এই তুমিটা আমার❤,পর্ব:০২
মাহিয়া_মেরিন
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হাসপাতালের কোলাহল পরিবেশটাও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। বাবার পাশে বসে জানালা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ উপভোগ করছি। সকালের সেই ভ্যাপসা গরমটা কমে এখন হালকা শীতল বাতাস চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশেও মেঘ জমে আছে,,হয়তো বৃষ্টি হবে। দিনশেষে ব্যাস্ত মানুষের মতো পাখিরাও দল বেঁধে তাদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
হাতের উপর কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দেখি বাবা আমার দিকে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার জ্ঞান ফিরতে দেখে ভাইয়া আর ভাবিও এসে বাবার পাশে বসলো।
–বাবা,,,এখন কেমন আছো তুমি? (মেঘ)
–আমি ভালো আছি বাবা।(আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে) তুই ঠিক আছিস তো মা??
–((বাবার কথা শুনে অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল)) আমি একদম ঠিক আছি বাবা।
–মেঘ,,,ডাক্তারকে গিয়ে বলো বাবার জ্ঞান ফিরেছে।(ভাবি)
–ওহ হ্যা! আমি যাচ্ছি।(মেঘ)
ভাইয়া চলে যেতেই বাবা আমার হাতের উপর তার হাতটা রেখে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো…
–আমার স্কুটিটা আরো সাবধানে চালানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না।
–এভাবে বলো না বাবা। এখানে তোমার কোন দোষ নেই। যা হয়েছে সেটা একটা এক্সিডেন্ট।
–তোর এ কি অবস্থা হয়েছে!! নিশ্চয়ই আমার চিন্তায় নিজের কথাই ভুলে গিয়েছিলি,,তাই না মা?? (বাবা)
–বাবা,,তুমি তো জানোই মিহু কেমন। তবুও তুমি চিন্তা করো না। আমরা আছি তো মিহুকে দেখে রাখার জন্য।।(ভাবি)
এরমধ্যে ভাইয়া ডাক্তারকে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। ডাক্তার সাহেব এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন..
–এখন কেমন আছেন আপনি??
এতোক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলেও কণ্ঠটা শুনেই পাশে ফিরে দেখি শুভ্র!!
বাবার সাথে টুকটাক কথা বলছে আর বাবার চেকআপ করছে। আমি একদৃষ্টিতে তার সব কার্যকলাপ দেখছি।
–আমার মেয়েটাকেও একটু দেখো তো বাবা। আমার জন্য চিন্তা করে নিজের কি অবস্থা করেছে দেখো।(বাবা)
–((হালকা হেসে)) চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো,,,উনার খেয়াল রাখবো।(শুভ্র)
শুভ্রর কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।
শুভ্র আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার চেকআপ করছেন। এদিকে আমি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছি,,,,আর বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। উনাকে দেখলেই এমন কেনো হচ্ছে আমার?? এমন তো না যে উনি খুব আহামরি সুদর্শন,,,,খুব সাধারণ একটা ছেলে। তবুও কেনো উনাকে দেখলে মনের ভিতর এক অজানা অনুভূতি এসে উঁকি দেয়??
–মাথার ব্যান্ডেজটা চেঞ্জ করতে হবে। আমি নার্সকে বলে দিবো। সময়মতো ঔষধ খাবেন। বাবার পাশাপাশি নিজেরও যত্ন নিবেন। ঠিক আছে?? (শুভ্র)
আমি এক ঘোরের মাঝেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালাম। শুভ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো। ঠিক চলে গেল বললে ভুল হবে,,,তার ওই মুচকি হাসি দিয়ে আমার বুকের ভেতরটা ঘায়েল করে গেলো।
🍁রাতে…
–মিহু,,,তুই হিমিকার সাথে বাসায় চলে যা। আমি আছি বাবার পাশে। এমনিতেও বাবাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছে,,এখনি ঘুমিয়ে পড়বে।(মেঘ)
–না ভাইয়া। আমি বাসায় যাবো না। আমি বাবার পাশেই থাকবো।
–মিহু দেখ,,জেদ করিস না। এখন বাসায় চলে যা,,,কাল সকালে আবার চলে আসবি।(মেঘ)
অবশেষে ভাইয়ার কথায় ভাবিকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে বসে আছি। বারবার ডাক্তার শুভ্রর প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে??? আমি তো আগে এমন ছিলাম না,,,হঠাত এমন বেহায়া মনের কিভাবে হয়ে গেলাম আমি?? যেই আমি কোনদিন চোখ তুলে কোন ছেলের দিকে তাকাইনি,,,সেই আমার এ দুচোখ শুধু তাকেই খুঁজে বেড়ায়!!
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোনরকম রাতটা পার করলাম।
🍁পরদিন সকালে….
