মায়াবিনী মানবী,পর্ব_০৫,০৬

মায়াবিনী মানবী,পর্ব_০৫,০৬
হুমাশা_এহতেশাম
পর্ব_০৫

–এতোদিন তো বাইক দেখলাম না।এখন আসলো কিভাবে?

বাড়ির গেটের সামনে বাইকে বসে থাকা আলআবির দিকে জুইঁ প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।আলআবি নির্দ্বিধায় উত্তর দিল…

–সার্ভিসিং এ ছিল তাই দেখনি।এখন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো।

জুইঁ হড়বড় করে বলতে লাগলো…

–আপনার বাইকে করে একসাথে আমি যাব না।পরে আবার ছবি তুলে পুরো বাংলাদেশ কে দেখাবেন।

বাড়ির গেটের সামনে থাকা লাইটের আলোতে জুইঁ দেখতে পেল আলআবি মৃদু পরিমাণে হাসি দিয়ে জুইঁর দিকে দৃষ্টি দিল আর বলল…

–এখন যদি বাইকে না ওঠো তাহলে কালকে বেনজিকে তোমার গোসল করাতে হবে।

আলআবির কথা কর্ণপাত হতেই জুইঁ তাড়াতাড়ি করে বাইকে উঠে বসলো।সঙ্গে সঙ্গে আলআবি বাইক থেকে নেমে পড়লো।জুইঁকেও নামিয়ে দিল।জুইঁ কে কিছু না বলেই বাড়ির গ্যারেজ এর দিকে চলে গেল।একটু পরেই আলআবি দু’হাতে দুটো হেলমেট সমেত ফিরে আসলো।জুইঁর সামনে এসে একটা হেলমেট জুইঁর দিকে ধরে বলল…

–সেফ্টি ফার্স্ট।পড়ে নাও।

হেলমেট টা জুইঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আলআবি নিজের হেলমেট টা পড়ে নিল।জুইঁ হেলমেট টা হাতে নিয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জুইঁ কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলআবি বলল…

–দাঁড়িয়ে আছো কেন? নাকি বেনজিকে গোসল করানোর ইচ্ছে জেগেছে।

–আমি হেলমেট পড়তে পারি না।আর আপনার বেনজিকেও গোসল করানোর কোন ইচ্ছে নেই।(জুইঁ)

আলআবি জুইঁর দিকে এগোতে এগোতে বলে…

–তোতাপাখির মতো কথা বলতে পারো কিন্তু কাজের কাজ কিছু পারো না।

বলতে বলতে আলআবি জুইঁর অনেকটা কাছে এসে পড়লো।জুইঁর হাত থেকে হেলমেট টা নিয়ে সন্তপর্নে পড়িয়ে দিতে লাগলো।হেলমেট পড়ানো শেষ হতেই হঠাৎ করে জুইঁ খেয়াল করল আলআবি জুইঁর হেলমেটের ফাঁকে থাকা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। জুইঁ কিছু টা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল।জুইঁ হালকা নড়েচড়ে একটু পিছিয়ে আসলো।আলআবি আর কোনপ্রকার কথা না বলে বাইকে উঠে পরলো। জুইঁ সাবধানে আলআবির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বাইকে বসে পরলো।

রাত এখন আটটা বাজে।আলআবি যে গতিতে তার বাইক চালাচ্ছে তাতে রিকশা ও ওদের থেকে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। জুইঁ ব্যাপক বিরক্তির সহিত আলআবি কে বলল…

–আপনার বাইক কি আরেকটু স্পীডে চলে না?না আবার আপনি ই চালাতে পারেন না।

আলআবি বাইক চালাতে চালাতে বলল…

–বেশি স্পীডে চালালে তুমি নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে পরবে না।আমাকে জড়িয়ে ধরতে হবে।তখন আবার বলবে ধীরে চালাতে।তাই আগে থেকে ই ধীরে সুস্থে চালাচ্ছি।

জুইঁ সন্দেহের বশে বলল…

–আপনি সত্যিই ডাক্তার এর কাছে যাচ্ছেন তো?ইচ্ছে করেই আপনি বাইক আস্তে আস্তে চালাচ্ছেন।আসলে আপনার মতলব টা কি বলেন তো?

