কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,২৩তম_পর্ব,২৪তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৩ তম_পর্ব
অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই পেছন থেকে একটি কন্ঠ শুনে বেশ ভড়কে যায় ধারা।
– ধারা…
কন্ঠটি ছ মাস পরে শুনছে। পিছনে না ফিরেও খুব ভালোভাবেই মানুষটিকে চিনতে পারছে সে। হাসিমুখটা নিমিষেই পাথরের ন্যায় অনুভুতি শূন্য হয়ে গেলো। এই ভয়টা প্রতিটা সময় কুড়ে কুড়ে খেত তাকে। দিগন্তের মুখোমুখি হতে একেবারেই নারাজ ছিলো সে। অনলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি তাক করতেই অনল বলে উঠলো,
– আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। যদি বাড়ি ফিরার ইচ্ছে থাকে তো একটা ফোন দিস আর নাহলে আমি কাল ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।
অনলের কথাটা শুনে মাথায় যেনো বজ্রপাত হয় ধারা। নিমিষেই তার সুখগুলো যেনো কর্পুরের ন্যায় উবে যায়। অনলের কথায় এটুকু স্পষ্ট ধারা এ পথটা তার নিজেরই হাটতে হবে। আজ যে সিদ্ধান্তটা নিবে তার তার নিজেরই নিতে হবে। এতোদিন প্রতিটা লড়াই এ অনল তার ঢাল হয়ে ছিলো আজ সেই ঢালটাও তার সাথে নেই। ধারা অসহায় চোখে অনলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরলো ধারা। স্থির দৃষ্টিতে স্পষ্ট, জড়তাহীন গলায় বললো,
– কেমন আছো দিগন্ত? এতোদিন পর কি মনে করে?
ধারার কথাটা শুনে অনেকটাই অবাক হলো দিগন্ত। ছয় মাস আগের ধারার আর আজকের ধারার মাঝে যেনো রাত দিন পার্থক্য। এ ধারা যেনো তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। একটু এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললো,
– তোমার কাছে বারে বারে কেনো আসি সে তো তোমার অজানা নয় ধারা।
– অবশ্যই অজানা, তোমার আমার মতো মেয়ের কাছে কি প্রয়োজন সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
– ধারা প্লিজ, এভাবে বলো না। মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু একটা সুযোগ কি আমাকে দেওয়া যায় না? আর তুমিও আমাকে বলো নি যে
– কি বলি নি দিগন্ত?
ভ্রু কুচকে ঝাঝালো কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ধারা। দিগন্ত ও জোড় দিয়ে বললো,
– এই যে তুমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করো নি
– আমি তো এটাও বলি নি যে আমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করেছি। তুমি নিজেই সব মনে করে নিয়েছো। তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করো নি। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছো প্রতিবারের মতো।
ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। দিগন্ত একবার ও সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে নি তখন। শুধু ধারার নামে মিথ্যে আরোপ দিয়ে গিয়েছিলো। আজ নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত দিগন্ত। মাথা নিচু করে বলে,
– আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না ধারা। ভুল আমার ছিলো, তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো কিন্তু আমাকে আজ ফিরিয়ে দিও না ধারা। তোমাকে ছাড়া আমি যে শূন্য। এই ছয়টা মাস নিজের হৃদয়ের যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না কতোটা কষ্টের মাঝে ছিলাম। কত রাত জেগে কেটেছে তার হিসাব নেই। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কল্পনা করতে পারি না ধারা। দম বন্ধ লাগে, প্লিজ একটা সুযোগ আমাকে দেও। এই বাচ্চাটা আমার, আমাকে আমার বাচ্চার কাছ থেকে দূর করো না। সেদিন যখন তোমাকে হাসপাতালে দেখেছিলাম সেদিন ই বুকের মাঝে অসংখ্য পাথর উঠে গিয়েছিলো। আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না আমার কতোটা কষ্ট হয়েছিলো যখন ভেবেছি তুমি শুধু বিয়ে করার জন্য আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছো। যখন জানতে পারলাম আমার বাচ্চাটি সুস্থ রয়েছে কতো যে আনন্দ হয়েছে বুঝাতে পারবো না। প্লিজ একটা সুযোগ দাও ধারা। প্লিজ এই সামান্য কাগজের সম্পর্কটাকে আমাদের মাঝে দেয়াল হতে দিও না। প্লিজ
গলা ধরে এসেছে দিগন্তের। কথা বলতে বলতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। কেনো যেনো আজ তার কান্নায় কষ্ট হচ্ছে না, করুণা হচ্ছে কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– তুমি কি আমাকে ভালোবাসো দিগন্ত?
