ফিউচার_হাসবেন্ড
পর্ব:৪.১ (শেষ)
লেখনীতে~মিহিন মার্টেল
মিথ্যুক? সে শ্লেষাত্মক হাসে। ওর দেখি সবটাতেই দোষ। দোষ নেই কিসে?
দুটি চোখ ঘুরেফিরে ওকে দেখে। এখানে ওখানে যেখানেই যায় কিছুক্ষণ পর দেখে সেই চোখ দুটোও উপস্থিত। ঘুরেফিরে বিরামহীন ওকে দেখছে। সত্যি বলতে মুগ্ধ ঐ দৃষ্টিতে বিদ্ধ হতে মোহিতার খারাপ লাগছে না। কখনো কখনো চোখাচোখিতে স্নিগ্ধ চোখ দুটো বেভুল সব মুগ্ধতা প্রকাশ করে ফেলছে। তাতে লাগাম টানবার কোন চেষ্টা নেই, অপ্রস্তুত কোন ভঙ্গি নেই, দৃশ্যটা ভারী সুন্দর!
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চমকে উঠল মোহিতা। রিদ রুমের দরজায় চেয়ার ঠেস দিয়ে বসে আছে। মোহিতা ভড়কানো সামলে নীরবে দরজার কাছে এল। চেয়ার ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করল। ছেলের যা ওজন চেয়ারের হাতল ভাঙবে চেয়ার টলবে না। রিদ না সরলে দরজা খোলা অসম্ভব। মোহিতা বিরক্ত কণ্ঠে বলে, ‘রিদ সরো।’
এতক্ষণে রিদ ফোন থেকে মুখ তুলল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ও মাই গড! তুমি আমার নাম জানো?’
‘এই রুমে তো চেয়ার ছিল না এল কিভাবে?’
‘আমার কোলে চড়ে। খুব আদর, ভালবাসা দিয়ে আনলাম।’
‘মজা করছ!?’
গম্ভীরমুখে, ‘তাই মনে হচ্ছে?’
‘অদ্ভুত, একটা মানুষকে আটকে রেখে চেয়ারের আদর বর্ণণা করছ এটা মজা না তো কি?’
রিদ আবার বিস্মিত হলো, ‘তুমি মানুষ?’
‘তাহলে কি?’
‘পরীইইই।’
রিদের ঠোঁটে কৌতুক হাসি ঝিকোয়। মোহিতা রেগে উঠে। রিদ আচমকা ওকে ঘুরিয়ে কোলে বসিয়ে নেয়। মোহিতা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই দুহাতে জড়িয়ে নেয় ওকে। মোহিতা মোচড়ামুচড়ি শুরু করল।
‘বেয়াদব, বেহায়া, লম্পট..’
ওর গালাগালির মাঝেই রিদ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভালবাসি।’
মোহিতা দমে যায়। লাল গাল, হৃদপিন্ডের জোর ধুকপুকানি আর সেই আগেকার অগোছালো সত্তটা ফিরে এসে সম্পূর্ণ বিবশ করে দেয় ওকে। অভিমানে গাল ফুলে, চোখে পানি নিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে ও।
রিদ একসময় বলল, ‘কিছু ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া উচিত।’
“আমি চাই না তা হোক।’
‘আমি চাই।’
মোহিতা মুখ তুলে তাকায়, চোখ দুটো জ্বলে উঠে তখন, ‘সাধ্য ছাড়া বড় বড় ডায়লগ দেয়ার জন্য?’
রিদও পালটা আক্রমণ করল, ‘সাধ্য! সাধ্য তোমারই কি আছে? নিজের অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেড়াও, সত্যটা সাহস করে একবারও স্বীকার করতে পারো না। তুমি সাধ্য সাধ্য চেঁচাচ্ছ?’
ব্যাঙ্গাত্মক হেসে, ‘যে পিছিয়ে গেছে তাকে ভালবাসি স্বীকার করব, অদ্ভুত!’
‘তুমি কখনো এগিয়ে ছিলে?’
‘তুমি তখন বলেছ ভালবাসি?’
‘তুমি কি অটিজম? ব্রেন অপরিপক্ক?’