আলআবি তার হেলমেট এর আড়ালে কিঞ্চিৎ হেসে জুইঁ কে বলল…

–বাহ্।আমার সাথে থেকে দেখি তোমার বুদ্ধি ধীরে ধীরে বাড়ছে।তুমি একদম ঠিক ধরেছ।আমরা কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না।

জুইঁ হালকা চেচিয়ে বলে উঠলো…

–কিহ!আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

–গেলেই তো দেখতে পাবে।(আলআবি)

জুইঁ আলআবি কে বারবার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কিন্তু আলআবি মুখ খুলতে নারাজ। সে তার মতো বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায় জুইঁ ও কোন উত্তর না পেয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকে।

রাস্তায় যানবাহনের কোন অভাব নেই।যেদিকে চোখ যায় সেদিকে ই রিকশা,সিএনজি,প্রাইভেট কার চোখে পড়ছে।সেই সাথে বাস তো রয়েছেই।

জুইঁর কাছে ঘড়ি নেই বলে সময় সম্পর্কে সে অবগত নয়।তবে অনুমান মোতাবেক জুইঁর মনে হচ্ছে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো পাড় হয়ে গিয়েছে। আলআবির বাইক চালানোর ধরনে এখন জুইঁর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। যেই না জুইঁ বড় একটা হামি দিতে যাবে তখনি বাইক টা থেমে গেল।বাইক থামার সঙ্গে জুইঁর অনাগত হামিটাও থেমে গেল।

জুইঁ বাইক থেকে নেমে হেলমেট টা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।তখন আলআবি এসে ওকে সাহায্য করে।হেলমেট দুটো একহাতে নিয়ে জুইঁর দিকে আলআবি এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে…

–হাতটা ধরে হাঁটবে?

জুইঁর কাছে আলআবির কথাটা অন্যরকম বলে মনে হলো।জুইঁর হাত ধরতে আলআবি জুইঁর অনুমতি চেয়েছে। এই বিষয়টা জুইঁর কাছে খুব ভালো লেগেছে। জুইঁ আলআবির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল।দেখল আলআবি মাথা টা হালকা ডানে কাত করে ডান হাতটা জুইঁর দিকে বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চশমা চোখে ডান কোণে জুইঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

জুইঁর দিক থেকে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আলআবি আবার বলল…

–চারপাশে তাকিয়ে দেখ।মোটামুটি ভীড় রয়েছে। হাতটা ধরে হাঁটলে সুবিধা হবে।

জুইঁ আশেপাশে পরখ করতেই দেখল ওরা পিচঢালা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।ফুটপাতে নানান রকমের নানান বয়সের মানুষের আনাগোনা। ফুটপাতের ওপর পাশেই ঝিলের ন্যায় কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আরেক পাশের যে ফুটপাত রয়েছে সেখানে ও মানুষ চলাচল করছে।ওই ফুটপাতের পাশে রয়েছে সারি সারি বাড়ির পাচিল।

জুইঁ আর কথা না বাড়িয়ে আলআবির হাতে হাত দিল।দুজন ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে পিচঢালা রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো।

জীবনে সবকিছুই হয় প্রথমবার।জুইঁ আজ এক আধপরিচিত যুবকের হাত ধরে হাঁটছে।যেটা জইঁর জীবনেও প্রথমবার।সেদিন ও আলআবি জুইঁর হাত ধরেছিল।তবে তা কব্জিতে ধরেছিল।কিন্তু আজ ওরা একে ওপরের হাতে হাত রেখে হাটঁছে।তাও আবার জুইঁর সম্মতিতেই।দুদিনের পরিস্থিতি দুই রকমের। সেদিন এর সাথে আজকের কোন মিল নেই।তাই বলে জুইঁ একজন যুবকের হাত ধরে হাঁটছে এতে খুব যে ভালো লাগছে তাও নয়।তার কাছে ভালোও লাগছে না আবার মন্দও লাগছে না।আজ সেদিনের মতো অস্বস্তিকর অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে না তফাৎ শুধু এটুকুই।

হাঁটতে হাঁটতেই আলআবি বলে উঠলো…

–এবার বলো এখানে কেন এনেছি তোমাকে?

–আশেপাশে দেখে মনে হচ্ছে এখানে মানুষ ঘুরতে এসেছে। তাহলে আমরাও নিশ্চয়ই ঘুরতেই এসেছি।(জুইঁ)

আলআবি ফুটপাত পাড় হয়ে ঝিলের পাড়ে একটা খোলামেলা জায়গায় এসে বলল…

–রং অ্যানসার।এতদূর তোমার সাথে কেবল ঘুরতে আসিনি।ফুচকা খেতে এসেছি।

আলআবির কথায় সঙ্গে সঙ্গে জুইঁর ভ্রুকুচকে এলো।গলায় অবিশ্বাসের রেশ টেনে বলল…

–এতদূর ফুচকা খেতে এসেছেন? তাও আবার আপনি?