– এভাবে কেনো বলছো ধারা?
– আমি তোমার অভ্যাস দিগন্ত ভালোবাসা নই। আমি তোমার জিদ, ভালোবাসা নয়। যদি ভালোবাসা হতাম তাহলে মূহুর্তেই পায়ে ঠেলে দিতে না আমায়। আমাকে বেশ্যা বলতেও তোমার মুখে বাধে নি। তুমি যদি আমাকে সত্যি ই ভালোবাসতে তাহলে কখনোই আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলতে পারতে না দিগন্ত। আমি তোমার কেবল কামনা। তোমার খারাপটা আমার শুন্যতার জন্য লাগে নি, আমাকে অন্য কারোর সাথে দেখে লেগেছে। আমি তোমার কাছে একটা প্রাইজের মতো। ভালোবাসা এটাকে বলে না। ভালোবাসার মধ্যে কামনা থাকে না। আমাকে কখনো তুমি ভালোই বাসো নি। আমি তোমার চাহিদা ছিলাম। আর আমি ও কতো বোকা তোমার লালসাটাকে ভালোবাসা হিসেবে মেনেছি। আমি মেয়ে নামে কলংক। তুমি আমাকে ভালোবাসলে কখনো কলংকিত করতে না। তুমি কি জানো এই ছয়মাস কিভাবে কেটেছে। জানো না জানার ইচ্ছে ও তোমার নেই। যেদিন তুমি বলেছিলে তুমি বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে পারবে না সেদিন আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম। অনল ভাই না থাকলে হয়তো মরেই যেতাম। এর পর ও দু এক বার এ চিন্তা আমার মাথায় এসেছিলো। এই বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মা-বাবার পা ধরে কেঁদেছি। সেদিন অনল ভাই না থাকলে হয়তো আমাকে আত্নহত্যা করতে হতো। আর কিসের বাচ্চা বাচ্চা করছো বলোতো? কোন বাচ্চা, যার দায়িত্ব তুমি নিতে চাও নি। কাপুরুষের মতো দায়িত্ব নেবার ভয়ে তাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে সেই বাচ্চার দোহাই দিচ্ছো। তুমি আদৌ জানো আমার প্রেগ্ন্যাসির অবস্থা কেমন ছিলো? বাচ্চাটা আদৌ কতটুকু বেড়েছে? আমার শরীরের পজিসন কেমন? না তুমি জানো না। অনল ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, সে এটাও বলতে পারবে বেবি দিতে কতোটুকু নড়াচড়া করে। সে বাবা না হয়েও বাবার সকল দায়িত্ব পূরণ করেছে। যে সময়টা আমার তোমাকে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো তখন সেই মানুষটা আমার পাশে ছিলো, আমার ঢাল হয়ে। আমাদের কুকীর্তির সম্পূর্ণ দায়টা নিজের নামে চালিয়েছেন। আমাকে কেউ যেনো আঘাত না করে সেজন্য আমার সামনে তাকে পেয়েছি তাকে। আর কি বললে কাগজের সম্পর্ক হ্যা আমাদের মাঝে সম্পর্কটা কাগজের। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। আমার ভাবনার খেলাঘরে তার বসবাস। আজ তোমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতি করুনা হয়েছে কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় নি। আমি তোমার কাছে ফিরবো না। এই কাগজের সম্পর্ক আমার সারাজীবনের অস্তিত্ব। এতোদিন তুমি আমার কাছে যা চেয়েছো আমি দিয়েছি আজ আমি চাচ্ছি। আমি তোমার থেকে মুক্তি চাচ্ছি। আমার বাচ্চা আর আমাকে মুক্তি দাও। আর কখনো আমার সামনে কোনো অহেতুক আবদার করো না। আমি রাখতে পারবো না। আরেকটা কথা, অনল ভাই যদি আমার জীবনে নাও থাকতো তাও আমি তোমার কাছে ফিরতাম না। যদি কোনোদিন অনল ভাই আমাকে ফিরিয়ে দিতে চায় আর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকে আমি আর আমার বাচ্চা মরে যাবো তাও তোমার কাছে ফিরবো না। আমি বলি কি, তুমি এবার কাউকে সত্যি ভালোবাসার চেষ্টা করো। দেখবে সুখী হবে। আসি দিগন্ত।
