যাত্রাশেষে (পর্ব-১১+১২)

যাত্রাশেষে (পর্ব-১১+১২)
হালিমা রহমান

আজ বিকালটা খুব সুন্দর।আকাশে কালো মেঘ নেই,সূর্যের প্রখর তাপ নেই।ঝিরিঝিরি বাতাস আছে আশেপাশে।সাবিনা বেগম এরকম আবহাওয়া খুব ভালোবাসেন।প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখলেই তার আগের দিনের কথা মনে পড়ে যায়।যখন তিনি মা ছিলেন না, কারো ঘরের বউ ছিলেন না,দায়িত্বের বেড়াজালে জীবন বন্দি ছিল না—এমনসব দিনের কথা।কি সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো!
সাবিনা বেগম রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন।তার দৃষ্টি চুলার উপরে থাকা পাতিলের উপর নিবদ্ধ।চা চাপিয়েছেন চুলায়।গরুর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে তাতে চাপাতি ঢেলে দিয়েছেন।এই রকম চা খুব পছন্দ মহুয়ার।গরুর দুধের এক কাপ চা হাতে পেলে সে বেশ আয়েশ করে তাতে চুমুক দেয়।স্বাদে তার দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসে।এই দৃশ্যটি খুব পছন্দ সাবিনা বেগমের।মনে হয় যেন, তিনি বিশ্ব রাঁধুনী ও মহুয়া বিচারক।রান্নায় মুগ্ধ হয়ে প্রশংসায় ভেঙে পড়ছেন মহামান্য বিচারক।ইদানিং, সাবিনা বেগম অল্পতেই অস্থির হয়ে যান।ভিতরটা শুকিয়ে যায় হুটহাট।যখন-তখন চোখ ভিজে আসে।এই অদ্ভুত রোগের কারণ খুব ভালো করেই জানেন তিনি।মহুয়ার বিয়ের তারিখ এগিয়ে এসেছে।আর মাত্র পনেরো দিন বাকি।কলিজার টুকরাটা আবারো চলে যাবে।সাবিনা বেগম কখনো ভাবেননি তার মেয়ের সাথেই বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটবে।মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই দু-বার বউ সাজতে হবে মহুয়াকে।তিনি মা।তিনি তো জানেন, মেয়েটা কি থেকে কি হয়ে গিয়েছিল।তার দু-চোখ ভরা কতটা স্বপ্ন ছিল।সাবিনা বেগম বরাবরই মহুয়ার প্রতি দুর্বল।একটা মাত্র মেয়ে তার।কিন্তু,এই দুর্বলতা কখনো দেখাননি তিনি।আফজাল সাহেব বিদেশে ছিলেন বলে একা হাতেই সামলাতে হয়েছে সব।একহাতে সংসার, অন্যহাতে মেয়ে।ইচ্ছে করেই কখনো মহুয়ার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেননি।তার সাথে মহুয়ার সম্পর্ক ছিল অনেকটা উর্ধতন-অধস্তনের মতো।এর পিছনে অবশ্য একটা কারণও আছে।তিনি সবসময় ভয়ে থাকতেন মেয়েকে নিয়ে।মেয়ের সাথে খোলামেলা আচরণ করলে যদি মেয়ে কথা না শোনে।যদি বখে যায়।তাই তাদের মা-মেয়ের সম্পর্কের গন্ডি শাসনে সীমাবদ্ধ।মেয়েকে যত ভালোবাসেন তার চাইতে বেশি শাসন করেন।

সাবিনা বেগম যখন চায়ের কাপ নিয়ে মহুয়ার ঘরে ঢুকলেন,তখন মহুয়া তৈরি হচ্ছে।হয়তো কোথাও যাবে।সাবিনা বেগম চায়ের কাপ মহুয়ার টেবিলের উপর রেখে বললেনঃ”রেডি হচ্ছিস যে?কোথায় যাবি?”
—” রবীন্দ্র সরোবরে।”
সাবিনা বেগম বেশ অবাক হয়ে যান।এই সময়ে ওখানে কি?তিনি বেশ অবাক হয়েই বলেনঃ” এই সময়ে?”
—“হ্যাঁ, মা।”
—” কি দরকারে যাবি?”
—” তুষার সাহেবের সাথে দেখা করতে।”
সাবিনা বেগম কপাল কুঁচকে ফেলেন।বিয়ের আগে এতো দেখাশোনা কিসের? সেদিন না দেখা করতে গেল!তিনি খাটের কোনে বসতে বসতে বললেনঃ”আজকে আবার কেন?”
মহুয়ার তৈরি হওয়া প্রায় শেষ।কালো রঙের হিজাবে, কাঁধের কাছে একটা পিন আটকে মায়ের পাশে এসে বসলো।হাতে তার ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। এক চুমুক চা গিলে নিয়ে বললঃ”আজকে মৃত্তিকার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন তিনি।তাই দেখা করতে বলেছেন।”
—” তোকে বলল আর তুইও চলে যাবি?বিয়ের আগে কি এতো দেখা করা ঠিক?”
—” হয়তো ঠিক না।কিন্তু অনেক আগেই বলেছিলেন, বিয়ের আগে আরেকদিন দেখা করবেন।এখন বলেছে আমি কি না করতে পারি?”
সাবিনা বেগম নাক-মুখ কুঁচকে বললেনঃ”এখনকার ছেলে-মেয়েদের আচরণ কিছুই মাথায় ঢুকে না আমার।বিয়ের আগে আবার এতো দেখা করতে হবে কেন?লাজ-লজ্জা কিছু নেই নাকি?দিন ছিল আমাদের সময়।তোর বাবার সাথে যেদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেদিন থেকে আমি আর বাড়ির বাইরেই পা দিতাম না।খালি লজ্জা করত।যদি কেউ বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে,কি বলব আমি?এই কথা ভেবে আর ঘর থেকেই বের হতাম না।অথচ, তোরা!আজ নিয়ে তিনদিন দেখা করতে যাচ্ছিস।কি একটা অবস্থা!”

