খুব ভালোবাসি তারে,শেষ পার্ট
লেখকঃ_সাব্বির আহাম্মেদ
গোটা ঘরেই তখন সুনসান নিরবতা বিরাজমান। শান্তার নাকে মলা দিয়ে বললাম,
-যা, এবার ঘুমো গিয়ে।
শান্তা চলে যায় এবার। আমি রুমেরে সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পাঁচ মিনিট শুধু দাঁড়িয়েই থাকলাম। বাসর ঘরে কি করে ঢুকবো আর কি হবে না হবে তা ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো।
___আশ্চর্যের বিষয়! আমার এমন লাগছিলো কেন তার কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। অতঃপর সাহস করে দরজাটা আলতো করে হালকা খুলেই ফেললাম। সালাম দিলাম আমি,
-আসসালামুআলাইকুম। আসবো ভেতরে?
তানহা মৃদুস্বরে জবাব দিলো,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম। আসুন জনাব।
দরজা লক করে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালাম এবার। তানহা বসে আছে। বললাম,
-ওজু আছে কি তোমার?
তানহা,
-জ্বী, আছে। নামাজ পড়বেন?
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,
-তুমি তো দেখছি জানোই তাহলে। হুম, নামাজ পড়বো।
তানহা,
-আচ্ছা দাঁড়ান।
এই বলে ও বিছানা থেকে নেমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দিলো আমায়। নিজের জন্যেও বিছালো বাঁ দিকের একটু পেছনে। দুজনেই দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম। আমি উঠে যাব এমন সময় তানহা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-মোনাজাত করবেননা?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
-তাই তো! হুমম, ইস্তেগফার আর দুরুদ শরীফ পড়ো।
দোয়া পড়তে শুরু করলাম,
-হে আসমান জমীনের মালিক! হে পরওয়ারদেগারে আলম! হে রাব্বুল আলামীন! এই মধ্য রজনীতে তোমার দুই বান্দা-বান্দী নিজেদের নতুন জীবনের সূচনালগ্নে তুমি রাব্বুল আলামীনের দরবারে দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায়ের পর ভিখারির বেশে হাত উঠিয়েছি মাওলা, তুমি আমাদের জীবনের সকল গোনাহ মাফ করে দাও।
__ তুমি আমাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে জান্নাতি সুখ আর শান্তি নাজিল করো। আমাদের পরষ্পরের মধ্যে যেন কোন ধরনের ভুল বুঝাবুঝি না হয় সে তাওফিক তুমি দান করো।
____আমাদের ঔরসে তুমি নেক সন্তান নসিব করিও। আমাদের মধ্যে তুমি বরকত দান করো। আমাদের দুজনের বাবার বংশের আর মায়ের বংশের যারা আজ মৃত তাদের সকলের কবরকে তুমি জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দাও। জীবিতদেরকে সুস্থ আর দীর্ঘ নেক হায়াত দান করো। গোটা পৃথিবীতে তুমি শান্তি নাজিল করো। আমিন ইয়া রাব্বুল আলামীন!
মোনাজাত শেষ হতেই তানহা পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়। কিছুটা অবাক হলাম। বললাম,
-কি ব্যাপার! করছো কি!
তানহা,
-আপনি মাদরাসায় পড়েছেন তাইনা?
আমি,
-হ্যা, জানতেনা তুমি?
তানহা,
-কে বলেছে যে জানবো?
আমি,
-তা ঠিক, এটা বড় একটা মিস্টেক ছিলো। জানানো হয়নি তোমায়।
তানহা,
-তা মাদরাসায় কতখানি পড়েছিলেন?
আমি এবার উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজগুলো রাখতে রাখতে ওকে বললাম,
-এই তো, হিফজ পড়েছিলাম। পরে দাখিল দিয়ে কলেজ ভর্তি হয়ে যাই।
তানহা,
-তারমানে তুমি….
আমি,
-হুম, তোমার স্বামী হাফেজ। তবে সে তোমার কাছে একজন দায়িত্বশীল এবং ভালো স্বামী হতে চায় আর এটাই এখন তার মূল লক্ষ্য।
এবার তানহাকে বিছানায় বসিয়ে ওর দেনমোহরের বাকি টাকাটা এনে ওর হাতে তুলে দিলাম। কেননা, বিয়ে পরানোর সময় সেখানে এক লক্ষ টাকা নগদ দিয়েছিলাম। টাকাগুলো দেখে তানহা বললো,
-শুনেছি, দেনমোহরের টাকা না দিলে নাকি পাপ হয়?
