তোমার রাঙা উঠানে,part:2

তোমার রাঙা উঠানে,part:2
writer:Alo Rahman

.
আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলাম সেখানে ফুল মা আর দাদীমনি বসে আছে।আমি গিয়ে ফুল মার পাশে বসলাম।ফুল মা বললেন,
“তুই কেমন যেন শুকিয়ে গেছিস,আলো।”
.
আমি হাসলাম।”মোটেও শুকিয়ে যাইনি।মায়ের চোখে এমনই মনে হয়।”
.
“আচ্ছা আলো,তোর ভার্সিটিতে কোনো ছেলে বন্ধু নেই?”
.
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।জিঙ্গেস করলাম,
“কেন বলো তো?”
.
“কিছুনা।আমি তো এমনি জানতে চাইলাম।বল না।”
.
“আছে।”
.
“তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে?”
.
“সেভাবে কোনো ভালো বন্ধু তো নেই,ফুল মা।সবাই প্রয়োজনের বন্ধু।”
.
ফুল মা আর কিছু বলার আগেই ফুল বাবা ঘরে ঢুকলেন।আমার পাশে বসেই বললেন,
“আলো মা,আমার জন্য একটু চা বানিয়ে আনবি?কবে থেকে তোর হাতের চা খাই না।”
.
দাদীমনি ধমক দিয়ে বলল,
“তুই কি রে?মেয়েটা একটু আগে বাড়ি এলো।আর তুই এখনই ওকে রান্নাঘরে পাঠাবি?”
.
আমি হেসে বললাম,
“ঠিক আছে,দাদীমনি।চা বানাতে আর কতক্ষণই বা লাগবে?আমি যাচ্ছি।”
.
ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।রান্নাঘরে ঢুকেই দেখলাম বিন্তি রান্না করছে।আর রান্নাঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে শুভ্র ভাই কি যেন করছে।আমি শুভ্র ভাইকে না দেখার ভান করে চা বানাতে শুরু করলাম।
বিন্তি বলল,
“আপা,চা খাইবেন?আমি বানাইয়া দেই সরেন।”
.
“না,বিন্তি।আমি খাব না।ফুল বাবার জন্য চা বানাবো।”
.
“আপনে সরেন।আমি বানাইতেছি।”
.
“আহ বিন্তি!তোকে বানাতে হবে না।তুই নিজের কাজ কর।”
.
“আপনেরা জানি কেমন?ভাইজানরে আপেল কাইটা দিতে চাইলাম,উনি কইলো নিজের কাম কর।আপনেরে চা বানাইয়া দিতে চাইলাম,আপনেও কইলেন নিজের কাম কর।আপনেরা তাইলে কন আমার কাম কি?”
.
“বিন্তি,তুই দয়া করে চুপ কর।চুপচাপ রান্না কর।”
.
আমি চা কাপে ঢেলে চিনি মিশাচ্ছি।হঠাৎ শুভ্র ভাই ‘আহ’ করে উঠলেন।আমি তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই বাম হাতের আঙুল চেপে ধরে আছে।আঙুলটা থেকে অনবরত রক্ত পরছে।আমি দৌড়ে গিয়ে আমার ওড়নার এক প্রান্ত শুভ্র ভাইয়ের আঙুলে চেপে ধরলাম।হড়বড় করে বলতে শুরু করলাম,
“আপনাকে কে আপেল কাটতে বলেছে,শুভ্র ভাই?যেই কাজ কখনো করেন সেটা কেন করতে আসেন?বিন্তিকে বললেই তো ও কাজটা করে দিতে পারতো।”
.
শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মুচকি মুচকি হাসছেন।আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“আপনি তো অদ্ভুত।হাত থেকে রক্ত ঝরে পরছে।আর আপনি হাসছেন।হাসি বন্ধ করুন।যত্তসব।আপনি দাঁড়ান।আমি ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসছি।”
.
আমি ফার্স্ট এইড বক্স আনার জন্য পা বাড়ালাম।কিন্তু যেতে পারলাম না।শুভ্র ভাই পিছন থেকে আমার ওড়না টেনে ধরলেন।আমি চোখেমুখে রাগ নিয়ে ফিরে তাকালাম।কিন্তু শুভ্র ভাই ভাবলেশহীন।বললেন,
“কিচ্ছু আনতে হবে না।”
.
“আনতে হবে না!কেন?”
.
শুভ্র ভাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।হুট করে আমার ওড়নার এক প্রান্ত ছিড়ে ফেললেন।আমি অস্থির হয়ে বললাম,
“আরেহ আরেহ!এটা কি করলেন আপনি?আমার ওড়না ছিড়ে দিলেন কেন?”
.
শুভ্র ভাই কিছু না বলে আমার ওড়নার ছেড়া অংশটা নিজের কাটা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আজব মানুষ তো!আমার ওড়নাটা!
.
.
.
.
