শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই 💞( দ্বিতীয় পর্ব )

শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই 💞( দ্বিতীয় পর্ব )
কলমে- দেবিকা_সাহা

(৫)
পঞ্চমীর রাতটা বেশ ভালোই কাটলো। বাড়ির পাশের প্যান্ডেলটার সাজো সাজো রব আর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কতোটা এটা দেখতেই বাড়ির খুদে সদস্যদের নিয়ে বেড়িয়েছিল আদ্রিতা।আর ছোটদের সাথে সময় কাটানো বরাবরই প্রিয় আদ্রিতার কাছে।ওদের সাথে ঘোড়া, ওদের সাথে গল্প,আড্ডা এই সবকিছু যেন একটা অন্য মাত্রার আনন্দ এনে দেয় বলে ওর মনে হয়।এসব নিয়েই দিনটা বেশ কাটলো।শুধু সকালবেলা অজান্তেই একটা ভুলভাল কাজ করে ফেলেছে আর সেটা যে কিভাবে মেটানো যায় সেটা নিয়েই আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে মেয়েটা।

আরে আমি জানবো কিকরে যে ওই ব্যক্তিই মৌলির সেই সেলিব্রিটি দাদা।আর জানলেই বা কি।আমি কি ভুল কিছু বলেছি নাকি।ওনারই তো দোষ। আবার মিনিমাম ভদ্রতার খাতিরে সরি টুকুও বলতে পারলেন না।তখন নয় সময় ছিল না।কিন্তু এখন দেখো।দেখেও যেন চিনতে পারছেন না।এখন তো আবার মনে হচ্ছে যে একটু মেমোরি প্রবলেম-ও রয়েছে যার জন্য সবকিছু মনে রাখতে পারেন না।কিন্তু আমার তো আর তা নেই।আমি যে কি করি।ধুর মৌলি নাকি এই দাদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এসবই আস্তে আস্তে আওড়াচ্ছিল আদ্রিতা ড্রয়িংরুমের সোফাটার উপর বসে।হঠাৎ করেই আবির্ভাব বলে উঠলো –
” এক্সকিউজ মি ম্যাডাম। আপনার কি কিছু হয়েছে? মানে কোন কারনে কি আপসেট।না মানে এভাবে বিড়বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছেন।মানে সামনে তো কেউ নেই।আপনি নিজে নিজেই বলছেন।তাই বললাম আর কি।প্রবলেম হলে বলতে পারেন।দ্বিধা বোধ করার কিচ্ছু নেই।আচ্ছা বুনুকে ডেকে দেবো??”

