ফিউচার হাসবেন্ড,পর্ব:১+২

ফিউচার হাসবেন্ড,পর্ব:১+২
লেখনীতে:মিহিন মার্টেল
পর্ব:১

১.
‘ফোনটা দাও।’

বলে রিদ নিজেই ফোনটা কেড়ে নিল। মন চাইল এখনই হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি শুরু করি। টিন এজার হলে সত্যিই রাস্তায় বসে যেতাম। লকস্ক্রিন খুললেই আমার এবং আমার প্রেমিকের দাঁত কেলানো ছবি। এর কন্টাক্ট নম্বর আবার ব্লক লিস্টে। পাসওয়ার্ডেও বহু আবেগ দিয়ে প্রেমিকের সাথে নিজের নামের গিট্টু দেয়া। রিদ শান্ত ভঙ্গিতে তাকাল, ‘পাসওয়ার্ড কি?’

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই। রিদ তাচ্ছিল্য হাসে, ‘আঙ্কেল বললেন তোমার যেন কার সাথে মাখো-মাখো প্রেম চলছে, সত্যি?’

চুপ করে রইলাম। মন চাইল একে সুদ্ধ বাবাকেও কোন কুয়ায় ফেলে আমার অন্তরাত্মা তৃপ্ত করি।

‘দিনের বেলা দেখতে এসে এত অবসেশন, রাত হতেই আমি ব্লক লিস্টে, বাহ!’

আমি এবারও উত্তর দিলাম না। মনে মনে ফুসতে থাকা রাগগুলো আফসোস শুরু করল, মোহিরে মোহি কালকে এত হাহাহিহি’র কি দরকার ছিল বোন? আমারই কি দোষ? আমি কি জানতাম নাকি ছেলেরা ক্রিঞ্জ কাউকে এত পছন্দ করে! সে আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার জায়গাটায় রাখে। আমি মনে মনে হাসি। নে নে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ধন্য হ। লকটা একবার খুলে দেখা। ডান হাতের প্রতিটা আঙুলের ফিঙ্গার প্রিন্ট পরীক্ষা করে তার ভ্রু কুচকে যায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ হচ্ছে না। ফোন পাসওয়ার্ড চাইছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে আমার বামটাও টেনে নেয়। আমি একটু বাধা দেয়ার ঢং করলাম শুধু। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তখন হাসিতে কুপোকাত হচ্ছি। কারন প্রিঙ্গারপ্রিন্ট আমার পায়ের আঙ্গুলের। এখন পর্যন্ত সেটা অনুমান করার মুরোদ নিশ্চিত কোন লোকের হয়নি। প্রতি আঙুলের ছাপ নিয়ে সে বিস্মিত। হতাশ। দুটোর মিশ্রণে রেগেও গেল খুব। ব্যাপারটা আমি চাইনি তবু আমার পৈশাচিক সত্তা ঠোঁট বাকিয়ে হেসে ফেলে।

তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে রিদ যেরকম চাহনীটা আমায় দিল আমার বাবা দেখলে নিশ্চিত বিয়ে ভেঙে যেত! বাঁচোয়া এই কে যেন এই ষাড়টাকে তখন কল দিল। ষাড়টা অন্যমনস্ক হয়ে পরে। এই ফাঁকে আমি ফোনটা কেড়েই উল্টোমুখে দৌড়।

হোস্টেলের মোড়ে রিক্সা বাক নিয়েছি চেনা বাইক চোখে পরল। আমি দ্রুত রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলি। রিদ বাইকে হেলে আরামসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে। এই ষাড় আমার হোস্টলটাও চিনে!

প্রিয়ন্তী আমাকে এসময়ে ওদের বাসায় দেখে অবাক হলো, ‘তুই এখানে?’

গাল ফুলিয়ে সম্পূর্ণটা বললাম। প্রিয়ন্তী হাসে, ‘ভাল তো দুটোই একসাথে চালা!’

‘হুস, আমার এত মুরোদ নেই।’

‘সায়ন্ত তোকে বলেছিল একবারে ওকে নিয়ে মামলা খালাস করে দে, তুইই অদ্ভুত বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে গেছিস..!’

