মায়াজাল ১১তম পর্ব,১২তম পর্ব

মায়াজাল
১১তম পর্ব,১২তম পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা
১১তম পর্ব

আজকে ফিরে যাচ্ছি আমার ভালোবাসার দেশে, আমার জন্মভূমিতে, আমার প্রিয়তমের নিকটে। নিউইর্য়কে দীর্ঘ ৫ টি দিন কাটিয়েছি। যদিও কথা ছিল এক সপ্তাহ কাটাতে হবে। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিল বিধায় আমার কাজ অতিদ্রুত শেষ হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের দুদিন আগেই ফিরতে পারছি দেশে। তবে রূপককে কিছুই জানাইনি। ওকে চমকে দিতে চাই। বিমান যাত্রা শুরু করেছে ঘণ্টাখানেক যাবৎ। আমি একটু চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করছি।

‘ রূথিলা আমার খুব মনে পড়ে তোকে। খুব মনে পড়ে। ‘ আকুতির স্বরে কেউ বলল।
‘ মেহুল তুই বেঁচে আছিস? ‘ অতি আশ্চর্যের সাথে প্রশ্ন করল রূথিলা।
‘ আছিতো আমি আজও তোর অন্তরের মাঝে অমলিন। ‘ কথাটা বলেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেহুল।
‘ মেহুল যাস না দাঁড়া। আমায় ক্ষমা করে দিস বোন। ‘

হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে রূথিলা। তারপর নিজের অবস্থান ঠাওর করার চেষ্টা করে সে। পরক্ষণে বুঝতে পারে রূথিলা যে সে স্বপ্নে মেহুলকে কল্পনা করেছে। হঠাৎ করেই তার দৃষ্টিপটে ভেসে উঠে মেহুলের কাটা মাথা উৎসর্গীকৃত মুহূর্তটি। মেহরাব যখন মেহুলের মাথা বস্তা থেকে বের করল তারপর একটা বালতির কিছু পরিমাণ তরলের মাঝে বেশ অনেকটা সময় ডুবিয়ে রেখে বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্র যেন পাঠ করছিল। তারপর সেই মাথাটা পেন্টাগ্রামের মাঝ বরাবর রেখেছিল। পরবর্তীকালে রূথিলা বুঝেছিল উক্ত তরল রাসায়নিক যে ফরমালিন ছিল। ফরমালিন হলো এমন এক রাসায়নিক যা মর্গে মরদেহ সংরক্ষনে ব্যবহৃত হয়। এই ফরমালিন ব্যবহার করেই এতগুলো মেয়ের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংরক্ষন করেছিল মেহরাব। এই দৃশ্য আজও রূথিলার চোখে ভাসে যদিও মাঝে পেরিয়েছে ১২ টি বছর। অথচ এই স্মৃতি কিছুতেই ভোলা সম্ভব হয়নি রূথিলার পক্ষে।

__________
এয়ারপোর্ট এলাকার সব কাজ শেষ করেছে রূথিলা। শরীরে তার প্রচণ্ড ক্লান্তি ভর করেছে। এই ক’টা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। সে তার প্রিয়তমের সংস্পর্শ ছাড়া ঘুমাতে পারে না। রূপকের বুকে মাথা না রাখতে পারলে ঘুম যেন চোখে ধরা দেয় না রূথিলার। বাংলাদেশে সফলভাবে অবতরণের পর ড্রাইভারকে কল করেছিল রূথিলা। সে গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবে।

‘ এখন শুধু অপেক্ষা রূপককে অবাক করে চমকে দেয়ার। আচ্ছা ওর কী অনূভুতি হবে! আমায় এতগুলো দিন পর দেখে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখবে না আমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে ব্যস্ত থাকবে? ‘ আনমনে এই কথাগুলো ভাবছিল রূথিলা আর ঠোঁটের কোণে ঝুলছিল স্নিগ্ধ হাসি।