– কি??? আর আপনি??না মানে আপনি এখানে কখন এলেন? আমি তো খেয়াল করিনি।
– অনেকক্ষণ। ওই যখন থেকে আপনি নিজের মনে আমার নামে একঘটি জল বেশি খাচ্ছিলেন তখন থেকেই।আপনি খেয়াল করেননি।এনিওয়ে সরি।আসলে আপনি তখন হঠাৎ করে একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন করে উঠলেন যে আমি সত্যিই একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। মানে কেউ এরকম মুখের উপর এতো কথা বলেনি তো।আসলে অভিজ্ঞতাটা নিতান্তই প্রথম। তাই আর কি।যাই হোক সকালের ঘটনার জন্য সরি।
এবার আদ্রিতা কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।আসলে যতই বলুক ওর নিজেরও তো দোষটা খানিকটা হলেও ছিলো। তারপর আবির্ভাবকে না চিনেই যেভাবে থ্রেট দিয়েছিল তারপর আর কি কথা সাজিয়ে বলবে সেটাই ভাবতে পারছে না।তাও একটু ভেবে নিয়ে বললো-
আসলে দোষটা খানিকটা হলেও আমার।আমিই না বুঝে তখন…আসলে দেরি হয়ে গেছিলো তাই মাথাটা একটু গরম ছিলো আর কি।আর আমিও আপনাকে না চিনেই অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছি।আমিও রিয়েলি সরি।
– বাবা ম্যাডাম এতো শান্ত ভাবেও কথা বলতে পারে? তবে ওই রনচন্ডী রূপটাই কিন্তু বেস্ট।এনিওয়ে বাদ দিন।হাই আমি আবির্ভাব।
– আদ্রিতা।
এই ঘটনা মানে এভাবে আবির্ভাবের সাথে আলাপ হবার পর আদ্রিতাও মনেও খানিকটা ওর সম্পর্কে ভাবনাটা পরিবর্তন হলো। তা সে একটুখানি হলেও।আসলে মৌলির মুখে আবির্ভাবের এতো প্রশংসা শুনে মনে হয়েছিল ছেলেটা হয়তো কিছুটা হলেও অহংকারী। কিন্তু বাস্তবে সেই ভাবনাটা সত্যিই ভুল। বিশেষ করে সকালে ওতো কিছু বলার পরেও এতো শান্ত ব্যবহার আদ্রিতা একেবারেই এক্সেপ্ট করেনি।যাই হোক ভাবনারাও তো ভুল হয়।এটা আবির্ভাব আজ প্রমান করে দিলো।
তারপর ষষ্ঠীর দিন বিকেলবেলা ঠাকুর দেখতে যাওয়ার যখন প্ল্যান হচ্ছিলো আবির্ভাবই তখন হঠাৎ করে আদ্রিতাকে ডেকে বললো-
আদ্রিতা এসো।বোসো না।আসলে আমরা কোথায় কোথায় যাওয়া যায় তার একটা গাইডলাইন বানাচ্ছিলাম।আসলে এই পুচকেগুলোকে নিয়ে যাবো তো।তাই একটা গাইডলাইন থাকার দরকার।তুমিও আমাদের হেল্প করো না যে কোথায় কিভাবে যাওয়া যায়।বুনু বলছিল তোমার নাকি এসব নিয়ে প্রচুর স্টক।প্লিজ হেল্প আস।
আদ্রিতাও কেমন অবাক হয়ে গেলো হঠাৎ করে।আসলে ও এখানে এটা করতেই আসছিলো কিন্তু আবির্ভাব ওকে এভাবে বলবে ভাবতে পারেনি।একদম আনএক্সেপ্টেড।তাই একটু হেসে কিছু কথা সাজিয়ে নিয়ে বললো-
আপনি তো প্ল্যান করছেন।করুন না।আমি তো পাশেই আছি মাঝে মাঝে আমার সাজেশন বলে দেবো।তবে আই থিংক আপনিই প্ল্যানটা করুন।তাতেই বেটার হবে।
– তা নাহয় বুঝলাম। সে আমি করছি।কিন্তু তুমি আমায় একটা কথা বলো আমায় দেখতে কি সত্যি খুব সিনিয়র সিটিজেন মনে হয় যে আপনি থেকে কিছুতেই তুমিতে আসা যায় না।আমি কিন্তু তুমিতে চলে এসেছি।
– এ মা তা নয়।
– কি তা নয়? তাই ই তো মনে হচ্ছে।
– না না ঠিকাছে প্ল্যানটা তুমিই করো।
– এই তো।দ্যাটস গুড।
(৬)
তারপর বেশ পূজোর কয়েকদিনে বেহিসাবেই আবির্ভাবের সাথে বেশ একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আদ্রিতার।একসাথে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে একসাথে ভোগ বিতরন করা,তারপর সেদিন মৌলি আর সায়নকে একটু একা বেড়োনোর সুযোগটা ওরাই প্ল্যান করে করে দিয়েছিল।আসলে মৌলি সায়নের উড বি।কয়েকমাস বাদেই ওদের বিয়ে।কিন্তু তবুও এই পূজোর মধ্যে বাড়িতে তো আর বলা যায়না যে সায়নের সাথে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি।তাই ও ভেবেছিলো যে এই আর্জিটা নিয়ে আদ্রিকে বলবে যে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে।কিন্তু ও বলার আগেই আদ্রিতা আর আবির্ভাব খুব সুন্দর ভাবে ওকে সারপ্রাইজটা দিয়েছিলো। মানে ওর সায়নের সাথে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সুযোগটা করে দিয়ে। আসলে সেদিন ছিলো অষ্টমীর সন্ধ্যে।তিনজন একসাথেই বেড়িয়েছিলো। কিন্তু ওই যে মৌলিকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে অবশিষ্ট যে দুজনই থাকলো।তখন আবির্ভাব বেশ মিষ্টি করেই কিছু কথা গুছিয়ে আদ্রিতাকে বলেছিলো-