রাত দুটো বাজে।আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না।আমার মাথায় শুধু ঘুরছে শুভ্র ভাইয়ের ব্রেসলেট পরানো আর ওড়না ছেড়ার ব্যাপারটা।অনেকক্ষণ ধরে এপাশ ওপাশ করছি বিছানায়।এবার উঠে বসলাম।গায়ে ওড়না জড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম।
ছাদে হলুদ রঙের আলো জ্বলে আছে।আকাশ মেঘলা।চাঁদ বা তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।শুধু ঘন অন্ধকার।ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলাম।হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,
“এতো রাতে ছাদে কি করছিস?”
.
হঠাৎ কারোর কথা শুনে আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে পিছনে তাকালাম।কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের মুখটা দেখে সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরলাম।শুভ্র ভাই ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ছাদের হলুদ আলোয় শুভ্র ভাইয়ের মুখ হলদে হয়ে গেছে।আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
“আ..আপনি?এভাবে হঠাৎ করে কেউ কথা বলে?আর একটু হলেই তো হার্ট এ্যাটাক করতাম।”
.
“তুই এভাবে চিৎকার করলি কেন?এভাবে কেউ চিৎকার করে?আশেপাশের মানুষ শুনলে ভাববে আমি তোর সাথে কি না কি করছি।”
.
“আপনি এতো রাতে ছাদে কেন?”
.
“সেই একই প্রশ্ন তো আমিও তোকে করলাম।”
.
“আমার ঘুম আসছিল না।তাই ছাদে এসেছি।আপনি কেন এসেছেন?”
.
“আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই এসেছি।”
.
আমি ছাদের রেলিং এর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম।শুভ্র ভাই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর শুভ্র ভাই বললেন,
“আলো,দোলনায় বসবি?”
.
আমি অবাক চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম।ছাদের একপাশে রাখা দোলনাটা শুভ্র ভাইয়ের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি।এই দোলনায় উনি ফুল মা ছাড়া আর কাউকে বসতে দেন না কখনো।আমার ছোটবেলা থেকেই এই দোলনার প্রতি খুব লোভ।কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের চড়ের ভয়ে কখনোই বসতে পারতাম না।শত হলেও এটা শুভ্র ভাইয়ের নিজের বাড়ি।কিন্তু আমার!?নিজের হয়েও নিজের নয়।
.
আমার উত্তর না পেয়ে শুভ্র ভাই আবার বললেন,
“কি রে?ভ্যাবলাকান্তর মতো তাকিয়ে আছিস কেন?”
.
আমি বিস্ময় নিয়েই বললাম,
“আপনি কি আমায় সত্যিই দোলনায় বসতে বললেন?”
.
শুভ্র ভাই হেসে উঠলেন।আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে দোলনায় বসিয়ে দিলেন।তারপর নিজেও আমার পাশে বসে পরলেন।আমার বিস্ময় কাটছেই না।আমি হুট করে বলে উঠলাম,
“শুভ্র ভাই,আপনি খুব অদ্ভুত বিহেভ করছেন।”
.
“কি করলাম?”
.
“আমি বাড়ি আসার পর থেকে আপনি যা যা করছেন,সবই তো অদ্ভুত।আমি আপনার কোনো কাজের মানে বুঝতে পারছি না।”
.
শুভ্র ভাই নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন,
“খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলবি।”
.
হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টি পরতে শুরু করলো।আমি চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা স্পর্শ করছি।হঠাৎ চোখ মেলে পাশে তাকিয়ে দেখি শুভ্র ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।কেমন গভীর সেই দৃষ্টি!
এই দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।আমি উঠে দাঁড়ালাম।অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“শুভ্র ভাই,বৃষ্টি শুরু হয়েছে।চলুন ঘরে যাই।”
.
তারপর প্রায় ছুটে নিজের ঘরে চলে এলাম।শুভ্র ভাইয়ের এমন দৃষ্টি তো আগে দেখি নি।এভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন উনি?
.
.
.
.
সকালে নাস্তা করার পর আমি নিজের ঘরে এসে খাতা কলম নিয়ে বসেছি।খাতায় কতগুলো অনাথ আশ্রমের নাম লিখছি।কারণ কয়েকদিন পরে আমার মা বাবার মৃত্যু বার্ষিকী।প্রত্যেক বছর এই দিনে ফুল বাবা আমাকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে যান।এবছর কোথায় যাব সেটাই ঠিক করার চেষ্টা করছি।
তখনই আজম চাচা ঘরে এলেন।আমার সামনে এক কাপ চা রেখে বললেন,
“এই যে মা,তোমার চা।”
.
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
“থ্যাংক ইউ,চাচা।”
.
“মা,চা খাইয়া তাড়াতাড়ি তোমার ফুল বাবার ঘরে যাও।তোমারে উনি ডাকেন।”
.
“ঠিক আছে,চাচা।আমি আসছি।”
.
আজম চাচা চলে গেলেন।আমি চায়ে পরপর কয়েকবার চুমুক দিলাম।হাত থেকে কলম আর কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালাম।সিড়ি বেয়ে নেমে সোজা ফুল বাবার ঘরে ঢুকলাম।সেখানে ফুল বাবা,ফুল মা,দাদীমনি,সবাই বসে ছিল।আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম,
“ফুল বাবা,আসবো?”
