তোমার রাঙা উঠানে,part:1

তোমার রাঙা উঠানে,part:1
writer:Alo Rahman

অতি সাবধানে হাঁটা সত্ত্বেও আমার পা কাদায় পিছলে গেল।আমার পাশাপাশি শুভ্র ভাই হাঁটছিলেন।উঁহু,সিনেমার নায়কদের মতো উনি আমাকে ধরে ফেলেন নি।আমি পুরোপুরি কাদার মধ্যেই পরে গেছি।ভাগ্যিস এই রাস্তাটায় কেউ ছিল না।নইলে কি লজ্জায়ই না পরতাম।কাদায় পরে গিয়ে আমি ড্যাবড্যাব করে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছি।কিন্তু উনার কোনো হেলদোল নেই।আমাকে উঠানোর জন্য আমার দিকে হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছে না খাটাশটা।
আমার তাকিয়ে থাকা দেখে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন উনি,
“এভাবে ভ্যাবলাকান্তর মতো তাকিয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি ওঠ।তোর জন্য তো অনন্তকাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না আমি।”
কথাটা বলেই উনি চলে যেতে লাগলেন।আমিও উঠে দাঁড়িয়ে উনার পিছু পিছু ছুটলাম।নইলে এই সন্ধ্যাবেলা যদি আবার রাস্তায় একা ফেলে চলে যায়!
.
আমি আলো।আমার মা বাবা নেই।আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি,তখন দুজন একসাথে আমাকে টাটা করে দিয়েছে।তখন আমার কোনো আত্মীয় স্বজন আমার দায়িত্ব নিতে আসে নি।আমি জলে ভাসা পদ্মের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিলাম।তারপর আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার ফুল মা আর ফুল বাবা।উনারা হলেন আমার জীবনের ধ্রুবতারা।ফুল বাবা আমার বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।উনারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন।আমাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছেন,অসম্ভব ভালোবাসা আর আদর-যত্ন দিয়েছেন।আমাকে জলে ভাসা পদ্ম থেকে টবে লাগানো যত্নের গোলাপ বানিয়েছেন।
আর আমার শুভ্র ভাই হলেন ফুল বাবা আর ফুল মায়ের একমাত্র ছেলে।শুভ্র ভাই অসম্ভব রকমের সুন্দর একজন মানুষ।ফর্সা,লম্বা,ঘন পল্লব ঘেরা চোখ,খয়েরি ঠোঁট,সিল্কি চুল,ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি,এক কথায় সুদর্শন হতে হলে যা যা দরকার সবই সৃষ্টিকর্তা উনাকে দিয়েছেন।ছেলেরা মেয়েদের রূপে মুগ্ধ হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো।শুভ্র ভাইয়ের রূপে মুগ্ধ হয়েছি আমি।শুধু রূপে নয়,শুভ্র ভাইয়ের কথা বলা,হাসি,রেগে আমার উপর চিৎকার করা,অন্যকে সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পরা,এই সবকিছুতেই মুগ্ধ আমি।আর শুভ্র ভাইয়ের উপর মুগ্ধ হয়েই কিশোরী বয়সে তাকে প্রেমপত্র পর্যন্ত দিয়েছিলাম আমি।তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম আর শুভ্র ভাই তখন নতুন নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন।কিন্তু সেদিন শুভ্র ভাই আমার অনুভূতিগুলো হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।সেদিন শুভ্র ভাইয়ের বিদ্রূপের হাসিতে আমার কিশোরী হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।সেই থেকেই নিদারুণ অভিমানে শুভ্র ভাইয়ের পিছনে ঘুরঘুর করা বাদ দিয়েছি।দরকার ছাড়া কথাও বলি না।তবে বেহায়া চোখটা বারবার উনার দিকেই চলে যায়।
.
এখন শুভ্র ভাই চাকরি করছেন।আর আমি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেছি।পরীক্ষা শেষ করে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছি আজই।শুভ্র ভাই আমাকে স্টেশন থেকে আনতে গিয়েছিলেন।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।সন্ধ্যার আবছায়াতে রাস্তার কাদাজল ঠিকভাবে দেখতে পাইনি বলেই এভাবে বেকায়দায় পরে যেতে হলো।
.
বাড়ির দরজায় পা দিতেই ফুল মা,ফুল বাবা,দাদীমনি,আজম চাচা আর বিন্তি দৌড়ে এলো।আজম চাচা আর বিন্তি এ বাড়িতে কাজ করে।আজম চাচাকে আমি ছোট থেকে দেখছি।কিন্তু বিন্তি কয়েক বছর আগে এসেছে।ফুল মা আমাকে দেখেই বলল,
“এসব কি হয়েছে,মা?কাদা লাগলো কি করে?”
.
আমি কিছু বলার আগেই শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“কি হবে আবার?মহারানী কাদায় পরে গেছেন।চোখ আকাশে তুলে হাঁটেন কিনা।”
.
দাদীমনি বলল,
“আহ!শুভ্র,তুই সবসময় আমার বুবুমনির সাথে এভাবে কথা বলবি না তো।মেয়েটা কতদিন পর বাড়ি আসলো।”
.
শুভ্র ভাই বললেন,
“হ্যাঁ,আর ওকে আনতে গিয়ে আমার বারোটা বাজলো।”
.
ফুল মা বললেন,
“তোর আবার কি হয়েছে?পরে তো গেছে আলো।তুই তো পরিস নি।”
.
“তোমরা শুধু ওর পরে যাওয়াটাই দেখলে,মা?আমি যে ওর এই ভারি ব্যাগটা টেনে নিয়ে এলাম,সেটা দেখলে না?উফ!হাত ব্যাথা হয়ে গেল।”
কথাটা বলেই উনি ব্যাগটা আমার দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
ফুল বাবা আজম চাচাকে বললেন,
“আজম,ওর ব্যাগটা ঘরে রেখে এসো।”
তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“কেমন আছিস,মা?”
