ফিউচার_হাসবেন্ড পর্ব:৩

ফিউচার_হাসবেন্ড
পর্ব:৩
লেখনীতে:মিহিন মার্টেল

৫.
ছয়টা বেজে দশ। গাড়ি বনরুপা রোডে এসে থামল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়াই। সায়ন্ত ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, ‘এত এনার্জি কোত্থেকে পাস তুই?’

হাসলাম, ‘আমি কিছুই না। জানিস আমার বাবা ১২টা, ১টায় ঘুমিয়েও ঠিকঠিক চারটায় উঠে গোসল টোসল করে গ্রাম থেকে রওনা হতো?’

সায়ন্ত হাই তুলল, ‘কতবার বলবি। মূখস্ত হয়ে গেছে।’

দেঁতো হাসলাম, ‘আমার বাবা একটা চিজই, না?’

‘তুইও ঐ চিজেই পাগল হয়েছিস।’

ভিড় কমে এসেছে। সায়ন্ত সিট থেকে বেরিয়ে পিছিয়ে দাঁড়ায়। আমি ব্যাগ কাধে বেরিয়ে আসি। প্রিয়ন্তীরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। কাছে পৌছুতেই প্রিয়ন্তী ব্যাগের ওপর দিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরল, ‘গুড মর্নিং, লাকি গার্ল।’

আনিকা নেমে যায়। প্রথমে আমি নেমে পিছু মুড়ে বলি, ‘লাকি গার্ল?’

প্রিয়ন্তী বাস থেকে নেমে এসে ক্লান্ত হাসে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘সারারাত যে বফের সাথে এলি সামথিং সামথিং কিছু হয়নি?’

বড় বড় চোখে মাথা নাড়লাম, ‘না, কিছু হওয়ার ছিল?’

প্রিয়ন্তী মুখ বেকিয়ে তাকাল। আনিকা হেসে ফেলে, ‘যেমন দেবা তেমন দেবী!’

প্রিয়ন্তী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি?’

বিরক্ত হয়ে, ‘না।’

প্রিয়ন্তী হা মুখে আনিকার দিকে তাকাল। আনিকা সশব্দে হাসতে লাগল। প্রিয়ন্তীর মাথায় গাট্টা মেরে বলি, ‘বিগড়ে যাচ্ছিস!’

মাথায় হাত বুলোয়ে বুলোতে, ‘তুইই বেশি সোজা আছিস।’ আনিকার দিকে ফিরে, ‘তুই বল, এমন পিউরিটান হলে চলে?’

‘আমার তো ভালই লাগে পিউরিটানদের।’

প্রিয়ন্তীর মুখ ভোতা হয়ে গেল। আমি হাসতে হাসতে আনিকার দিকে হাত বাড়াই। আনিকা হাত এগিয়ে সশব্দে হাত মেলায়। প্রিয়ন্তী অসন্তোষ মুখে দুজনকে উপদেশ দিতে লাগল। হাসাহাসির মাঝেও মনে হলো আমি কারও নজরবন্দী। আশপাশে তাকালাম। মারিয়ার ভাই আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে। সায়ন্ত তার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। অদ্ভুত, এখনো আমার গতকালকের মতো অনুভূতি হচ্ছে। অনুভূতিটা এত সূক্ষ্ম মনের ভুলও ভাবতে পারছি না। একসময় রিদের ওপর চোখ পরল। না রিদও চেয়ে নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে ফোন চালাচ্ছে। রিদ হঠাৎ চোখ তুলে তাকায়। আমার হৃদপিন্ডে তখুনি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে ভয়। মনে হলো ধুকপুকানিতে কোন সময় হৃৎপিন্ড না ছিড়ে যায়।