আমি,
-শুধু পাপ কি বলছো! এটা একটা অনেক বড় অন্যায়। এছাড়া দেনমোহরের টাকা পরিশোধ ব্যতিত স্ত্রীকে স্পর্শ না করতে পর্যন্ত বলা হয়েছে।
___বাদ দাও এসব। টাকাগুলো একসাথে বা যেভাবে সুবিধা হয় তুমি রেখে দাও। এর মালিক আজ থেকে তুমি। যেভাবে আর যে খাতে যখন খুশি আমার পারমিশন ছাড়াই খরচ করতে পারবে। এর উপর আমার কোন হক বা অধিকার নেই।
তানহার চোখেমুখে সে কি আনন্দ। আনন্দটা এই টাকা পাবার জন্যে নয়। ওর আনন্দের মাঝে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলাম যা ওর স্বামী হিসেবে আমার জন্য খুবই গৌরবের বিষয়।
*
*
*
___আমাদের পুরুষদের মাথায় রাখা উচিৎ যে, বিয়ের প্রথম রাতেই যেন স্ত্রীর সাথে মিলন না করা হয়।
___ কারণ, এই দিনে মেয়েটি তাঁর সকল আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে আসে। নতুন পরিবারে আসে। বিয়ের নানান আনুষ্ঠানিকতা সংক্রান্ত ঝামেলার মধ্য দিয়ে সে এই দিনটি অতিবাহিত করে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও পর্যন্ত করতে পারেনা যার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে।
( এই কথাটা ছেলেরা মাথায় রাখবেন..)
___এমন পরিস্থিতিতে একজন আদর্শবান স্বামীর কর্তব্য হবে সে যেন এসময় স্ত্রীর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে। প্রথম রাতটি স্বামী-স্ত্রী নানান রম্য কথাবার্তা বলে একে অপরের সাথে মিশে যেতে পারে। কাজেই বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর উচিৎ এগুলো মাথায় রাখা এবং স্ত্রীর মনের সকল প্রকার ভয়ভীতি দূর করে দেয়া। (রেফারেন্স- বেহেশতী জেওর)
__আমি এবার শুয়ে উপরের দিকে চেয়ে আছি। তানহা পাশে বসা। চুপ করে আছে ও। আমি অপেক্ষা করছি ও কিছু বলে কিনা। না, বেশ কিছু সময় চলে যাবার পরও ও কিছু বলছেনা দেখে আমি বললাম,
-কি হলো, বসে আছো যে, শুবে না?
তানহা আমতা আমতা করে বললো,
-জ্বী হ্যা।
এই বলে ও বালিশে মাথা রেখে শুতে যাবে এমন সময় আমি বললাম,
-বালিশে নয়, বুকে এসো!
ও যেন এমনি কোনকিছুর প্রত্যাশা করছিলো। হেসে উঠলো ও। অট্টহাসি নয় মুচকি হাসি।
বললাম,
-তা, তুমি ছোটবেলায় কেমন ছিলে বলতো!
তানহা,
-আমি ছোটবেলায় কেমন ছিলাম তা জেনে কি করবেন শুনি!
আমি,
-আরে বলোনা! খুব চঞ্চল ছিলে নাকি মিচকে শয়তান ছিলে?
তানহা,
-তেমন চঞ্চলও নয় আবার মিচকে শয়তানও নয়।
আমি,
-গাছে চড়ার অভ্যাস ছিলো কি?
তানহা,
-না। তবে ছোটবেলায় একদিন উঠোনের পেয়ারা গাছে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম। পরে একটুখানি উঠতেই নিচে পরে যাই আর ব্যথা পাই হাতে। এরপর আর কোনদিন গাছে ওঠার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমি,
-আহারে! হাতের কোথায় ব্যথা পেয়েছিলে দেখি তো!
তানহা এবার মাথা ভাসিয়ে আমার বুকে আলতো করে কিল বসিয়ে বললো,
-সেটা কি এখনো আছে নাকি হুম!
আমি ব্যথা না পেয়েও ব্যথা পাবার ভান করলাম যেন ওর থেকে সিম্পেথি পাই। পেলামও সেটা। তবে কি করে পেলাম তা এখানে বলার মতো নয়। পাঠক নিজ দায়িত্বে বুঝে নিবেন।
এই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে এতটা কাছাকাছি চলে আসতে পারবো সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। আমাকে স্বাভাবিক দেখে ও বললো,
-তা জনাব, ঘুমোবেননা?
*
*
*
আমি,
-সারাজীবনই তো ঘুমাবো। আজকের রাতটা না হয় নির্ঘুমই কাটুক।
তানহা,
-আচ্ছা, বলুন তো, স্ত্রীকে কখনোই কাদের সম্পর্ক তুলে বকাঝকা করতে নেই?
আমি জেনেও সঠিক উত্তরটা দিলামনা। জানি, ভুল কিছু বললে ও যদি আমাকে ভুল ধরতে পারে এবং সেটার সঠিক জবাবটা আমায় বলতে পারে তাহলে ওর মনটা অনেকটাই ফুরফুরে হয়ে যাবে। তাই বললাম,
-কি নিয়ে আবার, স্ত্রীদেরকে কখনোই খাবার-দাবার সম্পর্কে বকাঝকা করতে নেই।
তানহা বললো,
-মোটেই না। ভুল বলেছেন আপনি।
আমি,
-তাহলে সঠিক উত্তরটা কি হবে শুনি!