দিগন্তের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাটা দিলো ধারা। আজ মন থেকে একটা ভার করে গেছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা। কিন্তু যখনই ভাবছে অনল তাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজী হয়েছে। তার কাছে শুধু কাগজের স্ত্রী হয়ে থেকে গেলো ধারা। কেনো জোর করলো না সে, কেনো দিগন্তকে এই সুযোগটা দিলো অনল এটা ভাবতেই মনটা কালো মেঘের মতো দুঃখগুলো ভর করছে। এদিকে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দিগন্ত। বুকটা যেনো ফেটে যাচ্ছে, আজ নিজের কর্মকাণ্ড তাকে ধারার কাছ থেকে এতোটা দূর করে দিয়েছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। এক নজরে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ধারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। হাটু গেড়ে এখনো সেখানেই দেখছে সে। বুক থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরোলো।
পার্কের বাহিরে গাড়িতে বসে আছে অনল। মন এবং মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ক হেরে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে ছুটে যাবে ধারার কাছে ছুটে যেয়ে ধারাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হচ্ছে যদি ধারা এখনো তাকে ফোন দেয় নি তবে কি ধারা দিগন্তকে মেনে নিয়েছে। দিগন্তকে সে তো ভালোবাসতো। অনল তো তার কাছে শুধু একটা বটবৃক্ষের ন্যায়। সে তো অনলকে ভালোবাসে না। আর এই সম্পর্কটা তো শুধুমাত্র কাগজের। কাগজের সম্পর্ক কি আদৌ সত্যিকারের সম্পর্কের ন্যায় হয়!! কৃতজ্ঞতা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। এখনো যেহেতু ধারা ফোন দেয় নি তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানেই হয় না। না জানি কতো মান-অভিমানের অবসান ঘটছে। বুকে হাজারো ছুরির আঘাত হচ্ছে অনলের। চোখ মুখ মুছে গাড়ি স্টার্ট দিবে তখন…….
চলবে
কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
২৪তম_পর্ব
কাগজের সম্পর্ক কি আদৌ সত্যিকারের সম্পর্কের ন্যায় হয়!! কৃতজ্ঞতা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। এখনো যেহেতু ধারা ফোন দেয় নি তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানেই হয় না। না জানি কতো মান-অভিমানের অবসান ঘটছে। বুকে হাজারো ছুরির আঘাত হচ্ছে অনলের। চোখ মুখ মুছে গাড়ি স্টার্ট দিবে তখন মোবাইলটি বেজে উঠে। মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নাম্বারটা উঠে রয়েছে। বুকে একরকম চিনচিনে ব্যাথা করে উঠলো অনলের। হেরে গেছে সে, অবশ্য সে তো যুদ্ধ করেই নি। এখানে যুদ্ধ করবেই বা কিভাবে! ধারা তো তার কখনো ছিলোই না। যার আমানত তার কাছেই ফিরে গেছে ধারা। এটাই তো হবার ছিলো। ফোনটি রিসিভ করে কাঁপা স্বরে হ্যালো বলতেই অপরপাশ থেকে তার কানে আসে,
– আপনি জিতে গেছেন অনল। আপনি যুদ্ধ না করেও জিতে গেছেন আর আমি যুদ্ধ করেও হেরে গেলাম।
– মানে?