ব্যাগে টাকা বেশি একটা ছিল না। সায়ন্তকে বলে আশপাশের দোকানে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে তা তুলব। সায়ন্ত বলল ওরা কিছু কেনাকাটা করবে যেন প্রিয়ন্তীদের সাথে চলে যাই। আমিও সম্মতি দিয়ে দোকানে টাকা তুলতে আসি। টাকা তুলে বেরচ্ছি, দেখি ফোনের চার্জ ১ পার্সেন্ট। পাত্তা দিলাম না। ফোন দিয়ে আর কি কাজ? গুনগুনিয়ে ওরা যেখানে ছিল সে জায়গায় পৌছিয়েই সম্পূর্ণ ভড়কে গেলাম। কেউ নেই। আমি আশপাশের দোকানগুলোয় উঁকিঝুকি দেই। না ওদের কাউকে চোখে পরছে না। ফোনটা বের করে কল লিস্টে ঢুকেছি কি ঢুকিনি ফোন শাট ডাউন হয়ে গেল। ভীষণ ভড়কে গেলাম আমি। নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলাম। এটা এমন কিছু না। চিন্তার এক অসভ্য সত্তা সেই ভয়টাকেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে খুচিয়ে দিল। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, বান্ধবীর বাসার ঠিকানা জানি না হবে কি আমার? ঠোঁট দুটো টিপে প্রথমে ঘুরে ঘুরে কাছের দোকানগুলো দেখলাম। ওদের কেউ নেই।

একটা মুদির দোকানে এসে আরও ভড়কে গেলাম আমি। এই দোকানি অন্য টানে কথা বলছে। কিছু বুঝতে পারছি না। এত এত ভয় মিলে সত্যি সত্যি কান্না করে দিলাম এবার। দোকানি বিস্মিত হয়ে গেলেন। আশপাশে ভিড় জমতে লাগল। তখনকার ঐ বিকাশ দোকানের আঙ্কেল ভিড়ের মধ্যে ছিলেন। তিনি সামনে এসে কি বললেন এই দোকানীকে বুঝলাম না। তবে আঙ্কেলটা আমার দিকে ফিরে স্পষ্ট বললেন, ‘কি হয়েছে তোমার?’

আমি আমার ঘটনা বললাম। তিনি বলেন, ‘তাদের ফোন কর।’

চোখে মুছে, ‘ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।’

তিনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন, নিজের ফোন হঠাৎ এগিয়ে বললেম, ‘আমার ফোন থেকে কর তাহলে।’

কাঁপা হাতে ফোনটা নিলাম। চিন্তাশক্তি তখন সম্পূর্ণ ঘোলাটে। নাম্বার ডায়াল করতে গিয়ে আবার বাধল বিপত্তি। সায়ন্ত, প্রিয়ন্তীদের নাম্বার আমার মূখস্ত নেই। মূখস্ত নাম্বার ভাবতে ভাবতে একটা নাম্বারই মনে পরল। রিদ!

‘তুমি কি নাম্বারও জান না?’

আমি নিশব্দে ঐ রিদকেই কল করে ফেললাম। ফোন ধরা হাতটা থরথর করে কাঁপছে। একবার রিং হতেই রিদ ফোন তুলে। ওর কণ্ঠটা শুনে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম আমি। রিদ ভড়কে গেল, ‘হ্যালো কে বলছেন?’

‘আ আমি মো মোহিতা..’

‘তুমি? কি হয়েছে তোমার?’

‘আমি হারিয়ে গেছি।’

‘মানে? তুমি বাসায় যাওনি?’

কান্নার দমকে উত্তর এল না।

‘আচ্ছা এটা বলো এখন কই তুমি?’

আমি আশপাশে তাকিয়ে, শেষটায় আঙ্কেলকে প্রশ্ন করলাম, ‘জায়গার নাম কি?’

আঙ্কেল হেসে ফেললেন, ‘বনরুপা রোড।’

রিদকে তাই বললাম। সে তখুনি কল কেটে দিল। সময় গড়ায়। রিদ আসে না। কিছু লোক এখনো আছে। তাদের কৌতুহল চোখে ভয়ের সাথে লজ্জার মাত্রা বাড়ছে আমার।

৬.
‘আরে, রিদ..’

রিদ দ্রুত স্টেশনারি দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। সায়ন্ত বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকে। হলো কি এর?

