শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই( অন্তিম পর্ব )💞

শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই( অন্তিম পর্ব )💞
কলমে -দেবিকা_সাহা

(৯)

এরপর কেটে গেছে আরো বেশ কয়েকটা দিন।আবির্ভাবের সাথে আদৃতার বন্ধুত্বটা এখন অনেকটাই মজবুত। নিজেদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, আনন্দ,দুঃখ সবই একে অপরের সাথে শেয়ার করা চলে।এই যেমন সেদিন আবির্ভাবের এক বন্ধুর বার্থডে পার্টি ছিলো। ও তো কেমন জোড় করেই সেদিন আদ্রিতাকে সাথে নিয়ে গেছিলো। তারপর রবিবারের লাইব্রেরি যাবার প্ল্যানটা আদ্রিতা করেছিল আবির্ভাবকে নিয়ে।যদিওবা আবির্ভাবকে এবিষয়ে আগে থেকে কিছু বলা হয়নি।আসলে মনে হয়নি যে বলাটা দরকার। ও তো সিওর ছিলো যে আবির্ভাব ওর সাথে যাবেই।তাই সেদিনও একসাথে বইপাড়ার সৌন্দর্যটা উপভোগ করেছিলো দুজন মিলে।এখন তো মৌলির মাঝে মাঝে মনে হয় যে আদ্রিতার বেস্ট ফ্রেন্ড সে নয় তার দাদা।
এরমধ্যেই চলে এলো মৌলির আশীর্বাদের দিন।সেদিন সায়নের বাড়ির সবাই এসেছিলো মৌলিদের বাড়িতে। সাথে উত্তরাও।উত্তরার সাথে আদ্রিতার আলাপ ছিলো না এর আগে।তাই মৌলি একপ্রকার জোড় করেই আদ্রিতাকে উত্তরার কাছে নিয়ে গেলো আলাপ করাতে।
” উত্তরা দি তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দিই। যদিও তুমি ওর কথা আমার কাছে অনেকবার শুনেছো।কিন্তু আলাপ তো হয়নি।ও হল আদ্রিতা। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর আদ্রি এটা উত্তরা দি।সায়নের দিদি।আর দাদাভাই এর খুব ভালো বন্ধু।আর এছাড়াও ওর কিন্তু আরও একটা পরিচয় আছে জানিস তো।..”

– ” মৌলি কি হচ্ছেটা কি।বাদ দাও না ওসব।আপাতত এই পরিচয়টুকুই থাক।হাই আমি উত্তরা।তোমার কথা মৌলির কাছে অনেক শুনেছি।আর আবির্ভাবের কাছেও।নাইস টু মিট ইউ ডিয়ার।”
– আচ্ছা।
আদ্রিতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর কথার মাঝেই হঠাৎ করেই উওরা বলে উঠলো –

” জানো তো আদ্রিতা আজ তোমার জন্য শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার আর আবির্ভাবের সেই পুরোনো বন্ধুত্বটা আবার ফিরে এসেছে নতুন করে।এতদিনের সব মান অভিমান ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে আমাদের বন্ধুত্বটা ফিরে এসেছে।থ্যাংক ইউ সো মাচ আদ্রিতা।”

আদ্রিতা যেন এসব কথার কিছুই বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করেই সবকিছু যেন কেমন অচেনা ঠেকছে।উত্তরার কথা তো আবির্ভাবের মুখে কখনো শোনেনি।কই আবির্ভাব তো নিজে থেকেই নিজের সব বন্ধুদের কথা আমাকে বলতো তখন তো একবারও উত্তরার নামটা শোনেনি।আর আজ উত্তরা এমনকি মৌলীর কথা শুনেও মনে হচ্ছে যে এরা খুব ভালো বন্ধু।সব হিসেব যেন খুব গোলমেলে লাগছে।না আর কিছু নতুন করে ভাবা বা শুনতে পারছি না।তাও কিছু কথা সাজিয়ে উত্তরাকে বললো-