” তাহলে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে আমার মনে হয় প্যান্ডেলের সামনে লাইনটাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরাই ভালো।আর কিছুই না।তাহলে আর টাইমটা নষ্ট হবে না।আরো কয়েকটা ঠাকুর বেশি দেখা যাবে।”
আদ্রিতা এবার সত্যিই অবাক হয়ে গেলো।শুধু একবার মনে হলো যে মৌলি ভুল কিছু বলেনি এতোদিন ধরে।আসলে আবির্ভাব সত্যিই হয়তো একটু আলাদা।
তারপর সেদিন আদ্রিতাও একটু হিসেবের বাইরে গিয়ে মিশেছিলো ছেলেটার সাথে। একসাথে ফুচকা খাওয়া তারপর নিজের পছন্দের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিমটা ছেড়ে আবির্ভাবের সাথে ওর পছন্দের ভ্যানিলা ফ্লেভার এর আইসক্রিম টারও টেস্ট করেছিলো অনেকটা ইচ্ছে করেই।তারপর হঠাৎ বাচ্চাদের মতো বেলুন কিনে দেওয়ার আবদারটা নিজের অজান্তেই আবির্ভাবের কাছে করেছিলো। এইভাবেই বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই অচেনা মানুষদুটো বেশ অনেকটাই চেনা হয়ে গিয়েছিল নিজেদের মধ্যে।
আবির্ভাবের তো মাঝে মাঝে মনে হয় আদ্রিতা পাশে থাকলে, ওর কথাগুলো শুনলে বেশ যেন অন্যরকম একটা কিছু মনে হয়।আর ওর বাচ্চামো গুলোও যেন এমনি এমনিই দেখতে ইচ্ছে করে।বিনা কারনে।বিনা শর্তে।এই যেমন সেদিন ফ্যামিলির সবাই মিলে বসে একটা ছোটখাটো আড্ডা হচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আদ্রিতা সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো –
এই ট্রুথ ডেয়ার খেললে কেমন হয়।আমি তো স্কুলে প্রচুর খেলতাম।কলেজেও খেলতাম।এই মৌলী তোর মনে আছে নিশ্চই।কি মজাই না হতো বল।
সবাই তো ওর এই আচমকা সাজেশনে কিছুটা হলেও অবাক।মৌলি তো বলেই বসলো-
আদ্রি সেটাতো কলেজ আর এটা তো বাড়ি।
আদ্রিতা এবার বুঝতে পারলো যে ভুল জায়গায় ভুল কথা উপস্থাপন করা হয়ে গেছে।তাই হঠাৎ করে একটু হেসে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। আবার সেদিন ওই লুডো খেলায় হেরে যাওয়ায় ম্যাডামের কি মুড অফ্।কেমন বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে ছিলো।তারপর আবার পূজোর দিন বেলুন পেয়ে তার কি আনন্দ।কে বলবে যে এই মেয়ে নাকি চাকরি করে।আজকাল ওর এই বাচ্চামি গুলোই খুব খুব ভালো লাগে আবির্ভাবের। সবসময় যেন কারনে অকারনে ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে।আজকাল তো নিজের মনকে নিজেই বোঝে না আবির্ভাব। আদ্রিতার প্রতি যে কি ফিলিংস তা ঠিক বলতে পারবে না।শুধু এটুকু জানে যে আদ্রিতা পাশে থাকলে ওর সত্যিই খুব ভালো লাগে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় কই উত্তরা যখন আমার সাথে কথা বলতো,নিজের মতো করে আমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করতো তখন তো এরকম আলাদা করে কিছু মনে হতো না।কোন অন্যরকম ভালো লাগাও কাজ করতো না।কখনো একটু ইচ্ছে করেও একটা থ্যাংকস জানাতেও মন চাইতো না।তারপর যেদিন হয়তোবা রাগের বশেই আমার সাথে সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো একবারও তো রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করিনি।ভাঙানো তো দূরে থাক একটা কথাও তো বলে দেখিনি এতোগুলা বছরে।না আজ সত্যিই মনে হচ্ছে আদ্রিতা হয়তো আমার কাছে অনেকটাই আলাদা।যাকে নিয়ে হিসেবের বাইরেও অনেক চিন্তা মনে আসে।হিসেবের বাইরেও যার সাথে কথা বলা যায়।যার সাথে থাকলে হাসিটাও হয়তো হিসেব নিকেশের বাইরে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে থাকে…..