ভাবিকে সাথে নিয়ে আবার হাসপাতালে চলে আসলাম। আমাদের আসতে দেখে ভাইয়া বললো…
–হিমিকা,,আমাকে এখনই অফিসে যেতে হবে। অনেক বলেও আজকে ছুটি নিতে পারলাম না। তোমরা দুজন মিলে বাবাকে একটু দেখো। ওহ হ্যা,,,ফুপি ফোন দিয়েছিলো। উনি বলেছেন একটু পরেই নাকি আসবেন।(মেঘ)
–আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি সাবধানে থেকো।(ভাবি)
–হুম ঠিক আছে।
বাবার পাশে বসে আছি ঠিকই কিন্তু বেহায়া চোখ বারবার কেবিনের দরজার দিকেই যাচ্ছে। জানি না উনি এখন হাসপাতালে আছেন কিনা।। হঠাত কেবিনের দরজায় নক করার শব্দ শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তড়িঘড়ি করে দরজার সামনে এসে দরজা খুলেই মনটা খারাপ হয়ে গেল,,,ফুপি দাঁড়িয়ে আছে।
–কিরে মিহু!! কি অবস্থা তোর??(কেবিনে প্রবেশ করে)
–আমি ভালো আছি,,তোমার কি খবর??
–আছি কোনরকম। দেখ,,,,ভাইজানের জন্য তার প্রিয় সব খাবার রান্না করে এনেছি। আপাতত এই ফলগুলো কেটে সাথে পিঠাগুলো নিয়ে আয় তো।
–আমাকে দাও ফুপি। মিহু অসুস্থ,,,তার কিছু করতে হবে না।(ভাবি)
–হু,,তাও ঠিক। শোন মিহু,,,নিজের প্রতি যত্নবান হও। দিনদিন তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিস!!পরে কেউ বিয়ে করবে না তোকে।(ফুপি)
ফুপির কথা শুনে ভাবি ফিক করে হেসে দিলো। আমিও মুখটা কালো করে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।
–আয়শা,,,এসেই আমার মেয়ের পিছে লেগে গেলি??(বাবা)
–আরে না ভাইজান।মিহু তো আমার নিজের মেয়ের মতোই। তাকে একটু পরামর্শ দিচ্ছিলাম আরকি। যাই হোক এখন কেমন আছো তুমি??(ফুপি)
–এখন একটু ভালো আছি(বাবা)
বাবা আর ফুপি গল্প করছে। আমি মন খারাপ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এর মাঝে ভাবি ফল আর পিঠা নিয়ে আসলো।
–ফুপি,,,বাবাকে তো এগুলো খেতে ডাক্তার নিষেধ করছে।
–তুই চুপ কর তো মিহু। ডাক্তার কি জানে?? আমি জানি আমার ভাইজানের কি খাওয়া উচিত।
ফুপির কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছি। আমার কান্ড দেখে ভাবি মিটমিট করে হাসছে। হঠাত ফুপি আমাকে তার কাছে যেতে বললেন…কাছে যেতেই এতোগুলো পিঠা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন আর কয়েকটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
–এইতো,,এভাবেই বেশি বেশি করে খাবি মিহু।ভাইজান তুমি কোন চিন্তা করো না। এখন আমি এসে গেছি,,,দেখো কিভাবে মিহুর খেয়াল রাখি।(ফুপি)
রাগে দাঁত কটমট করতে করতে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাত কেবিনের দরজায় কেউ নক করায় কোন কিছু না ভেবেই দরজা খুলে দিতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। শুভ্র আমার দিকে চোখে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বাবার কাছে চলে গেলেন। আজব তো!! এভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেনো?? তখনি নিজের দিকে খেয়াল করে বুঝলাম কেনো এভাবে তাকিয়ে ছিলেন!!! আমার পুরো মুখ ভরা খাবার,,,ডান হাতেও কয়েকটা পিঠা ধরে আছি। এভাবে দেখলে যে কেউ আমাকে পেটুক ভাববে। ছিহ! না জানি শুভ্র কি ভেবেছেন!!
নিজেকে সামলে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্র বাবাকে দেখে যাওয়ার সময় আমার সামনে এসে বললেন…
–মিস মাহিরা তাসনীম!! একটু আস্তে ধীরে খান। এখানে আপনার খাবার কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে না।
কথাটা বলে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখে শুভ্র চলে গেলো। আমি এখনো তার দিকে হা হয়েই তাকিয়ে আছি। এটা কি বললেন উনি?? উনি কি সত্যিই আমাকে পেটুক ভেবেছেন?? এখন উনার সামনে গেলেই তো হাসবেন!! এই সব হয়েছে আমার গুণধর ফুপির জন্য,,,রাগে নিজের চুল নিজে টানতে ইচ্ছা করছে আমার।
–চলবে🍁