” ধন্যবাদ। সত্যিই আপনার সাথে পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগলো। আসলে আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি।পরে একদিন গল্প করবো।আসলে মৌলির কাছে যেতে হবে একটু।ও ডাকছিলো। ”

না আদ্রিতার অবাক হওয়াটা এখানেই শেষ নয়।অবাক হওয়ার আরো কিছু বাকি ছিলো। মৌলির কাছে গিয়ে উত্তরার কথা বলার আগেই মৌলি বেশ আনন্দের সাথেই বলে উঠলো –

” জানিস আদ্রি উত্তরা দির আরো একটা পরিচয় আছে।সে তো তখন বলতেই দিলো না তোর কাছে।আসলে তুই তো জানিসই যে আমার আর সায়নের বিয়েটা আমাদের পরিবারের তরফ থেকে ঠিক করা সেই ছোটবেলা থেকেই। আর সেই অনুযায়ী এই দীর্ঘদিন প্রেম করার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছি।তেমনি দাদাভাই আর উত্তরা দির বিয়েটাও ঠিক করা ছিলো। যদিও ওদের বিয়েটা হবে কিনা তাই নিয়ে অনেক সন্দেহ ছিলো। আসলে কি জানিস তো উত্তরা দি দাদাভাইকে অনেকদিন আগে থেকে পছন্দ করলেও দাদাভাই ওকে নিয়ে সেভাবে কোনদিন ভেবে দেখেনি।মেয়েটা অনেক কষ্টও পেয়েছে সেজন্য।কিন্তু যাই হোক শেষ ভালো যখন সব ভালো।এখন দাদাভাই আর উত্তরাদির মধ্যে বন্ধুত্বটা অনেকটাই ভালো।আর একটু ভালো করার জন্য তো আমরা রয়েইছি।আমরা এটাকে নিয়ে বিয়ের প্ল্যান করতেই পারি।কি বলিস??”

না এবার আর কিছু ভাবার ক্ষমতা নেই আদ্রিতার।ও এতোদিন মনে মনে আবির্ভাবকে অনেকটাই নিজের পাশে বসিয়েছিলো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেটা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।আবির্ভাব যে অন্য কারোর।আর সেটা অনেকদিন আগে থেকেই। আমিই বরং ওদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত মানুষ হয়ে ঢুকে পরেছি।আবির্ভাব হয়তো আমাকে নিজের একজন বন্ধু ভাবে।আর আমিই এসব উল্টো পালটা ভাবছিলাম এতোদিন ধরে।আবির্ভাবকে আমি হয়তো সত্যিই পছন্দ করি।তাই ও আমাকে যতই বন্ধু ভাবুক না কেনো আমি এখানে দাঁড়িয়ে ওর আর উত্তরার বিয়ের প্ল্যানিং করতে পারবো না সবার সাথে। এতো মহান এখনো নিজেকে বানিয়ে উঠতে পারিনি।আমাকে ওর থেকে দূরে যেতেই হবে।

(১০)