‘থাম, এমনিতে আফসোসে বাঁচছি না। আরও আফসোস না ধরিয়ে, সাজেশন দে।’

কিছুক্ষণ চিন্তা করে, ‘সায়ন্তকে কল লাগা।’

‘কি বলব? আমার হোস্টেলের সামনে বাবার ঠিক করা হবু বর বসে আছে যাও প্রেমিক তুমি গিয়ে হাতাহাতি করো!’

প্রিয়ন্তী খিলখিলিয়ে হাসে। রাগে ওর কাপড় ওর মুখেই ছুড়ে মারি। অবশেষে মেয়ের সুমতি হলো, বলল, ‘তোর ব্যাগ কি গোছানো?’

‘হু।’

‘তাহলে সায়ন্তকে বল নিয়ে আসতে।’

‘ষাড়ের সাথে মারামারি হলে?’

‘আরে ষাড় জানে নাকি, সায়ন্ত তোর প্রেমিক? নাকি জানিয়ে এসেছিস?’

আমি চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লাম। জানাইনি। প্রিয়ন্তী বলল, ‘তাহলে তাই কর।’

২.
মোহিতার ব্যাগ নিয়ে ফিরছিল সায়ন্ত। গলি শেষ হতেই থমকে গেল। কিছুক্ষণ ছোট চোখে চেয়ে রইল চায়ের স্টলটিতে। এরপরই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘রিদ!’

সায়ন্ত’র চাপড়ে রিদের চায়ের কাপ ছলকায়। চমকে পেছন ফিরে সে, ‘ওহ তুই।’

সায়ন্ত শব্দ করে পাশে বসে গেল, ‘এখানে কেন?’

রিদের মুখ বিরক্তিতে কুচকে যায়, ‘নারীঘটিত সমস্যা।’

সায়ন্ত শব্দ করে হাসতে থাকে। আবার বিশাল থাবা এসে পরে রিদের কাধে, ‘এই সময়ে এসে এমন নাকানি চুবানি খাচ্ছিস। কি ভাই, স্টিস্টেমে গন্ডগোল নাকি?’

রিদ ধাক্কা মারল সায়ন্তকে। সায়ন্ত আবার হাসে। রিদও মৃদু হাসে, ‘তুই এখানে কেন?’

‘গার্লফ্রেন্ডের জিনিসপত্র নিতে এলাম।’

সায়ন্ত ব্যাগটা তুলে দেখায়। রিদ কৌতুক হাসে, ‘কামলার মতো খাটিস দেখছি।’

‘হুর মিয়া, একটু সাহায্য করলে কামলা হয় কেউ?’

সায়ন্ত’র জন্যও এক কাপ চা এল। রিদ বলে, ‘মাসি বলছিল তুই যেন কোথায় যাবি আজকে..’

‘রাঙামাটিতে বান্ধবীর বিয়ে। যাবি?’

রিদ আবার মুখ বেকায়, ‘না, আমার অফিস আছে।’

‘রাখ ঐসব অফিস। সাত আটদিন ছুটি নিলে কিচ্ছু হয় না!’

‘সাত আটদিন! চিনি না জানি না এমন একজনের জন্য এতগুলো ছুটি নিব, অসম্ভব।’

‘ব্যাপক নেস্টি হয়ে যাচ্ছে তোর চিন্তাভাবনা। বলেছি ছুটি নিবি আমার জন্য, বান্ধবীর বিয়ে বলেছি বলে সব জায়গাতেই বান্ধবীকে দেখছিস। নাহ, মেয়েটা..’

সায়ন্ত কথা অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল। রিদ হাসে। চায়ের কাপ দোকানে ফেরত দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, ‘ব্যাগ নিয়ে কই যাবি এখন?’

‘লিফট দিবি?’

‘না। আমার কাজ আছে।’

‘মেয়ের পিছনে ঠিকই বাইক খাটছে, আমাকে একটু লিফট দিলেই যত সমস্যা!’

