কাগজের_তুমি_আমি দ্বিতীয়_অধ্যায়,২১তম_পর্ব,২২তম_পর্ব

কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,২১তম_পর্ব,২২তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
২১তম_পর্ব

হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে তাদের ধ্যান ভাঙ্গে। মহুয়া উঠে দরজাটা খুলে। এদিকে নিজের রুম থেকে উঠে আসেন সুভাসিনী বেগম। মনটা কেনো যেনো অস্থির লাগছিলো তার। দরজার কাছে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো তার। দরজার ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ তার কানে আসলো,
– সুভা…

কন্ঠটি যে খুব পরিচিত তার। শেষ কবে এই ডাকটা শুনেছিলেন সেটা মনে পড়ছে না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন তিনি। অনলের মতোই চোখ,মুখ, দেহের গঠন শুধু বয়সের ছাপ খুব ভালো করেই পড়েছে শরীরে, মুখে। ছ ফুটের লোকটি এখন আর আগের মতো বলিষ্ট নেই, কুজো হয়ে পড়েছে। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটা সোনালী ফ্রেমের চশমায় ঢাকা সেই চিরচেনা মায়াবী চোখ জোড়া। মাথায় সাদা চুলে ঢাকা। মলিন হাসি ঠোটে একে দাঁড়িয়ে আছেন সুভাসিনী বেগমের সামনে লোকটি। লোকটি আর কেউ নন রাজ্জাক সাহেব। ছাব্বিশ বছর পূর্বের রাজ্জাক সাহেবের মতোই সুভাসিনী বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। শুধুমাত্র সময়টা বদলে গেছে। কতগুলো বছর কেটে গেছেন। রাজ্জাক সাহেব ইতস্তত ভাব নিয়ে আবার ডেকে উঠেন,
– সুভা
– উনাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছো অনল? এ কথাতো তোমার সাথে আমার ছিলো না।

সুভাসিনী বেগমের কথা শুনে মাথাটা গ্লানিতে নিচু হয়ে যায়। অনল কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এটাই হয়তো রক্তের টান যা চেয়েও এড়াতে পাড়ে নি। সত্যি বলতে সুভাসিনী বেগমের সাথে দেখা করার জন্য অনেকটা হাতে পায়েই ধরেছিলেন রাজ্জাক সাহেব। জীবনের শেষ ভাগটা একা একা থাকার সাহসটা করে উঠতে পারেন নি। ছাব্বিশটা বছর তো কম নয়। এবার আবার একটা শেষ চেষ্টা করতে চান। অনলের আমতা আমতা করা দেখে কিছুই বললেন না সুভাসিনী বেগম। দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলেন। মাকে এভাবে চলে যেতে দেখে অনল পিছু নিতে চায়। ধারা বাধা দেয়। অসহায় ভাবে ধারার দিকে তাকালে চোখ দিয়ে ইশারা করে মানা করে। সুভাসিনীর হৃদয়ে কি ঝড় চলছে সে তা অনুভব করতে পারছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজ্জাক সাহেবের সামনে যায় সে। ধীর গলায় বলে,
– ফুপা, আসসালামু আলাইকুম। বেয়াদবি নিবেন না তবে আপনার এখানে আসা উচিত হয় নি। এখন এসেই যেহেতু পড়েছেন তাহলে যে কাজে এসেছেন সেটা করুন। তবে সেই কাজে কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না। যদি ফুপি আপনাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি ক্ষমা পাবেন নয়তো নয়। যদি ফুপি আপনাকে দয়া করে এ বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয় তবেই আপনি এখানে থাকতে পারবেন।

রাজ্জাক সাহেব মুচকি হাসি হেসে বললেন,
– তুমি ই ধারা?
– জ্বী ফুপা
– দোয়া করি যাতে সুখী হও। আর আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো।

বলেই তিনি সুভাসিনী বেগমের রুমের দিকে হাটা দিলেন। অনল ধুপ করে সোফায় বসে পড়লো। সুমনা বেগম এবং মহুয়ার মুখে কোনো কথা নেই। পরিস্থিতি মূহুর্তেই যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। সুভাসিনী বেগম রাজ্জাক সাহেবকে ফিরিয়ে দিবেন নাকি মেনে নিবেন এই চিন্তাটাই সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ধারা ধীর পায়ে অনলের পাশে বসে। তার হাতের উপরে হাত রেখে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
– তুমি তো বলেছিলে, শেষবারের মতো দেখা করতে যাচ্ছো। তাহলে? কি এমন হলো যে বাসায় নিয়ে এলে?

