মায়াজাল অন্তিম পর্ব

মায়াজাল
অন্তিম পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা

_________
বেশ কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর দরজা খোলার শব্দ পেলাম আমি। সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠল। রূপকের চেহারার একি হাল! কোথায় হারালো সেই মায়াময় মুখাবয়ব! সেই রূপের জৌলুস কোথায়? সুঠাম দেহ কাঠামো শুকিয়ে আজ জরাজীর্ণ আকার ধারণ করেছে। আমায় দেখে যে বেশ আশ্চর্য হয়েছে তা চোখে-মুখে স্পষ্টাকারে ফুটে উঠেছে। আমি কিছু বলার পূর্বে রূপক নিস্তেজ কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ কেমন আছে আমার রূথি পাখি? ‘

‘ কিছু বলার ভাষা নেই তো আমার রূপক। কেন এমন হলো? কেন তোমার সাথে আমার পথচলা দীর্ঘ হলো না? কেন তুমি আমায় আবার তোমার কথার মায়ায় দুর্বল করে দিলে? আমার ভালোবাসা তুমি কেন বুঝলে না? কেন? ‘ মনের চাপা ক্ষোভ মনেই পুষে রাখল রূথিলা। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিল,

‘ আমি রূথিলা তাবাস্সুম। আর রূথি পাখি বলে আমার স্বামী আমায় ডাকতো, এই নামে ডাকার অধিকার আমি কাউকে দেইনি। কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেয়ার ছিল তাই এসেছি। নিতে দিয়ে কৃতার্থ করবেন। ‘

‘ এটা তো তোমার্র বাড়ি যা দরকার নিয়ে যাও। ‘

‘ ক্ষমা করবেন। আমি কারো বাসায় ঢুকব না। ‘

‘ রুথিলা আজও এভাবে কথা বলবে? আর তো মাত্র কিছুদিনের অতিথি আমি। এবার অন্তত মাফ করে দাও। জানি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছি। তবুও আশা করব তোমার উদারতা। ‘ কাতর কণ্ঠে বলল রূপক।

‘ মমা…মানে? ‘

‘ আমি মরণব্যাধী এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। আমার এইডস হয়েছে। ইতোমধ্যে আমার শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি নষ্ট হতে শুরু করেছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পার করছি। দ্য রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে একটা কথা আছে তো, তারই প্রতিফলন ঘটছে আমার জীবনে। ‘ নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য করে কথাগুলো বলল রূপক।

” এই কথাগুলো শোনার আগেই যদি মরণ হতো আমার! ” খুব আফসোস করে কথাটা ভাবল রূথিলা। বুকে যেন পাথরের বোঝা পড়ে রয়েছে তার। তার ভালোবাসার মানুষটা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে উপনীত হয়েছে এ কঠিন বাক্যের ভার বহন করতে পারছে না রূথিলা। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মানুষটা না হয় তাকে সামান্য ঠকিয়েছে তাই বলে তার এত কঠোর পরিণতিতে কেন ভুগতে হচ্ছে? ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়। রূপক কেন এত কঠিন শাস্তি ভোগ করবে? এসব অনেক কথা ভাবছে রূথিলা। রূপককে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। সব কথা গলায় যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অতি কষ্টে ঢোক গিলে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভেজালো রূথিলা। তারপর বলল,

‘ আমার কাগজপত্রগুলো? ‘

‘ নিয়ে যাও। রূথিলা একটা অনুরোধ রাখবে? জীবনের শেষ কয়টা দিনের জন্য আমায় আবার বিয়ে করবে? আর ঠকাবো না তোমায়। ‘ অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে অনুরোধ করল রূপক।

‘ আমার স্মৃতিগুলোকে স্মরণ করে কাটিয়ে দিও বাকি দিনগুলো। তোমার অনুরোধ আমি রাখতে পারব না। ‘ এই বলে আমি রূপককে পেরিয়ে অন্দরমহলে ঢুকে গেলাম। রূপক ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আমি আমাদের বেডরুমে গিয়ে আলমারি খুললাম। সেখান থেকে আমার কাগজপত্র বের করার সময় একটা ডায়েরি চোখে পরল। এই ডায়েরিটা আমি ওর জন্মদিনে ওকে উপহার দিয়েছিলাম। কিন্তু ও কখনো ডায়েরি লিখত না। কী মনে করে যেন ওটা হাতে নিলাম। তারপর পাতা উল্টোতেই দেখি আমার হাতে লিখা সেই চার বছর আগের চিঠিটা। যেটা আমি আত্মহত্যা করার আগে লিখেছিলাম।

