শুভ্র_রঙের_প্রেম
পর্বঃ৩৩
লেখিকা~#রুবাইদা_হৃদি
সকালের নম্র বাতাস গুলো সাদা রঙের পর্দা ঠেলে সূর্যের মোলায়েম রোদ গুলোকে ঘরের মেঝেতে আছড়ে ফেলছে৷ হাওয়ায় দুলছে পাশে থাকা মানি প্ল্যান্টের সবুজ কুঁচি পাতা৷ বাতাসে আজ স্নিগ্ধতা ঘেরা৷ ফজরের আজান পরেছে সেই কখন৷ সদ্যস্নাত ভোরের আলো চোখেমুখে পরতেই চোখ খুলে নিজেকে স্নিগ্ধের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেতেই একরাশ লজ্জা হানা দেয়৷ আমি লজ্জায় উনার সাথে আরো মিশে চুপটি মেরে শুয়ে থাকি৷
দুনিয়া ভুলানো লজ্জা বোধহয় স্বামী নামক মানুষটার মাঝেই সীমাবদ্ধ৷ সমস্ত লজ্জা বোধহয় তাদের সামনেই উজাড় করার মাঝেও আলাদা শান্তি আছে৷ আমি আলতো ভাবে গুটিশুটি মেরে উনার বুকের ভেতর মিশে যেতে চাচ্ছি৷
–‘ বেড়াল ছানার মতো গুটিয়ে যাচ্ছো কেন? ‘
উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলতেই আমি দ্রুত সরে আসতে যাই৷ তার শক্ত বন্ধন থেকে মুক্ত না পেয়ে আরো জড়িয়ে গেলাম৷ একহাত একটু ছাড়া পেতেই চাঁদর উঠিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি৷ উনি হাসছেন!
চাঁদর সরিয়ে দিয়ে কঁপালে উষ্ণ পরশ দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি৷ প্রায় অনেকটা সময় পরে কোমল স্বরে বললেন,
–‘ ঘুম হয়েছে? রাত ঠিকঠাক কেটেছে তো? ‘
–‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! আপনার মুখে কথা আটকায় না? ‘
–‘ পজেটিভ মাইন্ডে নিলে পজেটিভ৷ আর তোমার মাইন্ডে নেগেটিভ কথাবার্তার ছড়াছড়ি সেটা আমি ভালোই জানি৷ ‘
আমি মুখ উঁচু করে তাকালাম৷ ভ্রু কুঁচকে বললাম,
–‘ আপনি আমার মাইন্ড ট্রাভেল করেছেন? উল্টাপাল্টা অপবাদ দিলেই হয় নাকি? ‘
–‘ অপবাদ দিয়েছি কি-না জানি না৷ তবে তোমার লজ্জা রাঙা রুপ থেকে ঝগড়ুটে রুপ দেখা সেটা দেখা দারুণ উপভোগ্য৷ ‘
আমি উনার কথা শুনে ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ উনি আমার মাথা টেনে বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে রেখে বললেন,
–‘ তোমায় লজ্জা পেলে স্পাইসি লাগে৷ ইউ নো? আই লাভ স্পাইসি৷ দেখলেই মনে হয় খেয়ে ফেলি৷ ‘
.
.
সারা ড্রয়িং রুম জুড়ে বিস্ফোরিত চোখের আনাগোনা৷ আমি মই বেয়ে উনার আগেই বাসায় ঢুকেছি৷ ঢুকতেই দেখি সব গুলো ড্রয়িং রুমে বসে আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে৷ ওদের তাকানো দেখে আমি ঘোমটা আরো টেনে নিলাম৷ কেমন অপ্রস্তুত লাগছে৷ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সব ঠিক আছে কি-না!