অনল ধারার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। প্রশ্নের উত্তরগুলো তাকে এতোটা ঘাটিয়ে দিবে বুঝে উঠতে পারে নি অনল। কয়েনের যেমন দুটো পিঠ থাকে ঠিক তেমন কিছু কিছু কাহিনীর ও দুটো পার্ট থাকে। এতোদিন সে শুধু সুভাসিনী বেগমের পার্ট টুকু জানতো। আজ যখন রাজ্জাক সাহেবের পার্ট টুকু জেনেছে তখন কেনো যেনো জমা অভিমানগুলো গলে গেলো।

অপরদিকে,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন সুভাসিনী বেগম। বেহায়া মনটা পুনরায় গলতে শুরু করেছে। সুপ্ত অনুভূতি গুলো দাবানলের ন্যায় বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে মনে। ফেলে আসা দিনগুলো মনে হানা দিচ্ছে। সুভাসিনী বেগম ভেবেছিলেন হয়তো মনটা রাজ্জাক সাহেবের প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে। কিন্তু তার সামনাসামনি হতেই ভুল প্রমানিত হলো তার ভাবনাগুলো। সূর্যটা পশ্চিমের দিকে ঢেলে পড়ছে। গোধুলির স্নিগ্ধ কিরণ মুখে আছড়ে পড়ছে সুভাসিনী বেগমের। রাজ্জাক সাহেব নীরবে তাকে দেখেই যাচ্ছেন। তার সামনে আঠারো বছরের কিশোরী নয় পঞ্চান্ন বছরের একজন নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কেশের সুগন্ধে একটা সময় তিনি মত্ত থাকতেন আজ সে কেশ কাঁচাপাকা রঙ্গে ডাকা। পুতুলের মতো যে মুখে নিজের শান্তি খুজছেন আজ তাতে বয়সের ছাপ পড়েছে। চামড়াটা ঝুলে গেছে। সময়টা অনেক বেশি কেটে গেছে। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত গুলো, নিজের জেদগুলো আজ তাদের সম্পর্ককে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বয়সের গরমে সেদিন ঠিকভুলের বিচার ভুলে গেছিলেন। জেদের বসে তালাকের কথাও তুলে ফেলেছিলেন। কেনো যে এমনটা করতে গেলেন। এখন নিজেই পশ্চাচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রহরে আর ভুল করতে চান না। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। জড়ানো গলায় ধীর স্বরে বললেন,
– সুভা
– কেনো ফিরে এসেছেন?
– আর কত শাস্তি দিবে আমায় সুভা?
– কিসের শাস্তি বলুন তো? আমি আপনাকে কখনোই কোনো শাস্তি দেই নি।
– ক্ষমাও তো করো নি?