মোহিতা আক্রোশে ফুসে উঠল, ‘তোমরা ছেলেরাই অপরিপক্ক। তোমাদের কিছু ঠিক আছে? ক্লাস ফাইভে ভুল করে এক ক্লাসমেটের ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম। হাদাও চেয়ে থাকত, দূর থেকে ফেকফেক করে হাসত। একদিন কনফেস করে শুনি হাদা আসলে কোন ক্লাসের এক ছোট বোনকে পছন্দ করে। বলো ছেলে জাতির ওপর এরপরও বিশ্বাস করব কোন দুঃখে!?’
রিদ কষ্ট করেও গম্ভীর মুখ ধরে রাখতে পারল না। হাসতে লাগল, ‘ক্লাস ফাইভ! তুমি এত ফার্স্ট?’
গাল ফুলিয়ে, ‘পছন্দ, প্রেমের ক্লাসিফিকেশন বুঝতাম নাকি তখন!’
‘কোন না কোন ক্লাস ফাইভের ছেলে ছেকা দিল সেই ছেকায় তুমি আমাকেও ছেকা দিলে বাহ!’
‘তুমিই তো সায়ন্তর ভাই হয়ে প্যাচ বাজিয়েছ!’
‘বাজে বকো না, প্যাচ বাজিয়েছ তুমি। পৃথিবীতে ৭৯০ কোটি মানুষ। তুমি খুজে খুজে আমার ভাইকেই পেলে। বেশ হয়েছে ফাইভের ছেলে ছেকা দিয়েছে!’
মোহিতা তৎক্ষনাৎ ওর হাতে চড় মারল। রিদ হাসতে শুরু করে। ছোট্ট সেই ঘটনা ধুয়ে মুছে নিংড়ে নেয় এতদিনের রাগ, অভিমান। থেমে থেমে একটু পর পরই হাসতে থাকে ওরা।
৯.
আমরা ঠিক করেছি কয়েক মাস চুটিয়ে প্রেম করব। করছিও। প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো প্রায় রাত জেগে আমাদের কথোপকথন চলছে। রাতে ও সারাদিনের ছোট ছোট বিষয়গুলো সব আমায় বলে। মাঝে মাঝে যেভাবে আচমকা রাগ করে বলে, ‘তুমিই বল এটা মানা যায়?’ আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠি। সপ্তাহের শুক্রবার সবার উইকএন্ড। এই শুক্রবারই আমাদের সারা সপ্তাহের ব্যস্ততম দিন। এলেই ঘুরতে বেরোই। কখনো ঢাকার ভেতরে, কখনো বাইরে। সে রাস্তায় নামলে আমার হাত শক্ত করে ধরে। আমি বিস্ময়ে বলি, ‘আমি কি বাচ্চা?’
সে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে। বাচ্চাই। কারন পরে পরিষ্কার হলো। ওর এখনো বিশ্বাস হয় না আমি ওর। সত্যি সত্যি ওর। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ওর এক সত্তা বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই একটু আফসোস কর। একটু ছেকা ছেকা ফিলিংসে এদিক ওদিক চেয়ে থাক। ওর কথাগুলো শুনে আমি হাসি। কখনোবা ঘুম থেকে উঠেই ফোন করে, ‘তুমি আমার। ঠিক না?’
আশ্চর্যের বিষয় কেউ আমাকে ওর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে যখন বলি বয়ফ্রেন্ড সে ভীষণ চটে যায়। একদিন বললাম, ‘তাহলে কি পরিচয় দিব? ভাই?’
সে ভ্রু কুচকায়, ‘বয়ফ্রেন্ড শব্দটা আমার সহ্য হয় না।’
আমি মিটিমিটি হাসি, ‘তাহলে তো ভালই সমস্যা। কেউ তোমার পরিচয় চাইলে কি বলব?’
‘কেন? ফিউচার হাসবেন্ড!’
পরিশিষ্ট:
‘এই এগুলোও আছে।’
মোহিতা শব্দ করে একগাদা জামা-কাপড় রিদের সামনে ফেলল। রিদ টুল থেকে স্লিপ কেটে সাবান ফেনাময় ফ্লোরে পরে যায়। মোহিতা খিলখিলিয়ে হাসে।
‘এগুলো কোথা থেকে বেরোলো?’
