নীলকণ্ঠ পর্ব_০৮,০৯

নীলকণ্ঠ
পর্ব_০৮,০৯
নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
পর্ব_০৮

অফিসে পৌঁছেই অনেকগুলো ফাইল ঠিক করছিলাম। বেশ অনেকক্ষণ পর কণ্ঠ আসল। ও প্রথমে ওর ডেস্কে গেল। তারপর আমার কাছে এসে বলল,
‘ নীল, আপনি আমার এই ফাইলগুলো চেক করে দেন তো। আমি দেখেছি তারপরেও একটু দেখে দেন। ‘
‘ তুমি দেখলে তাতে কী আর ভুল থাকতে পারে? তবুও তোমার অনুরোধ রাখতে দেখছি। ‘ কিঞ্চিৎ হেসে বললাম কথাটা।
‘ আপনি সবসময় একটু বেশিই বলেন। ‘ ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল কণ্ঠ।
‘ আচ্ছা তুমি রেখে যাও। আমি দেখে তোমায় দিয়ে আসব। কেমন! ‘
‘ জি অবশ্যই। ‘
_____________
বেশ অনেকক্ষণ পর এমডি স্যারের রুমে কণ্ঠকে যেতে দেখলাম। তারপর প্রচুর চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম স্যারের সাথে কণ্ঠের নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে। ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি স্যার কণ্ঠের গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে ওনার হাত ধরে ওনাকে আটকে দিলাম। উনি উত্তেজিত হয়ে হাত ছুড়তে লাগলেন। তারপর অফিসের অন্যান্য স্টাফরাও ছুটে আসেন এই কোলাহলের শব্দে। কণ্ঠ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ও ফোঁসফোঁস করছে। আমি এখানে সময় মত না পৌছালে মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যেত। কিন্তু কী এমন হলো! হঠাৎ এমন রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে কেন? অনেক কৌতূহল মনে চেপে রেখে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছি। তারপর সুযোগ বুঝে কণ্ঠকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আজকের ক্লাইন্ট মিট আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। মুহুর্তের মাঝে অফিসের পরিবেশ পাল্টে গেল। সবাই অবশ্য স্যারকে হাত তোলার অবস্থায় দেখেনি। শুধুমাত্র উত্তেজিত অবস্থায় দেখেছে। তারা ধারণা করছে যে – ‘ কোনো ইমপর্টেন্ট ফাইলে হয়তবা কণ্ঠ ভুল করেছে। তাই স্যার এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ‘
কিন্তু আমার মন বলছে অন্য কিছু। কণ্ঠকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আজকে অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। কণ্ঠ কোনো কথা না বলেই চলে গেল। আমিও আর কিছু বলিনি ওকে।
___________
রাতের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। শিশির বিন্দু জানালার গ্রিলে জমেছে। মনের কোণেও মেঘ জমেছে। হৃদয় উঠোনজুড়ে আজ শুধুই বিষণ্নতা। কোথাও কী শান্তি নেই? কেন জীবনে এত তোলপাড়? জীবন যদি থমকে যেত!
বারান্দায় বসে এই কথাগুলো একমনে ভাবছে কণ্ঠ। কী তার অপরাধ? মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই হয়ত তার জীবনের মস্ত বড় অপরাধ! বুক চিড়ে বেরিয়ে এল একরাশ দীর্ঘশ্বাস। আজকে এমডি স্যার আবারো কণ্ঠকে অপমান করেছে। নীলের সাথে দু-চারটা কথা হেসে বলেছে বলেই কী সে বেহায়া! এতটা নীচ কেন মানুষের মন মানসিকতা? রেগে গিয়ে কণ্ঠও কম কথা শোনায়নি ওই লোকটাকে। পরবর্তীতে মি.শোভন অবশ্য কণ্ঠকে কল করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। প্রতিত্তরে কণ্ঠ ছিল নিশ্চুপ। কালকে কণ্ঠকে শোভন একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলেছে। কণ্ঠ জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর করেছিল। যেহেতু অফিসে চাকরি করতে হবে তাই বসের কথা না শুনে কী কোনো উপায় আছে? রাতে নীল অনেক বার কল করেছিল কণ্ঠকে কিন্তু সে রিসিভ করেনি। তার মনপাড়া যে আজ বিষণ্নতার চাদরে ঢেকে আছে। তাই এই বিষণ্নতার সময়টা একান্তে নিজের সাথেই কাটাতে ভালো লাগে তার।