.
সবাই কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিল।আমাকে দেখেই সবাই চুপ করে গেল।ফুল বাবা বললেন,
“আলো মা,আয়।ভেতরে আয়।”
.
আমি ভেতরে গিয়ে বসলাম।ফুল মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আলো,তুই কত বড় হয়ে গেলি!এইতো সেদিন,আমার আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াতিস পুঁটি মাছের ভাজা খাবি বলে।”
.
আমি হেসে বললাম,
“পুঁটি মাছ থাকলে ভেজে ফেলো,ফুল মা।খেতে ভালোই লাগে।”
.
“সেটা ভেজে দেবো।কিন্তু এখন থেকে তোকে মাছ ভাজা খাওয়ার সাথে সাথে মাছ ভাজতেও শিখতে হবে।”
.
দাদীমনি বলল,
“শুধু মাছ ভাজতে নয়,আরও অনেক রান্নাই শিখতে হবে।নইলে বরকে খাওয়াবে কি?”
.
আমি বিস্ময় নিয়ে দাদীমনির দিকে তাকালাম।বললাম,
“বর মানে!!?কি বলছ,দাদীমনি?”
.
ফুল মা বললেন,
“আলো,আসলে…আমরা তোর বিয়ের কথা ভাবছিলাম।”
.
আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।বিয়ে!আমার বিয়ে!?
ফুল মা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
“তোর কি কাউকে পছন্দ আছে,আলো?থাকলে বল।”
.
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।কিই বা উত্তর দিতাম?আমার পছন্দ তাদের ছেলে,এই কথা কি করে বলবো আমি?যদি ফুল মা আর ফুল বাবা আঘাত পায়?আর শুভ্র নিজেও তো আমাকে…।
.
আমার ভাবনার মধ্যেই ফুল মা আবার বললেন,
“তুই কোনো সংকোচ করিস না,আলো।কাউকে পছন্দ করে থাকলে বল।”
.
আমি নিজের সব অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করে বললাম,
“না।আমার কোনো পছন্দ নেই,ফুল মা।”
.
ফুল বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আলো,তুই তো তোর ফুল বাবাকে ভরসা করিস,তাই না?আমি সবসময় চাই তুই ভালো থাক,মা।আমরা যেই ছেলেকে ঠিক করেছি,সে তোকে ভালো রাখবে।”
.
“ছেলে!ছেলে ঠিক করে ফেলেছ?”
.
“আমরা শুধু একজনকে পছন্দ করেছি।এখন তুই যা বলবি তাই হবে।তোকে আমরা জোড় করবো না।সিদ্ধান্ত তুই নিবি।”
.
আমি চুপচাপ বসে রইলাম।কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না।ফুল মা বললেন,
“তাড়াহুড়ো করতে হবে না,মা।তুই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নে।”
.
আমি এবার নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা তুলে তাকালাম।একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“ভাবার কিছু নেই,ফুল মা।তোমরা আমার জন্য অনেক কিছু করেছ।আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ।তোমরা যদি না থাকতে তাহলে হয়তো আমি বেঁচেই থাকতাম না।আমি জানি,তোমরা যা করবে আমার ভালোর জন্যই করবে।তোমাদের উপর সেই ভরসা আমার আছে।তোমরা যখন বলবে,আমি তখন বিয়ে করবো।যাকে বলবে,তাকেই বিয়ে করবো আমি।”
.
ফুল মা খুশি হয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
“আমি জানতাম তুই না করবি না।”
.
ফুল বাবা বললেন,
“ছেলেটার সাথে তুই পরিচিত হয়ে নে,মা।একদিন দেখা কর।”
.
“কবে দেখা করবো বলো।”
.
ফুল মা বললেন,
“আমি ওদের সাথে কথা বলে তারপর তোকে জানাবো।”
.
“ঠিক আছে,ফুল মা।আমি তাহলে ঘরে যাই?”
.
“যা।”
.
ফুল বাবার ঘর থেকে বেরুতেই দেখলাম শুভ্র ভাই সোফায় বসে টিভি দেখছেন।আমি পা টিপে টিপে গিয়ে পিছন থেকে শুভ্র ভাইয়ের কানের কাছে জোরে চিৎকার করলাম।শুভ্র ভাই প্রথমে আকস্মিক চিৎকারে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর রাগী গলায় বললেন,
“এটা কি ধরণের বাচ্চামি,আলো?তুই কি এখনো ছোট আছিস?”
.
আমি হেসে বললাম,
“উঁহু,আমি আর ছোট নেই।আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।ফুল বাবা আর ফুল মা আমার বিয়ে ঠিক করছেন।”
.
কথাটা বলেই আমি সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের ঘরে যেতে শুরু করলাম।একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে তাকাই নি।আমি আর মায়া বাড়াতে চাই না।একদম চাই না।
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here