ফিউচার_হাসবেন্ড
পর্ব: ৪ (শেষ)
লেখনীতে~মিহিন মার্টেল
সায়ন্ত রেগে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে র্যাপিংয়ে মুড়োনো একটি বক্স এবং কিছু শুকনো খাবার। রিদের রিক্সা এসে থামল।
বিরক্ত কণ্ঠে, ‘বাড়ির ঠিকানা জানিস না ঢেং ঢেং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, কান্ডজ্ঞান আছে?’
রিদ বিরস চেয়ে রইল। রিক্সা দুজনকে নিয়ে চলতে শুরু করে। রিদ তখনো অন্যমনস্ক।
‘কি এত ভাবিস?’
রিদের চটকা ভাঙল, ‘তোর বান্ধবীর বাসা কই আসলে?’
‘রাঙামাটিতেই।’
‘মজা না, তোর বান্ধবীর বাড়ির আশপাশে কি অনেকগুলো বাড়ি?’
সায়ন্ত শব্দ করে হাসতে লাগল। রিদ চিন্তিত মুখে চেয়ে থাকে।
৭.
মারিয়ার বিয়ে হয়েছে দুই মাস। মারিয়ার বিয়ের শেষদিকে রিদ নিজেই সায়ন্তকে আমাদের কথা বলেছিল। তুমুল ঝগড়া হলো ওদের। মিলেও গেল ওরা। আমি নির্বাক দর্শকের মতো দেখলাম। ততদিনে আমার মধ্যেও ঢের পরিবর্তন এসেছে।
রাঙামাটি থেকে ফিরে আসার কয়েকদিন পরেই রিদ বিয়ে ভেঙে দিল। বাবা হতাশ হলো খুব। ছেলে ভীষণ পছন্দ হয়েছিল উনার। প্রতিদিন আফসোস করতে লাগল কানের কাছে। আমি রাগ করে হোস্টেলে চলে এলাম। হোস্টেলে থেকে আমি আরও স্কলারশিপের জন্য পরিক্ষা দিলাম। হওয়া না হওয়া সেটা ভাগ্য। আমার আর সায়ন্তর সম্পর্ক জোয়ার ভাটা এলেও তখনো ছিড়ে যায়নি। ঝুলন্ত সাঁকোর মতো দুলছে শুধু। দুদিকেই ছেড়া অবস্থা। বাড়তি টানের প্রয়োজন। যেদিক ছিড়বে তার বিপরীত দিকেই সাঁকো যাবে। একদিন বলে বসলাম,
‘সায়ন্ত, আমার ব্রেক লাগবে।’
সায়ন্ত বিস্মিত হয়ে তাকায়, ‘কেন?’
কাঁদো-কাঁদো মুখে, ‘আমি নিজেকে বুঝতে পারছি না। কোথায় যেন অঙ্ক মিলছে না। সূত্র ভুল না ডাক ভুল বুঝতে পারছি না।’
‘আমি কোন ভুল করেছি?’
‘না। আমিই ভুল করছি।’
সায়ন্ত বলল, ‘কারন কি রিদ?’
শক্তমুখে বললাম, ‘না রিদ না।’
সায়ন্ত চুপচাপ পাশে বসে থাকে। আমি পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে পরি। সায়ন্ত আমার হাত চেপে বলে, ‘পালাচ্ছিস?’
হেচকি তুলে বললাম, ‘না।’
‘কাহিনী খোলাসা কর।’
‘আমাকে সময় দে।’
‘আমাদের সম্পর্ক তাহলে এখানেই শেষ?’
‘শেষ হবে কেন? আমি নিজেকে পরিষ্কার করে নিই আগে।’
সায়ন্ত ক্লিষ্ট হাসল। হাসিটা ঠিক মানাল না ওকে, ‘আচ্ছা ভেবে সিদ্ধান্ত নে। আমি জানি তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিবি।’
আমি কেঁদে উঠলাম। সে আমার মাথায় হাত বুলোতে থাকে। চোখ তুলে তাকালাম। সায়ন্ত ফিসফিসায়, ‘ইউ নো আই লাভ ইউ, রাইট?’
ঝাপ্সা চোখ দুটো আরও ঝাপ্সা হয়ে এল। তবু উপলব্ধি করলাম দুটো চোখ কি ভীষণ মমতা নিয়ে আমায় দেখছে। ওদের গভীরতা যেন অতলস্পর্শী। যেন বলতে চাইল, মানুষটা সবসময়ই আমার পাশে আছে। আমি ভাল খারাপ যাই হই, আমার পছন্দ অপছন্দ যাই হোক মানুষটার কাছে আমি আমিই। তার এই আমিটাকেই ভীষণ পছন্দ। হয়ত সেদিনই সায়ন্ত আমার ভাবনার উত্তর বুঝে গিয়েছিল।
দৈববশেই বোধ হয় আমি স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। দ্রুত দেশ ছাড়ার পায়তারা করতে লাগলাম। দেশ ছাড়ার আগের দিন সায়ন্তর সাথে দেখা,
‘তোর সিদ্ধান্তটা অফেন্সিভ। তবু ঠিক আছে।’
‘স্বার্থপর না?’