__________
বর্তমানে,
হঠাৎ করেই হারিয়ে ছিলাম অতীতের পাতায়। ফোনের ভাইব্রেশনে ফিরে এলাম বর্তমানে। স্ক্রিনে ‘ স্যার ‘ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। লোকটা আসলে চায় কী? বলেছি তো তাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। এমন নির্লজ্জ, বেহায়া মানুষ আমি আমার জীবনে দু’টো দেখিনি। কলটা কেটে দিলাম। সময় এখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। আমার জন্ম হয়েছিল বোধহয় কষ্ট পাওয়ার জন্যই। হয়ত মৃত্যুই পারবে আমাকে এসব থেকে মুক্তির পথ খুঁজে দিতে। কিন্তু আমার আম্মুর কী হবে আমি না থাকলে? মানুষটার যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই! ছেলে থেকেও নেই। কলঙ্ক! এমন সন্তান গর্ভের কলঙ্ক। আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা সবসময় করি আমার অবর্তমানে যেন আমার মায়ের কোনো কষ্ট না হয়। অনেক হতাশ আমি আমার জীবন নিয়ে। কত স্বপ্ন ছিল জীবন নিয়ে! অথচ সব স্বপ্নই রয়ে গেল, বাস্তবে রূপ পেল না। না হতে পারলাম কারো ভালোবাসার মানুষ, না হতে পারলাম মা, না হতে পারলাম জীবনে প্রতিষ্ঠিত? কী হল? কেন হলো? সবটাই ধোঁয়াশা, যার নেই কোনো উত্তর। ভাবনা চিন্তারাও আজকাল খাপছাড়া হয়ে গেছে। আজ যদি নীলের মত একজন জীবনসঙ্গীকে পাশে পেতাম! হয়তো তার কাঁধে আমার মাথাটা রেখে সব কষ্টগুলো দুজনায় ভাগ করে নিতাম। হতাশা হয়তো আমায় ছুতে পারত না। কিন্তু সবটাই যে অবাস্তব। চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। কালকে রিজাইন করছি এটাই ফাইনাল। এবারে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। এত জলদি কোনদিন ঘুম আসবে না জানি। তবুও ঘুম ছাড়া কেউ শান্তি দিতে জানে না। ওহ্ নীলকে একটা কল করি। সবটা বলতে হবে ওনাকে। যেই ভাবা সেই কাজ।
‘ হ্যালো কণ্ঠ তুমি ঠিক আছ? দু’দিন যাবৎ কল পিক করছ না কেন? কী হয়েছে তোমার? ‘ কল রিসিভ করেই উদ্বিগ্ন স্বরে কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে শ্বাস নিলেন নীল।
‘ ধীরে ধীরে বলেন। আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আগে একটা কথা বলেন তো আপনি কোথায় এখন? ‘ শান্ত ভাবে কথাগুলো বলল কণ্ঠ।
‘ আমি একটু বাজারে এসেছি। কালকে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে তো। তাই সময় পাবো না। আবার বাসার বাজারও শেষ। ‘ ক্লান্ত স্বরে বলল নীল।
‘ আপনি কাজ শেষ করে আমাকে কল দিয়েন আর শোনেন তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ‘
‘ আচ্ছা রাখি তাহলে। আমি অফিস থেকে এই কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছি। ‘
‘ আমারও মনে হয়েছিল। ‘ এই বলে ফোন কেটে দিল কণ্ঠ। আর কথা বাড়াতে চাইল না সে।
____________
অপরদিকে,
নীল নিজের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করার কাজে মনোযোগ দিয়েছে। কেননা কণ্ঠের সাথে কথা বলার পর তার মন শান্ত হয়েছে। মনের যে অস্থিরতায় সে ভুগছিল তা থেকে যেন খানিকটা মুক্তি সে পেয়েছে।
‘ আচ্ছা এই মাছগুলো কী তাজা? ‘
‘ হ মামা। লইয়া যান এক্কারে ফেরেস মাছ। ‘
‘ আচ্ছা আমাকে এইগুলা দেন। কত টাকা হয়েছে? ‘
‘ সব মিলাইয়া ১৫৭৫টাহা। ‘