–কেন আমি কি মানুষ না?আমি ফুচকা খেতে পারি না? (আলআবি)

–আপনি তো ছেলে।ছেলেরাও ফুচকা খায়?(জুইঁ)

আলআবি জোড় গলায় বলল…

–এদেশের সংবিধানে কি কেউ লিখে রেখেছে যে ছেলেরা ফুচকা চটপটি খেতে পারবেনা?

জুইঁ বলতে লাগলো…

–আরে না,না।সেভাবে তো বলিনি।আসলে আমার বড় মানে নিয়াজ ভাইয়া,তারপর আমার ফ্রন্ডের কাজিন সাদমান ভাইয়া ওরা তো এগুলো খায় না।আর আমার দেখা সব ছেলেরাই ফুচকা তেমন পছন্দ করে না।

–ওটা ওদের ব্যাপার। তা তুমি ও কি তোমার ভাইর মতো ফুচকা খাও না?(আলআবি)

জুইঁ একগাল হেঁসে জবাব দিল…

–খাব না কেন?ফুচকা খাওয়ার জন্য আমি একেবারে দুইপায়ে দাঁড়া।

যে মেয়ের ফুচকা পছন্দ না তাকে বেলপাতা বলাই শ্রেয়।যে একেবারে রসকষহীন।জুইঁ নিজেকে বেলপাতার কাতারে ফেলতে চায় না।

একটা ফুচকার ভ্যানের সামনে এসে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে পরলো।ভ্যানের সামনে ই আর এফ এল এর লাল নীল রঙের চেয়ার রাখা। সেখানে প্রায় সাত থেকে আটজনের মতো বসে ফুচকা খাচ্ছে। তাদের পাশেই অনেকগুলো চেয়ার খালি পড়ে রয়েছে। আলআবি জুইঁ কে পাঁচ থেকো ছয়টা চেয়ার পরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল…

–তুমি বসো।আমি অর্ডার দিয়ে আসছি।একজনকে কল করতে হবে। তাই একটু লেট হতে পারে আমার।

আলআবি দুইপ্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে ফুচকার ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে ই কাউকে কল করল।

এদিকে জুইঁ একা একা বসে আছে। তখনি হুট করে তিনটা ছেলে এসে জুইঁর পাশে বসে পড়লো।একজন বসে শিস বাজাতে লাগলো। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলো…

–আপু কি একা নাকি?

এদের বাহ্যিক আচরণ আর চালচলন জুঁইকে ইঙ্গিত দিয়ে দিচ্ছে এরা কোন ধরনের ছেলে হতে পারে। ছেলেগুলোর কথায় কান না দিয়ে জুঁই আশেপাশে আলআবি কে খুঁজতে লাগলো। সামনে চোখ বুলাতে দেখতে পেল আলাআবি ফুচকার ভ্যান এর পাশে দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু তার দৃষ্টি জুইঁর দিকেই। আবারো পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো…

— আপু কিন্তু অনেক সুন্দর।

আরেকজন বলে উঠলো…

–সুন্দরীকে সুন্দর না বলে সেক্সি বলতে হয়।এটাও জানিস না?

জুইঁ আবারও সামনে তাকাতেই দেখতে পায় আলআবি ফোনে এখন কারো সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ছেলেগুলোর কথায় জুইঁর যতনা রাগ উঠছে তার চেয়ে বেশি রাগ উঠছে আলআবিকে হাসতে দেখে।

এ কেমন ছেলে?সে তো দেখতে পাচ্ছে জুইঁর অবস্থা। তাহলে এগিয়ে আসছে না কেন?যশোরে কতো শুনেছে আলআবি ওমুক কে মেরে নাক ফাটিয়েছিল,তমুক কে মেরে গাল ফাটিয়েছিল।তাহলে এখন সেই মারামারি কোথায়?এখন এসে কেন ওদেরকে মেরে নাক কান ফাটিয়ে দিচ্ছে না?

“কি আপু কথা বলছেন না যে? সেক্সি বলায় মন ভরে নি?”