__________
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে বেশ খানিকটা পূর্বে। আরো মিনিট ৪৫ লাগবে রূপক আর রূথিলার ভালোবাসার বাংলোতে পৌছতে। বাংলোর নাম ” মায়াজাল ” নামটা নির্বাচনে রূথিলা বেশ সৌখিনতার পরিচয় দিয়েছে। রূপকের ভালোবাসার মায়াজালে জড়িয়ে গিয়েছে সে। তাই তাদের ভালোবাসার কুটিরের নামটাই হোক মায়াজাল। এমনই এক দুর্দান্ত ভাবনা থেকে বাংলোটার নাম নির্ধারণ করেছিল রূথিলা। রূপকেরও অবশ্য নামটা বেশ পছন্দ হয় তাই সেও কোনো আপত্তি করেনি।
গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে রাখা। ঠান্ডা বাতাস এসে রূথিলার চোখ, মুখ আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে। সে হারিয়ে যাচ্ছে অতলস্পর্শের গভীরতায়, চোখে ভেসে উঠছে রূপকের মায়াময়, মোহনীয় মুখাবয়ব। রূথিলা কিছু একটা ভেবে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ মামা একটা গান বাজিয়ে দেন তো। একটু শুনি। ‘
‘ আম্মা কোন গান হুনবেন? ‘ মুক্তোর মত চকচকে দাঁতগুলো বের করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ড্রাইভার শিহাব মিয়া।
‘ আজকে আমি আপনার পছন্দের গান শুনতে চাই। যেটা ইচ্ছে বাজিয়ে দিন। ‘
‘ আইচ্ছা আম্মা। আপনি অপেক্ষা করেন, ‘ এই সামান্য কথা বলাতেই উনার চোখে মুখে যেন আনন্দের বন্যা বইছে।

রূথিলা অবাক মনে ভাবছে, এই মানুষগুলোর চাওয়া খুব সামান্য। কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। সামান্য হেসে, ভালো করে কথা বললে তাদের যেন খুশির সীমা থাকে না। মামা আমাকে তার নিজের মেয়ের মত মনে করেন। একটা গান শুনে ধ্যান ভাঙল। গাড়িতে এখন বাজছে ” জলে ভাসা পদ্ম আমি ” এই গানটা অসম্ভব সুন্দর গান। তবে অবাক লাগছে, এই গানটা মামার পছন্দ! মামা কী কারোর বিরহে কষ্টে আছে? হতেই পারে, জীবনটা তো এমনই। ভাবনা শেষ হতেই রূথিলা ড্রাইভারকে বলল,

‘ মামা আপনি আমায় এখানেই নামিয়ে দিন। সামনে আর যেতে হবে না। আপনি বরং গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে রেখে আসেন। ‘
‘ আম্মা আপনের কষ্ট হইব। এত দূর থেইক্কা আইসেন…. ‘ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে কথাগুলো বলছিলেন শিহাব মিয়া। তবে রূথিলা আর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই বলে উঠল,

‘ আহা মামা! এত ভাবতে নেই। বাসায় এসে গেছি তো। আপনি এত চিন্তা করবেন না। ‘
‘ আইচ্ছা আম্মা। কোনো কিছু লাইগলে আমারে ডাইক্কেন। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘

___________
রাস্তায় নেমে পড়লাম। মাত্র দু’মিনিট হাঁটলেই বাংলোর সদর দরজা। সদর দরজা খোলাই ছিল। সময়টা এখন ভর দুপুর। সূর্য একদম মাথার উপরে থেকে প্রখর কিরণ দিচ্ছে। অন্দরমহলে ঢুকলাম অতিরিক্ত চাবি দিয়ে, তবে সু-কেবিনেটে জুতা রাখার সময় একজোড়া জুতা দেখে কপাল কুঁচকে এলো আমার। একটা হাই-হিল রয়েছে, আমার গোড়ালিতে সমস্যার কারণে কখনই এধরনের জুতা পড়া হয় না। তাহলে আমার বাসায় মেয়ে মানুষের জুতা আসবে কোথা থেকে? রূপক কাউকে নিয়ে এসেছে কি? কিন্তু আমার অবর্তমানেই কেন আনতে হবে? নাহ্ এসব আমি কী ভাবছি? হয়ত ওর কোনো অফিস কলিগ এসেছে, কলিগই হবে। অনেক ধরনের প্রশ্নে মনের ভেতরটা জর্জরিত হয়ে পড়েছে। মনটা কেমন যেন অস্থির লাগছে। তাই আর বিলম্ব না করে বেডরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দিতে হবে। কিন্তু রুমে ঢুকে যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম, তার জন্য আমি মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার পায়ের তলাটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল, নিজের ভারসাম্য যেন হারিয়ে ফেললাম। ক্ষিপ্ত হয়ে রুমে থাকা ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,