আসলে আমরা যা চাই বা যেরকম ভাবে আমরা আমাদের মনের কল্পনাগুলোকে নিজের মতো করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তুলি অনেক সময়ই তা বাস্তবে এসে মেলে না।আসলে বাস্তব যে একেবারেই আলাদা।কল্পনাকে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে চলতে চায় সে।আদ্রিতার ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল।এরপর তো আদ্রিতা নিজের মতো করে অনেক হিসেব করে নিয়েছিল। একদম নিজের জন্য।
এই যেমন সেদিন উত্তরার সাথে আলাপ হয়ে,মৌলির কাছে উত্তরার পরিচয়টা পেয়ে আবার দুদিন পর হঠাৎ করে দুই পরিবারের লোকজনকে মৌলির বিয়ের সাথে সাথে আবির্ভাব আর উত্তরার বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে দেখে নিজেকে অনেকটাই নিজের মতো করে গোছানোর চেষ্টা করছিলো মেয়েটা।
” না আজ মনে হচ্ছে জীবনে হিসেব করে চলাটা কতোটা দরকার। হিসেবের বাইরে চললে কিছুই থাকেনা।আমি হয়তো সত্যিই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।যা আমার নয়,কোনদিন ছিলোই না তাকেই আমি নিজের ভাবতে শুরু করেছি।ভুলটা আমারই। আর এই সিক্রেট টাও আমার।একান্তই আমার।আর এখন তো এসব কথা কারোর কাছে বলা মানে শুধু শুধু বোকামি আর বাচ্চামি।শুধু শুধুই হঠাৎ করে হিসেবের বাইরে গিয়ে কাউকে নিয়ে বেশি ভাবা।আর সবথেকে বড় কথা এখন যদি আমার ফিলিংস গুলো কেউ জানতে পারে আমি সবার কাছে হাসির বিষয় হয়ে যাবো।আর আবির্ভাব। সে কি ভাববে।ও যদি জানতে পারে যে আমি ওকে নিয়ে এতো আকাশ কুসুম কল্পনা করে গেছি ওর পারমিশন ছাড়াই,যেখানে ও আমার সাথে শুধু বন্ধুর মতো মিশেছে।হয়তো সত্যিকারের বন্ধুও ভাবেনি।যদি ভাবতো তাহলে একবার হলেও উত্তরার কথাটা আমায় বলতো।কি জানি কেন বললো না।হয়তো বলতে চায়নি।”

এরপর কয়েকদিন আদ্রিতা আবির্ভাবকে খানিকটা এড়িয়েই চলছে। এখন আর কারনে অকারনে আবির্ভাবের সাথে ঘুরতে বেড়োয় না।এমনকি কথাও বলে খুব হিসেব করে।এইতো সেদিন মৌলি,আবির্ভাব আর বাড়ির সবাই মিলে মুভি দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো। আদ্রিতা খানিকটা ইচ্ছে করেই ওদের সাথে গেলো না।যদিওবা মৌলি অনেক জোড়াজুড়ি করেছিলো।কিন্তু আদ্রিতা যায়নি।হয়তো চেয়েছিলো ওদের সাথে বিশেষ করে আবির্ভাবের সাথে আর না জড়িয়ে পরতে।এমনিতেই অনেকটা কষ্ট পেয়েছে।আর চায়না নিজে নিজে কষ্ট পেতে।
আবির্ভাবেরও আজকাল আদ্রিতাকে কেমন যেন অচেনা লাগে।সেই হাসি খুশি প্রানখোলা মেয়েটা যেন আজ অনেকটাই চুপচাপ। কেমন যেন হিসেব করে চলছে কয়েকদিন। বিশেষ করে আমার সাথে। কথাও বলছে খুব মেপে মেপে।কিন্তু হলো টা কি হঠাৎ করে মেয়েটার।ওর সাথে কথা বলার একটা সুযোগও তো দিচ্ছে না।যে ওর কাছ থেকে জানতে চাইবো যে ওর কি হয়েছে।

(১১)

আজ রবিবার। সবাই ডাইনিং এ বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। আদ্রিতা হঠাৎ করে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে নীচে এসে দাঁড়ালো।সবাইকে তো ওকে এভাবে দেখে অবাক।মৌলি বলে উঠলো –
” একি আদ্রি তুই যাচ্ছিস কোথায় এইভাবে ব্যাগ গুছিয়ে? ”
– ” আসলে বাবা মা ফিরে এসেছে। আর পূজোর সময় তো বাড়িতে ছিলাম না।অনেকদিন দেখা হয়না।তাই বাড়িতে যাচ্ছি রে।”(আদ্রিতা)

– ” কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে যাচ্ছিস? আর তোর অফিস?”