– মানে টা স্পষ্ট ধারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ধারা এখনো আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই ছয় মাসে ওর মন, ভাবনার থেকে এভাবে মুছে যাবো। অবশ্য এখানে আমার দোষ ই বেশি; আজ আমার নিজের কাজের জন্যই আমার প্রতি তার ভালোবাসাটা একেবারেই মলিন হয়ে গেছে। আর আপনার নামটা পার্মানেন্টভাবে খোদাই হয়ে গেছে। আমি আর আপনাদের জীবনে বাধা হতে চাই না। তবে একটা আবদার ওদের দেখে রাখবেন প্লিজ। ধারা হয়তো মুখ ফুটে কখনোই আপনাকে কিছু বলবে না তাই হয়তো আপনাকে তার মনের কথাটা বলা হয়ে উঠে নি। আপনি কখনো ওর হাতটা ছাড়বেন না প্লিজ। আমি ওর যোগ্য নই। তাইতো সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর যে আসছে তাকে কখনো বুঝতে দিবেন না যে আপনার সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। যদিও আপনাকে বলতে হবে না তবুও আপনার মনে যে দোটানার বীজ আমি বুনেছিলাম সেটাকে গোড়া থেকে উঠিয়ে ফেলুন। আমি কখনোই কোনো অধিকার নিয়ে আপনাদের কাছে আসবো না। আমার শুভকামনা রইলো আপনাদের জন্য। আর একটা কথা কাগজের সম্পর্কটা কাগজে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব সম্পর্কে পরিণত করুন। রাখছি।
দিগন্তের গলা ধরে এসেছে। আর কোনো কথা বলতে পারছে না। ফোনটা রেখে দিলো সে। অনলের উত্তরের অপেক্ষা করলো না। নিজের কথাগুলো বলেই রেখে দিলো সে। দিগন্তের কথাগুলো শুনে মনের সব কালো মেঘগুলো যেনো নিমিষেই সরে গেছে অনলের। তার ধারা তার ই আছে, ধারা তাকে ভালোবাসে। সে তাকে ছেড়ে যায় নি। আর প্রিন্সেসও তার কাছেই থাকবে। মরা মনটা নিমিষেই জীবিত হয়ে উঠেছে। সে ভেবেছিলো আবারও অন্ধকার জীবনে ফিরে যেতে হবে তার। শুন্যতা তাকে গ্রাস করে নিবে। কিন্তু ধারা সকল ভাবনা মিথ্যে প্রমাণ করে তার বেরঙ জীবনকে আবার রঙিন করে দিলো। কিন্তু ধারা তাকে ফোন কেনো করলো না। সে কোথায় আছে। ছুটতে ছুটতে পার্কে গেলো অনল। রীতিমতো পাগলের মতো খুঁজতে থাকে সে ধারাকে। তবে কি ধারা তার উপর অভিমান করেছে? একবার কি ধারাকে আগ থেকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিলো। ধারা তো তাকে ভালোবাসে তাহলে কেনো তার কাছে ফিরে আসলো না। ধারার ফোনটাও অফ। কোনোভাবেই রিচ করতে পারছে না। সূর্য পশ্চিমে অস্ত চলে গেছে। আলোটা নিভু নিভু হয়ে এসেছে। ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। ক্লান্ত হয়ে পার্কের মেইন গেটে চলে আসলে খেয়াল করে ফোনটা বেজেই চলেছে। সুভাসিনী বেগম রীতিমতো ফোন করেই যাচ্ছেন। এতোক্ষন খেয়াল ই করে নি অনল। ফোনটা রিসিভ করতেই,
– তোমার বোধবুদ্ধি কি জ্বলাঞ্জলি দিয়েছো। তোমার ফোনেই পাচ্ছিলাম না আমি। কখন থেকে ফোন করছি।
– জরুরি কিছু মা?
– ধারাকে রেখে বাড়ির নিচে রেখে কোথায় গিয়েছো তুমি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনো ফিরছো না যে?
– ধারা বাসায়?
– বাসায় মানে? ও তো আধা ঘন্টা হয়ে গেছে বাসায় এসেছে। ও তো বললো তুমি ওকে বাসার নিচে নামিয়ে দিয়েছো। তোমার নাকি জরুরি কাজ আছে। তুমি কোথায় অনল? আর তুমি ধারাকে একা ছেড়ে দিয়েছো?
সুভাসিনী বেগমের কথায় একদিকে আশ্বস্ত হলেও তার জেরার মুখোমুখি হওয়াতে কথা শুকিয়ে এসেছে অনলের। আমতাআমতা করে বললো,
– আসলে ধারা আমার উপর রাগ করে একাই বাসায় চলে এসেছে।
– কিহ? কি করেছো তুমি?