‘ এখানে এসব কী চলছে? ‘

আমার এই প্রশ্ন শুনে রুমে থাকা মানব-মানবী চমকে উঠল। নিজেদের এমন অপ্রস্তুত অবস্থা হয়ত তারা কল্পনাও করতে পারেনি। আরো কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও বেরুল না। সারাটা শরীর রাগে কাঁপছে। অনেক কষ্টে বললাম,

‘ আমার প্রশ্নের উত্তর কোথায়? ‘

এবারও নিশ্চুপ। কোনো সাড়া নেই। বেডরুম প্রস্থান করে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। একটা চাপাতি তুলে নিলাম হাতে। এরপর আমার স্টাডিরুমে গেলাম এবং একটি কেবিনেট থেকে ক্লোরোফর্ম নিলাম প্যান্টের পকেটে। তারপর একপ্রকার দৌঁড়ে এলাম বেডরুমে। তেড়ে গেলাম সেই নগ্ন মানবীর উদ্দেশ্যে। ইতোমধ্যে সে চাদর পেঁচিয়ে তার নগ্ন শরীর আবৃত করার চেষ্টা করছে। ডান হাতের চাপাতি দিয়ে তাকে আঘাত করতে যাব তার পূর্বে কেউ আমায় শক্ত করে টেনে ধরল। মানুষটা আর কেউ নয় আমার স্বামী রূপক। রাগের বশবর্তী হয়ে ছোটাছুটির চেষ্টা করলাম। ফলশ্রুতিতে চাপাতির আঘাতে তার হাত কেটে গেল। সুকৌশলে আমি ঐ নারীর উদ্দেশ্যে হাতে থাকা চাপাতি ছুড়ে মারলাম। খুব একটা জোরে লাগেনি তবে পা কেটেছে। সে চাপা আর্তনাদ করে উঠল। রূপক উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ ঈশানীকে কেন মারলে রূথিলা? ‘
‘ ওই বে*র জন্য তোর এত দরদ? বেশ করেছি। তুই ছাড় আমাকে। তোর স্পর্শে আমার ঘেণ্না হচ্ছে। ছাড় তুই। ‘ উত্তেজিত হয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কনুই দিয়ে সজোরে রূপকের তলপেটে আঘাত করল রূথিলা।

ফলশ্রুতিতে রূপকের হাত ফসকে যায়। রূথিলা ছাড়া পেয়ে দ্রুত পায়ে বিছানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায় ও ঈশানীর উদ্দেশ্যে বিশ্রী কতগুলো গালি ছুড়ে দেয়। তারপর আবার হাতে চাপাতি তুলে নেয়। রূপক এগিয়ে আসতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে থেমে যায়। কারণ রূথিলার মাথা ঠিক নেই সে যেকোন কিছু ঘটাতে পারে। তবে রূপক কিছু একটা ভেবে নিজের ফোনের ক্যামেরা অন করল এবং ভিডিও করতে শুরু করল তবে তা রূথিলার অগোচরেই। রূপক আবার রূথিলার দিকে এগুতে উদ্যত হয়। আর তা লক্ষ্য করে রূথিলা চিৎকার করে বলে উঠল,

‘ কসম রূপক তুই যদি আর এক পা বাড়িয়েছিস তাহলে আমি কিন্তু খুন করে ফেলব তোকে। এতে আমার হাত একফোঁটাও কাঁপবে না। নিরব আর মেহরাবের চেয়েও নিকৃষ্ট দশা তোর হবে। ‘ কথাগুলো বুকে পাথর চেপে বলল সে। আসলেই কি হাত কাঁপবে না!