(৭)

ইস্। কতোটা দেরি হয়ে গেলো।একে তো পূজোতে একদিনও দেখা করিনি। কিন্তু তাতে তো আমার কোন দোষ নেই তিনি তো নিজেই ব্যস্ত ছিলেন নিজের স্পেশাল কাজে।কিন্তু তা কি আর সে শুনবে।সেই তো ঘুড়ে ফিরে আমাকেই বলবে যে তুই তো ভিভিআইপি।তোর তো দেখাই পাওয়া যায়না। আরো কতো কি।তারউপর আবার আজকেও লেট হয়ে গেলো।সত্যি আজ আমার আর মনে হচ্ছে রক্ষা নেই।
প্রায় একরকম তাড়াহুড়োতেই আদ্রিতা ছুটলো আকাশের সাথে দেখা করতে।ছেলেটা এতোদিন নিজের আর্ট এক্সিবিশনের কিছু কাজে কোলকাতার বাইরে ছিলো। তাই পূজোর কটাদিন একবারও দেখা হয়নি।নইলে তো প্ল্যান ছিলো পূজোয় একদিন ওর সাথে বেরোবে।কোনবারই তো তার সাথে বেরোনো হয়না।সেই তো পূজো উপলক্ষে প্রতিবারই বাড়িতে চলে যেতে হয় আর ফেরা তো সেই পূজো কাটিয়ে।আর এবার যখন সুযোগটা পাওয়া গেলো তখনও হলো না।যাই হোক আকাশের আর্ট এক্সিবিশনটা তো ফাইনালি হচ্ছে।সত্যি ছেলেটা এই দিনটার জন্য কতো স্বপ্নই না দেখেছে সবসময়। আজ আলটিমেটলি স্বপ্ন পূরনের দিন।আর আকাশের কড়া নির্দেশ আদ্রিতাকে ওর সাথে এক্সিবিশনে থাকতেই হবে।কিছুক্ষনের জন্য হলেও।

আজ দশমী।পূজো প্রায় শেষ।তবু্ও পূজো শেষের আবেশটুকুকেও যে পুরোটা নিতে হবে।কাল থেকে তো আবার প্রতিদিনের রুটিনমাফিক ব্যস্ত জীবনের শুরু।তাই একটা মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না।