এরূপ বাজে একটা কথা জুইঁর কর্পাত হতেই জুইঁ আর সেখানে বসে থাকতে পারল না।রাগে গজগজ করতে করতে আলআবির কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরলো। কিছুটা জোরেই বলল…

–ফোনটা দয়া করে রাখুন।

আলআবি জুইঁর কথায় ফোনটা রেখে দিল।জুইঁ আবারও পূর্বের ন্যায় বলল…

— এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলেন?ছেলে গুলো আমাকে হ্যারেস করছিল দেখেও আপনি দাঁত বের করে হাসছিলেন কেন?

–তুমিও তো বসে বসে মজা নিচ্ছিলে।তোমারও হয়তো হ্যারেস হতে বেশ মজা লাগছিল।তাই আমিও আর কিছু বলি নি।(আলআবি)

–আপনি এটা ভাবলেন কিভাবে?তারমানে আপনি আমাকে বাজে মেয়ে ভাবেন।(জুইঁ)

আলআবির এধরনের আচরণ একেবারে ই প্রত্যাশা করে নি জুইঁ। শেষের কথা গুলো বলার সময় গলা ধরে আসছিল।জুইঁর চোখে পানি টলমলে হয়ে আসছে।আরেকটু পরেই হয়তো গড়িয়ে পড়বে।

আলআবি এবার সিরিয়াস হয়ে বেশ গম্ভীরতা টেনে জুইঁ কে উদ্দেশ্য করে বলল…

–তুমি যদি মজা নাই পেতে তাহলে এতোক্ষণে ওদের গালে তোমার হাতের থাপ্পড় থাকতো।সবসময় এটা কেন ভাব যে তুমি বিপদে পরলেই কেউ তোমায় বাঁচাতে আসবে।কই এখানে তো কত মানুষ কেউ কি তোমায় খেয়াল করেছে?আজ আমি তোমার পরিচিত বলে তুমি দৌড়ে আমার কাছে এসেছ।অপরিচিত হলে তখন কি করতে?প্রতিবাদ করতে শেখো।ওখানে বসে না থেকে যদি সাহস করে সবার সামনে কষে একটা চড় মেরে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে তাহলে আমি কেন সকলেই এগিয়ে যেত তোমার কাছে।তুমিই যখন কিছু বলোনি আমি কেন আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করতে যাবো।

জুইঁ আলআবির প্রত্যেকটা কথা শুনে কিছু মূহুর্ত মাথা নিচু করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।এরপর মাথা তুলে আলআবির দিকে একবার তাকিয়ে ফিরে গেল ছেলেগুলোর কাছে।যেয়ে একটা ছেলেকে স্বজোড়ে চড় বসিয়ে দিল।জুইঁর এমন কান্ডে ওখানে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি ছেলেগুলো আর জুইঁর দিকে পরলো।প্রত্যেকের নজর কাড়তে পেরে জুইঁর মনে হলো সে আরো সাহস পেয়ে গেল।জুইঁ চেঁচিয়ে বলল…

–মেয়েদের দেখলেই সেক্সি মনে হয়?মেয়ে দেখলেই ভুলে যাস তোরাও এক মেয়ের গর্ভ থেকে আগত।আজ আমাকে এখানে বসে হ্যারেস করছিস কিন্তু কাল হয়তো অন্যকেউ তোদের ভাগ্যে থাকা ওয়াইফকে হ্যারেস করবে সেটা তো তোরা জানতেও পারবি না।

জুইঁর কথায় অনেকেই ছুটে এলো জুইঁর কাছে।জটলা পেকে গেল চারদিকে। মাঝখানে আলআবি হুট করে এসে ছেলেগুলোকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো।কেউই কিছু বলল না।বাঁধাও দিল না।

কিছুক্ষণ পর ওদের ছেড়ে দিল।আশেপাশের মানুষ ও যে যে যার যার মতো চলে যেতে লাগলো।জুইঁ আর আলআবি দুজনেই পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।নিরবতা কাটিয়ে জুইঁ বলে উঠলো…

চলবে………….

#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৬

–থ্যাংক ইউ!

জুইঁ নিচুস্বরে আলআবি কে বলে উঠলো। আলআবি জুইঁর দিকে স্তব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো…

–ছেলেগুলোর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছ।তাই না?