রিদ কিছু বলল না। হেলমেট পরতে লাগল। সায়ন্তও অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ ফেরত দিয়ে দ্রুত ওর বাইকে উঠে বসে। রিদ কিছুক্ষণ জোরাজুরি করল। একসময় হাল ছেড়ে দিল। ওদের বংশটাই বোধ হয় ঘাড় ত্যাড়া। বাইক নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছেও সায়ন্ত বাইক থেকে নামছে না। রিদ বিরক্ত হয়ে উঠল। সায়ন্তর গার্লফ্রেন্ডও আরেক ঝামেলা। ফোন দিয়েছে কখন এখনও নিচে নামছে না। অবশেষে যে এল সে একদম টিংটিঙে। কলেজ পড়ুয়া বলে ভুল হয়।

বাসায় এসেও সায়ন্তর প্যানপ্যানানি। রিদ ত্যক্ত হয়ে বলে, ‘জার্নিতে শুধু মেয়েই যখন যেতে রাজি হয়েছিস কোন দুঃখে?’

সায়ন্ত দেঁতো হাসল, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড আছে না?’

রিদ বড় বড় দম নেয়। শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আছে যখন গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম কর যা।’

‘আরে ভাই চল না।’

‘আমি আজকেই বাসা চেঞ্জ করব!’

সায়ন্ত হাসে, ‘রাঙামাটি গেলে এমনিতেও অন্য বাসায় থাকবি। চল না ভাই।’

‘সর তুই সামনে থেকে।’

সায়ন্ত তবু ঘ্যানঘ্যানাতে লাগল। অতিষ্ঠ হয়ে রিদ ওর দিকে ঘুরে বসে..

৩.
‘গোসল করতে এতক্ষণ লাগে তোর?’

আমি হাসলাম। প্রিয়ন্তী ব্যাগটা বিছানার ওপর রাখল। ব্যাগের টুকিটাকি জিনিসপত্র ঠিক আছে কিনা দেখছি, প্রিয়ন্তী বলে, ‘সায়ন্ত’র সাথে একজন এসেছিল। চিনিস?’

‘কে?’

‘শ্যামলা মতো। পেটানো শরীর। হাতে কিসের যেন বড় একটা দাগ আছে। চোখের পাপড়ি, ভ্রু কি সুন্দর!’

মনে করার চেষ্ঠা করলাম। না সায়ন্ত এমন কাউকে আমার সাথে পরিচয় করায়নি। মনের মধ্যে কেন যেন একটু খচখচানি হতে লাগল। বর্ণণাটা যেন কোথায় দেখেছি। স্পষ্ট মনে পরছে না কোথায়।

‘হবে বোধ হয় সায়ন্তর ভাই, নয় ফ্রেন্ড কেউ।’

‘যা, সায়ন্তর থেকে সুন্দর। ফ্রেন্ডই হবে।’

কাধ নাচালাম। সায়দাবাদ থেকে বাসে উঠব। বাসা থেকে আগে আগেই বেরলাম দুজনে। জ্যামে আটকে পৌছতে পৌছতে প্রায় নয়টা বেজে গেল। আনিকা রেগে মেগে লাল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করল।

প্রিয়ন্তী ওকে দুহাতে জড়িয়ে হাসে, ‘একটু আস্তে দোস্ত। মানুষজন তাকাচ্ছে!’

আনিকা একটু দমল। তবে ফুসতে লাগল। বললাম, ‘সায়ন্ত আসেনি?’

‘তোর প্রেমিক তুই জানবি! বুঝি না ছেলে মানুষের কি এত সাজগোজ, ঐ শালারই তো আগে পৌছে থাকার কথা!’

আমি কয়েক পা এগিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। কল করছি। ধরছে না। বাসের সময় বলছিল সাড়ে নয়টায়। নয়টা পনেরো বাজছে। ওরা অস্থির হতে লাগল। বিশেষ করে আনিকা। একসময় ফোন ধরল সে। খোশমেজাজে বলল, ‘তোরা কই?’

‘আগে বল, তুই কই?’

‘ও দেখেছি।’

কলটা কেটে গেল। সামনে খুজলাম নেই। পেছন ফিরতেই চমকে উঠলাম। সে মানুষটাও বিস্মিত। রিদ!