‘ মানে? ‘ চরম অবাক হয়ে বলল রূপক। আর ওদিকে ঈশানী পালানোর পথ খুঁজছে। যেই মাটিতে পা বাড়াল ওমনি রূথিলা একটা কোপ বসিয়ে দিল। আর্তনাদ করে বিছানায় লুটিয়ে দেহত্যাগ করল ঈশানী। রূপক হতভম্ব হয়ে পুরো বিষয়টি প্রত্যক্ষ করল। তারপর রূথিলা তার অতীত জীবনের কালো অধ্যায়ের বর্ণনা করল রূপকের কাছে। রূপক নিস্তব্ধ হয়ে সবটাই শুনল তবে কিছু বলল না। তারপর রূথিলা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল,

‘ দেখেছ জীবন কতটা নিষ্ঠুর? ভেবেছিলাম হঠাৎ এসে চমকে দেব তোমাকে অথচ নিজেই চমকে গেছি। একটা কাজ কর, তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও নয়তো দেখবে আমি তোমাকেও মেরে ফেলব। আমি তোমাকে বিয়ের আগেই বলেছি আমায় ঠকালে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবুও তুমি শুনলে না! সেই আমার বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিলে? কেন রূপ কেন? আমি তো তোমায় ভালোবেসেছিলাম। কেন? ‘
রূথিলার হাত থেকে রক্তমাখা চাপাতিটা মাটিতে বিকট শব্দ তুলে আছড়ে পড়ল। আর রূথিলা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। এই কান্না দেখে রূপকের বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা অনূভুত হচ্ছে। কিছু বলতে চাইল রূপক তবে বলল না। তারপর বাংলো থেকে বেরিয়ে গেল।

__________
কারাকক্ষ জুড়ে দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল। সাগ্রতের চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। এই বুঝি একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আর দিশা সে তো কেঁদে কেঁদে সাগর, নদী সব বানিয়ে ফেলল। কী নির্মম পরিণতি! আর নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে রূথিলা। কাঁদতে কাঁদতে চোখের অশ্রু আজ শুকিয়ে গিয়েছে। বেরিয়ে রূপক কোথায় গিয়েছিল ভাবছেন তো? থানায় এসেছিল রূপক মামলা করতে। আর তারপর স্বামীর করা মামলায় গ্রেফতার হয় রূথিলা। প্রায় বছর খানেক পেরিয়েছে রূথিলার কারাভোগের। জীবনে বেঁচে থাকার সব আশা হারিয়ে গেছে তার। কিসের আশায় বাঁচবে সে? উত্তর রূথিলার অজানা। সাগ্রতের উদ্দেশ্যে রূথিলা একটি ভয়ানক বাক্য ছুড়ে দিল,

‘ বলতে পারেন আমার ফাঁসি হচ্ছে না কেন? ‘
‘ আপনার অপরাধগুলো ফাঁসির শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত নয়। ‘ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল সাগ্রত।
‘ ওহ্। তবে আমার কী হবে? ‘ হতাশ ভঙ্গিমায় বলল রূথিলা।
‘ হয়ত কয়েক বছরের কারাদণ্ড। বিজ্ঞ আদালত ভালো জানেন। ‘
‘ একটা উপকার করতে পারবেন? ‘ অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল রূথিলা।
‘ বলেন কী? ‘
‘ আমি একটা চিঠি লিখতে চাই, এটা একজনকে পাঠিয়ে দেবেন ব্যস। ‘
‘ ভেবে দেখছি। ‘

চলবে

মায়াজাল
১২তম পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা

হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছটফট করছে রূথিলা। অপেক্ষা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার। আকাশে ভীষণ মেঘ জমেছে। যেকোন সময় বৃষ্টির ফোঁটা আকারে ঝরে পরবে। আচ্ছা রূথিলার কষ্ট অনুধাবন করতেই কী প্রকৃতি এমন বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে? হাসপাতালের করিডোরে অফিসার সাগ্রত আর রূপক অপেক্ষা করছে। ডাক্তার অনেকক্ষণ যাবৎ অপারেশন থিয়েটারে রয়েছেন। রূপক অস্থিরতায়, অপরাধবোধে ছটফট করছে। অফিসার সাগ্রত শান্ত দৃষ্টিতে সবটা পর্যবেক্ষণ করছেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