– একটা বড় ভুল হয়ে গেছে মা। আমি আসছি এখনি।
বলেই ফোনটা রেখে দিলো অনল। সুভাসিনী বেগমকে কোনো কিছু বলার সুযোগ ই দিলো না সে। ফোনটা রাখতেই মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে সুভাসিনী বেগমের। ধারা অনলের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। কাগজের সম্পর্কটা নতুন রুপ নিচ্ছে। যে সম্পর্কে মান-অভিমান, অভিযোগ, রাগ থাকবে। ফোন রেখে ধারার রুমে যাওয়ার আগেই খেয়াল করলেন রান্নাঘর থেকে প্রচুর শব্দ আসছে। তড়িৎ গতিতে রান্নাঘরে যেয়ে দেখলেন চায়ের পাতিল পড়ে একাকার অবস্থা আর রাজ্জাক সাহেবের হাত অনেকটাই পুরে গেছে। তিনি অসহায়ের মতো হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স ষাটের ঘরে পৌছেছে। দু-একদিন ধরে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। সুভাসিনী বেগমকে তিনি জানতেও দেন নি। এমনিতেও এতোদিন একা থাকায় নিজের কাজ নিজে করাটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে রয়েছে তার। তাই সুভাসিনী বেগমকে না জানিয়েই চা বানাতে যাচ্ছিলেন। কাঁপা হাতে ঠিক ব্যালেন্স করে উঠতে পারেন নি বিধায় এই কান্ড হয়েছে। সুভাসিনী বেগমকে দেখে খানিকটা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রাখলেন তিনি। খানিকটা কড়া কন্ঠে সুভাসিনী বেগম বললেন,
– যখন পারেন না একা একা কাজ করতে তাহলে অহেতুক কি দরকার ছিলো এসব করে হাতটা পুড়ানোর? দেখি হাতটা কতোটা পুড়েছে
– আমি তো এতোদিন একা একাই থেকেছি, আমার অভ্যাস আছে। আসলে ব্যালেন্সটা রাখতে পারি নি, হাতটা কাঁপছে। আর ধারাকে এই অবস্থায় কিভাবে বলি?
আমতাআমতা করে রাজ্জাক সাহেব বলেন। এবার যেনো আরো তেজী গলায় বলেন সুভাসিনী বেগম,
– আমি কি মরে গেছিলাম? আমাকে বললে কি হতো?
– যার মুখ দেখতে চাও না তার জন্য অহেতুক কষ্ট করার কি দরকার?
মলিন হাসি হেসে কথা বললেন রাজ্জাক সাহেব। সুভাসিনী বেগম আর কোনো কথা বললেন না। চুপকরে তার হাতটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দেন সুভাসিনী বেগম। জীবনের পাঁচ ভাগের চার ভাগ মান-অভিমানে কেটে গেছে। এই শেষ ভাগটা নাহয় মান-অভিমানের অংকগুলোর হিসেবটা চুকিয়ে দেওয়া যাক। সুভাসিনী বেগম রাজ্জাক সাহেবকে চায়ের কাপটা ধরিয়ে শান্ত গলায় বলেন,
– কিছুদিন পর দাদা-দাদী হবো। এখন এসব পাগলামী গুলো করবেন না। বয়স তো হয়েছে।
– আমাকে ক্ষমা করা যায় না সুভা?
– এখনো আমার ক্ষমায় যায় আসে?
– আসে বলেই হয়তো তোমাদের প্রতি মূহুর্তের খবর নিয়েছি। শুধু সাহসটা করে উঠতে পারি নি। সাহসটা যোগাতে যোগাতে জীবনটা মৃত্যুর দাঁড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মরার আগে শুধু তোমার ক্ষমাটা চাই। জানো সুভা তুমি তো তাও তোমার ছেলেকে নিয়ে সবার মাঝে ছিলে। ছাব্বিশ টা বছর একা একা থাকার বেদনা তুমি হয়তো কল্পনা করতে পারবে না। মরে গেলে হয়তো কেউ টের ও পেতো না আমি নামক মানুষটা মরে গেছি।
রাজ্জাক সাহেবের কথাটা শুনে অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো সুভাসিনী বেগমের। অভিমানী গলায় বললেন,
– আপনাকে কি আমি বলেছিলাম একা থাকতে। যার জন্য ছেড়ে গেছিলেন সে কোথায় ছিলো?