– ” আসলে বাড়ির জন্য একটু মন কেমন করছে।তাই।আর অফিস যাবোনা কদিন।”

আবির্ভাব বেশ খানিকটা উত্তেজিত হয়েই এবার বলে উঠলো –
” তুমি আজকে যাবে আগে বলোনি তো।কালই তো তোমার সাথে কথা হলো।তখন তো এব্যাপারে কিছু বলোনি। আর আমি যাচ্ছি তোমার সাথে তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে।”
না আদ্রিতা আর অকারণ সহানুভূতি চায়না কারোর থেকে।এতে নিজের প্রতি আরো অন্যায় করা হবে আর আবার শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়া হবে।ও সেটা আর করতে পারবে না।তাই আদ্রিতা এবার বেশ খানিকটা গুছিয়ে কিছু কথা বললো আবির্ভাবকে।

” আসলে আগে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক হয়নি।কাল রাতেই ঠিক করলাম।আর সব কথা আমরা সবসময় বলে উঠতে পারি কি? পারি না।কখনো চাইলেও বলতে পারি না।আবার কখনো বলতে চাই না ইচ্ছে করেই।সে যাই হোক। আর তোমাকে শুধু শুধু ব্যস্ত হতে হবে না আমায় নিয়ে।আমি চলে যেতে পারবো।স্টেশনটা এখান থেকে খুব একটা দূরে না।আর আমার একা একা যাতায়াতের অভ্যাস আছে।যাই হোক আমি আসছি। ভালো থেকো।”

না এভাবে বলতেই হতো আমায়।আমি কোন ভুল করিনি।হয়তো এভাবে বলাতে আবির্ভাবের কিছুটা খারাপ লাগবে।কিন্তু সেটা তো সাময়িক। কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যাবে।এরপর আবার নিজের কাজ,নিজের প্রিয়জনদের সাথে ব্যস্ত হয়ে গেলে আমার বলা কোন কথাই আর মনে থাকবে না।কিন্তু এটা না করে আমি যদি বেশি জড়িয়ে পরতাম তাহলে আমার নিজের সাথে অন্যায় করা হতো।নিজেকে কষ্ট দেওয়া হতো।আর সত্যি কথা বলতে কি – আই নিড টাইম।আমার এবার নিজের জন্য কিছুটা সময় চাই।আমি সত্যিই খুব হাঁফিয়ে উঠেছি এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের হিসেব নিকেশ করতে করতে।আমাকে এবার সত্যিই কিছুটা সময় নিজেকে দিতে হবে।আর আমি একটু একা থাকতে চাই।নিজের মনের সাথে যে অনেক হিসেব বাকি আছে।খুব একান্তে হিসেবগুলো আমাকেই করতে হবে।আর এই মিথ্যেটাও বলতে হলো যে আমি বাড়ি যাচ্ছি।কিন্তু বাড়ি যেতে যে পারবো না।ওই যে ভিড়ের মধ্যে থাকতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে।একটু নিজের মতো থাকতে চাই।শান্তিনিকেতন। পিসিমনির কাছেই যাবো।শান্তিনিকেতনের নিরবতা,প্রকৃতির সৌন্দর্য্য,সেখানে ভেসে আসা আবহমান সঙ্গীত এগুলোই হয়তো মনকে একটু হলেও শান্ত করবে।

আচ্ছা আদ্রিতার কি হয়েছে।মেয়েটা কেন নিজেকে এতো গুটিয়ে নিচ্ছে।আর আজ হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি চলে গেলো। অবশ্য তুমি তার জন্য কারনও দেখালে।কিন্তু আমি জানি আদ্রিতা তুমি মিথ্যে মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলেছো সব।সে তুমি যতই গুছিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলো না কেন তোমার চোখ যে অন্য কিছু বলছিলো।তুমি আসলে আমার থেকে পালাতে চাইছিলে।কিন্তু কেন???