‘ আরে বেশি চাচ্ছেন কেন? ‘
‘ ওহন মাছের রেট একটু বেশিই। মাছের আকাল পড়ছে ভাইজান। ‘
‘ আচ্ছা দিয়ে দেন। ‘
মাছ কিনে নীল এগিয়ে গেল সবজির বাজারের দিকে। মাস প্রায় শেষের দিকে। তাই হাতে খুব একটা বেশি টাকা নেই। সেজন্য খুব হিসাব করে খরচ করতে হচ্ছে তার। এবার সবজির বাজারে গিয়ে নীল জিজ্ঞেস করল,
‘ তাজা কিছু সবজি দেন তো। ‘
‘ আইজকা কী নিবা বাবা? ‘
‘ বেগুন, বরবটি, ফুলকপি, টমেটো আর আলু দেন আপাতত। ‘
‘ আইচ্ছা তুমি খাড়াও আব্বা। আমি দিতাছি। ‘
‘ কত টাকা হলো? ‘
‘ সব হাফ কেজি কইরা দিছি। ৩৬৫ টাকা। ‘
‘ হুম দিয়ে দেন। ‘
আজকে আর রিকশায় করে যাওয়া যাবে না। কালকে আবার আম্মুকে নিয়ে বের হতে হবে। হাতে বাড়তি টাকা না থাকলে সমস্যা। তাড়াতাড়ি পৌঁছে কণ্ঠকে একটা কল দিতে হবে। মেয়েটা কী যেন বলতে চাইছিল। এমনি দু’দিন কোনো খবর ছিল না। আজ আবার অফিসেও যায়নি। এমন কী হয়েছিল সেদিন! এসব অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই বাড়ির পথে এগিয়ে চলছে নীল। হাতে তার অনেক বাজার। হেঁটে যেতে কষ্ট হচ্ছে সামান্য। তবে তা গায়ে মাখতে রাজি নয় নীল।
বাড়ি পৌঁছে ডোরবেল বাজিয়ে দিল নীল। তার মা দরজা খুললেন। তিনি বলে উঠলেন চিন্তিত স্বরে,
‘ বাবা আজ এত দেরি করলি যে? ‘
‘ বাজার শেষ হয়ে গেছে তো তাই বাজারে গিয়েছিলাম। ‘
‘ কালকে গেলেই তো পারতি। ‘
‘ ভুলে গেলে? কাল তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ডাক্তারের কাছে। আমি ফিরে এসে তোমায় নিয়ে যাব তো। সময় পাবো না বলেই আজকে কাজ সেরে এলাম। ‘
‘ সব দিকে খেয়াল থাকে তোর। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ‘
‘ কী যে বল তুমি? ‘
‘ যা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। ‘
‘ হুম। তুমি আর নীলা খেয়েছ? ‘
‘ হ্যাঁ খেয়েছি আমরা। এবারে তুইও খেয়ে নে। ‘
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর কণ্ঠকে কল করলাম। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো ফোন।

চলবে

#নীলকণ্ঠ
#পর্ব_০৯
#নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
___________
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর কণ্ঠকে কল করলাম। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো ফোন।
‘ কী করছেন নীল? ‘
‘ এইতো খেয়ে রেস্ট নিচ্ছি। তুমি? ‘
‘ কিছু ফাইল চেক করছিলাম। এখন আপনাকে যা বলতে চেয়েছিলাম তা বলছি। ‘
‘ হুম বল কী হয়েছে? যার দরুন দু’দিন যাবৎ তোমার কোনো খবর ছিল না। ‘
‘ নীল চাকরিটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি। ‘
‘ কীহ্! কিন্তু কেন? ‘ অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে বসল নীল।
‘ অনেক কথাই আপনাকে বলার আছে। আমি বলছি আপনি শুনুন সবটা। ‘
‘ হ্যাঁ বল তাড়াতাড়ি। ‘ কণ্ঠে নীলের তীব্র অস্থিরতা।
‘ অফিসে জয়েনিং শুরু থেকেই এমডি স্যারের চাহনি আমার কাছে অস্বস্তিকর ছিল। তখন তো শুধু তা চাহনিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আজকাল উনি বড্ড বেশি করছেন। আমাকে প্রায়ই উনি কিছু অপ্রীতিকর প্রস্তাব দিতেন। তবুও সবটা মেনে চোখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বাস করেন আমি আর এসব নিতে পারছি না। ‘ এতটুকু বলে থামল কণ্ঠ।
‘ তারপর? ‘ উৎকণ্ঠায় নীল তার শব্দভান্ডার থেকে যেন সব শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। সে তার কোনো কথা মুখ থেকে বের করতে পারল না।
‘ গত পরশুদিন এর কথা মনে আছে আপনার নীল? ‘