আবির্ভাবও তাই বেড়িয়েছিলো পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। একে তো অনেকদিন দেখা হয়না তার উপর আবার পূজোর মধ্যে দেখা করতে যাওয়া তাই ফিরতে ফিরতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিলো। প্রায় বিকেল।হঠাৎ করে ভিড়ের মধ্যে আদ্রিতার মতো কাউকে মনে হলো।হ্যাঁ আদ্রিতাই তো।কিন্তু ও এখানে কিভাবে।ওর তো এখন লাইব্রেরিতে তে থাকার কথা।ফোনে তো তাই বলতে শুনলাম যে লাইব্রেরি যাচ্ছে,ইনফ্যাক্ট বাড়িতেও তো সবাই যখন আসতে দিতে চাইছিলো না তখন বললো লাইব্রেরিতে কি একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ রয়েছে যে যেতেই হবে।তাহলে এখানে কি করছে? লাইব্রেরি তো সম্পূর্ণ উল্টোদিকের রাস্তায়।আর যার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সেই ছেলেটাই বা কে? ওর কোন বন্ধু হয়তো। নাকি স্পেশাল কেউ? যদি বন্ধুদের সাথেই দেখা করতে হতো তাহলে মিথ্যে বলে আসার কি ছিল? আর এই কারনেই হয়তো আমি যখন সকালে বললাম যে লিফ্ট দিয়ে দেই তখন কেমন এভোয়েড করলো।
হঠাৎ করে দেখলো আদ্রিতা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একা দাঁড়িয়ে। হয়তো বাসের অপেক্ষায়। আর ছেলেটাও উল্টোদিকের অডিটোরিয়ামের দিকে ঢুকে গেলো।না আদ্রিতার সাথে কথা তো বলতেই হবে যে ও মিথ্যে কেনো বললো।অন্তত ওর কাছ থেকে তো মিথ্যেটা একদম এক্সেপ্ট করেনি আবির্ভাব। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আদ্রিতার সামনে গিয়েই গাড়িটা দাঁড় করালো।মেয়েটা আনমনে কোনও একদিকে তাকিয়ে আছে।তাই ওকে ঠিক খেয়াল করেনি।আবির্ভাব তখন ভূমিকা না করেই বলে উঠলো –
” হাই আদ্রিতা।এখন বাড়িতেই যাবে তো নিশ্চই। উঠে এসো।আমি বাড়িতেই যাচ্ছি।”
আদ্রিতা এতোক্ষণ আবির্ভাবকে লক্ষ্য করেনি।তাই ওর কথা শুনে হঠাৎ অবাক হয়ে গেলো।
-” তুমি?? তুমি এখানে? ”
– ” হ্যা।আসলে অনেকদিন বাদে এলাম তো।তাই পুরোনো বন্ধুদের সাথে একটু দেখা করতে এসেছিলাম।এখন ফিরছি।কিন্তু তুমি এখানে?? তোমার না লাইব্রেরিতে যাবার কথা ছিলো।আর আমি যতদুর জানি যে লাইব্রেরিটা সম্পূর্ণ উল্টো দিকের রাস্তায়। ”
– ” না মানে আসলে….”
আদ্রিতাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আবির্ভাব বলে উঠলো-
ঠিক আছে। তোমাকে কিছু এক্সপ্লেন করতে হবেনা।তুমি গাড়িতে ওঠো।
আদ্রিতা আর কিছু বলতে পারলো না।আসলে আবির্ভাব বেশ শান্ত আর স্থির ভাবেই কথাগুলো বলেছিলো।আর গাড়িতে উঠেও আদ্রিতা লক্ষ্য করলো যে ছেলেটা যেন নিজে থেকে আর কথা বলছে না।কেমন যেন চুপচাপ।তাই আদ্রিতা নিজে থেকেই বললো-
” আসলে আবির্ভাব।আমি আসলে সকালে ওভাবে…..”
” প্লিজ আদ্রিতা তোমাকে এক্সপ্লেন করতে হবেনা।তুমি কোথায় গেছিলে সত্যিই তো সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আসলে কি জানো তো নিজের কাছের মানুষদের কাছ থেকে মিথ্যে কথাটা ঠিক শুনতে পারিনা।আর আমিই বা এতো কথা বলছি কেনো।সত্যিই তো তোমার পার্সোনাল ব্যাপার। যাক বাদ দাও।আর তখন যদি আমার কোন কথার জন্য তুমি হার্ট হয়ে থাকো তাহলে রিয়েলি সরি। ”