এসবই ভাবছিলো আবির্ভাব একমনে বসে।হঠাৎ করে একজনের ডাকে ভাবনাটা আপাতত থমকে গেলো।উত্তরা।
– আবির্ভাব।আসবো??
– হ্যাঁ এসো। বলো কেমন আছো? সব ঠিকঠাক চলছে তো?
– হ্যাঁ। আসলে তোমাকে একটা জিনিস দিতে এলাম।
– জিনিস? আমাকে? কি বলো তো?
– হ্যাঁ। এই যে আমার বিয়ের কার্ড।যদিওবা এখনো বেশ কিছুদিন দেরি আছে।তাও আমি আমার মতো করে নিজের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করাটা শুরু করে দিয়েছি।এই আর কি।আসলে বাবা মা চায় ভাইয়ার বিয়ের আগেই আমার বিয়েটা দিয়ে দিতে।আর আকাশও এখন নিজের কেরিয়ারের দিক থেকে পুরোপুরি সেটেল।
– আকাশ??
– আমার উড বি।বর্তমান বয়ফ্রেন্ড আর ভবিষ্যতের হাসবেন্ড। আসলে জানোতো আবির্ভাব আকাশ আমার জীবনে আসার পর আমি জেনেছি যে ভালোবাসা কাকে বলে।হ্যাঁ মানছি যে ছোটবেলায় তোমার প্রতি আমার একটা ফিলিংস ছিলো। কিন্তু ওটা ভালোবাসা নয়।ভালোলাগা।এখন সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারি। যাই হোক এবার তোমার কথা বলো তো। কবে সেটেল হচ্ছো?? আচ্ছা ওসব ছাড়ো নিজের পছন্দের মানুষটাকে কি বলা হয়েছে যে তুমি তাকে কতোটা পছন্দ করো।আদ্রিতা জানে তো তোমার মনের কথা??
– না ইয়ে মানে আসলে বলা হয়নি।
– কি? এখনো বলোনি?
– আরে প্রথম প্রথম তো সাহস ই পেতাম না।আর যখন সাহস করে ভাবলাম বলবো তখন ম্যাডামের মুড অফ্।আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।আর আজ তো হঠাৎ বাড়ি চলে গেলো।কি জানি মেয়েটার যে কি হয়েছে।আমার কোন কথায় বা ব্যবহারে কি কষ্ট পেয়েছে।
– আবির্ভাব আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি যে আদ্রিতার কি হয়েছে।আসলে কি জানোতো আদ্রিতাও তোমাকে মনে মনে পছন্দ করে।তাই সেদিন যখন মৌলীর কাছে শুনেছে যে আমি তোমার খুব ভালো বন্ধু ইনফ্যাক্ট এর বাইরেও আমার একটা পরিচয় আছে তখন নিজে থেকেই হয়তো সরে যেতে চাইছে।আর আজ মৌলির কাছে শুনলাম যে আমাদের যে বিয়ে ঠিক ছিলো অনেকদিন থেকেই এটা ও আদ্রিতাকে বলে দিয়েছে।আর আমার মনে হয় যে বাবা মা সেদিন কাকু কাকিমার সাথে আমাদের বিয়েটা নিয়ে আলোচনা করছিলো, সেটাও আদ্রিতা শুনে নিয়েছে।
– কি?? এটা নিয়ে আবার আলোচনা হচ্ছিলো?? কিন্তু আমি তো আগেই..
– আসলে কি আবির্ভাব। বাবা মা তো এতো কিছু জানেন না।ওরা ওদের মতো করে আমাদের ভালো চায়। তাই না।আর আমিও এতোদিন আকাশের কথা বাড়িতে বলিনি।কিন্তু আমি জানতাম না জানো যে বাবা মা ওই বিষয়টা নিয়ে আবার কথা বলবে।জানলে আমি আগেই বলে দিতাম আকাশের কথা।
তবে আমি ওদের সব বুঝিয়ে বলেছি আর মৌলিকেও।তবে এখন আর এবিষয়ে কোন চিন্তা নেই।এখন শুধু একটাই চিন্তা তোমার আর আদ্রিতার ভাব করানো বুঝলে।
– কিন্তু আদ্রিতা তো এখানে নেই
– তো কি হয়েছে।ও যেখানে আছে আমরাও সেখানেই যাবো।
সো এখন মিশন হলো আদ্রিতার লোকেশনে আমাদেরকে পৌঁছে যাওয়া। আর মেয়েটা সত্যি সত্যিই বাচ্চা।কেমন একা একা কষ্ট পাচ্ছে। যাই হোক ওকে আর কষ্ট পেতে দেওয়া যাবে না।এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে।এখন তাহলে মিশন আদ্রিতা।