বনরুপা রোডে এসে রিদ এদিক ওদিক তাকায়। এক জায়গায় ভিড় দেখে ছুটল সেদিকে। শ্যামলা মুখ শীতকালেও তখন ঘেমে হাঁপিয়ে লাল হয়ে গেছে। মোহিতা ওকে দেখে আবার কেঁদে উঠল।

বিরক্ত কণ্ঠে, ‘কাঁদছ কেন, আমি তো এসেছিই।’

মোহিতা শুধু চোখে মুছে হেচকি তুলে। উত্তর দেয় না। এই ষাড় কিভাবে জানবে এতগুলো অপরিচিতের মাঝে একজন পরিচিতকে কি ভীষণ আপন লাগছে তার।

‘মামা, গার্লফ্রেন্ডকে ঠিকমত বাসায় নামিয়ে দিবেন।’

রিক্সাওয়ালা মাথা নাড়ে। মোহিতা মুখ ঝামটে উঠে, ‘আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড নই।’

ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে, ‘এতক্ষণে ইভিল স্পিরিট ফিরেছে।’

মোহিতা গাল ফোলায়। রিদের ফোনে তখন সায়ন্ত’র কল আসছে। রিদ ধরল না, কেটে যাওয়ার অপেক্ষা করল। একবার মোহিতার দিকে তাকাল, মোহিতা তখনো রাগি দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। কল কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পরেছে ভঙ্গিতে রিদ ওর ফোন এগিয়ে বলে, ‘মারিয়া না কি নাম ওকে ফোন দাও।’

‘কেন?’

রিদ বিরক্ত হলো, ‘বাসার সামনে কনফিউজড হয়ে আবার আমাকে ডাকবা? অসম্ভব, আমি বারবার তোমাকে সাহায্য করতে পারব না!’

মোহিতা কেড়ে নিল ফোনটা। রাগ দেখিয়ে নাম্বার টাইপ করতে গেল এবং তখনই চুপসে গেল সে। চোরা চোখে রিদের দিকে তাকাতে লাগল। রিদ ব্যাপারটা আঁচ করে বলে, ‘সারা দুনিয়ায় শুধু আমাকেই চিনো? গার্লফ্রেন্ড!’

মোহিতা বলহীন আক্রোশে আবার বলে, ‘আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড নই।’

রিদ ফোন কেড়ে নিল, বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি বলিওনি তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড!’

বিস্মিত মুখে, ‘এইমাত্র বললা।’

রিদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকায়, ‘মামা আমি বলেছি ও আমার গার্লফ্রেন্ড? শুধু বলেছি না গার্লফ্রেন্ড?’

রিক্সাওয়ালা হাসে। উত্তর দেয় না। মোহিতা অবাক চেয়ে থাকে। পেটে পেটে এত প্যাচ!

‘যাও গিয়ে এখন ভিখারির মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরগে। মামা গার্লফ্রেন্ডকে ভালভাবে নিয়ে যাবেন।’

রিক্সা চলতে শুরু করল, মোহিতা চলন্ত রিক্সা থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘আবার হারিয়ে গেলে কি হবে?’

রিদ চেঁচিয়ে বলল, ‘তাতে আমার কিচ্ছু না।’

মোহিতা গাল ফুলিয়ে চেয়ে রইল, সে দৃষ্টি সীমানার বাইরে যাওয়ার আগে আগে দেখল রিদ আবার ওকে গার্লফ্রেন্ড বলে গালি দিচ্ছে। মোহিতা মুখ ফিরিয়ে বসে। কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে হঠাৎই হেসে উঠে। খারাপ হলেও ভাল আছে। ভাল খারাপ কখনো একসাথে হয়? কে জানে ষাড় বলেই হয়ত একেক সময়ে একেক রকম।

রিক্সাটা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে রিদও হাসল, ‘ভয়ের একটা ভাল কাজ হয়েছে দেখছি।’

রিদ রিকশায় উঠে। মাঝে সায়ন্ত আরেকবার ফোন করে। রিদ ফোন ধরতেই ধমকে উঠে সে, ‘পাগলের মতো কই গেলি?’

‘আসছি। কেনাকেনি শেষ?’

‘হু। বাসার ঠিকানা জানিস না?’

রিদ মিথ্যে বলল, ‘একদম না। আমাকে রেখে যাস না।’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here