_________
আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা,
কি করিলে বলো পাইব তোমাকে? দিতে পারবে কি কোনো উত্তর। যেই তুমি ছিলে আমার অন্ধকারের আলো সেই তোমার জন্যই আজ আমার জীবন আধারে ছেয়ে গেছে। খুব বিরক্ত করতাম বুঝি তোমায়? আমার ভালোবাসাগুলোকে মিথ্যে মনে হতো বুঝি? সবটার জন্যেই কি আমি দায়ী? দেখো আরজে রূথিলা তাবাস্সুম এর আজ একি দশা! কোনো কথাই গুছিয়ে লিখতে পারছি না। বেহায়া চোখজোড়া জলে ভরে উঠছে। সব ঝাপসা দেখছি, হাত অনবরত কাপছে। অথচ একটা সময় এই আমি আমার কথার জাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতাম। আমার গুছিয়ে বলা কথা সবাই কত ভালোবাসত তাই নাহ্? কিন্তু তোমার জন্য লিখতে গিয়ে ছন্দহারা হয়ে পড়েছি। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এসেছে। এই জানো তোমাকে না আমি খুব ভালোবসতাম এখনোও বাসি। আমি তোমাকে সেদিন খুন করতে চেয়েছিলাম তবে পারি নাই। কেন পারি নাই বলতে পারো? এই রূপ আমার প্রশ্ন কেন শেষ হয় না? চোখের জল কেন শুকায় না? তুই আমাকে ঠকাতে কেন এসেছিলি আমার জীবনে? ভালোই তো ছিলাম। বাপি-মা, মেহুল সবাই ছেড়ে চলে গেল আর তুই থেকেও নেই। তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচব বলতে পারিস? যাহ্ আমিই মরে যাব। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। এই বদ্ধ কারাগারে আমার দমবন্ধ লাগে। জানিস দিশাপু আমায় কত মেরেছে? পুরো শরীরে কত ব্যথা করত তা একমাত্র আমি জানি। আঘাতে আঘাতে শরীর ক্ষতবীক্ষত হয়ে উঠেছিল। আর ভালো লাগে না। আমি বাপি-মা আর মেহুলের কাছে ফিরে যাচ্ছি। শুনে রাখ আমাকে কষ্ট দিয়ে তুই কোনদিন ভালো থাকতে পারবি না। যদি কভু মনে পড়ে স্মৃতিতে হাতরে দেখো। আমি তোমার হৃদয়ে স্থান না পেলেও স্মৃতিতে ঠিকই স্থান পেয়েছি। অনেক সময় নষ্ট করলাম তোমার। ক্ষমা করে দিও। তুইতোকারির মাঝেও কিন্তু ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল। রাগ করো না। আর বিয়ে করলেও কিন্তু ওই বাংলোতে তোমার বউকে রেখো না। ঈশানীকে এনেছো বলে খুন করেছি! ওই মায়াজাল শুধুই আমার আর তোমার। ওখানে আর কারো অধিকার নেই। এই খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ভালো থেকো। তোমার মায়ায় কাউকে জড়ালেও বিশ্বাসঘাতকতা করো না কেমন?
ইতি
রূপের রূথি পাখি (মৃত্যু পথযাত্রী)

_________

চিঠিটা খুব সযত্নে রাখা। তারপরের পাতায় লিখা রোজ পড়ি আর তোমার কষ্ট অনুভব করি। দেখেছ আমার পরিণতি! অসময়ে তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করে আমি এখন সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছি। এ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ একমাত্র মৃত্যুই এনে দিতে পারে। আমি এখন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত।

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমি ডায়েরিটা জায়গা মত রেখে দিলাম। আর পড়তে পারলাম না। আমার রূপকের কষ্ট যে আমার সহ্য হচ্ছে না। চোখ মুছে নিলাম, তারপর পুরো বাড়ি একবার ঘুরে দেখলাম। সবটাই আগের মত আছে শুধু মানুষগুলোই আগের মত নেই। রূপক এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে। এবার আমায় বিদায় নিতে হবে। অনেক তো হলো এবার না হয় ঘুরে দাঁড়াই। রূপকের উদ্দেশ্যে বললাম,

‘ আমি আসছি, তুমি ভালো থেকো। ‘

‘ মারা গেলে দেখে যেও। ‘ নিচু স্বরে বলল।

‘ হুম। ‘ বলে বেরিয়ে এলাম। পিছু ফিরে তাকাতে চাইছিল মনটা কিন্তু সেই সাহস সঞ্চার হলো না। চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছে। এই ছেলে তুই বুঝিস না তোকে আমি আজও ভালোবাসি! তুই আমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে এসব বলিস তাই না! এবার খুশি তো আমি কাঁদছি। হ্যাঁ আমি কাঁদছি। তোর মায়াজালে জঘন্যভাবে জড়িয়ে আমি কাঁদছি। বিচ্ছেদই যদি হবার ছিল তবে কেন হয়েছিল আমাদের প্রেম! সম্পর্কের মায়াজাল ছিন্ন হলেও তার রেশ রয়ে যায় আজীবন।

পৃথিবীর বুকে কেউ কখনো থেমে থাকেনা। না সময়, না মূহুর্ত, না মানুষ, না উড়ন্ত ফানুস। সবকিছুই চলমান, সবকিছুই নিজ-নিজ জায়গা থেকে ক্ষনিকের জন্য পথ হারিয়ে দুঃখ বয়ে আনে। দিনশেষে দুঃখের আধার কাটিয়ে সুখের আলোতে আবার জীবনের গতিপথ ফিরে আসে। কিন্তু, ‘ মানুষ সুখ খুঁজতে গিয়ে সর্বদা দুঃখ বয়ে আনে। ‘

_________
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here