চলবে❤️

#ফিউচার_হাসবেন্ড
পর্ব~২
লেখনীতে~মিহিন মার্টেল

রিদ ভ্রু কুচকে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়েই ঝট করে সায়ন্ত’র দিকে তাকায়। সায়ন্ত হাসছে, দৃষ্টি আমার দিকে। তার যেন ধাধা লেগে গেল। দেখলাম প্রিয়ন্তীর দিকেও চাইল একবার। ব্যাপারটা আমার তখুনি পরিষ্কার হলো। দ্রুত ওর হাতের দিকে তাকালাম। ভয়ে এবার কাঁপাকাঁপি শুরু হলো আমার। ওর বাম হাতে কিসের যেন লম্বা কাটা দাগ। রিদ কাছে এসে কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায়। ওর দৃষ্টির শিকার একবার আমি তো একবার আমার ব্যাগ। ভয়ে আমার হাত-পা’র ঠান্ডা অবস্থা। সায়ন্ত একটা পলিথিন ভর্তি খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিল, আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও রিদম রড্রিক্স। [রিদের কাধ ঝাকিয়ে] আমার ভাই। প্রিয়ন্তী তখন দেখেছিলি না?’

প্রিয়ন্তী হাসে, হাত এগিয়ে বলে, ‘হ্যালমেটের জন্য চোখ দুটো দেখেছিলাম শুধু, আমি প্রিয়ন্তী গোমেজ।’

রিদ হাত মেলাল। আনিকা দূর থেকে হাত নাড়ে, ‘আমি আনিকা রহমান।’

রিদ সৌজন্য হাসল। ওর দৃষ্টি ঘুরে পরল আমার ওপর। সায়ন্ত তখন আমার কাধে হাত রেখে বলে, ‘ও আমার গার্লফ্রেন্ড।’

রিদ এতক্ষণ একটা ব্যাগ এহাত ওহাত করছিল। সর্বশেষে ব্যাগটা থেমেছিল ডান হাতে। সেটা ফেলে দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, ‘হাই!’

ব্যাগ পরল সায়ন্তর পায়ে। আমার কাধ থেকে তৎক্ষণাৎ ওর হাত খসে পরে, ‘রিদের বাচ্চা!’

রিদ চমকে উঠে হাসে, ‘সরি, খেয়ালে ছিল না।’

ওরা হেসে উঠল। আমি নীরবে তার সাথে হাত মিলাই। বাসে নিজেদের সিটে বসছি, রিদ জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কই বসবি?’

‘মোহির পাশে।’

সে একবার আমার দিকে চায়ল। ব্যাগটা ওপরের তাকে রেখে বলল, ‘ওহ।’

সায়ন্ত সিটে বসে বলে, ‘পানি এনেছিস?’

আমি মাথা নাড়লাম। আনিনি।

‘তোর পানি লাগবে না?’

‘না, আমি পানি খাই না।’

‘বমি না হওয়ার ঔষধ খেয়েছিস?’

আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, ‘একদম মনে নেই!’

বিরক্ত কণ্ঠে, ‘এত কেয়ারলেস তুই!’

আমি হাসলাম। সে বাস থেকে নেমে গেল। প্রিয়ন্তী, আনিকা কি নিয়ে যেন কথা বলছিল, হঠাৎ চমকে উঠে শুনলাম আনিকা বাঁশ গলায় বলছে, ‘তুইও মোহির মতো পায়ের ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছিস? খুলছে না কেন?’

প্রিয়ন্তী বলল, ‘আরে, আমার বাম হাতের ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট!’

ওরা দুজন হেসে উঠে। রিদের সিট প্রিয়ন্তীদের পরেরটা। সে বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিই। এত লজ্জা বোধ হয় আজ পর্যন্ত পাইনি।

আমার বমি করার অভ্যাস। বাসে উঠলে বমি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠি। তখন আশপাশের কিছুর খেয়াল থাকে না। আজকে বাসে উঠার আগে ফান্টা খেয়ে একদম বিশ্রী ঢোক উঠতে লাগল। আমি যতবার বমির জন্য মুখ ফোলাচ্ছি ততবার আমার থেকে সায়ন্ত বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছে। এই পানির বোতল, পলিথিন এগিয়ে দিচ্ছে, পলিথিনের ফুটোফাটা পরিক্ষা করছে। আমার মা’ও এতটা অস্থির হয় না।

ক্লান্ত হয়ে সিটে হেলে বসলাম। সায়ন্ত বলল, ‘কিছু খাবি?’