জুইঁ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল…

–ওই পরিস্থিতিতে যে কোন মেয়েরই খারাপ লাগার কথা।কিন্তু ওদের একটা শিক্ষা দিতে পেরে এখন খারাপ এর চেয়ে দ্বিগুণ ভালো লাগছে।

জুইঁ কথাগুলো বলে দিলেও মনে মনে এখনও একটু মন খারাপ। তখনি একটা ১০ থেকে ১১ বছরের ছেলে দুই হাতে দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে এসে ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল…

–এই যে লন।

আলআবি ছেলেটার হাত থেকে প্লেট দুইটা নিয়ে নিল। ফুচকার হালকা উষ্ণ ঘ্রাণটা নাকে আসতেই জুইঁ আলআবির হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে নেয়।একটু নাকের কাছে প্লেট টা এনে তৃপ্তির সহিত বড় একটা দম নেয়।আলআবি জুইঁর কান্ডে ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলে উঠলো…

–এটা কি করলে?ফুচকার ও যে কেউ স্মেল নেয় তা এই প্রথম দেখলাম।

জুইঁ কপট রাগ দেখিয়ে বলল…

–দেখেন নি যখন ভালো করে এখন দেখে নেন।

জুইঁ আলআবির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো এখনো আলআবি মিটমিট করে হাসছে।জুইঁ তার বা হাতের তর্জনি আঙুল আলআবির দিকে তাক করে বলল…

–আর একবার যদি আমার পছন্দের কাজের উপর হেসেছেন, তাহলে ওই ছেলেগুলোর মতো আপনাকেও একটা শিক্ষা দিয়ে দিব।

আলআবি খপ করে জুইঁর আঙুল ধরে ফেলল।এতে জুইঁ হকচকিয়ে গেল।আলআবি শান্ত কন্ঠে জুইঁ কে বলতে লাগলো…

–এই কাজ টা দ্বিতীয় বার করার সাহস করবে না।কারো সাথে আঙুল নাচিয়ে কথা বলা ব্যাড মেনার্স এর মধ্যে পরে।নেহাত তোমাকে এমুহূর্তে হাত নাচিয়ে কথা বলায় বিউটিফুল লাগছে বলে কিছু বললাম না।

আলআবির কথায় জুইঁর টনক নড়ে উঠলো। সত্যি ই তো এই কাজ টা ঠিক না।কিন্তু জুইঁর পছন্দের উপর কেউ হাসলে তার একদম ভালো লাগে না। এমন ভিন্ন ধরনের একটা পছন্দ সবারই আছে। কারো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে তো কারো রঙের ঘ্রাণ ভালো লাগে।সাদুর তো নতুন জুতার ঘ্রাণটাও ভালো লাগে।এমন জুইঁরও ফুচকা খাওয়ার আগে ফুচকার ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে।এতে হাসার কি হলো?এসব জিনিসে হাসলে জুইঁর একদম সহ্য হয় না।তাই জন্য ই তো হুট করেই আঙুল টা উঠে গিয়েছে।

জুইঁ আলআবির থেকে আঙুল টা ছাড়িয়ে নিয়ে ফুচকা খাওয়ায় মন প্রাণ দিয়ে মনোযোগ বসিয়ে দিল।ফুচকা খেতে খেতে একের্যায় জুইঁ হুট করে আলআবি কে বলল…

–ফুচকা আপনার ও প্রিয় আমারও প্রিয়।তাই না?

আলআবি মুখে একটা ফুচকা পুড়ে বলল…

–হুম।

জুইঁ এবার উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো…

–আচ্ছা চলুন তাহলে দেখি কে বেশি খেতে পারে। প্রতিযোগিতা হয়ে যাক?

আলআবি জুইঁর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল…

–এটা জানা কথা যে আমি ই জিতব।

জুইঁ ও তাচ্ছিল্যের স্বরে আলআবি কে বলল…

–হুহ! দেখা যাবে।

আলআবি তার অর্ধেক খাওয়া ফুচকার প্লেট টা চেয়ারে রেখে, গিয়ে আরো দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে আসলো।জুইঁ মনে মনে বেজায় খুশি হলো।কারণ আর যাই হোক ফুচকা খাওয়ায় কেউ ওকে হারাতে পারে না। আজ পর্যন্ত যত বারই সাদু আর রোজিনা আপুর সাথে প্রতিযোগিতা করেছে ততবারই জুইঁ জিতেছে।

