এই তুমিটা আমার❤,পর্ব:০১

এই তুমিটা আমার❤,পর্ব:০১
মাহিয়া মেরিন

ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে ভার্সিটির গেটের কাছে এসে দেখি একটু দূরে বাবা স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,,হাতে বাজারের ব্যাগ। বাবারা হয়তো এমনই হয়!!! দুহাত ভর্তি জিনিস নিয়ে এই গরমের দিনে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শুধু মাত্র আমাকে সাথে নিয়ে বাসায় যাবে বলে। যদিও আমি আর এখন ছোট না,,,তবুও বাবার কাছে আমি এখনো তার ছোট্ট মিহু!!

বাবার কাছে এসে তার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে স্কুটির পিছনে উঠে বসলাম। বাবা আমাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো…
–মিহু মা!! কেমন কাটলো আজকের দিন?? সব ঠিকঠাক ছিল তো?? (বাবা)
–হ্যা বাবা। সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু তোমাকে না কতোবার বললাম,,আমি এখন বড় হয়ে গিয়েছি,,,বাসায় একা যেতে পারবো। তোমাকে এভাবে কষ্ট করে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমার কোন কথাই তুমি শোন না।((রাগী রাগী কণ্ঠে))
–আহা!! আমার কোন কষ্টই হচ্ছে না,,মা। আর আমাকে নিয়ে তোর এতো ভাবতে হবে না। আমি একদম ঠিক আছি।
–হুহ!! (মুখ ফুলিয়ে) চলো যাই।

বাবা স্কুটি চালাচ্ছে আর আমি একহাত বাবার কাধে রেখে অন্যহাত দিয়ে বাজারের ব্যাগ ধরে বসে আছি।
–বুঝলে মামুনি,,,,বাজারে আজকাল জিনিসের যা দাম বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তো আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষের আর ভালো মন্দ খাওয়াই হবে না।
–তুমি এতো চিন্তা করো না বাবা। আমি ভালো মতো পড়ালেখা করে একটা ভালো চাকরি পেয়ে একদিন তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করবো,,ইনশাল্লাহ।
–((একটু হেসে))পাগলি মেয়ে আমার।

বাবার সাথে কথা বলছিলাম হঠাত পিছন থেকে একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে এসে আমাদের স্কুটি ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই স্কুটিটা ছিটকে দূরে পড়ে গেলো। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে দূরে পড়ে গেলাম,,,,চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। অনেক কষ্টে নিজের চোখ মেলে আবছা আবছা আলো দেখতে পারছি,,দুই কানে শুধু ঝিনঝিন শব্দ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর ধীরে ধীরে আশেপাশে থাকা মানুষের শোরগোলের শব্দ শুনতে পেলাম,,,চোখেও হালকা দেখতে পারছি। বাবার কথা মনে পড়তেই ধীরে ধীরে উঠে বসে চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখি একটু দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় বাবা রাস্তায় পড়ে আছে। বাবাকে এভাবে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে কোনরকমে বাবার সামনে গিয়ে বসে পড়ি। বাবার মাথা থেকে রক্ত পড়ছে,,,জ্ঞানহীন ভাবে পড়ে আছে।
–বাবা!!বাবা!! চোখ খুলো। তাকাও আমার দিকে। বাবা!!!((কান্না করতে করতে))

গায়ের ওড়নাটা শক্ত করে বাবার মাথায় বেঁধে দিলাম। আশেপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে।
–কেউ এম্বুলেন্স ডাকো। আমার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। প্লিজ কেউ সাহায্য করুন।((চিৎকার করে))
তাদের মধ্যে কেউ একজন এম্বুলেন্সকে কল দিয়ে আসতে বললো। কিছুক্ষণের মাঝেই এম্বুলেন্স এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসলো। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করতেই একজন নার্স দৌঁড়ে এসে বাবাকে দেখেই বললো…
–উনাকে এখনি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যাও। আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।(নার্স)

আমি এখনো পাগলের মতো বাবাকে ডেকে যাচ্ছি। বাবার এমন অবস্থা দেখে আমি সেই মুহূর্তে প্রায় ভুলেই গিয়েছি যে এক্সিডেন্ট আমিও করেছি। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে,,,বাবার যেন কিছু না হয়।
এর মধ্যে সেই নার্সটা দৌড়ে এসে বাবাকে অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে দিলেন।
–ডাক্তার কোথায়??এখনো আসছে না কেনো?? ((উত্তেজিত হয়ে))
–ডাক্তাররা সবাই অপারেশন থিয়েটারে আছেন। তারা কেউ আসতে পারছেন না। তবে একটু অপেক্ষা করুন,,আমি শুভ্র স্যারকে আসতে বলেছি।
–প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলুন।
–উনি এখনি চলে আসবেন।আরে,,,আপনার কপাল থেকে তো রক্ত বের হচ্ছে,,,হাতের অনেকটাই কেটে গেছে। চলুন আমি আপনাকে ব্যান্ডেজ করে দেই।
–আমি একদম ঠিক আছি।আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি প্লিজ ডাক্তারকে নিয়ে আসুন।

নার্সটা অনেকবার বোঝানোর পরেও যখন রাজি হইনি তখন উনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই চলে গেলেন। আমি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে,,,চাইলেও থামিয়ে রাখতে পারছি না। হঠাত সেই নার্স আর একজন ডাক্তার ওয়ার্ডের ভিতরে প্রবেশ করে বাবার ট্রিটমেন্ট শুরু করেন। বাহিরে দাঁড়িয়ে আমি তাদের কার্যকলাপ সব দেখছি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে আসতেই আমি দৌঁড়ে উনার কাছে গিয়ে…
–আমার বাবা কেমন আছে এখন??(উত্তেজিত হয়ে)