মহুয়া চা শেষ করে মুচকি হাসলো। তার মা বেশ রক্ষণশীল। কাপ রাখতে রাখতে বললঃ” তোমাদের সময় আর এখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য, মা।আজকে আর সময় নেই।এসে কথা বলব।এর আগের দুদিন তুষার সাহেব আমার জন্য অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন।আবার একই ঘটনা আজকেও ঘটুক, তা চাচ্ছি না।আসছি, আল্লাহ হাফেজ।”

***

মহুয়া আজকে তুষারের আগেই পৌঁছে গেছে।সরোবরের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে আছে সে।এই জায়গাটা খুব পছন্দ মহুয়ার।মানুষ থাকলেও খুব বেশি বিশৃঙ্খলা নেই।কেউ শরীরচর্চা করছে,কেউ আড্ডা দিচ্ছে,কেউ ঘুরতে এসেছে।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।এই জিনিসটাই খুব ভালো লাগে মহুয়ার।মহুয়ার থেকে খানিকটা দূরেই একটা দল বসে আছে।সাত-আটটা ছেলে-মেয়ে।খুব সম্ভবত এটা একটা বন্ধুর দল।একটা নিচু ঢিবির উপর গোল হয়ে বসে আছে সবাই।বেশ সুন্দর একটা ছেলের হাতে গিটার।সে কিছুক্ষণ আগে একটা সুর তুলেছে।এখনো সেই সুরেই গিটার বাজিয়ে যাচ্ছে।খুব পরিচিত একটা সুর।মহুয়া মনে করার চেষ্টা করল,এটা কোন গানের সুর হতে পারে।তার চিন্তার মাঝেই ছেলেটা তার সুন্দর কণ্ঠে গান ধরলো—

” ভুলিনি তো আমি
তোমার মুখের হাসি,
আমার গাওয়া গানে
তোমাকে ভালোবাসি।”

মহুয়া মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে।ছেলেটার গলায় জাদু আছে বলতে হবে।আশেপাশের অনেকেই নজর দিচ্ছে ছেলেটার উপর।মহুয়া গানে এতোটাই মজে ছিল যে, কখন তুষার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে তা বলতেই পারল না।

—” গানটা খুব সুন্দর,তাই না মহুয়া?”
—“হুম, খুবই সুন্দর”—বলতে বলতেই মহুয়ার চোখ যায় তুষারের উপর।অন্যান্য দিনের চাইতে আজকে একটু বেশিই পরিপাটি লাগছে মানুষটাকে।কালো রঙের টিশার্টে স্বাভাবিকের চাইতেও বেশি ফর্সা দেখাচ্ছে।তুষারের গায়ের রঙ হলুদ-ফর্সা।তাই হয়তো কালো রঙে বেশ মানিয়েছে তাকে।তুষারের কোলে মৃত্তিকার দিকে চাইতেই চওড়া হাসি ফুটে মহুয়ার ঠোঁটে।সাদা রঙের জামায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে!সে বাবার কোলে ভর দিয়ে আশপাশ দেখছে।

—” এই সাদা পরীটাকে কোথায় পেলেন?পরী তো দেখছি খুব কৌতূহলী।”
—” হুম। নতুন জিনিসে তার আগ্রহের শেষ নেই।এটাই আমার রাজকন্যা।”
তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার দিকে ফিরায়।মৃত্তিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেঃ” এই যে মা,এদিকে তাকাও। এইটা মহুয়া।পরিচিত হও।মিত্তি,মিত্তি।”
মৃত্তিকার কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না।সে আগের মতোই আশেপাশে নজর দিচ্ছে।তুষার আরো দুবার মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দিল।
—“এই যে মা,এদিকে তাকাও।এইতো এদিকে।”
মৃত্তিকা তার বাবার কথায় হয়তো খুব বিরক্ত হল।আরেকবার তুষার জোড়াজুড়ি করতেই “অ্যা” করে একটা চিৎকার দিল।এটা যে তার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ, তা বেশ বুঝতে পারলো মহুয়া।তাই হেসে তুষারকে বললঃ”ওকে ওর মতোই থাকতে দিন।আপনার রাজকন্যা পালিয়ে যাচ্ছে না আর আমিও পালিয়ে যাচ্ছি না।সময় হলে নিজে নিজেই পরিচিত হবে।আপনিও একটা পাগল, তুষার সাহেব।একটা বাচ্চার সাথে এরকম জোর করার কি আছে?”
তুষার হাল ছেড়ে দিয়ে মহুয়ার দিকে তাকালো।এই প্রথম খুব সূক্ষ্মভাবে নজর দিল মহুয়ার মুখের দিকে।সবার আগেই তার নজর গেল মহুয়ার থুতনিতে।থুতনির নিচে আপেলের মতো একটা ভাজ।অনেকটা আপেলের নিচের অংশের মতো।কপালের মাঝে একটা টিপের মতো তিল।হঠাৎ করে দেখলে এটাকে টিপের মতোই দেখা যায়।চোখগুলো একটু বড় বড়।চেহারার সাথে মানিয়েছে বেশ।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের নাকে সাদা রঙের নাক ফুল।ছোট্ট একটা পাথর যেন চেহারার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।মেয়েটা যখন হাসে, তখন ঠোঁটের আধ ইঞ্চি নিচে একটু ভাঁজ পড়ে।সৌন্দর্যের দিক দিয়ে যে মহুয়ার কমতি নেই তা তাকে দেখলেই বুঝা যায়।
এইরকম রূপকেও কোনো পুরুষ ঠেলে দিতে পারে?আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছা তুষারের।বিয়ের পর একদিন মহুয়াকে বলবে ছবি দেখাতে।মহুয়ার কাছে নিশ্চয়ই আবরারের কোনো না কোনো ছবি আছে।

—” তুষার সাহেব,এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
—” নাহ,চলুন হাঁটি।মিত্তি এখনো শান্ত আছে।কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না।না হাঁটলেই কান্নাকাটি শুরু করবে।”

মহুয়া ও তুষার হাঁটা শুরু করলো।তুষারের পাশে মহুয়া, কোলে মৃত্তিকা।তার কাছে বেশ ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট সুখী পরিবার।অলস বিকাল কাটাতে হাঁটতে বেড়িয়েছে।তুষার মনে মনে হাসে।দিন দিন তার নৈতিক অধঃপতন ঘটছে।একটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে পেয়েই তাকে বউ ভাবতে শুরু করে দিল!আশ্চর্য!

—” মৃত্তিকার বাবা,আরো আগে দেখা করা উচিৎ ছিল আপনার।বিয়ের পনেরো দিন আগে কেউ দেখা করতে চায়?”

মহুয়ার সম্বোধন খুব ভালো লাগে তুষারের।কি ডাকলো মহুয়া? মৃত্তিকার বাবা?এরকম তো কখনো কেউ ডাকেনি তাকে।মহিমা সবসময় নাম ধরে ডাকত।এটাই নাকি এখন ফ্যাশন। তুষার খুশি মনে বললঃ”তুমি খুব সুন্দর করে ডাকলে আমাকে।এরকম ডাক কোথায় শিখেছ?”
কিরকম খাপছাড়া প্রশ্ন! কাকে কি বলে ডাকতে হয় তা কখনো শেখা লাগে?মহুয়া বললঃ”কেউ শিখিয়ে দেয়নি।আপনি আমার অনেকটাই বড়।আমি বড় কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারি না।কেমন যেন লাগে।তাই ডাকলাম।আপনার কোনো আপত্তি আছে নাকি?”
—” আরে না,না। আমার খুব ভালো লাগলো।আমি অনেক আগেই তোমার সাথে দেখা করতাম।কিন্তু,এই কয়েকদিন বেশ ঝামেলায় ছিলাম।আমার ফ্ল্যাট পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে।তার জন্য আসবাব কিনতে হয়েছে।বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে হয়েছে।তার উপর ব্যবসায়ের কাজ তো আছেই।এসবের চক্করে পড়ে একদম সময় পাইনি।”
—“ওহ।”
—” বাড়ির সবাই ভালো আছে?”
—” হুম।”
মহুয়া কোনো কথা খুঁজে পেল না।মনে মনে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়।ভাব জমাতে খুব অপটু মহুয়া।
—” মহুয়া, বলো তো হিমু বেশিরভাগ একা একা হাঁটতো কেন?রূপাকে নিয়ে কেন হাঁটতো না?
প্রশ্নটা খুব ভালো বুঝতে পারলো না মহুয়া।তাই ভ্রু কুঁচকে বললঃ”মানে?”
—” আরে আমি হুমায়ূন আহমদের সৃষ্ট হিমু চরিত্রের কথা বলছি।পড়নি হিমু সবসময় একা একা রাস্তায় হাঁটতো?বলতো কেন?”
—” কি জানি।”
—” শোনো হিমু যদি সবসময় রূপাকে নিয়ে হাঁটতো,তবে কখনোই ভাবলেশহীনভাবে হাঁটতে পারত না।কারণ সুন্দরী রমনী নিয়ে হাঁটা যায় না।কেমন যেন একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব আসে শরীরে।এই যেমন এখন আমার মনে হচ্ছে।নিজেকে বিশ্বপ্রেমিক ভাবতে ইচ্ছে করছে।”
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললঃ”আপনি যে মহাত্যাদড়, তা কিন্তু আপনাকে দেখলে বুঝা যায় না।এক বাচ্চার বাবা হয়ে আরেক মেয়ের সাথে বাদড়ামি করতে লজ্জা করছে না?তার উপর মেয়েটা আপনার কোলেই আছে।”
—” আরে আমি তো আর….
—” বা বা,বা বা, বা বা”
তুষার কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকার জন্য।সে তার বাবার কোলেই খুব নড়াচড়া করছে আর পিছনদিকে ঠেলছে।তুষার থেমে পিছনে তাকালো।একটা হাওয়াই মিঠাইওয়ালা চলে যাচ্ছে।মৃত্তিকার এখন ওটা চাই।তার অঙ্গভঙ্গি দেখেই তুষার বুঝলো।সে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বললঃ”ঠিক আছে,বাবা এনে দিচ্ছি।”
মহুয়াও বুঝলো বাবা-মেয়ের কথা।সে তুষারকে বললঃ” ওকে আমার কাছে দিন।লোকটা তো দূরে চলে গেছে।ওকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।আমি মিত্তিকে নিয়ে দাড়াচ্ছি এখানে।”

তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার কোলে দিল।মৃত্তিকা বেশ গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইলো।বুঝাই যাচ্ছে মহুয়ার কোলে সে আরাম পাচ্ছে না।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কেঁদে ফেললো।তুষার বেশ এগিয়ে গেছে ততোক্ষণে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে একটু এদিক-ওদিক হাঁটলো।মৃত্তিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।মহুয়ার হাত থেমে গেল মৃত্তিকার প্যাম্পার্সের কাছে এসে।বেশ ভারী হয়ে আছে এটা।মহুয়া একটু খুলে দেখলো।যা ভেবেছে তাই ঠিক।মৃত্তিকা মলত্যাগ করেছে।মহুয়া প্যাম্পার্স্টা খুলে দিল।মৃত্তিকাকে কোলে ও প্যাম্পার্সটাকে পাশে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বললঃ” এই যে মা,কাঁদে না।তোমার বাবা এক্ষুনি এসে পড়বে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে তুষার চলে আসলো।তার হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই।তুষারকে দেখতেই তার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো মৃত্তিকা।তুষার মহুয়ার হাতে হাওয়াই মিঠাইগুলো ধরিয়ে দিল।

—ও কি খুব বিরক্ত…
তুষারের কথা থেমে গেল।কারণ তার পেটের দিকটা ভিজে গেল মৃত্তিকার জন্য।তুষার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকাতেই সে বললঃ”প্যাম্পার্সটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে খুলে দিয়েছি।খুব বেশি ভিজে গেছেন আপনি?”

***

দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল।আজকে মাসের এক তারিখ।এক তারিখের রাতেই,মহুয়ার নাম জুরে গেল তুষারের সাথে।সে এখন তুষার আহমেদের বউ,মৃত্তিকা আহমেদের মা।বিয়ে শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল।এতো দেরু হতো না।আজকে সকাল সকাল তুষারের খালু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাকে নিয়ে হাসপাতালে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।তুষার ভেবেছিল আজকে বিয়েই করবে না।এতো বিপদের মধ্যে আবার বিয়ে করা যায় নাকি!কিন্তু,তুষারের এই ইচ্ছাপূরণ করতে দিলেন না রুবিনা বেগম।বিকালের দিকে তার স্বামী একটু সুস্থ হতেই তুষারকে পাঠিয়ে দিলেন মহুয়াদের বাড়ি।যেভাবেই হোক আজকে তার ঘরে বউ চাই।আর কি করার! তুষার চলে গেল বিয়ে করতে।বিয়েতে খুব বেশি আয়োজন ছিল না।একদম ঘরোয়া পরিবেশের বিয়ে।নানা নিয়ম-কানুন শেষ করে মহুয়াকে নিয়ে বেড়তে বেড়তে এগারোটা বেজে গেল।এইবারেও গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে মহুয়া।এমনিতেই কালকে ঘুমাতে পারেনি।তাছাড়া আজ বিদায়ের সময় খুব কেঁদেছে।তাই গাড়ির মধ্যে ক্লান্ত শরীরে, তুষারের কাঁধে মাথা দিয়ে খুব শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লো।তুষার পড়েছে খুব বিপাকে।একদিকে বউ কাঁধে ঘুমিয়ে আছে অন্যদিকে মেয়ে বুকে ঘুমিয়ে আছে।বেচারা নড়াচড়াই করতে পারছে না।রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল না।তাই খুব দ্রুতই পৌঁছে যায় ওরা।তুষার আস্তে আস্তে ডাক দেয় মহুয়াকে।
—” মহুয়া, মহুয়া। উঠো।”
মহুয়ার নড়েচড়ে বসে।মাথা উঠিয়ে বলেঃ”এসে পড়েছি?”
—” হুম।”
তুষার আগে গাড়ি থেকে নামে।এলাকায় নতুন ও।মৃত্তিকাকে এককোলে নিয়ে আরেক হাতে মহুয়াকে নামায়।মহুয়ার চোখে খুব ঘুম। এখানেই হাত-পা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।ঢুলুঢুলু চোখে কোনোমতে ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় মহুয়া।ঘুমাতে না পারলে নিশ্চিত সে মরে যাবে।রুবিনা বেগম তৈরি ছিলেন।ছেলে,ছেলের বউকে আটকান না তিনি।মহুয়ার সাথে ভালো-মন্দ কথা বলে ওকে ঘরে পৌঁছে দেয়।ঘরে এসে হাফ ছাড়ে মহুয়া।ভেবেছিল এখানেও নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে।পুরো ঘরে চোখ বুলায় একবার।ঘর নতুন সাজানো হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।আসবাবপত্রে ঠেসে আছে একদম।মহুয়া আর কোনোদিকে নজর না দিয়ে লাগেজ থেকে শাড়ি বের করে।তুষার আসার আগেই শাড়ি বদলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।মৃত্তিকাও খাটের মাঝে শুয়ে আছে।ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে যায় মহুয়া।বেঁচে থাকলে তুষারের সাথে পরেও কথা বলা যাবে।এখন যদি মহুয়া না ঘুমায় তবে হয়তো মাথাব্যথায় মরেই যাবে।খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না মহুয়াকে।দ্রুতই পাড়ি জমালো স্বপ্নরাজ্যে।
তুষার যখন ঘরে এসেছে তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে বারোটার ঘরে।সে এসেই দেখলো মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো তুষারের।সে এরকম কিছুই ভেবেছিল।মহুয়াকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল,তার খুব ঘুম পেয়েছে।তুষার হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছিল।মহুয়াকে ঘুমাতে দেখে খুব বেশি ভাবলো না সে।খাবারের প্লেট রেখে মৃত্তিকার আরেক পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।সকাল থেকে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।শরীর ভেঙে আসছে।না ঘুমালে চলবেই না।