পেছন থেকে পায়ের শব্দ পেতেই দেখি সে একহাত দিয়ে ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে এগিয়ে আসছে৷ ব্লু রঙের শার্ট টা তে অতিরিক্ত সুন্দর দেখাচ্ছে৷ ফর্সা লোমশ হাতে লাল হয়ে যাওয়া একটু জায়গা চোখে পরতেই লজ্জায় আর অস্বস্তি তে পরে যাই৷ এখানে যে কয়টা আছে সব নির্লজ্জ৷ পরশ স্যারের সামনে কি সব বলবে ভেবেই আমার দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে৷
উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাশে থেকে শাড়ি টেনে কোমর ঢেকে দেন সবার অগোচরে৷ ফিসফিস করে বললেন,
–‘ শাড়ি সামলাতে পারো না? ‘
–‘ সেফটি পিন ফেলে গিয়েছি নিচেই৷ পিন ছাড়া এদিক ওদিক সরে তো যাবেই৷ ‘
উনি কঁপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ তোমায় না বলেছি, যেখানে যাবে তোমার আগে যেন সেফটি পিন যায়৷ ‘
–‘ আপনি’ই তো আমার সেফটি পিন৷ নকল পিনের আর কি দরকার বলেন তো? ‘
উনি মাথা নীচু করে দুলিয়ে হাসলেন আমার কথা শুনে৷ আমিও হাসলাম৷ উনি সামনে তাকাতেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন,
–‘ এনিথিং রং গাইস? মুখ এমন চুপসে যাওয়া লেবুর মতো কেন? ‘
–‘ গুরু গো….ওও সাদা রঙের দুলাভাই আপনি এইভাবে ধোকা আমারে দিবার পারলেন? ‘
রাহাত উঠে দাঁড়িয়ে বিলাপ করে বলল৷ আমি বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললাম৷ এই ছেলেটা এতো ন্যাকামো করে৷ আমি কিছু বলার আগে নোমান ভাইয়া এগিয়ে এসে থমথমে মুখে গাল দেখিয়ে বললেন,
–‘ এই দ্যাখ৷ ‘ আমি আর উনি নোমান ভাইয়ার গালে তাকালাম৷ দেখি লাল হয়ে আছে৷
উনি হঠাৎ গেঞ্জি টেনে খুলতেই আমার চোখের উপর উনি হাত দিয়ে ঢেকে রাগী সুরে নোমান ভাইয়ার উদ্দেশ্য বললেন,
–‘ এইটা কি তোর বেডরুম? গেঞ্জি রুমে গিয়ে খোল৷ এই মীম,ওকে রুমে নিয়ে যা তো৷ ‘
নোমান ভাইয়া উনার কথা না শুনেই পেছন ফিরে পিঠ দেখিয়ে বললেন,
–‘ দেখ দোস্ত দেখ! তোর বাসর ঘরের ব্যাঘাত রুখতে গিয়ে কিছু জন্তুরা আমার পিঠের হাল কি বানিয়েছে৷ ‘
উনি তাকিয়ে দেখলেন,সম্পূর্ণ পিঠ লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ মীম আপু ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ধরাম করে ঘুষি মেরে বললেন,
–‘ স্নিগ্ধ, এই মিথ্যুক মিথ্যা কথা বলছে৷ এর কথা একদম বিশ্বাস করবি না৷ ‘
–‘ শালা মিথ্যুক৷ আমাকে রঙ দিয়ে কি বানিয়েছে দেখ৷ কেমন লাল বান্দরের মতো দেখা যায়৷ ‘ আদি ভাইয়াও কোথা থেকে এসে আরেকটা ঘুষি মেরে বললেন৷ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেন নোমান ভাইয়া৷ আমার চোখ থেকে উনার হাত সরে গেছে সেই কখন৷ আমি আদি ভাইয়াকে দেখে হো হো করে হেসে উঠলাম৷ পুরো মুখ,কান,দাঁত,ঠোঁট সব লাল হয়ে আছে৷ আমার হাসি দেখে জান্নাত আরো জোরে জোরে হেসে উঠে বলল,
–‘ বুঝলা সবাই ,আমি আদা দেখেছি কিন্তু লাল আদা জীবনে প্রথম দেখলাম৷ ‘
আদি ভাইয়া কটমট চোখে তাকিয়ে বললেন,
–‘ তোমার গাল আর আমার গাল লাল৷ দুইজন আমরা এক তাই না জানু৷ ‘
–‘ হৃদি আপু এই আদাকে কিছু বলো তুমি৷ ‘