এবার মলিন হাসি হেসে তার দিকে তাকান তিনি। এক রাশ অভিমান নিয়ে কঠিন কন্ঠে বলেন সুভাসিনী বেগম,
– দোষটা কি আমার ছিলো? ক্ষমা পাবার মতো কাজ কি আপনি সত্যি করেছেন? নিজের বউ বাচ্চা ফেলে যখন দিনের দিন একজনের কাছে পড়ে ছিলেন তখন তো আপনার এই কথাটা মনে পড়েনি। আজ হঠাৎ ক্ষমার কথা মনে পড়লো। সেদিন তো খুব বড় গলায় বলেছেন আমার মতো নারীর সাথে এক ঘরে থাকবেন না আপনি। তাহলে আজ কেনো এই নারীর ক্ষমার প্রয়োজনীয়তা হলো আপনার?
– তুমি সেদিনও আমাকে ভুল বুঝেছো আজও। সাফিয়ার সাথে আমার তখন ও কোনো সম্পর্ক ছিলো না এখনো নেই। শুধু বন্ধুত্ব ব্যাতীত কোনো সম্পর্ক আমাদের কখনো ছিলো না। সেদিনো তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। তুমি বুঝো নি। ও অসুস্থ ছিলো বলেই আমি তার সাথে হাসপাতালে ছিলাম।
– তাই তো আমাদের ছেড়ে তাকে বেছে নিয়েছিলেন। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন সেদিন আমার থেকে মুক্তিটা আপনি চেয়েছিলেন। আমি শুধু আপনার কথা রেখেছিলাম। সকল দায়িত্ব থেকে আপনাকে মুক্তি দিয়েছি। আপনি আমার কখনো ছিলেন ই না। আমি মরীচিকার পেছনে ছুটেছি কেবল।

সুভাসিনী বেগমের গলা কাপছে। ঠিক ভাবে কথাও বলে উঠতে পারছেন না। কোনো নারী তার স্বামীকে অন্য কারোর সাথে ভাগ করে নিতে পারেন না। তার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছিলো। ছাব্বিশ বছর পূর্বে নিজের সাজানো সংসার ভাঙ্গার ভয়ে রাজ্জাক সাহেবকে বাধা দিয়েছিলেন। রাজ্জাক সাহেবের কলিগ এবং বন্ধু ছিলেন সাফিয়া। তাদের মাঝের বন্ধুত্ব এতোটাই গভীর ছিলো যে মাঝ রাতেও সাফিয়া বেগম রাজ্জাক সাহেবকে ফোন দিতেন। সংসার ভাঙ্গার ভয় মনে জেকে বসেছিলো সুভাসিনীর বেগমের। তাই তাকে বাধা দিতে চাইছিলেন। কিন্তু এই বাধাই তার সংসারকে ভেঙ্গে ফেলবে কখনো বুঝতে পারেন নি। রাগের বশে ঘর ছেড়েছিলেন রাজ্জাক সাহেব। সুভাসিনী বেগম হয়ে গিয়েছিলো তখন একজন সন্দেহপ্রবণ, কন্ট্রোলকারী মহিলা যে তার বন্ধুত্ব সম্পর্ককেও সন্দেহ করে। অনলকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। শুধু নিজের বাবা-মার জন্য পারেন নি। সময়ের সাথে সাথে রাগ,জেদগুলো ঠুনকো হতে লাগলো। আত্নগ্লানিতে ভুগতে লাগলেন রাজ্জাক সাহেব। আমরা রাগের বশে কতোভুলই না করি। ক্ষণসময়ের রাগে প্রিয় মানুষকেও কত কি না বলি। রাগটা পরে গেলে আফসোস করেও কুল পাই না। মাথানিচু করে রাজ্জাক সাহেব বলেন,
– বারবার ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারি নি। কিন্তু তোমাদের কখনো ভুলি নি। প্রতিটা মূহুর্ত তোমাদের খোজ নিয়েছি। আচ্ছা তুমি তো জানতে আমি একটু রাগী,
– সে জন্যই আপনার পাঠানো ডিভোর্স পেপারে সাইন করি নি। ভেবেছি হয়তো ফিরবেন। আশা করেছি, অপেক্ষা করেছি। কিন্তু অপেক্ষার বাধটা ভেঙ্গে গেছে। ছাব্বিশটা বছর কেটে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে আছি। যখন আমার আপনাকে খুব দরকার ছিলো তখনই আপনাকে খুজে পাই নি। আচ্ছা কতটা বয়স ছিলো আমার বলুন তো? কি ভুল ছিলো আমার? এটাই যে আপনাকে হারাতে চাই নি। সর্বস্ব দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম এটাই তো। ভুল করেছিলাম, সেটার শাস্তি এতোটা কঠিন হবে বুঝি নি। যাক গে, এতোটা সময় আপনার ব্যাতীত আমি কাটিয়েছি, এখন আর নতুন করে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা বুড়ো চোখে নেই।
– সুভা, একা থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এটা আমার বুড়ো বয়সের ভীমরতি বলো কিংবা মৃত্যুর আগ ইচ্ছে, জীবনের শেষ পর্যায়ে পরিবার নামক সুখটাকে আবার আগলে ধরতে চাই। আচ্ছা সুভা তোমার কি ইচ্ছে হয় না?

রাজ্জাক সাহেবের কথা শুনে চুপ হয়ে যান সুভাসিনী বেগম। মান-অভিমানের এই খেলায় জীবন যে মৃত্যুর দারপ্রান্তে এসেছে এটাই ভুলতে বসেছিলেন। একটা গোলাকধাধার মাঝে পড়ে গেলেন তিনি। আচ্ছা চাইলেই কি ক্ষমা করা যায়? কিছু ভুলকে হয়তো চাইলেও ক্ষমা করা যায় না। কিংবা ক্ষমা করার সময়টা পেরিয়ে যায়।

রাত ৮টা,
সুভাসিনী বেগম ঘরে থাকার পারমিশন তো দিয়েছেন তবে এক রুমে তার কিছুতে থাকবেন না। ধারা চিন্তিত মনে বসে রয়েছে। বুড়ো বয়সে এখন ফুপাকে তো ড্রয়িংরুমে থাকতে হচ্ছে। অনলের কাছ থেকে সব শোনার পর ধারাও তার সিদ্ধান্তে একমত হলো। দোষ হয়তো রাজ্জাক সাহেবের ও ছিলো কিন্তু সুভাসিনী বেগমের ছিলো না এমনটা নয়। আর রাজ্জাক সাহেবের শরীরটাও ভালো নয়। হার্টের রোগ ধরা পড়েছে। লাঙ্গস ও দূর্বল এই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেওয়াটা ছেলে হিসেবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো অনলদের বাসাটা অতি ছোট। দুটো রুম আর ড্রয়িং,ডাইনিং। এখন রাজ্জাক সাহেবকে কোথায় রাখবে ধারা বুঝে উঠতে পারছিলো না। তখন অনল একটা রেডিমেট খাট কিনে নিয়ে এসেছে। ফুপি এবং ফুপার সম্পর্কটা ঠিক কিভাবে করা যায় এটাই ভাবছে আর এক বড় বাটি আচার আর তরকারির চামচ নিয়ে খাটের উপর বসে আছে সে। চিন্তা করতে করতে আচার খাচ্ছে। আনমনে আচার খাচ্ছিলো তখন ই রুমে প্রবেশ ঘটে অনলের। ধারার হাতে এতো বড় বাটি দেখে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে,
– তুই আচার খাচ্ছিস নাকি সাঁতার কাঁটছিস?

কথাটা শোনামাত্র তড়িৎ গতিতে অনলের দিকে তাকায় ধারা। অনল তার পাশে বসতে বসতে বলে,
– একেই লিলিফুট, এই হারে খেলে একটা ছোট খাটো ফুটবল হয়ে যাবি। এমনিতেও ফুটবল ই লাগে তোকে।

বলেই গাল টিপে দেয় ধারার। অনলের কথা শুনে বেশ ক্ষেপে যায় ধারা। আচারের বাটিটা ছেড়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
– এই শোনো খোটা দিবে না, একদম খোটা দিবে না। কে বলেছিলো তোমাকে আমাকে এতো এতো দুধ, ডিম খাওয়াতে। ঠুসায় ঠুসায় খাওয়াবা আর এখন একটু আমার পছন্দের জিনিস খেলেই দোষ?
– দেখোছো প্রিন্সেস তোমার মাম্মাম কতোটা ঝগরুটে হয়ে গেছে। সারাক্ষণ এভাবে ঝগড়া করে তোমার বাবার সাথে।

অনলের কথায় একেবারে বেকুব বনে যায় ধারা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া অনল করলো আর মেয়ের কাছে ধারাকে দোষী বানাচ্ছে। এর সাথে কথা বলা মানেই অহেতুক কষ্ট। মুখ ফুলিয়ে চুপ করে বসে পড়লো ধারা। ধারার মুখ ফুলানো দেখে হো হো করে হেসে উঠে অনল। চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে অনল তখন বললো,
– তুই এতো কিউট কেনো বলতো? আচ্ছা শোন কালকে চেকাপ আছে কিন্তু সকালে। উঠে পরিস। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোলে হবে না।
– নিজে ঘুমায় আমাকে বলছে। দেখা যাবে আমার ই ডাকতে হবে। হাহ।
– ঠিক আছে মহারাণী। আমার ভুল। এই যে কান ধরলাম

অনলের কান ধরা দেখে মূহুর্তেই খিলখিল করে হেসে উঠে ধারা। লোকটাকে যে তার এতো ভালোলাগে বলে বুঝাতে পারবে না। অনল ধারার চঞ্চল হাসিকে মন ভরে দেখে। মেয়েটা ধীরে ধীরে মনে নিজের খুটি বসিয়েছে। মনের গহীনে নিজের বিস্তার করে নিয়েছে। এখন শুধু মনের কথাটা বলা বাকি________

সকাল ১১টা,
চেকাপ করিয়ে বের হয়েছে অনল ধারা। বাচ্চা এবং মায়ের রিপোর্টগুলো খুব ভালো এসেছে। তাই অনলের মন বেশ ভালো। রাস্তায় আইসক্রিম দেখেই ধারা আইসক্রিমের জিদ শুরু করলো। একেই কড়ারোদ, উপরে প্রেগ্ন্যাসির সময় একটু বেশি ই গরম লাগে। প্রথমে না করলেও ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন বাজি ধরতে পারবে অনল। আইসক্রিম তো একটা সামান্য ব্যাপার। বাধ্য হয়ে আইসক্রিম কিনে দিতে হলো। দু হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেতে লাগে ধারা। আর অনল এক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে। তখন ই এক জোড়া চোখ ধারাকে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে থাকে। এক রাশ বেদনা তার চোখে ফুটে উঠে।

ধারাকে বাসায় রেখে ডিউটিতে আসে অনল। মনটা আজ খুব ভালো অনলের; বাবাকে ফিরে পেয়েছে, ধারার শরীরটাও ভালো। এখন শুধু ডেলিভারিতে ঝামেলা না হলেই হয়। হঠাৎ……..

চলবে

কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
২২তম_পর্ব

ধারাকে বাসায় রেখে ডিউটিতে আসে অনল। মনটা আজ খুব ভালো অনলের; বাবাকে ফিরে পেয়েছে, ধারার শরীরটাও ভালো। এখন শুধু ডেলিভারিতে ঝামেলা না হলেই হয়। হঠাৎ একজন অচেনা পুরুষ তার সামনে দাঁড়ায়। পুরুষ বললে ভুল হবে, সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক। কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকে খুতিয়ে দেখে নিলো অনল। শ্যাম বর্ণের একটি যুবক, চুলগুলো উসকো খুসকো হয়ে আছে। চোখযুগল লাল বর্ণ হয়ে ফুলে আছে, চোখের নিচে কালি স্পষ্ট। চোখে মুখে মারাত্নক বিসন্নতা ভর করে আছে যুবকটির। অনল ভাবলো কোনো রোগীর এটেন্ডেন্ট হয়তো। যুবকটি অনলের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে শান্ত স্বরে বললো,
– অনল মাহমুদ?
– জ্বী, কিছু বলবেন?

যুবকটি মলিন হাসি হেসে বলে,
– বলার তো অনেককিছু আছে কিন্তু এই জায়গাটা কথাগুলো বলার জন্য সঠিক নয়। আপনার কি একটু সময় হবে? তাহলে কোথাও বসে কথা যেতো
– আমি আপনাকে চিনতে পারছি না, আপনি কি কোনো প্যাশেন্টের রিলেটিভ?
– জ্বী না, আমি আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিলো। একটু কি বাহিরে যাওয়া যায়?
– সরি, আমি ভেবেছিলাম আপনি রোগীর কেউ। আমি একটু ব্যাস্ত আছি। আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার কোনো জরুরি কথা থাকতে পারে।

বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই যুবকটি একটা কথা বলে যা অনলের পা আটকে দেয়।
– আমি দিগন্ত। ধারার গর্ভে আমার সন্তান ই বেড়ে উঠছে।

দুপুর ১২টা,
কফি শপে মুখোমুখি বসে রয়েছে দিগন্ত এবং অনল। অনলের চোয়াল শক্ত, মুখে তার কোনো কথাই নেই। কি বলবে বুঝছে না। দিগন্ত কফির কাপে একটা চুমুক দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবতা ভেঙ্গে অনল বললো,
– যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।
– ধারাকে আপনি ডিভোর্স দিন।

দিগন্তের ভাবলেশহীন ভাবে বলা কথা শুনে মূহুর্তেই অবাক হয়ে যায় অনল। রাগে গা রি রি করছে। ইচ্ছে করছে দিগন্তে ধরে কিছুক্ষণ কেলাতে। নিজেকে খুব কষ্ট করে সামলে জিজ্ঞেস করে,
– মাথা ঠিক আছে? নেশা টেশা করেন নাকি মশাই। সকাল সকাল মশকরা করছেন কেন?
– আমি মশকরা করছি না, আমি ধারাকে ফিরে পেতে চাই। আমার বাচ্চাকে ফিরে পেতে চাই। জানি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু সময় তো এখনো চলে যায় নি। তাই আপনার কাছে অনুরোধ করতে এসেছি। প্লিজ আমার ধারা আর বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিন।
– আপনি যাকে নিয়ে কথা বলছেন সে আমার ওয়াইফ। আর কোন বাচ্চার কথা বলছেন বলুন তো? ধারার গর্ভের বাচ্চাটিও আমার। সুতরাং অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করবেন না।

বলে উঠে যেতে নিলে দিগন্ত বলতে লাগে,
– ধারার গর্ভের বাচ্চার ছয় মাস দু সপ্তাহ চলছে। আর আপনাদের বিয়ের তো ছয় মাস হয়েছে। তাহলে সেটা আপনার বাচ্চা কি করে হয়? অন্যের পাপের ফসলকে নিজের দাম দিতে একবার ও খারাপ লাগছে না আপনার। যাক গে হয়তো ধারার প্রতি দূর্বল হয়ে এই কাজ করছেন। ভেবেছেন এতে করে ধারা হয়তো পটে যাবে। আসলে আমিও তো পুরুষ আমি জানি। আর এতো কিসের স্বামী স্ত্রী হবার বড়াই করছেন? সম্পর্কটা তো কাগজের একটা ঠুনকো সম্পর্ক। না ধারা আপনাকে ভালোবাসে না আপনি। ধারার মতো মেয়েকে কোনো ভদ্র ছেলে ভালোবাসতে পারবে না এটা আমি…..

কথা শেষ করার আগেই অনল বাঘের মতো হিংস্র হয়ে একটা ঘুষি দিয়ে বসে দিগন্তকে। দিগন্তের ঠোঁট ফেটে যায়। অনলের রুদ্র রুপ দেখে একটু ভড়কে যায় দিগন্ত। কফি শপের সবাই তাদের দেখছে। তারা আগ্রহের সাথে এমন ভাবে দেখছে যেনো কোনো নাটকের শুটিং চলছে। কলারটা টেনে দিগন্তকে দাঁড় করায় অনল। বজ্র কন্ঠে বলে,
– একটা বাজে কথা আর নয় দিগন্ত। নয়তো এখানেই পুতে ফেলবো। আজ তোদের মতো ছেলের জন্য না জানি কতো মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। কিছু মেয়ে ব্যতীত সব মেয়েরা আবেগের বশে বিশ্বাস করে নিজের সবচেয়ে দামী জিনিসটা বিসর্জন দেয়৷ কিন্তু যখন তোদের অকামের ফল তাদের গর্ভে বেড়ে উঠে, তখন দায়িত্ব নিতে তোরা ভুলে যাস। ফলটা ওই মেয়েটা আর আর তার পরিবারকে ভুগতে হয়। হয় তাদের আত্নহত্যার পথ বেঁছে নিতে হয় নয়তো ডাস্টবিনে কিছু অপরিণত শিশুর ফিটাস দেখি। আজ আমাকে সে কথাগুলো বলছিলি সেটা ছয় মাস আগে কেনো মনে ছিলো না। যখন ধারা তোকে বলেছিলো তার গর্ভে তোর সন্তান আছে। তোদের কিছু সময়ের ফুর্তি একটা মেয়েকে কলঙ্কিনী করে দেয়। সারা সমাজের ধিক্কার শুনতে হয়। সেদিন আমি ধারার হাত না ধরলে এখন ওর জীবনটাও তেমন হতো। এখন কোন মুখে আমার সামনে এই কথা বলছিস। আর একটা কথা আবার বলছি, আমি তোর মতো শরীরের খাঁজে ভালোবাসা খুজি না। আমি ধারাকে ভালোবাসি, শুধু তাই নয় যে আসছে তাকেও আমি মাথায় করে রাখবো ইনশাআল্লাহ। আমি ওদের আমার কাছ থেকে দূর হতে দিবো না। তাই অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না।

বলেই দিগন্তের কলারটা ছেড়ে দেয় অনল। রাগে গা রি রি করছে। দিগন্তের ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের রক্ত মুছে দিগন্ত বাঁকা হাসি হেসে বলেন,
– ধারার সব ডিসিশন দেখছি আপনি ই নিচ্ছেন। আমি তো আমার ভুল স্বীকার করছি৷ আর আমি ধারাকে অসম্ভব ভালোসি নয়তো ফিরে আসতাম না। সে এই ছয়মাস আপনার ওয়াইফ ছিলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর আমিও জানি ধারা আমাকে ভালোবাসে। তাই আপনার মনে হচ্ছে না নিজের মহত্ব দেখিয়ে আমাদের দুজনের মাঝে দেয়াল তৈরি করছেন আপনি। আর বাচ্চাটা আমার, আমার রক্ত। একজন বাবাকে তার বাচ্চা থেকে আলাদা রাখার অধিকার কি আপনার আছে? রক্তের একটা টান আছে। পালক বাবা পালক ই হয়।

দিগন্তের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় অনল। কোনো কথা না বলে কফি শপ থেকে বেড়িয়ে যায়। সে কি কোনো ভুল করছে! ধারাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই কি উচিত হবে? উফফফ মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে তার। ধারাকে নিজের থেকে আলাদা করার চিন্তায় মাথা আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকে একটা অজানা চিনিচিনে ব্যাথা হচ্ছে। হাহাকার করছে বুকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে কি করবে কিছুই বুঝে উঠছে না, মানুষ নিজের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিজেই আকড়ে যায়। এ থেকে নিস্তার পাওয়াটা খুব কষ্টকর।

সন্ধ্যা ৭টা,
বাসায় কেবল তিনটে প্রাণী, রাজ্জাক সাহেব, সুভাসিনী বেগম আর ধারা। মহুয়া এবং সুমনা বেগম চলে গিয়েছেন বিকেলে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে কোনো কথাই বলেন না সুভাসিনী বেগম। ধারা তাদের মাঝে একটা সেতুবন্ধনের ন্যায় কাজ করছে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে অবশ্য ধারার বেশ খাতির হয়েছে। সুভাসিনী বেগমের রাগ ভাঙ্গাতে সব চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। আজ বেলীফুলের মালা নিয়ে এসেছিলেন। যদিও সুভাসিনী বেগম সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন। রাজ্জাক সাহেব তবুও হার মানবেন না। ছাব্বিশ বছরের রাগ বলে কথা! ড্রয়িংরুমে বসে এইটা নিয়েই চিন্তা করছিলো ধারা। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ধারার ধ্যান ভাঙ্গে। ধীর পায়ে যেয়ে দরজাটা খুলতে দেখে দরজার ওপারে অনল দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ধারার পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায় সে। ধারার মনে অসংখ্য কৌতুহল জাগে কিন্তু চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে।

রাত ১১টা,
ধোঁয়ায় নিজের চিন্তাগুলো উড়াচ্ছে অনল। বারবার দিগন্তের বলা কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যতই অস্বীকার করুক বাচ্চাটা তো তার, তার রক্ত। রাজ্জাক সাহেবের এতো বড় অন্যায়ের পর ও রক্তের টানকে অস্বীকার করতে পারে নি সে। আচ্ছা ধারা কি এখনো দিগন্তকে ভালোবাসে? হতেই পারে, যার জন্য এতো বড় স্টেপ নিতে সে একবার চিন্তা করে নি। মাথাটা দপদপ করছে। ধারাকে হারাবার কথায় আরো বেশি এলোমেলো হয়ে পড়ছে দিগন্ত।
– কি নিয়ে চিন্তা করছো?

ধারার কথায় হুশ ফিরে অনলের। অনলের করুণ মুখটা দেখে বুকে কামড় পড়ে ধারার। শত যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অনল একবার বলতে চেয়েছিলো তার পর ও কিছু বললো না। মলিন হাসি হেসে বললো,
– কিছু না, এমনেই কাজ নিয়ে একটু স্ট্রেসড আছি।
– সত্যি?
– হু, তুই ঘুমাতে যা রাত হয়েছে।

কেনো যেনো অনলের কথাতে আশ্বস্ত হতে পারে না ধারা। এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো লুকাচ্ছো, যেখানে এতো স্ট্রেসের পর ও সিগারেট ধরাও না আজ কি এমন হলো সে একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাচ্ছো? কি হয়েছে আমাকে বলো
– আচ্ছা ধারা, রক্তের টান কি সব কিছুর উপরে হয়?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন?
– এই যে দেখ বাবা এতো বড় ভুল করা সত্ত্বেও আমি তার সামনে যেতেই দূর্বল হয়ে পড়লাম। নিজের রক্ত যদি ভুল করে তবুও কি তার টান মানুষ অগ্রাহ্য করতে পারে?
– অবশ্যই পারে না। যতই হোক রক্ত তো। আর নিজের বাবা-মা ভুল করলেও সন্তান হিসেবে তাদের দোষ ধরাটা আমাদের উচিত নয়। আফটার অল মা-বাবা তারা। তাদের কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো আমাদের পছন্দ হয় না, কিন্তু তাদের নিজেরও কিছু এক্সপ্লেনেশন থাকে। আমাদের নিজের দিকটা সবসময় না দেখে তাদের দিকটাও দেখা উচিত। ঠিক না? তুমি ফুপি-ফুপাকে নিয়ে চিন্তা করো নাতো। চলো ঘুমাতে।

বলেই নিজ রুমে চলে যায় ধারা। ধারার কথাগুলো যেনো আরো ঘেটে দেয় অনলকে। একজন বাবা আর সন্তানকে আলাদা করাটা কি সত্যি উচিত হবে। কিন্তু দিগন্ত যা করেছে তার পরে ধারাকে তার কাছে ফিরে যেতে দেওয়া মানে বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে অনলের, বাচ্চাটার জন্য এবং ধারার জন্য।

পাঁচ দিন পর,
একটা পার্কে ঘুরতে নিয়ে এসেছে অনল ধারাকে। বিকেলের দিকে পার্কে এসে ধারার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। তখন অনল হাটু গেড়ে বললো,
– প্রিন্সেস বাবা যা করছে তোমার এবং তোমার মাম্মামের জন্য। তোমার মাম্মাম যা সিদ্ধান্ত নিবে তোমার বাবা সেটা মেনে নিবে। একটা জিনিস মাথায় রেখো সোনা, তুমি আমার কাছে থাকো বা নাই থাকো আমার কাছে তুমি সবসময় আমার বাচ্চাই থাকবে।

অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here