”
.
কথা শেষ করে উনি অফিসের উদ্দেশ্যে উঠে গেলেন।আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।পরোটা তো উনার জন্যই পুড়লো।উনি তখন ওড়নাটা না দিলে তো এমন হতো না।আর এখন দেখ,আমাকেই সবার সামনে কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল।ইচ্ছা তো করছিল উনার নাক বরাবর ফ্রি স্টাইল ঘুঁসি মারি।যত্তসব!
.
.
.
.
বিকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।আধ ঘন্টা ধরে রেস্টুরেন্টে বসে আছি।স্বপন সরকার নামক লোকটার পাঁচটায় আসার কথা ছিল।কিন্তু এখনও তার আসার নাম নেই।
আমি আজ খুব সেজেছি।নীল শাড়ি পরেছি,চোখে গাঢ় করে কাজল পরেছি,ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগিয়েছি,হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুড়ি পরেছি,পায়ে নূপুর পরেছি।
.
সাড়ে পাঁচটা পার হতেই লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।ছবিতে যেমন দেখেছিলাম,তেমনই দেখতে।তবে ছবির থেকে বয়সটা একটু বেশি লাগছে।বোধহয় ছবিটা দুয়েক বছর আগের।আমি হাসিমুখে বললাম,
“স্বপন সাহেব?”
.
স্বপন হেসে আমার পাশের চেয়ারে এসে গা ঘেঁষে বসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আলো।তোমায় ছবিতে দেখেছি।তুমি ছবির মতই সুন্দর।”
.
উনি আমার পাশে এসে বসায় আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।অদ্ভুত লোক তো!প্রথম দেখাতেই একটা মেয়ের এতো কাছে এসে বসে পরলেন!হুমায়ূন স্যার একটা কথা বলেছেন।পুরুষ মানুষ দুই দলে বিভক্ত।একদল তাকায় মেয়েদের চোখের দিকে,আরেকদল তাকায় মেয়েদের বুকের দিকে।এই স্বপন সাহেবকে দ্বিতীয় দলের বলে মনে হচ্ছে।
আমি অস্বস্তি চাপা দিয়ে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বললাম,
“আপনার এতো দেরি হলো যে?”
.
“আসলে অফিসে কাজের খুব প্রেসার।তাই দেরি হয়ে গেল।”
.
“আপনি কি আমার সম্পর্কে সব জানেন?”
.
চলবে…..