সত্যিই আবির্ভাব হয়তো আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে।আর খারাপ লাগাটা তো স্বাভাবিক। আমার সাথেও যদি কেউ এমন ব্যবহার করতো তাহলে তো আমারও রাগ হতো।সত্যি বলতে দোষটা তো আমারই। আমিই তো ওরকম ভাবে সকালবেলা ওকে এভোয়েড করলাম।আসলে আমারও তো কিছু করার ছিলো না।সত্যিটা যে সবাইকে জানতে দেওয়া যেতো না।আমি তো নিজেই প্রমিস করেছিলাম নিজের কাছে।কিন্তু আবির্ভাব। ও কি বললো কিছুক্ষন আগে।আমি ওর কাছের মানুষ। সত্যিই কি এই কয়েকদিনে আমি ওর কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি।জানি না।তবে এটুকু জানি ও যখন এখন আমার উপর রেগে আছে,আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে, আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছে না তখন সত্যিই একটা ভীষণ খারাপ লাগা এসে ভিড় করছে মনে।না বন্ধু হিসেবে ওকে আমি সত্যিটা বলতেই পারি।এসব ভেবেই আদ্রিতা বেশ খানিকটা জোড় খাটিয়েই বললো-
” আবির্ভাব আজ তো দশমী।মা দুর্গার নিজের ঘরে ফেরার সময়।তাই মানছি যে আমাদের মন খারাপ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এরম মুখ গোমড়া করে বসে থাকলে মা কিন্তু খুব রাগ করবেন।তার থেকে বলি কি সামনে একটা ফুড কোর্ট আছে।আমার খুব প্রিয় জায়গা।চলো না ওখানে গিয়ে একটু আইসক্রিম খেয়ে আসি।গল্পও হবে আর তোমার মুডটাও ঠিক হয়ে যাবে।”
আবির্ভাব সত্যিই এবারো অবাক।তবে কি আদ্রিতার মুখের উপর না বলার ক্ষমতা ওর নেই।তাই একটু চাপা অভিমান আর অভিযোগ মনে নিয়েই বললো ঠিকাছে চলো।কিন্তু বেশিক্ষণ কিন্তু থাকা যাবে না।এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
– একদম।দেরি হবে না।তাহলে যাওয়া যাক।
(৮)

” দেখো আবির্ভাব আমি ভূমিকা না করেই বলছি।আমি জানি তুমি আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছো।তুমি হয়তো এটাই ভাবছো যে আমি মিথ্যে কেন বলতে গেলাম।সত্যিই তো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলে মিথ্যে কথা বলার দরকারটা কি।আর আমি জানি না তুমি আমার সাথে আকাশকে দেখেছো কিনা।আসলে ওর সাথে দেখা করতে গেলে আমাকে এমনটাই করতে হয়।মিথ্যে বলতে হয়।ইচ্ছে না থাকলেও বলতে হয়।”
ও তার মানে সত্যিই ভুল কিছু ভাবিনি।আদ্রিতার জীবনে সেই স্পেশাল মানুষটা হয়তো আছেই।সত্যিই আই থিংক সে খুব লাকি।আদ্রিতার মতো কাউকে নিজের পাশে পেয়েছে।
– ” আদ্রিতা ইটস্ ওকে।দেখো আমি রেগে নেই।রিল্যাক্স। হ্যা আমি তোমার সাথে তোমার আকাশকে দেখেছি।সত্যিই খুব ভালো লাগছিলো তোমাদের দুজনকে”
– ” এই এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড। কি বললে আমার আকাশ, আমাদেরকে। এই তুমি আবার ওকে আমার বয় ফ্রেন্ড ভাবছো না তো।”
– ” হ্যাঁ মানে না মানে হ্যাঁ। মানে তুমিই তো তাই বললে।তুমিই তো বললে যে ওর সাথে দেখা করতে গেলে তোমাকে সবার কাছে মিথ্যে বলতে হয়।মানে স্পেশাল কেউ নিশ্চই।নাহলে দেখা করতে হলে মিথ্যে কেন বলতে হবে??”
– ” মানে সত্যি। আমি স্পিচলেস।মৌলি দাদার নামে এতো প্রশংসা করতো, কই কখনো তো বলেনি যে তার দাদা একটু মাথামোটা আছে”
– কি?????
– তো কি।কিসব যুক্তি।স্পেশাল কারোর সাথে কথা বলতে গেলে নাকি মিথ্যে কথা বলতে হয়।কই তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে কতোবার কার কাছে মিথ্যে বলেছি।সত্যি এমন যুক্তি কে দেয়।