তানহা,
-স্ত্রীদেরকে কখনোই তাদের বাপের বাড়ির সম্পর্ক টেনে বা তাদের বাবা-মায়ের সম্পর্ক টেনে বকাঝকা করতে নেই। এতে সরাসরি ওদের কলিজায় গিয়ে আঘাত করে। খুব কষ্ট পায় তারা।
——%–%-%%%—%
আমি,
-তাই নাকি! আচ্ছা, বিষয়টা মাথায় থাকবে। তা, তোমার কি কি পছন্দ আর অপছন্দ বলতো শুনি?
তানহা,
-এতদিন নিজের একটা পছন্দ অপছন্দের বিষয় ছিলো। কিন্ত আজ থেকে আমার পছন্দ আর অপছন্দটা নির্ভর করবে আপনাকে ঘিরে।
আমি,
-সেটা আবার কিভাবে?
তানহা,
-আপনার যা পছন্দ আমার পছন্দের তালিকাতেও সেটা যোগ হবে। আপনার যা অপছন্দ সেটা আমারো অপছন্দের তালিকায় চলে যাবে।
আমি,
-কিন্ত এটা কেন?
তানহা,
-দেখুন, একজন মেয়েলোক জন্মের পর তার ভরণপোষণের সকলপ্রকার দায়দায়িত্ব থাকে তার বাবা-মায়ের উপর। এবং সেটা বিয়ের আগ পর্যন্ত। বিয়ের পর সেই দায়িত্ব গিয়ে অর্পিত হয় স্বামীর উপর।
___ স্বামীর ভালো লাগা মন্দ লাগাকে প্রাধান্য দেয়াটা স্ত্রীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর আমিও সেটাই করব যেন আমার স্বামী আমরণ আমাকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন এবং শুধুমাত্র আমাকেই তাঁর সবটা দিয়ে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন।
আমি ওর কথাগুলো যতই শুনছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। বললাম,
-আমি কি পারবো তোমার যথাযথ সম্মান আর মর্যাদা দিয়ে আমার বউ করে রাখতে?
তানহা,
-পারবেননা কেন? আমার যথেষ্ট ভরসা রয়েছে, আপনি পারবেন এবং সেটা খুব ভালোভাবেই।
আমি,
-আমি চেষ্টা করবো একজন স্বামী হিসেবে তোমার সব ধরনের অধিকার সুনিশ্চিত করার। তোমাকে নিজের সাধ্যমতো সবটুকু দিয়ে সুখী রাখার। তোমার কাছে আমার আবেদন থাকবে কখনো আমার অবাধ্য হয়োনা।
___ কখনো আমার মায়ের সাথে অসদাচরণ করোনা। আমার সকল আত্মীয়স্বজনকে তুমি নিজের আপনজন হিসেবেই দেখবে। আমিও তোমার সকল আত্মীয়স্বজনকে দেখবো। সাধ্যমতো সবটুকু দিয়ে।
তানহা,
-হুমম, দেখবো। আপনি যা যা বলবেন আমি তাই তাই করবো। কখনো অবাধ্য হবোনা।
___আমি এবার ওকে আমাদের বাড়ির মহিলাদের সম্বন্ধে পুরো ধারণা দিয়ে দিলাম। কোন মহিলা কেমন, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে, কাকে কি বললে বেশি খুশি হবে, কাকে ভুলেও কখনো কোন কথাটি বলা যাবেনা, কিভাবে চললে আমাদের বাড়ির মানুষ তাঁকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সম্মানের চোখে দেখবে এবং মূল্যায়ন করবে তার ষোলকলা ওকে বলে দিলাম আমি।
___ আর এভাবেই কিছু খুনসুটি, কিছু হাসি, কিছু রোমান্টিকতা আর কিছু বর্ণনাতীত মুহুর্তের মধ্য দিয়ে রাত পার করে দিলাম দুজনে। সকালে আমি একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে টের পেয়ে চোখ মেললাম আমি। ঝাপসা চোখে তানহার মুখের হাসিটা দেখতে পেয়ে মন জুড়িয়ে গেলো।
বললাম,
-কখন উঠলে? নামাজের পর ঘুমাওনি?
তানহা,
-পরে ঘুমিয়ে নিব কাজ করেছিলাম একটু। চা এনেছি পান করে নিন!
এই বলে ও চায়ের কাপটি এগিয়ে দিলো আমার দিকে। এক চুমুক চা মুখে দিয়েই চিনি কম হওয়ার ছুতোয় ওকে কাছে টেনে নিলাম আমি। জড়িয়ে ধরে পান করে নিলাম অমৃত সুধা!
(সমাপ্ত)