আমি এদের ঝগড়া দেখে কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ নীতি কোথায়? ও এই পরিস্থিতি সামলাতে পারবে৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও নেই৷ সাথে রাফিন ও৷ তার দিকে তাকাতেই এতো হট্টগোলর মধ্যেও আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বললেন,
–‘ ভোরে ঢাকা চলে গেছে৷ আব্বু-আম্মু যেতে বলেছে৷ ‘
–‘ স্নিগ্ধ, তোর জন্য মাইর খেয়ে তক্তা হলাম কিছু বলবি না এই জন্তুদের? ‘
নোমান ভাইয়ার কথা শুনে উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সবার উদ্দেশ্য বললেন,
–‘ আমার তরফ থেকে আরো দু-চার ঘা লাগিয়ে
দে৷ ‘
মীম আপু আর আদি ভাইয়া সত্যি মার দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ভাইয়া বললেন,
–‘ আপু বাঁচাও প্লিজ৷ আই সোয়্যার আর মিথ্যা বলবো না৷ তোমাদের বাঁচানোর জন্য কতো কিছু সহ্য করতে হচ্ছে৷ ‘
–‘ কাল সব প্ল্যান তুই করে ওদের ফাঁসিয়েছিস৷ এখন আমার সামনে ন্যাকা সাজা হচ্ছে তাই না? ‘
উনি বলেই নোমান ভাইয়ার পিঠে মারলেন৷ বেচারা মার খেতে খেতে মরেই যাবে৷
কাল চিলেকোঠার সকল ব্যবস্থা উনিই করে দিয়েছেন৷ আর নিচে সবাইকে নিয়ে রঙ ঢালার প্ল্যান৷ আদি ভাইয়াকে বেডের কোণায় রেখেছেন যাতে রঙ তার উপর ঢালতে পারেন৷ মীম আপু আর তার বিয়ের সময় না’কি আদি ভাইয়া এই কাজ করেছিলো৷
তবে মীম আপুর ব্যাপারটা বুঝছি না সে কেন মারছে৷
নোমান ভাইয়া মীম আপুর আঁচল ধরে ক্লান্ত গলায় বললেন,
–‘ সত্যি বলছি বউ,আমার এক্স নেই৷ আমি কাল মিথ্যা বলেছি৷ তোমার রিয়্যাকশন দেখতে৷ ‘
মীম আপু আঁচল ছাড়িয়ে শাসিয়ে চলে গেলেন৷ ড্রয়িং রুম জুড়ে আবারো হাসির ফোয়ারা বয়ে গেলো৷
_________________________
সাদা রঙের মেঝেতে নানা ধরণের কারুকাজ করা৷ চারদিকের দেয়ালে সাদা আর কালো সংমিশ্রণে পেইন্ট করা৷ বেডের একসাইডে ছোট সেন্টার টেবিলের উপর যুগলবন্দী একটা ছবি৷ হিমছড়ির পাহাড়ে তোলা৷ যখন আমি পিছিয়ে যাচ্ছিলাম উনি হাত ধরে টান দিয়েছিলেন৷ সূর্যের প্রথম কিরণ হলুদ আভা ছড়াচ্ছে আমাকে আর উনাকে ঘিরে৷ উনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আর আমি অবাক চোখে৷ কি সুন্দর ছবি গুলো৷ মনে হচ্ছে জীবন্ত! হাত বাড়ালে ছুঁতে পারবো৷
–‘ আমি তোমার পাশেই আছি৷ ছুঁয়ে দেউ ওই ভোরের আলোর মতো৷
নিংড়ে দাও সমস্ত ভালোবাসা আমার সত্তায়৷ ‘
উনি আমার ঘাড়ে থুতনি রেখে বলতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠে৷
আমি কাঁপা গলায় বললাম,
–‘ স..রুন প্লীজ৷ ‘
–‘ কেন? ‘
–‘ আপনার ছোঁয়াতে কার্বন ডাই-অক্সাইড আছে৷ যা মূহুর্তেই আমার শ্বাস রোধ করে ফেলে৷ ‘
উনি আলতো স্পর্শ করলেন৷ আমি ছুটে চলে যেতে চাইলে আটকে বললেন,
–‘ পালাই পালাই করো কেন? যেখানে যাবে সব জায়গায় আমার বিচরণ পাবে৷ ‘
সব কিঁছুতে মোহময় আবেশের ছোঁয়া৷ উনি আমার ঠোঁটের দিকে আগাতেই জান্নাত আর রাহাত তাড়াহুড়ো করে ঢুকেই চোখে হাত দিয়ে বলল,
–‘ ভুল টাইমে এন্ট্রি৷ সর্যি সর্যি৷ ‘
–‘ কি রোম্যান্টিক স্টোরি দোস্ত৷ আমি তো ফিদা হয়েগেছি আপনার উপর দুলাভাই৷ ‘
আমি ঘুরে তাকিয়ে দৌড়ে বারান্দায় চলে যাই৷ ওরা কি ভাবছে? দিনে দিনে সব লজ্জা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে উনার৷
লজ্জা কীভাবে পেতে হয় সেটার ক্লাস বাংলাদেশে থাকা দরকার৷ তাহলে,এই সব লজ্জাহীন প্রেমিক পুরুষ গুলোকে শিক্ষা দেওয়া যেত…!