(১২)

আজ দুদিন হয়ে গেলো আমি এখানে এসেছি।কই কেউ একটা ফোন পর্যন্ত করলো না।নাহয় জানতো না যে আমি এখানে এসেছি।কিন্তু আমি বাড়ি গিয়েছি এটা তো জানতো। এমনকি মৌলীও।ও এটা কিকরে করতে পারলো।এই নাকি আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। দেখিস আর কথা বলবো না আমি তোর সাথে।খুব রেগে আছি আমি।আর আবির্ভাব। ও হয়তো আমাকে ভুলেই গেছে।আর আমিও বা কিসব ভাবছি।মনে রাখবেই বা কেন??
শান্তিনিকতের সকালটা বেশ মনোরম।মনের সাথে বেশ ভালোই কথা বলা যায়।আদ্রিতাও তাই ই করছিলো। হঠাৎ করেই ওর পিসিমনির ডাক।

-আদ্রি দেখ মা কারা তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।
– কারা আসবে এখন। এখানে।তাও আবার আমার সাথে দেখা করতে।অদ্ভুত তো।কেউ তো জানেই না যে আমি এখানে এসেছি।আর এখানে আমার তেমন পরিচিতও কেউ নেই।তাহলে কারা।আচ্ছা পিসিমনির কোন চেনা পরিচিত কেউ নয় তো।হ্যাঁ হ্যাঁ তাই ই হবে।( মনে মনে ভাবলো আদ্রিতা)
– কি রে আদ্রি।আয় তাড়াতাড়ি।
– হ্যাঁ পিসিমনি আসছি।

বাইরে এসে আদ্রিতা যাদের দেখলো তাদের দেখে সত্যিই ও ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তাই কোন ভূমিকা না করেই হঠাৎ বলে উঠলো –

– একি।তোরা? তোরা এখানে? মানে কখন এলি? না মানে কিভাবে এলি? মানে কেন এলি? না মানে আমি বলতে চাইছি যে তোদের কি এখানে কোন কাজ ছিলো?

– এই তুই চুপ করতো।বাবা রে বাবা মেয়ের কতো প্রশ্ন।কখন,কেন,কিভাবে,কিজন্য আরো কতো কি।তুই কি ভাবলি তুই যে আমাদের মিথ্যে বলে এসেছিস আমরা বুঝতে পারবো না।তোর ফোন তো সুইচ অফ্ ছিলো।তারপর কাকিমার ফোনে ফোন করে জানতে পারলাম যে তুই বাড়ি যাসনি।আর আমি তো জানি একা থাকতে চাইলে তুই এই জায়গাটাই বেছে নিবি।পিসিমনির বাড়ি।শান্তিনিকেতন।আর আমাদেরও অনেকদিন ঘোড়া হয়নি।তাই চলে এলাম।তোর সাথে দেখাও হবে আবার ঘোড়াটাও হবে।কি আইডিয়া টা কেমন?? আর দেখ সায়ন,উত্তরা দি,আকাশ দা সবাই এসেছি আমরা। একেবারে সদলবলে।(মৌলী)

– হ্যাঁ সবই তো বুঝলাম।কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না।আকাশ ।তুই এখানে? এদের সাথে? তুই এদেরকে চিনিস??(আদ্রিতা)

-আদ্রিতা তোকে বলেছিলাম না তোর জন্য একটা সারপ্রাইস আছে।তোকে আমার জীবনের স্পেশাল মানুষটার সাথে পরিচয় করাবো।(আকাশ)