ডাক্তার সাহেব আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে একবার পর্যবেক্ষণ করে জোরে জোরে নার্সকে ডাকতে শুরু করলেন।
–জি স্যার,,,,বলুন।।।(ভয়ে ভয়ে)
–উনার অবস্থা দেখেছো একবার?? একজন এক্সিডেন্ট করা রোগী এখনো ট্রিটমেন্ট ছাড়া বসে আছে,,,আর কেউ তাকে খেয়াল করেনি???(শুভ্র)
–স্যার,,,আমরা উনাকে অনেকবার বলেছি। কিন্তু উনার একটাই কথা “”আমি ঠিক আছি। আপনি শুধু বাবার ট্রিটমেন্ট করুন।””
ডাক্তার আমার দিকে তাকাতেই বললাম…
–আমি সত্যিই ঠিক আ….((বাকি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে))
–আপনি ঠিক আছেন কিনা সেটা কেউ জানতে চায়নি আপনার কাছে। আপনি এই অবস্থায় ট্রিটমেন্ট ছাড়া বসে আছেন,,,,আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে তখন আপনার বাবার পাশে আপনাকেও ভর্তি করাতে হবে। উনি(নার্সকে দেখিয়ে) এখন আপনাকে ব্যান্ডেজ করে দিবেন। আর কোন কথাই আমরা শুনতে চাই না।বুঝতে পেরেছেন??((ধমক দিয়ে কথাগুলো বলে,,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে)) যাই হোক,,,আপনার বাবার মাথা থেকে অনেক রক্ত পড়ায় উনাকে জরুরী এক ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। যতো দ্রুত সম্ভব O+ রক্তের ব্যবস্থা করুন।((কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন))

🍁নার্স আমার কপালে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন।আর আমি উনার ফোন দিয়ে ভাইয়াকে কল দিচ্ছি,,,দুইবার রিং হওয়ার পর ভাইয়া কল রিসিভ করলো…
–হ্যালো ভাইয়া। কোথায় তুমি??((কাঁদতে কাঁদতে))
–মিহু!! আমি অফিসে। কি হয়েছে তোর??(মেঘ)
–ভাইয়া!! বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।।।
–কিহহহ????তোরা এখন কোথায়??
–বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। বাবাকে রক্ত দিতে হবে।
–তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনি আসছি।।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসলো। ভাবী আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিচ্ছে আর ভাইয়া রক্ত দিতে গিয়েছে। প্রায় অনেকক্ষণ পর ডাক্তার রুম থেকে বের হয়ে এসে বললেন…
–উনি এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। তবে জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে,,,চিন্তার কোন কারন নেই।
কথাটা শুনে মনটা শান্ত হলো। এতোক্ষণ ধরে আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো।। মা মারা যাওয়ার পর বাবা খুব আদর যত্নে আমাকে বড় করেছে। তাই বাবার এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারছিলাম না।

হঠাত ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললো…
–আসলে,,,তখনকার ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আমি জানি পরিবারের কেউ এমন পরিস্থিতিতে থাকলে তখন নিজের প্রতি কারোই খেয়াল থাকে না। তখন যদি শাসন করে কথাগুলো না বলতাম তাহলে আপনি কখনোই নিজের ট্রিটমেন্ট করতেন না। আমি একজন ডাক্তার,,,এভাবে কাউকে আহত অবস্থায় দেখে আমি বসে থাকতে পারিনা। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।((কথাটা বলেই মুচকি হেসে উনি চলে গেলেন))

আমি এখনো একদৃষ্টিতে উনার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। এতোক্ষণে ধরে ভালোভাবে উনাকে পর্যবেক্ষণ করেছি। বয়স খুব একটা বেশি না,,,এই ২৭/২৮ হবে হয়তো। বেশ উঁচা লম্বা,,,সুঠাম দেহের অধিকারী। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ,,ঝলমলে চুল,,চোখে কালো ফ্রেমের একটা চশমা। খুব বেশি আহামরি সুন্দর না হলেও,,,খুব বেশি মায়াবী ছিল তার চোখ দুটি। সবচেয়ে বেশি যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো উনার মুচকি হাসি,,,,একদম আমার বুকের ভিতর তীরের মতো গেঁথে গেছে।।। উনার বলা কথাগুলো মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে আর মায়াবী চেহারাটা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে।

ধুর!! কিসব ভাবছি আমি?? এক্সিডেন্ট করে মাথা নষ্ট হয়ে গেলো নাকি আমার!! আমি আর কিছু না ভেবে বাবার কাছে গেলাম,,, এতোক্ষণে বাবাকে একটা কেবিনে নেওয়া হয়েছে। বাবার কাছে যেতেই সেই নার্সটা এসে বললো…
–উনার জ্ঞান ফিরলে আমাদেরকে খবর দিবেন। আর রাতে শুভ্র স্যার আবার এসে উনাকে দেখে যাবেন।
–((ওহ!! উনার নাম তাহলে শুভ্র। ভালোই,,,নামের সাথে মিল আছে উনার। এই এক মিনিট!! আমি আবার উনাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি?? ওহ মিহু!!তুই পাগল হয়ে যাবি)) জি,,ঠিক আছে।

–চলবে🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here