আমার ওর দিকে তাকিয়ে হাসি। সে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়, বললাম, ‘মনে হয় আগের জন্মে তোর বাচ্চা কাচ্চা ছিলাম আমি, না?’

বিরক্ত কণ্ঠে, ‘উদ্ভট কথা বলবি না তো। প্রচুর বিরক্ত লাগছে আমার।’

ল্যাম্প পোস্ট পাশ কেটে গেল। আমি ঠিক ঠিক দেখলাম সায়ন্তর চোখে-মুখে বিরক্তির ছিটেফোটা নেই। বরংচ ঢের বেশি উদ্বিগ্নতা। সায়ন্ত আবার বলে, ‘কিছু খাবি?’

আমি ওর বাম বাহুতে মাথা রাখলাম। উত্তর দিলাম না। সে আমার চুল ঠিকঠাক করে দেয়। শীত লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করে। একসময় চুপ হয়ে যায়। মনে হলো কেউ আমাকে নিবিড় চোখে দেখছে। চোখ খুলি। না সায়ন্তর মুখটা সামনে ঘোরানো। আবার চোখ বন্ধ করি। এবারও একি অনুভূতি হলো, তার বাহুতে গাল ঘষে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘সায়ন্ত রে, তুই আমার জন্য মিঠা মিঠা আশীর্বাদ, এত ভাল কেন তুই?’

৪.
আনিকা সিট থেকে উঁকি দিয়ে পাশে তাকায়। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না ওদের। তবে ফিসফিসানো কণ্ঠটা ঠিকই কানে আসে। আনিকা হাসে, ‘সায়ন্ত খুব কেয়ারিং না রে?’

প্রিয়ন্তী কান থেকে ফোন সরিয়ে তাকাল, ‘হু?’

‘কিছু না। কথা বল তুই!’

প্রিয়ন্তী সত্যিই আবার কথা বলায় ধ্যান দিল। ওদের কেউই দেখল না একটা মানুষ হিংসায়, রাগে, আক্রোশে এবং সম্পূর্ণ অসহায় অনুভূতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পরেছে। গম্ভীর মুখের আড়ালে এত এত অনুভূতির দ্বন্দ্ব তাকে একই সাথে অপ্রস্তুত এবং বেপরোয়া করে তুলল।

‘রিদ, এই রিদ। ওঠ। ওয়াশরুমে যাবি না?’

রিদের চোখ মাত্র লেগে এসেছিল। লাল চোখ দুটো মেলে তাকাল। সায়ন্ত সামনে দাঁড়িয়ে, ‘ওয়াশরুমে যাবি না?’

‘এসে গেছি?’

‘না। বাস ব্রেক দিয়েছে।’

রিদ আড়মোড়া ভেঙে ধীরে সুস্থে উঠে। সায়ন্ত বাস থেকে নেমে গেছে। সেও হেলেদুলে নিচে নামে। ঘাড়ে হাত দিয়ে মাথা এদিক ওদিক নাড়ছে, হঠাৎ চোখ আটকাল একটা মুদির দোকানে। আনিকা, প্রিয়ন্তীর ক্লান্ত, ঘুম ঘুম অবস্থা। তাদের তুলনায় মোহিতা সবে এক ঘুম পেয়ে উঠল। ক্লান্তির বদলে তার চোখে-মুখে এখন বিপুল প্রাণোচ্ছলতা। হাত নেড়ে, নিজে অঙ্গভঙ্গি করে ওদের কিসব বলছে আর দুটোয় ক্লান্ত চোখে-মুখেও হিহি করে হাসছে। রিদ ফোন বের করে কতগুলো ছবি তুলে নিল। আজকেরটা নিয়ে সর্বমোট দেড়শটা। ফোনের স্পেস হয়ত এই মেয়েটার জন্যই একদিন ফুল হবে! রিদ পকেটে পুরতেই খেয়াল করে আনিকা তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা সূচালো। সে ভাবলেশহীন হাঁটা শুরু করল। যেন কিছুই হয়নি।

‘আমি স্যান্ডউইচ, বার্গার সব খাব!’