– হ্যাঁ বলেছিলিস তো।

– হ্যাঁ। এই হলো উত্তরা।মাই উড বি।সামনের মাসে আমাদের বিয়ে।হঠাৎ করেই বিয়েটা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেলো।ভেবেছিলাম তোকে সেদিনই বলে দেবো।কিন্তু এরা যখন তারপর তোকে সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যানটা করলো তখন আর এই প্ল্যানটা ক্যান্সেল করতে ইচ্ছে করলো না রে।(আকাশ)

– হ্যাঁ??? মানে আমি ঠিক শুনছি?? উত্তরার সাথে তোর বিয়ে?? এটা সত্যি?? (আদ্রিতা)

– হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। সত্যি সত্যি তিন সত্যি।আমার সাথে আকাশেরই বিয়ে।আমি বাবা ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।( হাসতে হাসতে বললো উত্তরা)

– কিন্তু মৌলী তুই যে বললি।তারপর সেদিন তো কাকু কাকিমাও…

– কি বলেছি আমি? কি জানতে চাইছিস?ও ওই উত্তরা দির সাথে দাদাভাই এর বিয়ের কথাটা।সরি রে।ওটা বড়সড় একটা মিসটেক হয়ে গেছে।আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে তুই কি আমার বলা ওই কথাটা শুনে এতোদিন ধরে মন খারাপ করে ছিলি?? কি রে বল।
( বেশ মজা করেই মৌলি কথাটা আদ্রিতাকে বললো)

– না না আমি কেন মন খারাপ করতে যাবো? আমি তো মন খারাপ করিনি।আর যার জন্য মন খারাপ সেই ই তো আসলো না।

– এই তুই কিছু বললি নাকি রে? ঠিক শুনতে পেলাম না।

– না না কই কিছু না তো।

– আরে তোরা কি সব গল্প এখনই করবি? খেতে হবে তো কিছু।যা তো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।( পিসিমনি)

-হ্যাঁ পিসিমনি যাচ্ছি।এই আদ্রিতাটাই আমাদের কেমন কনফিউস করে দিচ্ছে।চলো তো।( মৌলি)

(১৩)

ইস্।কিসব ভুলভাল ভেবে গেলাম এতোদিন ধরে।মিছি মিছিই নিজেকে কষ্ট দেওয়া হলো।সবাই ঠিকই বলে, যে আদ্রিতা তুই এখনো বাচ্চাটাই রয়ে গেলি।এখন মনে হচ্ছে সত্যিই লোকজন ভুল কিছু বলে না।কিন্তু আবির্ভাব। ও কোথায়?? ও তো এলো না। আমার উপরে মনে হয় খুব রেগে আছে।আর রেগে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। এটা ঠিক যে ওর সাথে উত্তরার কোন সম্পর্ক নেই।তবে তার মানে তো এটাও নয় যে ও আমায় পছন্দ করে।এরকম ভাবার কোন মানেই হয় না।যাই হোক।কিন্তু আমি তো ওকে পছন্দ করি।ওকে ভালোবাসি।তাই আমি এটাই চাই ও যেন সবসময় ভালো থাকে।ও যাকে পছন্দ করে, যেভাবে ভালো থাকতে পছন্দ করে সেভাবেই যেন ভালো থাকে।
আমি এটাই চাই।(এসবই বাড়ির থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা মাঠে একা একা বসে ভাবছিলো আদ্রিতা)

– প্রথমত আমি তোমাকে চাই
তোমার মতো করে আমি তোমাকে চাই
আমার আমির জন্য তোমাকেই চাই
একসাথে ভরসায় থাকবো, তোমাকে চাই
পাশাপাশি হাতটা ধরে তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই।।

আদ্রিতা হঠাৎ করে খুব স্থির হয়ে গেলো। চঞ্চলতাটা যেন এই মুহূর্তের জন্য একেবারেই নেই।এ আমি কাকে দেখছি।আবির্ভাব। গিটার হাতে।আর ও কি বললো।আমি কি ঠিক শুনলাম?এতোটা সুন্দর করে,নিজের মতো করে ও কথাগুলো আমাকে বললো।আমি কি ঠিক ভাবছি?