এটা কি বললো আদ্রিতা। আমার সাথে কথা বলার সাথে স্পেশাল কারো তুলনা।আবির্ভাবের ভাবনার মাঝেই আদ্রিতা আবার বলে উঠলো –

” আসলে আকাশ আমার খুব ভালো বন্ধু।যদিও সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ওর আমাকে প্রপোজ করা দিয়েই।রিলেশনেও ছিলাম বেশ কয়েকদিন।আসলে ছোটবেলার প্রেম তো।ভালোলাগাটাই থাকে তাতে।ভালোবাসা নয়।ওই আবেগে ভাসা যাকে বলে।তখন আমার সবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হয়েছে।বুঝতেই পারছো ম্যাচুরিটি একেবারেই কম।আর সত্যি বলতে কি প্রেমটা টেকেওনি।যদিও ওটা প্রেম কম পাগলামিই ছিল বেশি।আর আকাশ আর আমার চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণই আলাদা।তাই ব্রেকাপটা হয়েই গেছিলো। আসলে তার পর ও আমাকে কম কথা শোনায়নি।তখন সত্যিই খুব খারাপ লেগেছিল আর আপসেটও ছিলাম।একে তো ওই ছোট বয়সে এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে পড়াশুনোর ক্ষতি করেছিলাম তার উপর আবার এসব নিয়ে আপসেটও ছিলাম।আর আমার এসব কান্ড মায়ের চোখ এড়াইনি।তাই একপ্রকার বারনই করে দিয়েছিলো ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে। আসলে মা হয়তো ভেবেছিল আমি এসব ভাবলে আরো বেশি কষ্ট পাবো।তাই হয়তো এমন বলেছিল।কিন্তু কদিন বাদে আকাশ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য ক্ষমা চেয়েছিল।আর সত্যি বলতে ছেলেটা আমায় খুব ভরসা করে।তাই আর কারো ভরসায় আঘাত করতে চাইলাম না।আসলে ওর কারনেই আমার একদিন ভরসা ভেঙেছিল।কারোর উপর সেভাবে ভরসা করা আমি ভুলেই গেছি তারপর থেকে।ভয় পাই জানোতো খুব।যে যদি কোন কারনে ভরসা, বিশ্বাস এগুলো ভেঙে যায়।তাই আর ওর আমার প্রতি ভরসায় আঘাত করতে পারলাম না।আমি একেবারেই চাইনা এই সেম কষ্ট আরো কেউ পাক।তাই আসলে যোগাযোগটা রাখি।আর বন্ধুত্বও টা।আর বাড়িতে এটা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে।তাই আর কাউকে কিছু বলিনা।যে যার মতো ভালো থাকুক।এই আর কি।”
সত্যিই মেয়েটা অদ্ভুত। যার জন্য নিজে একসময় কষ্ট পেয়েছে তাকেই আঘাত করতে চায় না।
– ” আচ্ছা তুমি কি এখনও আকাশকে পছন্দ করো??”
– পাগল নাকি।এবার দেখছি তুমি সত্যি সত্যিই মাথা মোটা।এতোক্ষন আমি তোমায় কি বোঝালাম এতো বকবক করে?? আরে এসবের বাইরেও একটা শব্দ থাকে। আর সেটা হলো ‘বন্ধু’।
আর সেটা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দুজনেরই।কেউ যদি তোমায় সত্যি সত্যি মন থেকে নিজের বন্ধু ভাবে তো তোমারই রেসপন্সিবিলিটি থাকে সেই বন্ধুত্বটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কারন জীবনে তোমার কথা ভাববে এমন বন্ধুর সংখ্যা খুব কমই।তাই কাউকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই।বুঝলে।
আবির্ভাব আজ সত্যিই অভিভূত। কতো সুন্দর করে বন্ধুত্বের ব্যখ্যা দিলো মেয়েটা। সত্যিই মেয়েটা আলাদা।একদম আলাদা।সবার থেকে আলাদা।
©দেবিকা..

……………..(চলবে)…………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here