সায়ন্ত মাথা নাড়ে, ‘একদম না। নিজেকেই সবসময় বাছাই করবি।’
সেদিন আমি চোখ বড় বড় করে এই মানুষটাকে দেখছিলাম। আমার এখনো অবাক লাগে একটা মানুষ কি করে এত বুঝদার হয়? আমার প্রতি কোন আক্ষেপ নেই, কোন তর্জন গর্জন নেই শুধু সাপোর্ট করে যাওয়া। আচ্ছা এও কি সম্ভব? সেদিন হয়ত তার বিয়ের প্রস্তাবটা নাকচ নাও করতে পারতাম। দিব্যি হেসেখেলে আমার জীবন চলে যেত। তখন দিনদিন নিজের কাছেই ছোট হতাম না কি? একটা মানুষ সর্বক্ষণ আমাকে শুদ্ধমনে ভালবাসছে আমিও বেহায়ার মতো বারবার শুন্যহাতে চলে যাচ্ছি ঋণের বোঝা বাড়াতে। এর চেয়ে বাজে কিছু আদো আছে?
সায়ন্তর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার থেকে আমার কাছে মনে হয়েছিল সায়ন্তর ঐ শুদ্ধ ভালবাসার প্রতিদানে ভালবাসা শূন্য মন নিয়ে ওর সাথে বেঁচে থাকাই ভীষণ লজ্জার। এই যে দিন যাচ্ছে, আমার প্রায়ই আফসোস হয় কেন ওর প্রেমে পরলাম না! এক বছর খুব কম সময়? আফসোস ফেলে উত্তরটা নিজেই সামনে আসে, মন যা চায়, তাই চায়। ছক বেধে অঙ্ক কষে তা হয় না। কখনো কখনো আমরা সম্পর্কেই জড়াই প্রেমে পরি না।
৮.
‘পার্থিবে হেমাঙ্গ বলেছিল, বাঙালিদের প্রেম হলো সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার আর বিয়ে হলো মস্ত কীর্তি। ব্যস জীবনের সব সার্থকতা হয়ে গেল। মনে আছে তোর?’
আনিকা হেসে মাথা নাড়ে, মনে আছে, ‘আমি সায়ন্তকেও আসতে বলেছিলাম। বেটা বউ বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। এলো না।’
মোহিতা বড় চোখে চায়, ‘সায়ন্ত বিয়ে করেছে?’
‘জানিস না?’
মোহিতা মাথা নাড়ল। জানত না। আনিকা বলে, ‘ভালই হয়েছে। আন্টি জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তোর প্রেমে জীবন নষ্ট করবে কেন! একটু কষ্ট পেলি কি?’
মোহিতা সত্যিকারে হাসল। ভারী কোন বোঝা যেন হঠাৎই নেমে গেল, ‘কাজের কাজ করেছে। প্রেম টেমই তো জীবন না ভাই। আচ্ছা ও ভাল আছে তো?’
“পুতুল মতো বউ পেয়েছে, ভাল থাকবে না? মেয়েটার আকর্ষণ ক্ষমতা আছে ভাই, মিষ্টিও ভীষণ। বছর ঘুরতেই সায়ন্তকে সামলে নিল।’
মোহিতা আশ্বস্ত হলো। আনিকা মানুষ চিনে। নিশ্চয় ভাল আছে সে।
‘যাই বলিস বিদেশ থাকতে থাকতে দেখার মতো হয়েছিস তুই।’
মোহিতা খিলখিলিয়ে হাসে, ‘আগেও কিন্তু ছিলাম।’
‘না শুধু রূপ ছিল। এখন ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস সব তাকালেই ঠিকরে পরছে। আমার শুধু চেয়ে থাকতে মন চাইছে রে।’
মোহিতা লেহেঙ্গা সামলে ওর পাশে বসল। আনিকা আক্রোশে বলে, ‘প্রিয়ন্তী বিয়ে করে একদম পল্টি খেয়েছে। বর ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। বল প্রিয়ন্তীই আগে সুন্দর দেখলে লাফালাফি শুরু করত না?’
মোহিতা ঠোঁট টিপে হাসে। আনিকা বিরক্ত মুখে প্রিয়ন্তীকে গালাগালি করে। মোহিতা ফোনে কি যেন করছে। ওর দিকে চোখ পরতেই আনিকার বিরক্তি উবে গেল। ঠোঁটে ঝিকোতে লাগল কৌতুক হাসি। ঐ বছরগুলোয় মোহিতার সিদ্ধান্ত ভিতু পালিয়ে যাওয়া মানুষদের মতো লাগলেও আজ মনে হচ্ছে মেয়েটা ঠিকই ছিল। জীবনটা ভেসে যায়নি।
‘আমার Doja Cat এর বেস্টফ্রেন্ড গান তোকে ডেডিকেট করতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘হু?’
‘That my best friend, she a real bad bitch
Got her own money, she ‘on’t need no nig’
মোহিতা নিজেও নাচতে লাগল। রুমে উঁকি দিয়ে যেতে যেতে মানুষজন দেখল বিয়ের কনে, তার বান্ধবীকে নিয়ে নাচছে। আনিকার ছোট কাজিনগুলো হাসতে হাসতে তার ছবি তুলে।
বিয়ের দাওয়াত ছিল অপ্রত্যাশিত। রিদ অনেকক্ষণ যাবৎ বিয়ের কার্ডটা খুটিয়ে দেখেছিল। এরপর ড্রয়ারে বেশ অবহেলায় রেখে দিয়েছিল। ওর যেয়ে কাজ কি? কদিন আগে আনিকা ওকে নিজে থেকে কল দিল। ওকে যেতেই হবে। বিয়ে জিনিসটাই এখন ওর চক্ষুশূল। মা-বাবা উঠতে বসতে বিয়ে বিয়ে ঘ্যানঘ্যানাচ্ছে। অফিস কলিগগুলো টিপ্পনী কাটছে, ‘কি ভাই, চিরকুমার ব্রত নিলেন নাকি?’
কোন বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা, পেটে মস্ত ভুড়ি, সে তার ফিটনেস দেখে বলছে, ‘শরীর বাঁচিয়ে রাখতেই বিয়ে করছিস না নাকি?’
বিয়ে বাড়ি, আত্মীয় স্বজনদের কোন দাওয়াতে যাওয়া যাচ্ছে না। গেলেই কেউ না কেউ নিজের কুমারী মেয়ের জন্য পছন্দ করে বসছে। নয়ত কম বয়সী মেয়েগুলো ন্যাকামি শুরু করছে। অসহ্য! সুদর্শন হওয়া শুধু মেয়েই না ব্যাচেলর ছেলেদেরও কষ্ট। আর সে যদি ক্যারিয়ার গড়ে ফেলে! ও বাবা, কপালে রাজটিকা!
রিদ তাই ভদ্রস্বরে দাওয়াতটা নাকচ করল। আনিকা নাছোড়বান্দা তাকে যেতেই হবে। একসময় অন্যভাবে নাস্তানাবুদ করল, ‘আমি অন্য ধর্মের বলে কি ঘেন্না করছেন আসতে?’
‘আমাকে নিম্নস্তরের মানুষ ভাবো নাকি?’
‘তাহলে আসবেন না কেন?’
‘বিয়ের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে গেছি বোন। তোমার রিসেপশনে..’
‘রিসেপশনে না এলে না আসবেন। বিয়েতে আপনাকে আসতেই হবে।’
রিদ আরও কিছুক্ষণ জোরাজুরি করল। মেয়েটা মানল না। ওকে যেতেই হবে।
সকাল থেকে রিদের তাই মেজাজ চটে আছে। ভীষণ খারাপ মেজাজে পাঞ্জাবি গায়ে চড়াল। কালো পরার ইচ্ছে ছিল, মা এসে বলল কালোতে ওকে ভীষণ মানায়। সে চট জলদি মত বদলে লাল পরে নেয়। বেরিয়ে যাওয়ার সময় মা অবাক চোখে বললেন, “কালো পরলি না?’
‘না।’
রিদ বেরিয়ে যায়। মা হাসে। ছেলেটা যদি জানত লালে আরও মানাচ্ছে!
বিয়ে বাড়িতে এসে ক্যামেরা হাতে একা একা ঘুরছিল রিদ। কখনো ক্যামেরা তুলে এর ওর ছবি তুলছিল। দেখতে পেল না দুটো মুগ্ধ চোখ ওকে তখন থেকে দেখছে। বুঝলও না। নইলে পাত্তা দিল না। ঘুরে ঘুরে ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে একসময় থমকায় সে। জুম করে। ঠিকই দেখছে। লাল লেহেঙ্গা পরা মেয়েটি আন্টি গোছের কারোর সাথে খুব হেসে কথা বলছে। অনুষ্ঠানে প্রায় প্রায় চোখাচোখি হলো। মেয়েটা উদাস চোখ সরিয়ে নিল। যেন রিদ অচেনা কেউ।
রিদ নিজেই একসময় এগিয়ে আসে, ‘ভাল আছ?’
মোহিতা ফিরে তাকায়। যেন কষ্ট করে চিনল ওকে। উত্তর দিল না। মুখ ঝামটা মেরে ঘুরিয়ে নিল। রিদ ওর পাশের চেয়ারটায় বসল। মোহিতা ভ্রু বেকিয়ে তাকায়। রিদ ক্লিষ্ট হাসে। মোহিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। মেয়েটি হেঁটে গেলে রিদ স্পষ্ট শুনে তার আক্রোশপূর্ণ বিরবিরানো, ‘মিথ্যুক!’
(সমাপ্ত) চলবে❤️