‘হয়েছে কি, এগুলো আলমারির কোণে জমিয়ে রেখেছিলাম গত সপ্তাহে আমার এদের কথা মনে ছিল না। আজকে আলমারি খুলতেই চোখে পরল।’
রিদ সূচালো চোখে তাকায়, ‘আজকেই চোখে পরল?’
মোহিতা ঠোঁট টিপে হাসে, ‘পরল..’
‘আমি ধুঁতে পারব না। তোমার পালায় এগুলো ছিল তুমি আগামী সপ্তাহে ধুঁবে!’
চোখ বড় বড় করে, ‘দেখো ভিজে গেছে। এগুলো আর আলমারিতে রাখা যাবে?’
অগত্যা রিদকে সেসব কাপড়ও ভিজাতে হলো। ধুলোও সে। মোহিতা ঝারা মোছার কারবার সেরে তখন টিভি দেখছে। রিদ ভেজা কাপড়ে দুহাতে বালতি ভর্তি কাপড় চোপড় দিয়ে টলতে টলতে আসে। মোহিতা একবার ফিরে তাকাল শুধু। মুখ ঘুরিয়ে আবার মগ্ন হলো টিভিতে। ছাদে কাপড়গুলো মেলে এসে ধপ করে ওর পাশে বসল রিদ। ওর কাধে মাথা রেখে গা ছেড়ে দিল। মোহিতা ওড়নার কোণে ওর ঘামগুলো মুছে দেয়।
‘তুমি আজকে মশারি টাঙাবে, আমি তোমার পালার কাপড়গুলো ধুয়েছি।’
বিস্মিত কণ্ঠে, “বাহ, তুমি গত কয়েক সপ্তাহ বাইরে ছিলে তখন আমি টাঙাইনি?’
‘আমি ছিলাম তখন? তুমিই তো টাঙাবা।’
“আমি যে প্রতিদিন রান্না করি সে পালা গুনছ না?’
রিদ এবার নিরস্ত হলো। এই একটা কাজের জন্য মোহিতা সবসময় জিতে। ও ঠোঁট ফুলিয়ে তাকায়। মেয়েটা ফিরেও তাকায় না, নিমগ্ন হয়ে
কংফু পান্ডা দেখতে থাকে। রিদ ভাবল HBO চ্যানেলটা কেটে দিতে হবে। কালকেই বলে আসবে। বর পাশে বসে তবু পাত্তা নেই। নিষ্ঠুর!
পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর। এই নিষ্ঠুর নারীই ওর স্ত্রী। যে অলসতায় নিজের মশারি টাঙানোর দিনে দ্রুত ঘুমিয়ে পরে। শুক্রবার সকালে তাড়াতাড়ি উঠে রান্না করার ভয়ে ওকেও ঘুম পারিয়ে রাখে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত। সকাল সেদিন উপোসই যায়। বাইরে কোন মেয়েকে ড্যাবড্যাবিয়ে ওর দিকে তাকাতে দেখলে সরাসরি বলে বসে, “এই মেয়ে চোখ সরাও।’ মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে রিদের কি একটা ভুল মনে পরল অমনি ভুতের মতো এলোচুলে বসে ডাকতে লাগল, ‘এই তুমি এটা করেছিলে কেন?’ বাইরে থেকে টুকটাক খাবার না আনলে যে অসহায় মুখে বলে, ‘কিছু মিছু আনোনি?’ শীতকালে নিজের গরম কাপড় ছেড়ে রিদেরটায় হামলে পরে। ‘এত ঠান্ডায় গায়ে গরম জামা কই?’ প্রশ্নের উত্তরে যে রিদের খোলা চেইনের জ্যাকেটের ভেতর দুহাত ঢুকিয়ে জড়িয়ে ধরে দেঁতো হাসে। এই মেয়েটাই ওর স্ত্রী। বাকি ঐ নিরুপদ্রব নরম সরম মেয়েটা ওর হবুই ছিল।
রিদ অনেকক্ষণ যাবৎ স্থির তাকিয়ে। মোহিতা টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রু উঁচায়। কি? রিদ হাসল। মোহিতাকে জড়িয়ে ভাবল, মেয়েটা স্বৈরাচারী হলেও ওরই তো! থাক, HBO চ্যানেল কেটে কি হবে?
সমাপ্ত❤️