.
.
.
ফাগুন শেষের দিকে৷ রাস্তার ধারে এখনো লাল টকটকে শিমুলের আনাগোনা আছে৷ আবার কোনো গাছে সাদা তুলো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে৷ শান্ত নির্জন পরিবেশে ছুটে চলেছে৷ ঢাকা যাচ্ছি! রিসেপশনের আয়োজন কাল করা হচ্ছে৷ আজ যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে,উনার ” ভুবন বিলাস ”
এনজিও৷ সেখানে সকল বাচ্চাদের সাথে দেখা করা৷ নোমান ভাইয়া আর মীম আপু বাদে সবাই আমাদের সাথে যাচ্ছে৷ আগামীকাল তারা আসবে৷ চট্রগ্রাম পার করে হাতিরঝিল এর দিকে গাড়ি এগিয়ে চলেছে৷ পেছনের ওদের গাড়ি বাসার উদ্দেশ্য যাচ্ছে৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,
–‘ গুলশানের ” ভুবন বিলাসে ” না গিয়ে এখানে কেন? ‘
–‘ দরকার আছে তাই৷ ‘
আমি কথা বাড়ালাম না৷ আড়চোখে উনাকে পরখ করতে লাগলাম৷ লোকটার সৌন্দর্য দিনে দিনে বেড়ে চলেছে৷
বিয়ে হলে মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে৷ এখানে দেখি উল্টো৷ আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামিয়ে দিলেন৷ তারপর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
–‘ কাল দেখেও শান্তি হয় নি? ‘
আমি থতমত খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম৷ বিড়বিড় করে বললাম,’ নির্লজ্জ৷ ‘
–‘ তোমার’ই প্রেমে৷ ‘ উনি ঝুঁকে এসে আমার গালে চুমু খেয়ে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলান৷ আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি৷
আমার পাশের দরজা খুলে টেনে নামিয়ে বললেন,
–‘ হুটহাট মেডিসিন হজম করেতে শেখো বউ৷ ‘
আমি আবারো নির্বাক৷ আমার ভাবনার মাঝেই সে টেনে নিয়ে বসালো বেঞ্চিতে৷ তারপর আমার সামনে হাটু মুড়ে বসে একজোড়া নুপুর শাড়ি কিছুটা উঁচু করে পরাতে গেলেই আমি পা পিছিয়ে নিলাম৷ উনি আবার টেনে নুপুর জোড়া পরিয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ আজ চার বছর পূর্ণ হলো! তুমি সেদিন ছিলে অচেনা রমণী আর আজ তুমি আমার ব্যাক্তিগত শুভ্র রাঙা পরী৷ ‘
আমি এদিক ওদিকে তাকিয়ে ঝুঁকে পরলাম উনার বুকের উপর৷ দুনিয়ায় কতো কিছু হয় তবে কিছু কিছু হওয়া জীবনের বড় প্রাপ্তি সেটা কি সবাই জানে??
চলবে….
~” বিভিন্ন পর্বে লেখা কবিতা বা ছন্দ আমার লেখা৷ তাই কার্টেসী বিহীন কপি করবেন না৷ দেরি করার জন্য দুঃখিত৷ লেখার স্পীড পাচ্ছি না আগের মতো৷ বানানের ভুল ধরিয়ে দিবেন আর ক্ষমার চোখে দেখবেন~♥