– কি ম্যাডাম।কি ভাবছেন? উত্তরার ব্যাপারটা তো এতোক্ষনে জেনে গেছেন।তো এবার কি ভাবছেন এই যে আমি আপনার উপর হয়তো প্রচুর রেগে আছি।হয়তো আর কথাই বলবো না।তাই সবাই যখন এলো তাও আমি আপনার সাথে দেখা করতে এলাম না।এই তো??

– না মানে হ্যাঁ মানে।মানে তুমি কিকরে জানলে?

– আরে তোমাকে জানবো না, তোমাকে চিনবো না এটা কি হয়? ওই যে বললাম তোমার মতো করে আমি তোমাকে চাই।আর তাছাড়া তুমি যা ক্ষেপি আর পাগলি তাতে যে তুমি এটাই ভাববে তা আমি খুব ভালো করেই জানি।

– কি? আমি ক্ষেপি আর পাগলি? তুমি আমাকে এমন বলতে পারলে?( খানিকটা মিথ্যে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে আদ্রিতা বললো)

– কেন? কোন সন্দেহ আছে? আমার তো নেই।তা না হলে বুনু কি বললো আর তুমি কি শুনলে তাই নিয়ে এতোদূর ভেবে ফেললে।যে চুপচাপ আমাদেরকে মিথ্যে কথা বলে এখানে চলে এলে।নিজে নিজে এতোদিন ধরে কষ্ট পেলে।মানছি আমি তোমাকে উত্তরার কথা বলিনি।আসলে ও আমাকে বন্ধু ভাবলেও আমিই হয়তো ওর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি।ওকে বন্ধু ভাবতে পারিনি।তারপর যখন তুমি তোমার আর আকাশের বন্ধুত্বের কথাটা বললে আমি যেনো তখন বন্ধুত্বের একটা নতুন মানে খুঁজে পেলাম।সত্যি বলছি।একদম নতুন মানে।আর সেটা তোমার থেকেই শিখেছি।তাইতো আবার নতুন করে ওকে ওর বন্ধুত্বের মর্যাদাটা আমি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।সবটাই শুধুমাত্র তোমার জন্য।তোমাকে বলবো বলেও ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই মহারানি গেলেন রেগে।আমাকে এভোয়েড করেই তো চলতে।বলার সুযোগটাই তো দিলে না।

আদ্রিতার এবার সত্যিই আর কিছু বলার থাকে না।সত্যিই আমি বোকা। কিভাবে নিজের কাছের মানুষটাকে এতোটা ভুল ভাবতে পারলাম?? শুধু একটা কথাই বলে-
” আবির্ভাব। সরি।আমি জানি আমি খুব ভুল করে ফেলেছি।”
– ধূর পাগলি।জানোনা বন্ধুত্বে নো সরি নো থ্যাংকস। তুমিই আমায় একদিন বলেছিলে।
আদ্রিতা।তুমি আমার সাথে আমায় নিয়ে সারাটা জীবন থাকবে তো??
আবির্ভাবের এই স্থির প্রশ্নটার উত্তরে আদ্রিতার হয়তো অনেক কিছুই বলার ছিল।কিন্তু ওতো কথা বলতে পারলো না।শুধু কয়েকটা শব্দই গুছিয়ে নিয়ে বলতে পারলো-
তোমার পাশে থেকে আমি তোমাকে চাই
সারাটা জীবন আমি তোমাকে চাই
ভালো থাকার জন্য আমি তোমাকে চাই
তোমার জন্য আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই।।

আবির্ভাব এবার আদ্রিতার হাতটা ধরে নিলো শক্ত করে।নিজের জন্য।আর ওর আদ্রিতার জন্য।জিতে গেলো একটা সুন্দর বন্ধুত্ব।শুরু হলো একটা মিষ্টি ভালোবাসার…………

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here