যাত্রাশেষে (১৩)

যাত্রাশেষে (১৩)
হালিমা রহমান

মহুয়ার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।অস্বস্তির কারণ আবরার নয় তুষার।তুষারের হাত এখনো তার কাঁধের উপর।মহুয়ার মাথা তুষারের গলার কাছাকাছি।খুব সহজেই তুষারের পারফিউমের গন্ধ মহুয়ার নাকে ধাক্কা দেয়।তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও এতোটা ধরা-ছোঁয়ার সম্পর্ক নেই।তাই সারা শরীরে অস্বস্তিরা ভর করেছে।এই তুষার আবার তাকে আবরারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।হাহ!পৃথিবীতে কত আজব ঘটনাই না ঘটে।আবরারকে মহুয়ার চাইতে ভালো আর কে চিনে?এরকম হারামজাদা মহুয়া একটাই দেখেছে।তবে এবার আর আবরারের মুখোমুখি হয়ে থমকে গেল না মহুয়া।সকাল থেকেই নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করে নিয়েছে।আবরার শুধুমাত্র প্রাক্তন। বর্তমান তো আর নয়।তাছাড়া, আবরার মহুয়ার প্রতি আকৃষ্ট নয়।মহুয়াও আবরারের প্রতি দুর্বল নয়।তাহলে?অস্বস্তিতে ভোগার আর কারণই নেই।তাই তুষার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর মহুয়া মুচকি হাসলো।বেশ প্রসন্ন গলায় বললঃ”আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।ভালো আছেন?”
—” হ্যাঁ। তুমি ভালো আছ?”—আবরারের কন্ঠ অপ্রস্তুত।চোখের দৃষ্টিতেও বিচলতার ছাপ।
—” আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”
মহুয়া নিজের কাঁধ থেকে তুষারের হাত ছাড়িয়ে নেয়।তার কোলে থাকা মৃত্তিকা এদিক-ওদিক দেখছে।এই পরিবেশ তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন।মহুয়া তুষারকে বললঃ” আমি ঘরে যাচ্ছি।”
—” আচ্ছা।”

মহুয়া পা বাড়ালেও মৃত্তিকা বেশ অস্থিরতা শুরু করে দেয়।তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সে এখন এখান থেকে যাবে না।মহুয়া আবারো তুষারের দিকে এগিয়ে আসে।
—” মিত্তির বাবা,বাবুকে রাখেন।ও এখন ঘরে যাবে না।”
—” দেও।”

মহুয়ার কোল থেকে মৃত্তিকাকে আলতোহাতে কোলে নেয় তুষার।তার ঠোঁটের কোনের হাসি ও মুখের অনবদ্য সুখের ছাপ আবরারের চোখ এড়ায় না।মহুয়া আগের থেকে অনেকটাই বদলে গেছে।আগে আরেকটু সুন্দর ছিল।এখন বেশ শুকিয়ে গেছে।মেয়েটাকে শাড়ি পরলে বেশ লাগে।শাড়ি সামলাতেও পারে খুব।একটা কথা আবরারের খুব জানতে ইচ্ছে করে।মহুয়ার বিয়ে হলো কবে?এতো বড় একটা মেয়েই বা কবে হলো?তবে দুজনকে মানিয়েছে বেশ।ওদের বাচ্চাটাও খুব সুন্দর।একদম তুলতুলে।ঠিক বিড়াল ছানার মতো।বিড়াল ছানার কথা মনে আসতেই মহুয়ার আবদারের কথা মনে পড়ে যায়।আবরারের কাছেও ঠিক এরকম একটা বিড়াল ছানার আবদার করেছিল মহুয়া।যার ছোট দুটো হাত থাকবে,দুটো পা থাকবে,ঘরজুরে ঘুরে বেড়াবে–এরকম একটা বিড়াল ছানা।মেয়েটার চাহিদাগুলোও কেমন অদ্ভুত ছিল।ময়না পাখি, গাছ-গাছালি,প্রশংসা আর আবরারের একটু সময়–এই কয়েকটা জিনিসই চেয়েছিল সে।কিন্তু তার একটাও দিতে পারেনি আবরার।দীর্ঘশ্বাসে তার ভিতরটা ভারী হয়ে আসে।মহুয়া যাওয়ার আগে কোনো অভিশাপ দিয়ে যায়নি ঠিকই,কিন্তু আবরারের ভিতর অনুশোচনার বীজ বুনে দিয়ে গেছে।এর যন্ত্রণা যে কি তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় আবরার।

—” বা বা,বা বা “—মৃত্তিকার কন্ঠে চিন্তার রাজ্যে ভাঙন ধরে আবরারের।মেয়েটা কথাও বলতে জানে!কি সুন্দর করে তার বাবাকে ডাকলো!আবরার খুব প্রশংসার সুরে বলেঃ” আপনার মেয়েটা ভারী মিষ্টি, তুষার ভাই।বয়স কত ওর?
—” একবছর হয়নি এখনো।একবছর হতে আর কয়েকদিন বাকি।”

একবছর?তাহলে কি এটা মহুয়ার নিজের মেয়ে না?আবরার বেশ ইতস্তত করে বলেঃ”মেয়ের মায়ের সাথে কিন্তু মেয়ের চেহারা মিলে না।মনেই হয় না যে এটা মহুয়ার মেয়ে।”
আবরারের ইঙ্গিতের ধারে কাছেও যায় না তুষার।মেয়ের গালে চুমু খেয়ে মুচকি হাসে।
—” চেহারা না মিললে কি হয়েছে এটা মহুয়ারই মেয়ে।আমার সাথেও তো চেহারা মিলে না।তো?এটা আমাদেরই মেয়ে।”
—” ওহ,আচ্ছা।”

তুষার মৃত্তিকাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটে।হাত দিয়ে এটা -ওটা দেখায়।বারান্দাটা খোলা।মহুয়ার না বারান্দা পছন্দ?তুষার অনেকগুলো গাছ এনে দেবে।অনেকগুলো বাহারি গাছ লাগানো যাবে এখানে।ছোট-খাটো একটা ময়না পাখিও এনে দেবে।মহুয়ার ইচ্ছেগুলো সব মনে আছে তুষারের।সামান্য ইচ্ছে পূরণ করে যদি কারো মুখে হাসি ফোটানো যায়,তবে মন্দ কি!

—” ইশতি,ইশতি।কোথায় তুমি?”
অনন্যার কন্ঠ কানে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় আবরার।তুষারের থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেঃ” আসছি, তুষার ভাই।মিসেস ডাকছে।আপনার সাথে পরে কথা হবে।”
—” আচ্ছা।একদিন আসবেন আমাদের বাড়ি।”
—” ঠিকাছে।”

মুখে সম্মতি জানালেও মনে মনে হাসে আবরার।তুষার বোধহয় জানে না, সে মহুয়ার প্রাক্তন ছিল।জানলেও কি একই কথা বলবে?কে জানে!
আবরার ঘরে যেয়ে দেখলো, অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে।একদম তৈরি হয়ে আছে।হয়তো কোথাও যাবে।মেয়েটা পারেও বটে।অফিস থেকে ফিরেছে আধ-ঘণ্টাও হয়নি।অথচ,এর মাঝেই একেবারে হাত-মুখ ধুয়ে আবার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।অনন্যা বেশ আধুনিক মেয়ে।সংসার,চাকরি সামলানোর পরে এখন আবার একটা মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য হয়েছে।তাই সারাদিনে সে বেশ ব্যস্ত থাকে।আবরারের সাথে অফিস থেকে ফিরার পর, ঘরের কাজ-কর্ম শেষ করে কখনো বাড়ি থাকে আবার কখনো থাকে না।বেশিরভাগ সময়ই রাতের আগে অনন্যার চেহারা দেখার ভাগ্যও হয় না আবরারের।এসবকিছুই আবরার মেনে নিয়েছে।আজকাল বেশ শান্ত হয়ে গেছে সে।আগের সেই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার বাতিক নেই।অবশ্য, অনন্যার সাথে কখনো রাগ দেখাতেও পারেনি আবরার।ইচ্ছে করেই দেখাতো না।অনন্যা তার বড় সাধের মানুষ।তার অর্ধাঙ্গিনী, প্রেয়সী।এরকম মানুষের সাথে রাগ দেখানো যায়?

—” ইশতি, খাবার রান্না করা আছে।একটু কষ্ট করে খাওয়ার আগে গরম করে নিও।”
—” আজকে না গেলে হয় না অনু?”
—” আরে না। আজ একটা সম্মেলন আছে।”
—” আচ্ছা,সন্ধ্যাবেলায় কিসের সম্মেলন থাকে প্রতিদিন?এইরকম সংগঠন জীবনেও দেখিনি আমি।”
ফুঁসে উঠে অনন্যা।এটা তার ভালোবাসার জায়গা।কটকটে গলায় উত্তর দেয়ঃ” যেটা বুঝো না, সেটা নিয়ে কথা বলবে না।চাকরিজীবী মহিলাদের জন্য এই ব্যবস্থা।তাছাড়া, আমি না থাকলে তোমার কি সমস্যা?আমি তো আর বাসা-বাড়ি কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছি না।”
—” সেটাই।তুমি না থাকলে আমার কি সমস্যা!আচ্ছা একটা কথা বলো,যদিই বিয়ের পর আমাকে সময়ই না দিতে পারো তবে বিয়ে করেছ কেন?তোমাকে মাঝে মাঝে আমি মিলাতে পারি না।তুমি আর আগের মতো নেই অনু।আগে তুমি আমার সঙ্গ পছন্দ করতে,সারাদিন কথা বলার পরেও কথা ফুরাত না,একদিন দেখা না করলে পাগল হয়ে যেতে–এরকম আরো কত পাগলামি করেছ।এসব কি একবারের জন্যও মনে পড়ে না?তুমি বদলে গেছ, অনু।”
শেষদিকে খুব অসহায় শোনায় আবরারের কন্ঠ।খানিকটা ক্ষোভও ফুটে উঠে গলায়।হয়তো অনন্যারও খারাপ লাগে।সে হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখে।একপা-দুপা করে আবরারের দিকে এগিয়ে এসে তার চুল নেড়ে দেয়।বেশ আদুরে গলায় বলেঃ” তোমার অনু বদলায়নি,কখনো বদলাবেও না।সে শুধু একটু ব্যস্ত হয়ে গেছে।রাগ করো না, ইশতি।আজ খুব জলদি চলে আসব।প্রমিস।তুমিও আমার সাথে চলো।তোমার বেশ ভালো লাগবে।”
—” আমার ভালো লাগার দরকার নেই।তোমার ভালো লাগলেই চলবে।যাও,যেখানে যাচ্ছিলে।”

আবরার মুখ ফিরিয়ে নেয়।ভালো লাগে না তার এসব।নিজেকে এখন ব্যর্থ মনে হয়।বুঝতে পারে জীবনটা দীর্ঘশ্বাসে ভরে গেছে।জেনে-বুঝে দুটো নারীর মন ভেঙেছে।তাদের চোখের জল ঝরিয়েছে।এদের মূল্য তো চুকাতেই হবে।সৃষ্টিকর্তা কখনো ছেড়ে দেন না।

***

মহুয়া ঘর গোছাচ্ছিল।কালকে আসার পর আর গোছানো হয়নি।ফলস্বরূপ এখানে কাপড়, ওখানে কাপড়।সারাঘরে পোশাকের ছড়াছড়ি।গোছাতে গোছাতেই হাত আটকে যায় বিয়ের শাড়ির উপর।বিয়ের জন্য একটা সিঁদূর লাল রঙের শাড়ি কিনেছে তুষার।খুব ভারী শাড়ি না।সাধারনের মধ্যে অসাধারন।মহুয়ার একটুও কষ্ট হয়নি কাল।সাজগোজের বাহুল্যও ছিল না খুব।তুষারের পছন্দ আছে বলতে হবে।মহুয়ার শাড়ির সাথে মিল রেখে খুঁজে খুঁজে একই রঙের একটা জামা কিনেছে মৃত্তিকার জন্য।জামাটায় দারুন মানিয়েছে মৃত্তিকাকে।একদম একটা পুতুল।মাঝে মাঝেই মৃত্তিকাকে কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে মহুয়ার।একটা বাচ্চা এতো ফুটফুটে কেন হবে?

—“এই মহুয়া, দেখেছিলে গয়নাগুলো?ভালো লেগেছে?”
তুষার মহুয়ার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।মৃত্তিকা খাটে বসা।তুষারকে দেখেই খুব বিরক্ত লাগলো মহুয়ার।জ্ঞানহীন লোক।যার না তার সাথেই নিজের বউয়ের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।ফাজিল কোথাকার।
মহুয়া নিজের বিরক্তি গিলে নিল।হাজার হলেও সে নতুন বউ।অযথা ঝামেলা করার কি দরকার?তাই হাতের কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে রাখতে বললঃ” হুম,ভালোই।”
—“পরেছো?”
—” না।”
—” কেন?”
—” ইচ্ছে করছে না।”

মহুয়ার কন্ঠস্বর তুষারের কানে খট করে বাজে।নিষ্প্রাণ কন্ঠ।মেয়েটার কি মন খারাপ?তুষার মহুয়ার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।তার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়।মহুয়ার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরায়।

—” মন খারাপ?বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে।”
—” খানিকটা।”
—” মন খারাপ করো না।কালকে বৌভাতের পরেই তো যাব।আর কয়েকটা ঘন্টা মাত্র।”
—” আচ্ছা, আর মন খারাপ করব না।এখন ছাড়ুন।হয়েছে কি আপনার বলুন তো?যখন তখন কাঁধ জড়িয়ে ধরছেন।সরুন এখান থেকে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”

তুষার হাত সরিয়ে নিলেও মহুয়ার পাশ থেকে সরে যায় না।বরং মহুয়ার গা ঘেসে আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।মুখে হাসি টেনে বলেঃ”আজকে খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে,বুঝলে।বিয়ের পানি পেটে পরেছে।তাই কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে।আমার কি দোষ বলো?”
—“আপনি চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ।কথা-বার্তার কি ছিড়ি!আপনি আজকে ভয়াবহ একটা অন্যায় করেছেন।এর জন্য আপনাকে চরম শাস্তি দেওয়া উচিৎ। ”
তুষার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”কি করলাম আমি?”
—” আপনি আমাকে যার-তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কেন?বউ বলেই কি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে?”
—” সবার সাথে কোথায় পরিচয় করালাম?শুধু ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথেই তো।আরে উনি একদম নাকের ডগার প্রতিবেশী। ব্যবহারও ভালো।এদের সাথে ভাব না জমালে…..
মহুয়া তেড়ে আসে তুষারের দিকে।দু-পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলেঃ” খবরদার,মিত্তির বাবা।আর একবার যদি আপনার সাধের ইশতিয়াক ভাইয়ের নামে গুণগান করেছেন,খবর আছে আপনার।কসম, আমি আপনার গলায় ছুরি ধরব।”
মহুয়ার এরকম আগ্রাসী রূপ দেখে থমকে যায় তুষার।একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকায় মহুয়ার চোখের হিংস্রতা নজর এড়ায় না।তার খটকা লাগে।কি ব্যাপার? ইশতিয়াক ভাইকে নিয়ে এতো সমস্যা কেন মহুয়ার?তারা কি পূর্ব পরিচিত?
তুষার মহুয়ার হাত টেনে খাটে বসায়।গ্লাসে পানি ঢেলে তা বাড়িয়ে দেয় মহুয়ার দিকে।
—” নেও পানি খাও।খেয়ে পুরো কথা খুলে বলো।ইশতিয়াক ভাই তোমার পরিচিত?”

মহুয়া এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে নেয়।গলাটা শুকিয়ে গেছে একদম।মৃত্তিকাও ততোক্ষণে মহুয়ার কাছে এসে পড়েছে।মহুয়ার কাঁধে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।মহুয়ার খোপা একটা কাঠি দিয়ে আটকানো।বেশ বাহারি জিনিস এটা।মাথায় আঁচল না থাকায়,সহজেই তা চোখে পড়ে মৃত্তিকার।মুহূর্তেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মায়ের খোপা নিয়ে।খেলতে খেলতে মুখ দিয়ে নানা ধরনের অর্থহীন শব্দ করে।এগুলো যে তার কথা বলার প্রচেষ্টা, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
পানি খেয়ে মহুয়া লম্বা দম নেয়।এ যেন রাগ গিলে নেওয়ার কৌশল।মহুয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নেয় তুষার।মহুয়ার পাশে বসে আশ্বস্তের ভঙ্গিতে বলেঃ” এবার বলো ঘটনা কি।ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ”
—” ইশতিয়াক আবরার!নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে না আপনার?—খুব উত্তেজিত শোনায় মহুয়ার কন্ঠ।
“ইশতিয়াক আবরার” নামটাকে নিজের মনেই দুবার আওড়ে নেয় তুষার।দুবারের বেলায় জ্বিভ থমকে যায়।আবরার! তুষারের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।মহুয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেঃ”তোমার প্রাক্তনের নাম আবরার না?এই কি সে?”
মহুয়া মাথা নাড়ায়।ইশারায় বুঝিয়ে দেয় এটাই সেই মানুষ।
অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তুষার।এরকম একটা ঘটনাকে আসলে কি বলা যায়?কাকতালীয়?
—” আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার।ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে তা কল্পনাও করিনি।”
—” এটাই সেই শয়তান আবরার।ব্যবহার দেখেছেন হারামজাদার?একে দেখে কেউ বলবে,এ একটা প্রতারক?”
মাথা নাড়ায় তুষার।চলনে-বলনে বেশ বিনয়ী আবরার।হঠাৎ করেই একটা কথা মাথায় আসে তুষারের।সে সোজা হয়ে বসে।মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবুকের মতো বলেঃ”এখানে আসার পর আবরারের সাথে তোমার প্রথম কখন দেখা হয়েছিল?”
—” আজ সকালে।ঘুম থেকে উঠেই যখন আমি বারান্দায় গিয়েছিলাম তখন।”
—” ও আচ্ছা,এই জন্যই।”
তুষারের কথা বুঝতে পারে না মহুয়া।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ” কি বলছেন?”
—“একটু আগে আমি যখন বারান্দায় গেলাম,তখন সেই আগে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো।এই ফ্ল্যাটে যে আমি থাকি তা হয়তো জানত না।আমাকে দেখে স্ত্রী-সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলো।তখন তুমিও বারান্দায় গেলে।তাই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।আবার তুমি চলে আসার পর কি বলল,জানো?”
—” কি বলল?”
—” বলে মিত্তির সাথে তোমার চেহারার মিল নেই।আমি তো তখন বুঝিনি। তাই তার ইঙ্গিত ধরতে পারিনি।তোমার বিয়ে হয়েছে কবে এটাই জানতে চেয়েছে বোধহয়।আমাকে তো আর সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবে না।তাই আকার-ইঙ্গিতে জানতে চেয়েছে।”
—” দেখেছেন কত্ত বড় শয়তান!আমার কবে বিয়ে হয়েছে সেটা ওই বেয়াদব জেনে কি করবে?আবার, আমার আর মিত্তির মাঝে মিল খুঁজে!কেন? আমাদের সাথে ওর কি সম্পর্ক? নির্লজ্জ কুকুর একটা।”

মহুয়ার কন্ঠের উত্তেজনা খুব সহজেই চোখে পড়ে তুষারের।আবরারের করা পাপ নিয়ে এখনো এতো উত্তেজিত মহুয়া!এতোদিনেও ভুলে যেতে পারেনি?কথাটা ভেবেও আবার বাদ দিয়ে দেয় তুষার।নিজেকেই নিজে বুঝ দেয়,কেন ভুলবে?ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ?আবরার মহুয়ার জীবনে প্রথম প্রেম ছিল –সেটা তো মহুয়ার কথা থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।বিয়ের আগেই তো এসব বলেছে মহুয়া।এখন বিয়ের পর আবারো আবরারের চোখের সামনে এসে পড়লো ওরা।এ যেন পুরোনো ক্ষতের রক্তক্ষরণ। খুব দরকার ছিল এসব?সৃষ্টিকর্তা আবার কি পরিকল্পনা করেছেন,কে জানে!আরেকবার বিরূপ ভাগ্যের শিকার হতে চায় না তুষার।বউ-বাচ্চা নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চায়।যেরকম শান্তি সবাই চায়।কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব আল্লাহ মালুম।চোখের সামনে প্রাক্তনের সাজানো সংসার দেখে মহুয়াই কি পারবে আবার সুন্দর করে সব শুরু করতে?দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তুষারের।ব্যতিক্রম ভাগ্য বইতে বইতে ক্লান্ত সে।আর ভালো লাগে না এসব।

—” এই মিত্তির বাবা,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার দিকে সচেতন হয়ে তাকায় তুষার।ভালোই লাগে মেয়েটাকে এখন।নিজের ভাবনাগুলো একপাশে ঠেলে দিয়ে,মুচকি হাসে।
—” ভাবছি তোমার কথা।তোমার মতো মহীয়সী নারী বাংলার ঘরে ঘরে দরকার।কি করে পারলে এটা করতে?”
—” কি করলাম আমি!”
—“তখন নিজের প্রথম প্রেমকে কি সুন্দর ভাইয়া ডাকলে।কয়টা মেয়ে পারে বলো তো?তোমার ভিতর দম আছে বলতে হবে।আমার খুব ভালো লাগছে, বুঝলে।যতবারই আবরারকে ভাইয়া ডাকার কথা মনে পড়ছে,ততোবারই খুব শান্তি শান্তি লাগছে।আমার কাছে নোবেল থাকলে, তোমাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দিতাম।”
মহুয়ার পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তুষার।দু-হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা দেয়।উদাস গলায় বলেঃ”দুশ্চিন্তা না থাকলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো, তাই না মহুয়া?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here