সায়ন্ত ভ্রু কুচকে তাকাল, ‘ভাল জিনিস খা।’

মোহিতা দেঁতো হাসে, ‘কেন? আমার বমির গন্ধ মিষ্টি না?’

প্রিয়ন্তীরা বটেই সায়ন্ত অবদি ধমকে উঠল, ‘মোহি!’

মোহিতা খিলখিলিয়ে হাসে। রিদ এসে বসতেই হাসিতে ভাটা পরল ওর। রিদ বসেছে মোহিতার সামনা সামনি। খাওয়া থেকে চোখ তুললেই চোখাচোখি হচ্ছে আর ভয়ে ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে তার। সায়ন্ত খাওয়া থামিয়ে ফোন দেখছিল। হাত বাড়িয়ে মোহিতার ফোনটা নিল। অন করে আবার ওকে ফেরত দিয়ে বলল, ‘লক খুলে দে তো, আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।’

রিদ ওর দিকে তাকিয়ে, টেবিলের নিচে তাকায়। গাল গরম হয়ে উঠে মোহিতার! ভেবেছে কি লোকটা! আনিকা, প্রিয়ন্তী লক্ষ্য করল ব্যাপারটা। শব্দ করে হেসে উঠল প্রিয়ন্তী। আনিকা ঠোঁট টিপে ওকে ধাক্কায়।

সায়ন্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, ‘কি হলো হাসছিস কেন তোরা?’

ওরা উত্তর দেয় না। মোহিতা গাল ফুলিয়ে ফোনটা সামনে ধরে। লক খুলে যায়। ভীষণ অবাক হলো রিদ। হঠাৎই মনে পরল, মোহিতাকে জোরাজুরি করার সময়ে মেয়েটা বারবার চোখ বন্ধ করছিল, নয় মুখ ঘুরিয়ে ফেলছিল। নিজের ওপরই মেজাজ চটে গেল তার। সামান্য এই ব্যাপারটা মাথায় এল না? ফোন বারবার চেহেরা চিনতে পারছে না দেখাচ্ছিল তখনই তো বোঝা উচিত ছিল। গাধা!

সায়ন্ত বিল মেটাতে গেছে। প্রিয়ন্তীরা গাড়িতে উঠে পরেছে। রিদ সিগারেটের জন্য পকেটে হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নিল। কিছুদূরে মোহিতা কোমল পানীয়ের ফ্রিজটার সামনে দাঁড়িয়ে হাতল ধরে টানছে। হাসি পেল ওর। তবে এগিয়ে এল গম্ভীর মুখে। মোহিতা ওকে দেখে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। রিদ কিছু বলল না। দরজাটা খুলে ধরল। মোহিতা পেছন থেকে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘পেপসির ক্যান..’

রিদ পেপসির ক্যান নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। মোহিতা হালকা হেসে হাত বাড়ায়। রিদ ক্যানটা সরিয়ে নেয়। অবাক হলো মোহিতা। রিদ কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থাকে, একসময় গম্ভীর ছাড়া ছাড়া শব্দে বলে, ‘ওয়াট’স মাইন ইজ মাইন!’

ফাজিল ছেলে ওর সামনেই ক্যান খুলল এবং চুমুক দিয়ে ভাবসাব নিয়ে চলে গেল। মোহিতা গাল ফুলিয়ে বলে, ‘অসভ্য!’

সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আনিকা বাসে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে। প্রিয়ন্তী বলে, ‘কি রে বসছিস না কেন?’

আনিকা কপাল কুচকে বলে, ‘রিদম ছেলেটার মধ্যে ঘাপলা আছে!’

প্রিয়ন্তী হাসে, ‘হ্যা, টু মাচ হ্যান্ডসাম এন্ড হট!’

আনিকা মুখ বেকাল। আবার জানলার বাইরে তাকাল। সায়ন্ত ঐ ফ্রিজটা খুলে মোহিতাকে পেপসির ক্যানই এগিয়ে দিচ্ছে। সেটা কিছুদূরে একহাতে সিগারেট অন্যহাতে পেপসি ক্যান নিয়ে বিরস চোখে দেখছে রিদ। আনিকা হঠাৎ হেসে উঠে, ‘উম, ইন্টারেস্টিং।’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here