‘ আপনার তো খুশি হবার কথা? তবে আপনি কেন এতটা অস্থির হচ্ছেন?
‘ এই এক বছরে আমি অনেকটাই পাল্টে গেছি অফিসার সাগ্রত, ‘ অপরাধীর মত ক্ষীণ সুরে বলল রূপক।

বেশ অনেকটা সময় জুড়ে চলে নিরবতা। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। তবে রূপক একটা বিষয় ভেবে খুব অবাক হচ্ছে সাগ্রত যেন রূথিলার ব্যাপারে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন! আইনত রূথিলা এখনো রূপকের স্ত্রী তাই তার ব্যাপারে অন্য কারো এত ভাবনা রূপকের সহ্য হচ্ছে না, ভালো লাগছে না। অন্তর্দহনের প্রখরতায় রূপকের হৃদয় যেন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই রূপক আর সাগ্রত ছুটে গেল। সাগ্রতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রূপক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ ডক্টর আমার ওয়াইফ কেমন আছে? ‘
‘ উনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন। হাতের রগ অনেকটা কেটে ফেলেছেন, যার ফলে ওনার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাছাড়া ওনার রক্তের গ্রুপ অনেক রেয়ার। এবি নেগেটিভ , এর রক্ত আর মাত্র দু’ব্যাগ আছে আমাদের হাসপাতালে। আপনারা দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করে রাখুন। যেকোনো সময় প্রয়োজন হতে পারে। আর উনি মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিধ্বস্ত ছিলেন। উনি নিজে থেকেই সুস্থ হতে চাইছেন না। ৪৮ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। আপনারা আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। ‘ কথাগুলো বলেই ডাক্তার উক্ত স্থান ত্যাগ করলেন।

রূপকের কাছে ডাক্তারের বলা কথাগুলো যেন বজ্রাঘাতের মত। সাগ্রত সব আশা ছেড়ে দিল। এই মাঝরাতে কীভাবে যোগাড় হবে এবি নেগেটিভ রক্ত। ডোনার পাওয়া যাবে কোথায়? আবারো হাসপাতালের করিডোরে পিনপতন নিরবতা। শুধুই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শ্রোতাদের কর্ণগোচর হচ্ছে।

__________
অতীত,

রূথিলাকে তার ইচ্ছেনুযায়ী চিঠি লিখতে দেয়ার জন্য এক টুকরো কাগজ ও একটি কলম দেয়া হয়। রূথিলা তার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রাপকের উদ্দেশ্যে নিজের মনে জমে থাকা শেষ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করে। তারপর লিখা শেষ হতেই সে আনমনে হাসতে থাকে। এ হাসি কিন্তু কোনো সুখের স্মৃতি স্মরণ করে নয় বরং দুঃখকে আলিঙ্গন করে নেয়ার জন্য। তারপর রূথিলা গুণগুণিয়ে গাইতে থাকে,

দিশাহীন চোখে খুঁজে যায়,
শুধু খুঁজে যায়, কি আশায়
এ শহর বড় অচেনা
কেউ বোঝেনা, তাকে হায়।

জেগে থাকে মন চেনা নামে তার
জেগে থাকে মন চেনা নামে তার,
কেন আর ডাকে না আমায়।

দিশাহীন চোখে খুঁজে যায়,
শুধু খুঁজে যায়, কি আশায়
এ শহর বড় অচেনা
কেউ বোঝেনা, তাকে হায়।

লাগে না, ভালো লাগে না
মায়াহীন এ পৃথিবী আর,
যেতে চায়, মন পেতে চায়
স্নেহ ভরা সে পরশ আবার।

দিশাহীন চোখে খুঁজে যায়,
শুধু খুঁজে যায়, কি আশায়
এ শহর বড় অচেনা
কেউ বোঝেনা, তাকে হায়।

একা প্রাণ, তবু খুঁজ়ে যায়
কোথা হারিয়ে গেছে মান,
ভেজা চোখ, ধরে রাখে আজ
শুধু অবুঝ বোবা কান্না।

দিশাহীন চোখে খুঁজে যায়,
শুধু খুঁজে যায়, কি আশায়
এ শহর বড় অচেনা
কেউ বোঝেনা, তাকে হায়।