জুইঁ আলআবি দুজনেই একেরপর এক ফুচকা খেয়ে যাচ্ছে।ফুচকা মোটামুটি ঝালই বলা চলে।জুইঁ বারবার টিস্যু দিয়ে নাক মুচ্ছে।কারণ তার ঝাল খেলে চোখ দিয়ে কোন কালেই পানি পরেনি।পরে শুধু নাক দিয়ে।আলআবি মোট দুই প্লেট খেয়েই রেখে দিয়েছে।

জুইঁ তিন নাম্বার প্লেটের শেষ ফুচকাটা মুখে দিয়ে আলআবির দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি দিল।টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জুইঁ বলল…

–ওভার কনফিডেন্স শরীর ও মনের জন্য হানিকারক।

জুইঁ ভালো করে হাতটা মুছে আলআবিকে ব্যঙ্গ করে বলল…

–এটা জানা কথা যে আমি ই জিতব।

বলেই জুইঁ অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।জুইঁ কে হাসতে দেখে আলআবি বলে উঠলো…

–ফ্রেমে অলরেডি ছবি বাঁধানো হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কুরিয়ার করে পাঠানো বাকি।ভাবছি সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দিব। কেমন হবে?

আলআবির কথায় জুইঁর হাসি উবে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে তেজি কন্ঠে বলে উঠলো…

–এখানে আপনার ওই বেনজি না গেঞ্জি নামের কুকুর টা নেই।তাই আমাকে ভয় দেখিয়েও লাভ নেই।

আলআবি জুইঁ কে কিছু না বলে হাত দিয়ে চুলগুলোকে নেড়েচেড়ে জুইঁর দিকে তাকিয়ে শয়তান রূপি হাসি হেঁসে বলল…

–যত পারো বলে নেও।হাতে আমার আরো ৮ দিন আছে। এখন চলো।

আলআবি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো। সামনে গিয়ে ফুচকার বিল দিয়ে আবার পিছনে বাইকের দিকে হাঁটতে লাগলো। এবার আলআবি জুইঁর হাত ধরায় জুইঁ আর কিছু বলল না।

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই জুইঁ আলআবি কে জিজ্ঞেস করল…

–আচ্ছা কয়টা বাজে এখন।বের হয়েছি তো অনেক সময় হয়েছে।

আলআবি পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখে বলল…

–বেশি না পৌনে দশটা বাজে।

জুইঁ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো। আলআবি কে উদ্দেশ্য করে উৎকন্ঠা হয়ে বলল…

–দশটা বাজে!বাসায় আঙ্কেল আন্টিকে কি বলব?আন্টিতো নিশ্চয়ই বুঝে যাবে আমরা ডাক্তার এর কাছে যাইনি।

আলআবি জুইঁর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো আর জুইঁকে বলল…

–তোমার আন্টি জেনে গিয়েছে আমরা ডাক্তার এর কাছে যাইনি।

জুইঁ উত্তেজিত হয়ে বলল…

–কিহ!কীভাবে জানল?

–আমি ফোন করে বলেছি ডাক্তার আজ জরুরি কাজে আটকে গিয়েছে।তার চেম্বারে আসতে পারেনি। তাই তোমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে এসেছি।

জুইঁ আলআবির কথায় অবাক হয়ে বলে ফেলল…

–আপনি এতো মিথ্যে কথা কেন বলেন?আর আঙ্কেল এর সাথে সবসময় ত্যাড়া ভাবে কথা কেন বলেন?

আলআবি হঠাৎ করেই গম্ভীরতার রেশ টেনে বলে উঠলো…

–আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

জুইঁ আলআবির হুট করে অন্যভাবে কথা বলাটা ঠিক ধরতে পেরেছে।কিন্তু এমন করে কেন বলল তা জুইঁর বোধগম্য হলো না। জুইঁ আলআবি কে আর না ঘাটিয়ে সেও আলআবির সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে রইল।

বাইকের কাছাকাছি আসতেই আলআবি জুইঁ কে নিয়ে রোড ক্রস করে একটা আধভাঙা টঙ্গের চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জুইঁ আলআবি কে বলল…

–আপনার বাইক তো ওপাশে।এখানে আসলেন কেন?