খুব সকালে ঘুম ভাঙে মহুয়ার।চারপাশে আলো ফুটেছে।ঘুম পালিয়ে যাওয়ায় উঠে বসে মহুয়া।তারপাশেই তুষার ঘুমিয়ে আছে।তুষারের বুকের উপর মৃত্তিকা।মহুয়া মুচকি হাসে।কিভাবে ঘুমাচ্ছে এরা।তুষারের থেকে নিয়ে মৃত্তিকাকে বালিশে শোয়ায়।ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠে তুষার।মেয়ের দিকে ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।বারান্দার দরজাটা খোলা।মহুয়া নিচে নেমে শাড়ি ঠিক করে।টেবিলের উপর খাবারের প্লেট দেখেই ওর ক্ষিদে পেয়ে যায়।কালরাতে সেই নয়টা বাজে খেয়েছিল।মহুয়া হাতখোপা করতে করতে বারান্দার দিকে যায়।ওর বারান্দার প্রতি আলাদা আকর্ষণ আছে।বারান্দা মহুয়ার খুব পছন্দ।সদ্য ঘুম ভাঙা নিস্তেজ শরীর নিয়ে মহুয়া বারান্দায় দাঁড়ায়।ভোরের আলো তার শরীর ছুঁয়ে যায়।ভালোমতো চোখ মেলে সামনে তাকাতেই মহুয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।হৃৎপিন্ডের গতি তীব্র হয়।শরীরে কাঁপন ধরে।সামনের বারান্দায় ঠিক একই অবস্থা আবরারের।সেও ভূতের মতো চোখ মেলে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১২)

একটা নতুন ভোরেই এরকম একটা অপ্রত্যাশিত মানুষের মুখোমুখি হবে, তা কখনো ভাবেনি মহুয়া।আবরার তার সামনেই দাঁড়ানো।দুজনের মাঝে দূরত্ব বড়জোর দেড়হাত হবে।দুটো বাড়ির মাঝে এতটুকুই ফাঁক।মহুয়া কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব চোখে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর সবটা বোধগম্য হতেই দ্রুতপায়ে ঘরের দিকে ছুটলো। কোনো পঁচা,নোংরা অতীতের মুখোমুখি হতে চায় না সে।মহুয়া ঘরে ঢুকে সশব্দে বারান্দার দরজা আটকে দেয়।হৃৎপিণ্ডের গতি তীব্র। মহুয়া দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।খুলে যাওয়া চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে নেয়।নিজেকেই নিজে মনে মনে ধমক দেয়।প্রাক্তনকে দেখে এমন করার কি আছে? পৃথিবীটা ছোট।এখানে চলতি পথে মানুষের পাশাপাশি কতগুলো ইতরের সাথেও দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক।তো?এতো থমকে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।মহুয়া ধীরপায়ে খাটের কোনে বসে পড়ে।মৃত্তিকা ও তুষার এখনো ঘুমিয়ে আছে।মিনিট কয়েক বসে থাকার পরেই, হঠাৎ করে মহুয়ার মাথায় একটা ভাবনা খেলে যায়।সে আসলে আছে কোথায়?এটা কোন জায়গা?আবরার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল,সেই জায়গাটা খুব পরিচিত মহুয়ার।এক সময়ে সে এখানে স্বর্গসুখ লাভ করতো।তবে কি? মহুয়া মৃত্তিকার উপর দিয়ে তুষারের কপালে হাত দেয়।হালকা ধাক্কা দিয়ে মৃদু গলায় ডাক দেয় তাকে।

—” মিত্তির বাবা,মিত্তির বাবা।এই মিত্তির বাবা।”
—” হুম”—ঘুমঘুম কন্ঠে উত্তর দেয় তুষার।এতোক্ষণ একপাশ হয়ে শুয়ে থাকলেও, এখন সোজা হয়ে শোয়।ডান চোখটা হালকা মেলে রাখে।
—” আমরা এখন কোথায় আছি?লক্ষ্মীবাজারে না?”
—” উঁহু।নয়া পল্টন।”
—” নয়া পল্টন কেন?আপনার বাড়ি না লক্ষ্মীবাজার?”
—” ফ্ল্যাটের কথা বলেছিলাম না তোমায়?ফ্ল্যাট নয়া পল্টনে।লক্ষ্মীবাজারে এতোদিন আমি ভাড়া থাকতাম।কালকে এখানে শিফট হয়েছি।তুমি উঠেছো কেন?ঘুমিয়ে থাক।”
—” আমার আর ঘুম আসবে না।”
—” তাহলে একটু কষ্ট করে মিত্তির প্যাম্পার্সটা খুলে দেও না।কাল রাত থেকে পরে আছে।অনেক ভারী হয়ে গেছে মনে হয়।”
—“ঠিক আছে।”

আবারো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায় তুষার।তার ক্লান্তির রেশ যে এখনো কাটেনি তা দেখলেই বুঝা যায়।মহুয়ার মাথা ঝিমঝিম করছে।সে থম ধরে বসে থাকে কতক্ষণ। তার মানে এই সেই ফ্ল্যাট, যেটা আবরারদের ঘর থেকে সে উঁকি দিয়ে দেখতো!এটা খুব পছন্দ ছিল মহুয়ার।রুমগুলো, বারান্দাটা কত বড়।মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো রুম দেখলো।সাদা-গোলাপি রঙ করা হয়েছে।রুমটা বেশ বড়।খাট,আলমারি,ড্রেসিং টেবিল,টেবিল,দুটো ফুলদানি,দেয়াল শোকেস সব একসাথেই এ ঘরে রাখা।তাই একটু দমবন্ধ হয়ে আসে।বাইরের রুমগুলোর কি অবস্থা, তা জানা নেই মহুয়ার।কাল রাতে চোখে ঘুম ছিল বলেই বোধহয় ঘরটা পরিচিত মনে হয়নি।মহুয়ার নিজের ভাগ্যের উপর এখন আর রাগ হয় না।আক্ষেপও হয় না।নিজের ভাগ্যের উপর খুব হাসি পায় তার।ঘুরে ফিরে এক জায়গায়ই কেন চলে আসে সে?আগের সবকিছু ভুলে মহুয়া নতুন করে সব শুরু করলো।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, যাতে আর কখনো অতীতের দেখা না পায়।অথচ বিয়ের পরের দিনই দেখে সে প্রাক্তনের চোখের সামনে এসে পড়েছে।মানে, এরকম আজগুবি জিনিস আর কার সাথে ঘটেছে?মহুয়া কি জীবনে খুব বেশি পাপ-টাপ করে ফেললো নাকি?নাকি আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে?কে জানে!
পাশে মৃত্তিকা নড়েচড়ে উঠতেই সচেতন হয় মহুয়া।মেয়েটার বোধহয় খুব অস্বস্তি হচ্ছে।ঘুমের মধ্যেই খুব অস্থিরতা করছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিজের কাছে টেনে আনে।আলতোহাতে প্যাম্পার্স খুলে দেয়।এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে তার।মহুয়ার বরাবরই একটা বাচ্চার শখ।একদম ছোটবেলা থেকে।তার কেন কোনো ছোট ভাই-বোন নেই,এ নিয়ে প্রশ্ন করে সাবিনা বেগমকে কম বিরক্ত করেনি সে।বাচ্চাদের ধরতে,আদর করতে, কোলে নিতে খুব ভালো লাগে তার।বিয়ের পর ভেবেছিল আবারারের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু বিধি বাম! সেখানেও ব্যর্থ।তুষারকে নিয়ে এখনো কোনোকিছু ভাবেনি মহুয়া।ভাবতেও চায় না।যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।মহুয়ার কেবল এই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি মায়া।একটা বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায় না?অবশ্যই যায়।মহুয়া ঠিক এটাই করবে।সে কখনোই তুষারের প্রতি আগে আগেই দুর্বলতা দেখাবে না।আগে তুষারের মতিগতি বুঝবে।তারপর যা হবে দেখা যাবে।
মহুয়া মৃত্তিকার পাশ থেকে উঠে নিজের ফোন খুঁজে।কোথায় আছে কে জানে!কাল আসার পর বাড়িতে একবারও কথা বলা হয়নি।মা-বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে নাকি আল্লাহ মালুম।বহু খুঁজেও ফোন পেল না মহুয়া।লাগেজের ভিতর,ব্যাগের ভিতর,তুষারের পাঞ্জাবীর পকেটে –কোথাও নেই।মহুয়ার চোখ যায় টেবিলের উপর।খাবারের প্লেটের পাশেই একটা ফোন।খুব সম্ভবত তুষারের।মহুয়া মুখ বেঁকিয়ে ভাবলো।ফোনটা কি ধরবে?তুষার তো ঘুমাচ্ছে।না বলে কারো ব্যাক্তিগত জিনিস কি ধরা উচিৎ? মহুয়া বেশ কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখন তুষারের ফোনটাই ব্যবহার করবে।তুষারকে ঘুম থেকে তুলে অনুমতি নেবে।না বলে আরেকজনের জিনিস আবার কিভাবে ধরে?মহুয়া মোটেও অসামাজিক নয়।তাই মহুয়া ধীরে ধীরে তুষারের পাশে যেয়ে বসে।আবারো আস্তে আস্তে কপালে হাত ছোঁয়ায়।মৃদু স্বরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তুষারকে।

—” মিত্তির বাবা,এই মিত্তির বাবা।”
তুষার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখ মেলে তাকায়।তার কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
—” আবার কি, মহুয়া?”—বেশ অসহায় শোনায় তুষারের কন্ঠ।
—” আপনার মোবাইলটা একটু নেই।আমারটা খুঁজে পাচ্ছি না।বাসায় ফোন দেব।”
বেশ অবাক হয়ে উঠে বসে তুষার।ক্ষীণ গলায় বলেঃ”এই জন্য আমাকে তুমি ডেকেছো?শুধুমাত্র এই সামান্য কারণে? ”
—“হ্যাঁ! ”
—“এটা অনুমতি নেওয়ার কি আছে, মহুয়া?আমার ফোন ধরলে কি আমি তোমায় বকা দেব?আশ্চর্য!মানুষ কিডনিও এভাবে চায় না।”
মহুয়া কিছু না বলে ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।গলায় বিরক্ত ফুটিয়ে তুলে —” আমাকে অসামাজিক ভেবেছেন?আমি কারো ব্যক্তিগত জিনিস না বলে ধরি না।আর বিরক্ত করব না।ঘুমিয়ে থাকুন।”
—“আরেকবার বিরক্ত করলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।আগামী আধ-ঘন্টার আগে মোটেও ডাকবে না আমাকে।”

মহুয়াকে কথাগুলো বলে আবারো শুয়ে পড়ে তুষার।কাঁচা ঘুম ভাঙলে কেমন লাগে মানুষের?মৃত্তিকা নিজের জায়গা থেকে গড়িয়ে তার বাবার জায়গায় এসে পড়েছে।তুষার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।এটা তার স্বভাব।ঘুমের সময় মেয়েকে না জড়িয়ে ধরলে তার ঘুমই আসে না।তুষারের চোখে ঘুম নেমে আসার আগেই তা ভেঙে যায়।কারণ,ঘুমের মাঝেই মৃত্তিকা তার শরীর ভিজিয়ে ফেলেছে।তুষার চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।পাশে মহুয়া এখনো দাঁড়ানো।তার দিন- দুনিয়া অন্ধকার করে হাসি আসছে।তুষারের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে।কিন্তু এখন মোটেও হাসা যাবে না।তুষার বেশ অনেক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকার ফট করে উঠে দাঁড়ায়।আজ দিনটাই খারাপ।তার বউ ও মেয়ে বিশ্বখারাপ।ঘুমাতেই দিলো না।অসহ্য।বিরবির করতে করতেই বাথরুমের দিকে ছুটে তুষার।

***

মহুয়া গোসল সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।কাল রাতে ঘুমিয়ে না গেলে আগেই গোসল করতো।গাড়ি থেকে নেমে গোসল না করলে খুব অসহ্য লাগে মহুয়ার।তাছাড়া, খুব ক্ষিদেও পেয়েছে।মহুয়া তার রুমে রাখা খাবারের প্লেট নিয়ে বেড়িয়ে এলো।খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।তুষার বাইরে গেছে,মৃত্তিকা এখনো ঘুমায়।মহুয়া রুমের বাইরে পা দিয়ে কাউকে দেখলো না।বিয়েবাড়ি হলেও তুষারের বাড়িতে কোনো আমেজই নেই।এদের কি কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?মহুয়া মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে রান্নাঘরের দিকে গেল।এখান থেকে পানির আওয়াজ আসছে।মহুয়া সেখানে যেয়ে দেখলো, রুবিনা বেগম চা বানাচ্ছেন।মহুয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলায় হালকা কাশি তুলে।রুবিনা বেগম পিছু ফিরে মহুয়াকে দেখে মুচকি হাসে।

—” এসো মহুয়া।কখন উঠলে?”
—” একটু আগে।”
—” মিত্তি উঠেছে?”
—” জ্বি না।”
রুবিনা বেগমের চোখ যায় মহুয়ার হাতের প্লেটের দিকে।
—” ওটাতে কি?”
—” খাবার।কালকে রাতে মনে হয় মিত্তির বাবা নিয়ে গেছিল।নষ্ট হয়ে গেছে।”
—” খাওনি তোমরা রাতে!”
—” জ্বি না।খাওয়া হয়নি।”
—” ওমা এতোক্ষণ না খেয়ে কিভাবে থাকে মানুষ?চা হয়ে গেছে, চা খাও।তুষার নাস্তা আনতে গেছে।”
রুবিনা বেগম কাপে চা ঢালার আয়োজন করেন।মহুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পর বলেঃ” খালুর শরীরটা এখন কেমন?”
—” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
—” কি হয়েছিল?”
—” হঠাৎ করেই কাল বুকে ব্যথা উঠেছিল।এখন অবশ্য অনেকটাই ভালো।ঘুমাচ্ছে।তোমার সাথে আলাপ হয়েছে?”
—” জ্বি না।”
—” ঘুম থেকে উঠলে পরিচয় করিয়ে দেব।এখন খাও তো।”

মহুয়ার চা খাওয়ার ফাঁকেই তুষার এসে পড়ে।মহুয়া ডাইনিংয়ে বসেছিল।তুষারও এসে ওর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে।রুবিনা বেগমকে হাঁক দিয়ে বলে—” খালামনি,নাস্তা এনেছি।চা দেও।”
—” দিচ্ছি,অপেক্ষা কর।”
তুষার এক নজর মহুয়ার দিকে তাকায়।গোসল করায় বেশ সতেজ লাগছে মেয়েটাকে।গায়ে একটা নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।শাড়ির সোনালী আঁচল মাথায় দেওয়া।তুষার বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিচুস্বরে বললঃ” তোমাকে শাড়ি পড়লে অনেক বড় বড় দেখা যায়।”
—” আমি তো বড়ই।আমার সাতাশ চলছে,অষ্টাদশ নয়।”
—” হ্যাঁ, ঠিকাছে।কিন্তু এতোদিন এতো বড় দেখা যেত না।আজ দেখাচ্ছে।এখন থেকে পারলে শাড়িই পরো। ”
—” দেখি।আপনার এতো দেরি হলো যে?”
তুষার চেয়ারে হেলান দেয়।
—” আর বলো না,নতুন এলাকায় রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না।হোটেল খুঁজতে খুঁজতেই দেরি হয়ে গেল।”
—“গলির মাথাতেই একটা দোকান আছে।ওখানে গেলেই পেয়ে যেতেন।”
তুষার সোজা হয়ে বসে।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”তুমি কি করে জানলে?”
—“আমি এই নয়া পল্টনেই ছিলাম।তাই অনেক কিছুই চিনি।আমার কথা ছাড়ুন। আপনি বলুন,দোকান কি করে খুঁজে পেলেন?”
—” ইশতিয়াক নামের একজন ভদ্রলোক সাহায্য করেছেন।উনিও নাকি এদিকেই থাকেন।তিনি না থাকলে আরো দেরি হতো।ভদ্রলোক বেশ অমায়িক, বুঝলে।আমাকে নিজে দোকানে নিয়ে গেল।”

ওদের আলাপচারিতা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতে পারতো কিন্তু চললো না মৃত্তিকার জন্য।সে উঠে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।তুষার উঠার আগেই মহুয়া উঠে পড়লো।মুখে বললঃ” আমি এখন মেয়ের সাথে ভাব জমাবো।আপনি কিন্তু আমাদের মাঝে আসবেন না।হয়তো মিত্তি কাঁদবে।তাও নাক গলাবেন না। বুঝেছেন?”
তুষার মাথা নাড়ে।মা-মেয়ের রাজ্যে সে এখন নিষিদ্ধ প্রানী।

***

বিকালে মহুয়া ও মৃত্তিকা বসেছিল ঘরে।মৃত্তিকা অনেকটাই চিনে গেছে মহুয়াকে।সকালবেলা মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটেছে,খাবার খাইয়ে দিয়েছে,দুপুরে গোসল করিয়ে দিয়েছে।মহুয়ার বুকের উপর ভর দিয়ে বসেছিল মৃত্তিকা।সে তার মায়ের কানের দুল নিয়ে খেলছে।এটা তার জন্য নতুন খেলা।সে বেশ আগ্রহী।ঘড়ির কাটায় সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে।এমন সময় ঘরে ঢুকলো তুষার।সে আজ দোকানে যায়নি।বিয়ে উপলক্ষে কয়েকদিন কাজ থেকে দূরে থাকবে।তুষার এসে মহুয়ার পাশে বসে।মৃত্তিকাকে কোলে টেনে বলেঃ” আমার মা আমাকে ভুলে গেছে?”
মহুয়া বেশ বিরক্ত হয় এতে।সে আধশোয়া থেকে উঠে বসে। কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমরা খেলছিলাম,মিত্তির বাবা।আপনি একটা ডিস্টার্ব। ”
—” খেলো, আমি কি মানা করেছি?”
—” হুহ।মেয়েকে নিয়ে গেছেন আপনি।”
তুষার মহুয়ার কথায় কিছু বলল না।আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে তা মহুয়ার হাতে দিল।
—” এই নেও।”
—” কি এটা?”
—” তোমার প্রথম রাতের উপহার।কালকে তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলে,তাই দিতে পারিনি।দেখে বলো তো কেমন হয়েছে।”
মহুয়া শপিং ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করলো।বেশ সুন্দর একটা চেইন আছে তাতে।পাশে আরেকটা ছোট্ট বাক্স।সেটা খুলে দেখলো, তাতে একজোড়া চুড়ি।মৃত্তিকার হাতের মাপের।দুটোই বেশ সুন্দর।
—” বাহ,বেশ সুন্দর তো।”
মহুয়া মুখ তুলে দেখলো তুষার নেই।তাকে দেখতে বলে বারান্দাতে চলে গেছে।সেখান থেকে তার কথা শোনা যাচ্ছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে সেখানে গেল।লোকটা সত্যিই একটা পাগল।মহুয়া বারান্দায় যেয়ে দেখলো, তুষার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের সাথে কথা বলছে।মহুয়ার অস্তিত্ব টের পেতেই সে পিছু ফিরে। হাত বাড়িয়ে মহুয়ার কাঁধ টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।তারপর আবার আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ”এই যে ইশতিয়াক ভাই,এটা আমার বউ মহুয়া।আর এটা মেয়ে মৃত্তিকা।আর মহুয়া উনি ইশতিয়াক আবরার।ওই যে সকালে ইশতিয়াক ভাইয়ের কথা বললাম না,উনিই তিনি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here