.
আমি হেসে বললাম,
“ভালো আছি,ফুল বাবা।তোমরা ভালো আছ?”
.
“তুই এসে গেছিস।এবার সবাই ভালো থাকবো।যা ঘরে যা।ফ্রেশ হয়ে নে।”
.
.
.
.
ঘরে গিয়েই লম্বা একটা শাওয়ার নিয়েছি।ফুল মা ঘরটা আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছে।আমি নিজের বই খাতাগুলো টেবিলে গোছাতে শুরু করলাম।গোছাতে গিয়ে পুরাতন একটা বইয়ের ভেতর থেকে কিছু কাগজের টুকরো পরলো।আমি মেঝেতে বসে কাগজের টুকরোগুলো হাতে নিলাম।কাগজগুলোতে চোখ বুলাতেই আমার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।কারণ এটা সেই প্রেমপত্র যেটা আমি শুভ্র ভাইয়ের জন্য লিখেছিলাম।সেই দিনের কথা মনে পরতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সেদিন নিজের মনের রঙিন অনুভূতিগুলো শব্দ দিয়ে সাজিয়েছিলাম।লাজুক মুখে কাঁপাকাঁপা হাতে শুভ্র ভাইয়ের ঘরে চিঠিটা রেখে এসেছিলাম।কিন্তু শুভ্র ভাই!শুভ্র ভাই চিঠিটা পড়ে হোহা করে হেসে উঠেছিলেন।হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরেছিলেন।বিদ্রূপ করে বলেছিলেন,
“তুই আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিস নাকি?কি হাস্যকর!তোর মতো গাধীকে কি আমার পাশে মানায়?এসব চিন্তা বাদ দে।যা পড়তে বস।”
তারপর হাসতে হাসতেই চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছিল।সেই সাথে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল আমার মনটাও।আমি সেই ছেড়া টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনে সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম বই এর ভেতরে।কথাগুলো মনে পরতেই বুকের ভেতর চিনচিন করছে।মাঝে মাঝে মনে হয়,আমার কেউ নেই বলেই বোধহয় শুভ্র ভাই আমাকে এতো অবহেলা করে।
আমি চোখ মুছে মেঝে থেকে উঠলাম।টেবিল গুছিয়ে রেখে আয়নার সামনে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে শুরু করলাম।হঠাৎ
আয়নায় শুভ্র ভাইকে দেখতে পেলাম।শুভ্র ভাই আমার দরজায় হেলান দিয়ে হাতের উপর হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ঘুরে তাকালাম।গাঢ় নীল রঙের টি শার্ট ফর্সা শরীরে খুব মানিয়েছে।সিল্কি চুলগুলো কপালে পরে আছে।কি স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে।মানুষ এতো সুন্দর হয় বুঝি?
আমার ভাবনার ঘোর কাটিয়ে উনি বলে উঠলেন,
“ছিহ আলো!একটা ব্যাচেলর ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে তোর লজ্জা করছে না?”
.
আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
“আপনিই বা একটা কুমারী যুবতী মেয়ের ঘরে এই সাঁঝের বেলা কি করছেন?আপনারও তো লজ্জা করা উচিত।”
.
“ও বাবাহ!পড়াশোনা শিখে এসে তোর মুখে তো খুব কথা ফুটেছে দেখছি।”
.
“আমার ঘরে কেন এসেছেন?”
.
শুভ্র ভাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।ঘরের ভেতরে এসে সোজা আমার বিছানায় বসে পরলেন।
আমি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
“এভাবে ভ্রু কুঁচকাবি না আলো।তোকে পেত্নির মতো লাগে।”
.
আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে এবার।অযথা আমার ঘরে এসে এসব কথা বলার কোনো মানে হয়?অসহ্যকর লোক একটা।আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
“আপনি আমার ঘর থেকে যান।”
.
শুভ্র ভাই এবার উঠে আমার কাছে এলেন।হুট করে আমার হাতটা টেনে নিজের হাতে নিলেন।তারপর পকেট থেকে একটা ব্রেসলেট বের করে পরিয়ে দিলেন।আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম।শুভ্র ভাই আমার গালে হালকা ঘুঁসি মেরে বললেন,
“এটা যেন কখনো হাত থেকে খুলতে না দেখি।যদি দেখেছি খুলে রেখেছিস,তাহলে তুলে আছাড় মারবো।”
কথাটা বলেই শুভ্র ভাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।আমি তখনও ভেবলির মতো দাঁড়িয়ে আছি।শুভ্র ভাই আমাকে ব্রেসলেট দিয়েছে!তাও নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছে!ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চাইছে না।এটা কি সত্যি!?নাকি স্বপ্ন দেখছি আমি?
.
ঘরে দাঁড়িয়ে থেকে হাতের ব্রেসলেট নাড়াচাড়া করছি।তখনই ঘরে ঢুকলো বিন্তি।আমাকে বলল,
“আপা,নিচে চলেন।আপনেরে সকলে ডাকে।”
.
আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম,
“বিন্তি,তুই কি আমার হাতে একটা ব্রেসলেট দেখতে পাচ্ছিস?”
.
বিন্তি হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও মা।কি সুন্দর!কই থেকে কিনছেন,আপা?”
.
আমি এবার হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ…হ্যাঁ মানে ওই আর কি।”
.
“কি ওই আর কি?”
.
“কিছুনা।চল নিচে যাই।”
.
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি বিন্তি হা করে দাঁড়িয়ে আছে।
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here