জেগে থাকে মন চেনা নামে তার
জেগে থাকে মন চেনা নামে তার,
কেন আর ডাকে না আমায়।

গান শেষ করে চোখ মেলতেই চোখের কোণা গরম দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অশ্রু কপোল গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই রূথিলা তা মুছে ফেলে। তারপর রূথিলার কানে আরো একটি মেয়েলি কান্নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে থাকে। কান্নার উৎসের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সে দেখল দিশা মুখ চেপে ধরে অশ্রু ঠেকানোর অহেতুক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রূথিলা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় দিশার এহেন আচরণে। দিশার উদ্দেশ্যে রূথিলা নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল,

‘ আপনি কিন্তু পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে অপমান করছেন! একজন অপরাধীর জন্য কেউ এভাবে কাঁদে? তাও এই অপরাধী তিনটি খুনের আসামী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাতটি খুন করেছে। ‘
‘ আপনার জীবনটাই কেন এমন হলো। আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। ‘ অশ্রুসজল নয়নে বলল দিশা।
‘ আমায় শেষ একটা উপকার করবেন? ‘ রূথিলার কণ্ঠে প্রবল আকুতি।
‘ এভাবে কেন বলছেন? বলেন কী করতে পারি? ‘
‘ এই চিঠিটা সাগ্রত স্যারের হাতে দেবেন। আর প্লিজ লিখে রাখা ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। মনে করেন এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। ‘ কঠোর কণ্ঠে এই ভয়ানক কথাগুলো রূথিলা উচ্চারণ করল।
‘ ঠিক আছে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল। ‘ দিশার সরল জবাব।
‘ বলেন কী জানতে চান? ‘ মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বলল রূথিলা।
‘ এই ঠিকানাটা তো মায়াজালের মানে আপনাদের বাসার। তাই না? ‘
‘ হুম। ‘
‘ আপনি রূপক সাহেবকে চিঠিটা পাঠাতে চাইছেন? ‘
‘ হ্যাঁ, ‘ কিঞ্চিৎ হেসে বলল রূথিলা।
‘ কিন্তু কেন? ‘ প্রশ্নটা গম্ভীর কণ্ঠে করল দিশা।
‘ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আজ আমরা আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী পালন করতাম। এটাই রূপককে স্মরণ করাতে চাইছি। ‘ রূথিলার কণ্ঠে মলিনতা।

‘ যেই মানুষটা এই এক বছরে আপনাকে একটি বার দেখতে আসল না অথচ তার কথা ভেবে আপনি প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পাচ্ছেন! যেই লোকটা তার প্রেমিকার জন্য বিবাহিত স্ত্রীকে জেলে পাঠাতে পিছু হটল না, তার কাছে এখনো আপনি কিছু প্রত্যাশা করেন। জীবনটা আপনার সাথে শুধুই ছলনা করল। ‘ কথাগুলো মনের মাঝেই রাখল দিশা। আর কথা বাড়ালো না।

দিশা কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই রূথিলা হাতে ব্লেড তুলে নিল। অনেক কষ্ট হচ্ছিলো তার। বারবার চোখের সামনে রূপক আর ঈশানীর সেই অপ্রীতিকর মুহূর্ত ভেসে উঠছিলো। সেই ঐ ঘটনা না ঘটলে আজ হয়ত তারা একসাথে নিজেদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী উৎযাপন করত। কিন্তু সবটাই নিয়তি! রূথিলার শেষবারের মত রূপকের মায়াময় মুখাবয়ব স্মরণ করে নিল। নিজের বাবা-মা আর মেহুলের পর রূথিলার জীবনে রূপকই ছিল একমাত্র ব্যক্তি যাকে সে মন উজাড় করে ভালোবেসেছিল। যার মায়াজালে নিজেকে আবদ্ধ করেছিল। রূথিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর চোখ বন্ধ করে হাতের রগের উপর ব্লেড দিয়ে বারংবার আঘাত করল। একসময় সেই অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রণা সইতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত বেয়ে টপটপ শব্দে রক্তের ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগল। এই রক্তের ফোঁটাগুলো দেখে শত যন্ত্রণার মাঝেও রূথিলার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আস্তে আস্তে রূথিলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসল, তবে চোখ বন্ধ হওয়ার রূপকের মুখটা আবারও চোখে ভেসে উঠলো। রূথিলা মনে মনে শেষবারের মত ভাবল, ‘ রূপক দেখ আমি চলে যাচ্ছি। আমাদের ভালোবাসার সব মায়াজাল ছিন্ন করে পারি জমাচ্ছি পরপারে। একটু ভুল হয়ে গেল আমাদের নয়, আমার একপাক্ষিক ভালোবাসা ছিল। তুমি ভালো থেকো। যদি কখনও মনে পড়ে, স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও। তোমার সাথে পথচলার সৌভাগ্য আমার আর হবে না। ‘ আর কিছুই ভাবার ফুরসত পেল না রূথিলা। চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার।

__________
চিঠিটা পাঠানো হয়েছে এই খবরটি দিতে দিশা রূথিলার কাছে এসেছিল। কিন্তু এসে যা দেখল তাতে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। রূথিলার রক্তে মেঝে রঞ্জিত হয়ে রয়েছে। সারা মেঝেজুড়ে রক্ত। রূথিলার হাত থেকে এখনো রক্তের ফোঁটা মেঝেতে পরছে। কে জানে কতক্ষণ যাবৎ এই অবস্থায় পড়ে রয়েছে রূথিলা। তাই আর বিলম্ব না করে চিৎকার করে ডাকল সাগ্রতকে। সাগ্রত দিশার চিৎকার শুনে ছুটে এল। কিন্তু এসে যা দেখল তাতে তার বুকের ভেতর সুপ্ত ব্যাথা অনুভূত হলো। এটা শুধুমাত্র মানবতাবোধের জন্য না অন্য কোনো লুকানো অনুভূতি। তবে এখন এসব ভাববার মত সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই নেই। রূথিলাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। সাগ্রত দিশাকে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘ এসব কী করে হলো? ‘
‘ স্যার আমি কিছু জানিনা। তবে ব্লেড দিয়ে হাত কেটেছেন তিনি। ‘
‘ আচ্ছা অ্যাম্বুলেন্স কল কর দিশা কুইক। রূথিলাকে হসপিটালে নিতে হবে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ‘

___________
বেলা ডুবে গেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রূথিলাকে স্বনামধন্য মেডিকেলে এডমিট করা হয়েছে। রূপককে খবর পাঠানোর পূর্বেই সে রূথিলার চিঠি পেয়ে ছুটে এসেছিল থানায়। তবে থানায় এসে যা শুনল তাতে রূপকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। যেহেতু রূথিলার বিশেষ অনুরোধ ছিল তাই সাগ্রত ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রূপকের নিকট চিঠিটা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেয়। চিঠিটা হাতে পেয়ে রূপক বেশ অবাক হয়েছিল। তারপর চিঠিটি পড়েই থানায় আসে অতঃপর হাসপাতালে।

__________
ভোরের আলো ফুটেছে। সেই স্নিগ্ধ আলো হাসপাতালের কেবিনের জানালা পেরিয়ে এসে দিশার চোখ-মুখ ছুয়ে দিচ্ছে। কাল রাতে প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দিশা নিজের ডিউটি শেষ করে ছুটে এসেছিল রূথিলাকে দেখতে। তারপর এসে জানতে পারে রূথিলার রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ, যা কিনা পাওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু দিশার রক্তের গ্রুপ রূথিলার সাথে মিলে যায় তাই সে কালক্ষেপণ না করে রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়। এরপর যদিও দিশা বাসায় ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু সাগ্রত তাকে আটকে দেয়। রূপক চুপচাপ থেকে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছিল। আর রূথিলার অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত তবে সে শঙ্কামুক্ত নয়। আজকে রূথিলার আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা ছিল। আজকে হয়ত তার শাস্তির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। তবে শুনানি হবে কিন্তু রূথিলার অনুপস্থিতিতে। দিশা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। তার চোখের ক্লান্তি এখনো কাটেনি। তবে রূথিলার শুকনো মুখটা, যন্ত্রণায় ছটফট করা মুহূর্তের কথা স্মরণ হতেই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় বয়ে যায়।

_________
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here