–মালাই চায়ের টঙ্গ এপাশে। তাই এপাশে এসেছি। (আলআবি)

–আপনি এখন চা খাবেন?(জুইঁ)

–আমি না।আমরা এখন চা খাব।তোমার কোন সমস্যা আছে? (আলআবি)

জুইঁ মৃদু হেসে মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে বুঝালো তার কোন সমস্যা নেই।জুইঁ কে মোটামুটি চা প্রেমিকা ই বলা চলে।সকালে উঠে প্রতিদিন তার কড়া লিকার এর দুধ চা না হলে ঘুমের রেশটাই পুরোপুরি কাটে না।

এই টঙ্গে বসার জায়গা মাত্র ৫ জনের।৫ টা সিটেই কাস্টমার বসে আছে। আলআবি খেয়াল করল দোকানের পাশে ই একটা ভ্যান রাখা। দেড়ি না করে জুইঁকে নিয়ে ভ্যানের সামনে এসে পা ঝুলিয়ে ভ্যানের উপর বসে পরলো।আলআবির দেখাদেখি জুইঁ পা ঝুলিয়ে আলআবির পাশে ই বসে পরলো।

ল্যাম্পপোস্টের কালচে হলদে কমলার মিশেল আলোয় জুইঁর গাঁয়ের বাদামি বর্ণের জামাটা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। জুইঁ চা খাচ্ছিল আর তার জামার রঙ দেখছিল।এই জিনিসটা জুইঁর কাছে অনেক ভালো লাগে।একরঙের জামা পড়ে বের হলে রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তা অন্যরঙের হয়ে যায়।

বসে বসে দুজনেই চা খাচ্ছিল।মানুষের কোলাহল আগের মতোই আছে।ঝিলের পানির গন্ধ এসে নাকে বারবার বারি খাচ্ছে।ঝিলের পাড় হওয়ায় পরিবেশে মৃদু বাতাসের আনাগোনা রয়েছে। এই বাতাসের কারণেই ঝিলের পানির গন্ধ টা বারবার জুইঁর নাক ছুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা জুইঁর খারাপ লাগছে না। বরং সে এই পরিবেশে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম চা ফু দিয়ে খেতে বেশ মজা পাচ্ছে। মুহূর্ত টাকে জুইঁ খুব ভালো করে মুগ্ধতার সহিত উপভোগ করছে।

চা খাওয়া শেষে আবার রোড ক্রস করে দুজন বাইকের কাছে আসলো।এতো সময় হেলমেট আলআবির হাতেই ঝুলিয়ে রাখা ছিল।জুইঁ কে হেলমেট পড়িয়ে দিয়ে আলআবি নিজেও হেলমেট পড়ে নিল।তারপর বাইকে চড়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল।এবার আগের তুলনায় একটু দ্রুতগতিতে ই আলআবি বাইক চালাচ্ছে। জুইঁ বাইকের পিছনে শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে।

বাড়িতে আসতেই জুইঁ ড্রইংরুমে দেখতে পেল সিরাজ সাহেব, মিসেস পারভীন, লিপি বসে আছে। আরও দুজন সার্ভেন্ট ও আছে সেখানে।

ওদের দুজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সিরাজ সাহেব আলআবি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন…

–দাঁড়াও। ঘড়িতে কয়টা বাজে?

আলআবি কোন কথা না বলে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে সময় দেখে সিরাজ সাহেব কে জবাব দিল…

–১১ টা ১৭ মিনিট।

সিরাজ সাহেব তেতে উঠে বললেন…

–রাত ১১ টা পর্যন্ত তুমি একটা মেয়েকে নিয়ে বাইরে কিভাবে থাকো।ওকে নিয়ে এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে।ওর কোন ক্ষতি হলে তখন ওর বাবাকে কি বলতাম আমি?

আলআবি গাঁ ছাড়া একটা ভাব নিয়ে বলল…

–ক্ষতি তো হয়নি।এখানে এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছু তো আমি দেখছি না।আর আমি তো ছিলাম ওর সাথে।

–সমস্যা তো সেখানেই। তুমি ছিলে বলেই ভয় হচ্ছিল। কোথাও গেলে তো মারপিট না করে বাড়ি ফিরতে পারো না।আর আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।(সিরাজ সাহেব)

–আমি জানি আজকের কথা তুমি সব জেনে গেছ।আর আজকের কথা যে তোমাকে শাফিন বলেছে এটাও ভালো করে জানি।জেনেছ যখন ভালো হয়েছে। এবার আমি আসি।(আলআবি)

গটগট করে আলআবি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।সিরাজ সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না।জুইঁ এসে সিরাজ সাহেব কে বলল…

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here