– হাহাহা, সুভা তুমি এখনো সেই কিশোরী টি রয়ে গেলে। সাফিয়া তার জীবনে নাতি পুতি নিয়ে সুখে আছে। ও আমাদের মাঝে কোথাও ছিলোই না। ছিলো শুধু ভুলবুঝাবুঝি।
সুভাসিনী বেগম আর কথা বাড়ালেন না। শুধু শান্ত গলায় বললেন,
– এখন থেকে আর ড্রয়িং রুমে থাকা লাগবে না। এমনেই শরীরটা ভালো নেই আপনার।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধারা সুভাসিনী বেগমের কাছে এসে হাজির হলো। খানিকটা ভাঙ্গা স্বরে বললো,
– ফুপি আমি তোমার সাথে থাকবো আজ থেকে। ফুপাকে আর ড্রয়িং রুমে থাকা লাগবে না। অনলভাই এর সাথেই উনি থাকতে পারবেন।
রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ধারা আলাদা রুমে থাকতে চাচ্ছে মানে বড় কিছুই হয়েছে তাদের মাঝে। অনল নিজে যদি ধারার রাগ না ভাঙ্গায় তবে এ রাগটা অভিমানে পরিণত হবে, আর অভিমান ভাঙ্গানো কঠিন নয় অনেক সময় দুষ্কর হয়ে উঠে___
সন্ধ্যা ৭.৩০টা,
অনল পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরেছে। ঘরে ঢুকতে বাবা-মার সাথে দেখা হয় তার। সুভাসিনী বেগমকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বলেন,
– তোমার রুমেই আছে সে, চাচ্ছিলো আমার রুমে শিফট করতে। কিন্তু আমি বাধা দিয়েছি। দেখো যদি রাগ ভাঙ্গাতে পারো।
অনল একমিনিট দেরি না করে নিজের রুমে চলে যায়। রুমের কোথাও সে নেই; অনলের বুঝতে বাকি নেই ধারা কোথায় আছে। ধীর পায়ে বারান্দার কাছে যেতেই দেখলো ধারা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো খোলা, দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির। সোডিয়ামের লাইটে তার উদাসীন চোখজোড়া খুব ভালো করেই লক্ষ করতে পারছে অনল। গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো সে। ধারার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। এখনো সে তার জায়গায় স্থির। এবার অনল ধীর পায়ে এগিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো; শান্ত গলায় বললো,
– আমাকে ফোন দিলি না যে
– দিলে কি হতো
ধারার নির্বিকার প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো অনল। ধারার দৃষ্টি এখনো বাহিরের দিকে। অনল বুঝলো ধারা অনেকটাই রেগে রয়েছে। এবার ধীর কন্ঠে বললো,
– তুই আমার উপর রেগে আছিস?
– নাতো, রেগে থাকার মতো তো কিছু হয় নি। তুমি যেটা ঠিক মনে করেছো। এতে রাগ হবার তো কিছু নেই।
– তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তোর উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই নি। আর সত্যি বলতে ও বাচ্চাটির বাবা। আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
অনলের কথা শুনে এবার ঘুরে দাঁড়ালো ধারা। ঝাঝালো এবং কাঁপা স্বরে বললো,
– একবার আমার মতামত টা কি নেয়া যেতো না অনল ভাই? আমি কি চাই সেটা জানার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। সুন্দর মতো আমাকে মিথ্যে বলে নিয়ে গেলে। আমি তোমার স্ত্রী অনল ভাই, ভালোবাসো নাই বা বাসো আমি তোমার স্ত্রী। হোক না সেটা কাগজের। একজন উটকো লোক এসে বললো আর তুমি আমাকে তার কাছে দিয়ে আসলে।
– ধারা, আমার কথাটা তো শোন
– কি শুনবো হ্যা কি শুনবো? আচ্ছা একটা বার তোমার কি বাধলো না দিগন্তের কাছে আমাকে রেখে যেতে। যদি আমি দিগন্তের কাছে যেতে দিতাম তুমি আসলেই আমাকে ওর কাছে যেতে দিতে। আটকাতে না। ওহ হ্যা আটকাবে কেনো? তুমি তো অনন্যা আপুকে ভালোবাসো। আমি তো তোমার আশ্রিতা। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, যদি আমাদের বোঝা মনে হয় তবে বলে দিও আমরা তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিবো তবে এভাবে যার তার কাছে আমাদের দিয়ে এসো না। আমি এতো ফেলনা নই যে…..
ধারা আর কিছুই বলতে পারলো না, তার আগেই তার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নিলো অনল। আকর্ষিক ঘটনায়……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি