ভাবী_যখন_বউ
পর্ব_১২
Syed_Redwan
সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি যে আমি রাইফাকে জড়িয়ে ধরে নেই। তার মানে কি রাইফা গতকালের ঘটনায় মন খারাপ করেছে? খুব খারাপ লাগছে আমার এখন এসব চিন্তা করে। আজ সকালে রাইফার সাথে তেমন কোন কথা হয়নি।
আমি ভার্সিটির পর বিকেলের দিকে পাশের এলাকায় গেলাম একটু একা একা ঘুরতে। যখনই কোন জটিল বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন হয় আমার, আমি একা একা একটু ঘুরে চিন্তা করতে পছন্দ করি, বিশেষ করে এই এলাকাতেই। সেখানে একটা টঙে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ করেই আমার পাশের বেঞ্চে একজন এসে বসলো। আমি তার দিকে ভালোমতো খেয়াল করেই চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি আমি? তাহলে কি আমি খুনীকে পেয়ে গেলাম?
আমি ঠিক যেমনটা অনুমান করেছিলাম ট্রাকচালকের মুখের আদল, ঠিক তেমন চেহারারই একজন আমার পাশে এসে বসলো। কালো কুচকুচে, মুখে দাড়ি-গোঁফ ভরা, সাথে দেখতে গাঞ্জাখোরদের মতো লাগছে। সে ফুলহাতা একটা নোংরা সাদা শার্ট গায়ে দিয়ে রাখায় তার হাতে দাগ আছে কিনা, বুঝতে পারছি না।
এই গরমের মাঝে কীভাবে ফুলহাতা পড়ে আছে লোকটা? তার কি গরম লাগে না? খালি একবারের জন্য হাতাটা একটু উপরে ওঠালেই হয়। দেখি একটু অপেক্ষা করে, কিছু দেখা যায় কিনা।
লোকটা দোকানদারের কাছে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। আমি ওই লোককে টার্গেট করে তার লেভেলেরই কথা বলা শুরু করলাম,
“আজকালকার দিন বড়ই ভালো যাচ্ছে। দেশের আইনকানুন ফাঁকি দিলেও পুলিশ ধরতে পারে না। একটু চেষ্টা করলেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে খুন করেও পালিয়ে যাওয়া যায়, সেখানে সামান্য চুরি করে পগারপার হওয়াটা তো মামুলি ব্যাপার। এটা একদিক দিয়ে ভালোই হলো আমার জন্য। এত কষ্ট কোন ছাগলে করবে হ্যাঁ জীবনে উপরে উঠার জন্য? তার চেয়ে বরং যতদিন সুযোগ পাচ্ছি ততদিন একটু এভাবেই আইন ফাঁকি দিয়ে দুই-চার পয়সা বাড়তি কামাই করলে মন্দ কী?”
আমার কথা শুনে দোকানী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। আমি তার নিয়মিত খদ্দের না হলেও আমাকে মোটামুটি চিনেন তিনি। আমার মতো শিক্ষিত এবং তার জানামতে ভদ্র একটা ছেলের মুখে তিনি কখনোই এমন কথা আশা করতে পারেননি। তিনি বললেন,
“কী কন আপনি ভাই? আপনার মতো এতো শিক্ষিত মানুষ এমন কথা কইতাছে?”
“নয় তো কী। আমি একটা শিক্ষক। আমার পড়ানো ভালো হলে আমাকে প্রোমোশন দিবে। উল্লেখযোগ্য আকারে ভালো হলে হয়তো অন্য ভার্সিটিতে পার্টটাইম লেকচারের জন্য ডাকতে পারে। হয়তো আমার ব্যক্তিগত কিছু ছাত্রও জুটতে পারে। কিন্তু এসব হতে অনেক বছর লাগবে। টাকা ইনকাম করার জন্য এত বছর আমি বেহুদা বসে থাকবো? আমার কি শখ-আহ্লাদ নেই? আছেই যখন, সাথে পরিবার আর বউও আছে, তাই আমি এই দুই নম্বরি করবই। আমার জীবনে টাকা দরকার, টাকা! ভালো মানুষের উপাধি আমাকে ভাত দিবে না, বুঝলেন?”
আমার এহেন কথায় দোকানী মর্মাহত হলেও আমার সন্দেহভাজন লোকটি মনে হয় আমার কথাগুলো শুনে বেশ অনেকটাই খুশি হয়ে গেল। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুখে একটা হাসির রেশ ফুটিয়ে তুলেছে। আমার প্ল্যান মনে হয় কাজ করছে। সে এবার প্রথমবারের মতো মুখ খুললো। দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আরে ভাই, এটা তো ঠিকই আছে। ওতো ভালো মানুষের মতো জীবন পার করার কথা মুখে বলাই মানায়, বুঝলেন? হকিকতে না।”
এইতো! ব্যাটার মুখের বুলি ছুটতে আরম্ভ করেছে। দেখি একে ভুলিয়ে ভালিয়ে আসল সত্যিটা বের করা যায় না কি। আমি আবার বললাম,
“আগে আমিও ভাবতাম যে ভালো মানুষ হওয়াটাই জীবনে বড় কিছু। কিন্তু ইদানীং বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারি যে কতটা ভুল ছিলাম আমি এতদিন। আসলে, বলতে গেলে ভালো মানুষের কোন ভাতই নাই বর্তমান দুনিয়ায়। তাই ভাগ্যিস, সময় থাকতেই আমি এটা বুঝতে পেরেছি। এখন মোটামুটি সৌভাগ্যের বদৌলতে আর নিজের এতদিনের সুপ্ত দুর্বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বেশ ভালোই চলছে আমার জীবন।”
আমার কথায় দোকানী বেচারা একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। সে কোনদিন হয়তো কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি যে আমি এমনটা বলতে পারি। আমাকে বেশ কয়েক বছর ধরেই চিনেন তিনি। এতদিনের ‘আমি’র সাথে যেন আজকের এই মুহূর্তের ‘আমি’র বড্ড অমিল খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। আমার নিজের ব্যক্তিত্ব সাময়িকভাবে ওনার নিকট খারাপ বানানোয় নিজের কাছেই খারাপ লাগলেও সেটাকে আমলে নিলাম না। কিন্তু আমার কথায় ওই সন্দেহভাজন লোকটা আগ্রহ পেয়ে বসলো। বলল,
“যাক তাইলে! আপনার মতো শিক্ষিত ভাইও তাহলে জীবনে সফল হওয়ার পথটা জাইনা গেলেন। খালি আফসোস এইটা যে আপনার মতো সবাই এইটা বুঝতে পারে না। আরে মিয়া জীবনে দুর্নীতি না করলে টাকা আসে নাকি হ্যাঁ? আমি হলপ কইরা কইতে পারমু, আমি নিজে ট্রাকচালক হইলেও আমার কাছে অনেক শিক্ষিত মানুষের চেয়েও বেশি টাকা আছে হ্যাঁ।”
লোকটা ট্রাকচালক? তার মানে অর্ধেক সন্দেহ আমার সত্যি হয়ে গিয়েছে। বাকি অর্ধেক মিলাতে হবে। বললাম,
“হুম ভাই। তবে যত কম মানুষ দুর্নীতি করবে, অবৈধ কাজ করবে, ততই আমাদের মঙ্গল। সবাই একসাথে খারাপ কাজ করা শুরু করলে আবার কোন লাভ হবে না। তাই দোয়া করি অধিকাংশ মানুষ যেন ভালো থাকে, আর মাঝে আমরা একটু আধটু দুই নম্বরি করে আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ করি নিজেদের, কী বলেন?” বলেই একটা চোখ টিপ দিলাম লোকটার পানে তাকিয়ে।
আমার কথায় লোকটা সম্ভবত মজা পেয়েছে, তাই তো এটা শোনামাত্রই একটা বিকট অট্টহাসি দিল। সেটা যে কী বিভৎস লেগেছে আমার কাছে সাথে ওর হাসির শব্দটা যে কতটা বিষাক্ত মনে হয়েছে আমার কাছে, সেটা আমার পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমি আমার আচরণে সেটা বুঝতে দিলাম না তাকে। সে তার হাসি থামলে বলতে লাগল,
“তা ভাই, কেমন দুর্নীতি করছেন জীবনে? শুনি একটু?”
আমি একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“এইতো, কিছুদিন হলো করছি। যেমন ধরেন, ছাত্রদের কাছ থেকে পরীক্ষায় পাশ নম্বর দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে টাকা নেওয়া, ভার্সিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে টাকা মারা আরো আছে আরকি!”
নিজের বিরুদ্ধে এইসব ডাহামিথ্যে বলতে গিয়ে আমার নিজের গলা বিষিয়ে গেল। কিন্তু আর যে কোন উপায় নেই। লোকটা এবার বলল,
“এইগুলা তো কিছুই না ভাই। আমার পঞ্চাশ বছরের জীবনে এর চেয়েও বড় পাপ করছি আমি। আপনারে বিশ্বাস করা যায়, তাই কইতাছি।”
আমার হৃদয় আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে গেল। নিজের কৌতূহল আড়াল করে জিজ্ঞেস করলাম,
“যেমন?”
“কত মানুষ মারছি! সাথে ডাকাতি তো আছেই। এমনকি আমার বউ আমার এমন কাজে প্রতিবাদ করায় তারেও পৃথিবীতে থেইকা খাল্লাস কইরা দিছি। শালির বেটি বেশি সুখে থাইকা পাখনা গজায়া ফেলছিল ঘাড়ে, যে আমারে পুলিশের ডর দেখানি শুরু করছিল। একদিন বেশি বাড়াবাড়ি করায় এক্কেবারে চালায় দিছি রামদা গলা বরাবর!”
এমন নৃশংস পৈশাচিক কথায় শুনে আমার মাথা ঘৃণায় গুলিয়ে গেল। তবুও আমি সেটা অনেক কষ্টে আড়াল করে গেলাম৷ বললাম,
“তারপর?”
“তারপর আর কী বউ মইরা গেল। তাছাড়া বউ মরলে আমার কী যায় আসে? বউয়ের কাজই হইলো শরীরের চাহিদা মেটানো। শরীরের চাহিদা বউ বাদেও অনেক মেয়ে দিয়ে মিটানো যায়। তাছাড়া আমার বউ মুটকি হইয়া গেছিলো। ওর লগে ইয়া কইরা আর তেমন মজা পাইতাম না। তাই ও মইরা ভালাই হইছে, আপদ কমছে।”
“আপনার পরিবারে আর কেউ নাই?”
“একটা পোলা আছিলো। ওর মা’রে ওর চোখের সামনে খুন করার পর ভুলেও আমার সামনে টু শব্দও করতো না। এরপর একটা মাইয়ারে বিয়া কইরা কই জানি গেছেগা। আর খোঁজ নাই কোন হের। কিন্তু এতে আমার কোন আফসোস নাই, আমি আমার মতো বিন্দাস জীবন বাঁচতাছি। টাকার বিনিময়ে কাম করো, মাইয়া লইয়া ফুর্তি করো, মদ গাঞ্জা খাও, জীবনে আর কী লাগে হু?”
এরকম নরপশুতুল্য মানুষও যে পৃথিবীতে বিদ্যমান, এই লোকটাকে না দেখলে আমি হয়তো কোনকালেই বিশ্বাস করতে পারতাম না। আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে ও-ই খুনী আমার ভাইয়া আর ভাবীর। খালি একটু জিজ্ঞাসাবাদ করা বাকি। তাছাড়া সে এখনও কিছুটা হলেও নেশার ঘোরে আছে। তাই অপরিচিত লোকের সামনেও সে মনে হয় না আর কিছু লুকোবে। এমনিতেই অনেককিছুই বলে দিয়েছে সে। আমি বললাম,
“ওও। ভালোই তো। তা, ট্রাক চালানো বাদে আর কী করেন?”
“এইতো, বছরে দুই-তিনটা খুন করি। এতে কইরা যে টাকা পাই, তাতেই ফুরফুরাভাবে বছর চইলা যায়।”
“বাহ! অসাধারণ! তা, সর্বশেষ খুন কবে করলেন?
“এইতো, কিছুদিন আগেই। (জায়গার নাম) জায়গায়। জানেন, এর জন্য বেশ ভালো টাকাই পাইছি আমি। পুরা দুই লাখ টাকা হা হা হা।”
লোকটা নিজের হাতা উঠিয়ে হাত চুলকাতে লাগল। আমি স্পষ্ট সেদিনের দেখা কাটাদাগটা খেয়াল করলাম। ব্যস! দুইয়ে দুইয়ে চার মিলেই গেল অবশেষে। আমার মনের সমস্ত ক্রোধ একসাথে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে, যেটার মধ্যে শামিল মূলত ভাইয়া আর ভাবীকে খুন করার প্রতিশোধ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে তার অতীতের করা বহু খারাপ কাজ করার জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছা। আমি ফাঁকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম একজনকে। একটু পর লোকটা বলল,
“আসি তাইলে। ভালা লাগলো নিজের ক্যাটাগরির একজনের সাথে কথা বলে। আসি।”
লোকটা চা শেষ করে উঠে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলো।
আমি তড়িঘড়ি করে দোকানীকে চায়ের বিলটা দিলাম। দোকানী বেচারা আমার মুখ থেকে এহেন কথাবার্তা শুনে এতক্ষণ স্তব্ধ হয়েই আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। আমি তার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে দ্রুততার সঙ্গে বললাম,
“ওই লোকটা আমার ভাইয়া আর ভাবীর খুনী। তাকে বশে আনার জন্য এতক্ষণ নিজের সম্বন্ধে বহুকষ্টে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আশা করি কিছু মনে করবেন না। আমি পরে আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। এখন আসি।”
আমি দোকানীর উত্তরের অপেক্ষা না করে দৌঁড় দিয়ে খুনীর পিছনে যেতে লাগলাম।
কিছুদূর যাওয়ার পর লোকটা বুঝতে পারলো যে আমি তাকে অনুসরণ করছি। সে আমার দিকে ঘুরে তাকালো।
“কী ব্যাপার, কিছু লাগবে?”
“লাগবে তো অবশ্যই।”
“আমার কাছ থেকে আবার কী লাগবে আপনার? এই মাত্রই তো কথা হলো আমাদের প্রথমবারের মতো।”
“যদি বলি, তোর জীবন লাগবে, তাহলে?!”
আমার কথা শুনে লোকটা বিস্মিত হয়ে গেল। তবে সে বুঝতে পারল যে আমি তাকে হুমকি দিচ্ছি। সে বলল,
“আমার সাথে আপনের কী শত্রুতা থাকবার পারে?”
“আমার ভাইয়া আর ভাবীকে তুই খুন করেছিস। তার সাথে তোর আগের করা খারাপ কাজ তো আছেই। কী ভেবেছিলিস, সারাজীবন পার পেয়ে যাবি এভাবেই? পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। তোকে আজ প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। তোর নরক জীবন শুরু আজ হতেই!” হুংকার দিয়ে কথাটা বললাম আমি।
বলে রাখা ভালো, যেই জায়গাটাতে তার সাথে আমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি, সেই জায়গাটা অনেকটাই নিরব। দুই-চারজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে নিরব দর্শক হিসেবে। এমনটাই হয়। সচরাচর কেউ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো দূর, সামান্য একটা সাহায্যের সময়ও কারো জন্য এগিয়ে আসে না।
লোকটা এবার আচমকাই আমাকে আক্রমণ করে বসলো। লোকটার শরীরে ভালোই জোর আছে বলতে হবে, তবে নেশার ইফেক্ট তখনও কিছুটা বিদ্যমান থাকায় সে নিজের শরীরের শক্তিটাকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলো না। উপরন্তু আমিও খুব শক্তিশালী না হলেও দুর্বল নই, সাথে নিজেকে কোনমতে তেমন কোন মারাত্মক আঘাত পাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে পাশে থাকা একটা পরিত্যক্ত লাঠি কুড়িয়ে লাগিয়ে দিলাম লোকটার মাথায় তিন ঘা। লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। আমি যেই আরেকটা আঘাত করতে যাবো তাকে, ঠিক তখনই কেউ আমার হাত পিছন থেকে ধরে ফেললো।
আমি তাকিয়ে দেখি আরমান ভাই, আমার বেস্টফ্রেন্ড জুনায়েদের বড় ভাই। পুলিশের এসআই বর্তমানে। তার সাথে বন্ধুর মতোই সম্পর্ক আমার। আসলে, চা পান করার সময় আমি জুনায়েদকে আমার লোকেশন ট্র্যাক করে তার ভাইকে আমার সাথে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। আমাকে বললেন তিনি,
“একেবারেই মেরে ফেলবে নাকি, হুম? ছাড়ো।” বলেই আমার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে ফেলে দিলেন।
এরপর ওই খুনীকে নিয়ে গেলেন জেলে।
আমি জুনায়েদ আর আরমান ভাইকে বাধ্য হয়ে আমার-রাইফার এবং ভাইয়া-স্নিগ্ধা ভাবীর মধ্যকার গোপন কথাটা বললাম। সবটা শুনে তারাও ভিষণ অবাক হয়ে যায়। এরপর ওই খুনীটাকে জেলের ভিতর সকল সত্য কথা বের করার জন্য নির্মমভাবে পেটানো হয়। সে স্বীকার করে পুলিশের সামনে যে সে-ই ভাইয়া আর ভাবীকে খুন করেছে পরিকল্পিতভাবে ট্রাপচাপা দিয়ে। সবকিছুই করেছে সে টাকার জন্য। খুন করার জন্য আগেই দুই লক্ষ টাকা পেয়েছিল সে। কিন্তু অনেক মারার পরও সে বলতে পারেনি কে তাকে টাকা দিয়েছিল এই দুটো খুন করার জন্য। সে বলেছে, তাকে মেসেঞ্জারে একজন মহিলা কল দিয়ে বলেছিল এই খুন দুটো করতে। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যায় সময়মতো খুন করার জন্য। তবে খুনের অর্ডার দেওয়া মহিলার কোন পরিচয়ই দিতে পারেনি সে।
সবকিছু শোনার পর একটু আশাহত হলাম, এখনও যে জানতে পারলাম না আমার ভাইয়া আর ভাবীর আরেক খুনী কে। সাথে নিজের মধ্যে প্রচন্ড প্রতিহিংসার আগুন টগবগ করছে। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরমান ভাই বললেন,
“চিন্তা করো না, আমরা আসল অপরাধীকে নিশ্চয়ই ধরতে পারবো। ধৈর্য্য ধরো। আর হ্যাঁ, এই নর্দমার কীটটার(ট্রাকচালক) কুকুরের মতো মৃত্যু আমি নিজেই নিশ্চিত করবো, চিন্তা করো না।”
“ওর মৃত্যুটা আমার নিজের হাতে হলেই ভালো হতো। যাই হোক, আমি নিজের চোখে ওর মরণ দেখতে চাই।”
“তাই হবে। ওকে মারার সময় আমি তোমাকে ডেকে দিবনে।”
আমি বাসায় এসে পড়লাম। আমার অর্ধেক কাজ শেষ। কিন্তু এখনো যে অর্ধেক কাজ রয়ে গিয়েছে বাকি! প্রধান খুনীকে আমি কীভাবে ধরব? পারব কি ধরতে আমি? এসবই ভাবছিলাম রাতে। আমাদের পরিবারে আমি আর রাইফা বাদে কেউ এই বিষয়ে জানে না। সম্পূর্ণ এটার সমাধান না করে আমি আর কাউকে কিছুই জানাবো না।
আজ বাসায় আসার পর থেকেই রাইফাকে বেশ অনেকটাই খুশি খুশি মনে হচ্ছে। এটার কারণ অজানা, জানতেও চাইনি আর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ও বাসায় আসার সাথে সাথেই কীভাবে যেন বুঝে ফেললো যে আমি আজকে মারপিট করেছি ও হাতে-পায়ে সামান্য আঘাত পেয়েছি। আমাকে দ্রুততার সহিত ঔষধ খাইয়ে দেয় এবং আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে মলম লাগিয়ে দিল আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও।
ও যে কীভাবে এসব জানতে পারল, এটাই আমার কাছে এখন পর্যন্ত একটা রহস্যই রয়ে গেল। জিজ্ঞেসও করিনি আর যে ও কীভাবে জেনেছে এটা।
রাতে ঘুমানোর ঠিক আগেই ও আমাকে একগ্লাস পানির সাথে ঔষধ মিশিয়ে বলল খেতে। কিন্তু আমার জানামতে তো আমি খাওয়ার পরপরই পেইনকিলার নিয়ে নিয়েছি। তাহলে এটা কীসের জন্য?
“এটা আবার কী ঔষধ?”
“একটা স্পেশাল পেইনকিলার, সাথে ঘুম আসার টনিক। রাতে ব্যথার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না।”
“আমি তেমন ব্যথাই তো পাইনি। একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না এটা?”
“মোটেও না। আমি আমার হাসবেন্ডের একটুও কষ্ট হতে দিব না, এতে তুমি না করার কেউ হও না। হুহ!”
আমাকে এক প্রকারের জোর করেই সেই গ্লাসের পানিটা পান করিয়ে দিল। কিন্তু সেটার টেস্ট কিছুটা অদ্ভুত মনে হয় আমার কাছে। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকই ধরে নেই।
আমি মোবাইল টিপায় মনোযোগ দিলাম। রাইফা রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ করেই আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। আমি কোনমতে টেবিলের উপর মোবাইলটা রাখার সাথে সাথেই এক লাফে রাইফা এসে আমাকে ধরে ফেলে।
“আমার মাথা ঘুরছে কেন এভাবে। আমি আগেও অনেক মারপিট করেছি, কিন্তু এমন তো হয়নি।”
রাইফা আমার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে বলে,
“কিচ্ছু হবে না। তুমি একটু শান্ত হও। রিল্যাক্স!”
ধীরে ধীরে আমার মাথার সরণ ঘটে নিচের দিকে যেতে থাকে। রাইফা নিজের বুকের সাথে আমার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে। মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝতে পারি যে কী ঘটতে চলেছে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারছি না, বুঝতে পারলাম যে আমি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছি। শেষমেশ নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রাইফার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম।
আমি কোনমতে খাটের এক কোণায় গিয়ে বসলাম মাথায় হাত দিয়ে এই আশায় যে আমি ঠিক হয়ে যাব এখনি। কিন্তু বিধি বাম! আমার মাথা ঘুরানো তো কমছেই না, বরং আমি আগের চেয়েও বেশি করে নিজের শরীরের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি। ঠিক এই সময়ই রাইফা আমার কোলের উপরে এসে বসলো। আমার দু’গালে হাত দিয়ে মুখটা নিজের কাছে টেনে নিল। নিজের কপালের সাথে আমার কপাল ঠেকালো। ওর প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি। ওর মুখ হতে বেরিয়ে আসা গরম নিঃশ্বাস আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওর শরীর থেকে এক অদ্ভুত এবং মনমাতানো সুন্দর ঘ্রাণ আসছে পারফিউমের। আমি এবার ওর দিকে ভালোমতো তাকালাম। একদম পাতলা এবং কিছুটা ট্র্যান্সপারেন্ট নাইটি পড়েছে ও। ওর শরীরের ভাঁজগুলো একদম স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমি। আমার তো ওর দিকে এভাবে এখনই তাকানোর কথা না। তাহলে কেন নিজের বেহায়া চোখজোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না? ও আমাকে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“কী ব্যাপার, হুম? ভয় পাচ্ছ? কোন ভয় নেই। আমিই তো। তোমার বউ। আমার কাছে কীসের ভয় হুম?”
“আমি জানি না আমার সাথে কী হচ্ছে। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। তুমি নিশ্চয়ই ঔষধের সাথে কিছু মিশিয়েছ উল্টাপাল্টা, তাই না?” বলতে গিয়েই আমার গলা ধরে আসছে।
“আমি আবার কী মিশাবো, হুম?(একটা শয়তানি হাসি দিয়ে)। আর যদি মিশিয়েও থাকি, তো বেশ করেছি। আজকে আমি তোমার ভালোবাসা আদায় করেই ছাড়বো। তুমি শুধুই আমার, তোমার ভালোবাসারও একমাত্র দাবিদার চিরকাল আমিই থাকবো।” বলার সাথে সাথেই আড়াআড়িভাবে দু’হাতে আমার মাথার চুল খামচে ধরে আমার ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট দুটো মিলিয়ে দিল। ওকে বাধা দেওয়ার সাধ্য আমার ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। আমার মস্তিষ্ক আমাকে যদিও সামান্য ইশারা করছে এমনটা না করতে, কিন্তু আমার মন এবং বিশেষ করে আমার শরীর রাইফাকে খুব করে কাছে পেতে চাইছে। এক পর্যায়ে গিয়ে আমার মস্তিষ্ক আমার মন আর শরীরের কাছে হেরে গেল। আমি রাইফার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। নিজের অজান্তেই আমার হাত দু’টো রাইফার তুলতুলে নরম কোমরে গিয়ে ঠেকলো। ওর কোমর ধরে টান দিয়ে ওকে আমি নিজের সাথে মিশিয়ে নিলাম। আমার রেসপন্স পেয়ে রাইফা খুশি হয়ে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমাদের মাঝে বিন্দু পরিমাণ ফাঁক আর অবশিষ্ট নেই। নেই আমার নিজেরই নিজের শরীরের প্রতি কোন কন্ট্রোল, রাইফার কথা তো বাদই দিলাম।
আমিও রাইফার ডাকে সাড়া দিতে লাগলাম। আমার নিজেরও এখন খুব করে মনে চাইছে নিজেকে ওর ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিতে। এভাবেই একে অপরকে সর্বাঙ্গে চুমু খেতে খেতে কখন যে দু’জনেই অর্ধ বিবস্ত্র হয়ে গেলাম, খাটে শুয়ে একে অপরকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে ধীরে ধীরে চূড়ান্তভাবে অন্তরঙ্গ হতে লাগল আমাদের দু’জনের দেহ, খেয়ালই নেই।
শেষবারের মতো যখন আমি একেবারেই ক্ষণিকের জন্য নিজের সম্বিত ফিরে পেলাম, তখন আমি রাইফার উপর শুয়ে আছি। আমাদের পরনে অন্তর্বাস ব্যতীত আর কিচ্ছুটি নেই, আর সেটাও দু’জনেরই অর্ধ খোলা অবস্থায়। আমি শেষবারের মতো ওর সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছাকে ক্ষণিকের জন্য বর্জন করতে সক্ষম হয়ে ওর থেকে আলাদা হয়ে কোনমতে সেই অবস্থাতেই রুম থেকে বের হওয়ার জন্য যেই উঠতে নিব, ঠিক তখনই ও আমাকে টেনে আবার ওর উপর ফেলে দেয়। সাথে সাথেই আমাকে আগের চেয়েও শক্ত করে হাত-পা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর চোখেমুখে কামনার আগুন, সাথে ভালোবাসার আহবান। এই মুহূর্তে ওকে দেখতে অপূর্ব লাগছে আমার কাছে, ও আমার কাছে বিশ্বসেরা সুন্দরী। আমি যেন ভুলেই গিয়েছি যে একটা সময় ওকে আমি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করেছিলাম, ভুলেই গেলাম যে ওর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে আমি নিজের সাথেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। হারিয়ে ফেললাম নিজের প্রতি থাকা সর্বশেষ নিয়ন্ত্রণটুকুও।
বদ্ধ রুমটিতে বিছানার ওপর কাঁথায় আবৃত পবিত্র বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানবদেহ একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সরে যায় তাদের মধ্যকার অন্তিম আবরণটুকুও। দু’জন দুজনার শরীরের উষ্ণতা বিনিময় করে, একে অপরের মাঝে ভালোবাসা খোঁজায় মগ্ন হয়। হারিয়ে ফেলে নিজেদের অস্তিত্ব পরস্পরের মধ্যে। পূর্ণতা পায় দু’জনেই ভালোবাসার ঘনিষ্ঠতম মিলনে। পূর্ণতা পায় দু’জনের ‘স্বামী-স্ত্রী’ নামক সম্পর্কটি। পূর্ণতা পায় দু’জনেই একে অপরের গহিনে। মিলিত হয় আমাদের দেহ দু’টো, মিলিত হই আমরা দু’জনেই শ্রেষ্ঠ, পবিত্র এবং ঘনিষ্ঠতম ভালোবাসায়।❤️
চলবে