‘ হুম। ‘
‘ আমি আপনার সাথে সামান্য হেসে কথা বলেছিলাম, তাও ফাইল চেকের বিষয়ে কথা হয়েছিল আমার। তারপর আমি গিয়েছিলাম এমডি স্যারের কেবিনে। লোকটা আমাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করল। আমার অপরাধ আমি অফিস টাইমে নাকি প্রেম করছি আপনার সাথে। আমি নাকি চরম বেহায়া যার জন্য আমার ডিভোর্স হয়েছে। আমি তার প্রতিবাদ করেছি বলে গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিল পর্যন্ত। ভাগ্যিস আপনি সময় মত এসেছিলেন। ‘ কথাটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল কণ্ঠ।
ওপাশে নীল নিস্তব্ধ হয়ে সব শুনছে। কোনো কথা বলছে না। কণ্ঠ আবার বলতে শুরু করল,
‘ ওইদিন রাতে উনি আমায় মেসেজ করেছিলেন। তাতে যা লিখা ছিল আমি হুবহু বলছি। ” কণ্ঠ আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার ওরকম ব্যবহার করা একদম উচিত হয়নি। আসলে তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি তো। অন্য কারোর সাথে তোমাকে সহ্য করতে পারি না। প্লিজ তুমি কালকে আমার সাথে ফাগুন রেস্টুরেন্টে দেখা করবে। প্লিজ। কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করব না। ” আমিও তার এমন সরল শিকারোক্তি দেখে তার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেই। ‘ কণ্ঠ থামল।
‘ রেস্টুরেন্টে কী হলো কণ্ঠ। ‘ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল নীল।
‘ বলছি। উনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এর আগেও দুবার দিয়েছিলেন। আমি প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ায় উনি বললেন আপনার চাকরি নাকি থাকবে না। আর আমি নাকি আপনাকে ভালোবাসি। ‘
‘ তা তোমার কি জবাব ছিল? বাস নাকি ভালো আমায়? ‘ অতি আগ্রহদীপ্ত হয়ে বলল নীল।
‘ আমার জবাব ছিল আপনি আমার ভালো বন্ধু, আমার কলিগ কিন্তু আমাদের মাঝে এর বাইরে কোনো সম্পর্ক নেই। ‘
‘ ওহ্। দেখা যাক কাল কী হয়? তুমি নিজেকে অপরাধী ভেবো না। আমার চাকরি গেলে যাক। তুমি তোমার স্বাচ্ছন্দ বেছে নাও। ‘ আবেগপূর্ণ হয়ে বলল নীল।
‘ আপনার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে আমার জন্য। কিন্তু এই চাকরিটা ছেড়ে দেয়া ছাড়া যে আর কোনো উপায় দেখছি না আমি। আমায় ক্ষমা করবেন নীল। ‘ কণ্ঠ প্রচণ্ড আফসোস করে কথাগুলো বলল কণ্ঠ।
‘ আহা দেখা যাক না কি হয়। আচ্ছা রাখছি। তুমি ঘুমিয়ে পড় আর প্লিজ টেনশন করো না। ‘ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নীলের সহজ শিকারোক্তি।
‘ হুম। ‘
কলটা কেটে দিল কণ্ঠ। ২৪ মিনিটের দীর্ঘ কথোপকথনের পরিসমাপ্তি ঘটল অবশেষে। কিন্তু দুই প্রান্তে অবস্থিত নীল, কণ্ঠের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। কী ঘটতে পারে আগামীকাল! হয়ত বিষয়টি মেনে নেয়া দুপক্ষের জন্যই কষ্টসাধ্য হবে। নির্ঘুম থেকেই দুজনের রাত কাটল নানান মুখোরোচক চিন্তা ভাবনায়। রাতের শেষ প্রান্তে অবশ্য ক্লান্তির ভারে উভয়ের নেত্রযুগল বন্ধ হয়ে আসে। তারা হারিয়ে যায় ঘুমের ঘোরে।
___________
পরদিন সকালে,
নীল অফিসের উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। তবে তার মনে অজানা আশঙ্কা। আশঙ্কাটা আসলে চাকরি হারানোর নাকি কণ্ঠকে হারানোর? তা ঠিক ঠাওর করতে পারছে না নীল। তবে অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় নীলের মনের ভেতরটায় প্রচণ্ড আনচান করছে। মনে হচ্ছে আজ কোনো ভয়াবহ ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের থমথমে নিরবতায় ছেয়ে গেছে হৃদয় উঠোন। এমন সময় নীলের কানে নীলার ডাক ভেসে এল। সে বেরিয়ে এল নিজের চিন্তার জগৎ থেকে। মনোযোগ দেয় নীলার কথায়।
‘ ভাইয়া আজকে কখন আসবি? ‘
‘ আজকে বিকেল চারটায় বেরোব। আসতে আসতে বিশ মিনিট লাগবে হয়ত। ‘
‘ ওহ্ তাহলে আমি আম্মুকে রেডি করে রাখব। তুই এসে খালি নিয়ে যাস। ‘
‘ নীলা তুই খুব ভালো তা কি তুই জানিস? ‘
‘ ভাইয়া তোর হয়েছে টা কি? ‘
‘ আমি তোকে খুব ভালোবাসি কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারি না। তোর সব চাওয়া পূরণ করতে পারি না। তোর এই অপদার্থ ভাইকে ক্ষমা করিস। আর আম্মুকে সবসময় দেখে রাখিস। ‘
‘ এই তুই এসব বলছিস কেন? আমার ভালো লাগে না। আর বলবি না কখনো। তুই আর মা আমার পৃথিবী। তোদের দেখে রাখব না তো কাকে দেখে রাখব। ‘
হঠাৎ নীলের মা ছুটে আসেন। নীলার চেচামেচি শুনে।
‘ আহ্ ছেলেটা বের হচ্ছে। তা তুই সকালবেলা এমন চিৎকার জুড়ে দিলি কেন? ‘
‘ আরে আম্মু ওকে বুচি বলেছি বলে, ‘ মিষ্টি হেসে বোনকে বাঁচিয়ে দিল নীল।
‘ তুইও পারিস বটে। এখন যা অফিসে। দেরি হয়ে যাবে নয়ত। ‘
‘ আচ্ছা আম্মু তুমি তৈরি থেকো। আমি নিয়ে যাব কিন্তু। আর আম্মু কখনো তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিও। মনে পুষে রেখো না তোমার অভিমান। ‘
‘ না রে বাবা। তুই আমার মনে কখনো আঘাত দিস নাই। তবে তোর বিয়ের কথা বললেই কেমন যেন করিস? ‘ একটু অভিমানভরা কণ্ঠে বললেন নীলের মা।
‘ আচ্ছা আর করবো না। এবার আসি তবে। নয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। ‘
‘ হুম আয় বাবা। ‘
দরজা খুলে বের হতে গিয়ে নীল একটা হোঁচট খেল। তারপর খানিকটা সময় থেমে রইল। কিন্তু নীলের মা এই ঘটনা দেখে অস্থির হয়ে বললেন,
‘ বাবা তুই একটু পরে বের হ। যাওয়ার পথে কেমন বাধা পড়ল। ‘
‘ আহা আম্মু! তুমিও না! একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পা বাড়াতে গিয়ে সামান্য হোঁচট খেয়েছি। তাতেই অস্থির হয়ে পড়লে? ‘
‘ না বাবা আমার মনটা কেমন যেন করছে। কিছু ভালো লাগছে না। বাবা তুই সাবধানে যাস। ‘
‘ আচ্ছা মা। নীলা মায়ের খেয়াল রাখিস। আর কল করলে সময় মতো রিসিভ করিস। ‘
‘ আচ্ছা ভাইয়া। ‘
নীল নিজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। তবে দরজা থেকে বেরিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকালো। তার মায়ের চিন্তিত মুখখানা আর বোনের অস্থিরতায় পূর্ণ মুখাবয়ব একনজরে দেখে নিল। কেন যেন তার মনে হচ্ছে এই বুঝি পরিবারের সাথে তার শেষ দেখা। আর বোধহয় বাড়ি ফেরা হবে না। কিন্তু হঠাৎ এমন অবান্তর চিন্তার কূলকিনারা উদ্ঘাটন করতে অক্ষম হলো নীল।
__________
অপরদিকে,
সকালে বাসার সব কাজ সেরে কণ্ঠ নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র গুছিয়ে রওনা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বের হওয়ার পূর্বে সে তার মাকে দীর্ঘক্ষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিল। তার মনে হচ্ছিল মাকে ছেড়ে দিলে বুঝি সে হারিয়ে যাবে। আজ কণ্ঠের চোখে শুধু সেদিনের সেই দুঃস্বপ্ন ভাসছে। হঠাৎ চারিদিক ধোঁয়াময় হয়ে উঠে, নীল হারিয়ে যায় আর কণ্ঠের শ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হয়। কিন্তু কেন? আজকে এসব মনে পড়ছে কেন হঠাৎ? কী হতে চলেছে তবে নীল আর কণ্ঠের জীবনে? কেন তারা আজ এতটা শঙ্কিত? আছে কী এর কোনো উত্তর?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here