কাগজের_তুমি_আমি দ্বিতীয়_অধ্যায়,১৯তম_পর্ব,২০তম_পর্ব

কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,১৯তম_পর্ব,২০তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৯তম_পর্ব

ধারা খেয়াল করলো তার বুকে যেনো কেউ ড্রামপিট বাজাচ্ছে। অনলের চোখে চোখে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে, যেনো চোর ধরা পরেছে। এখন এই রুমে একেবারেই থাকতে পারবে না সে। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি খেতে আসো আমি ফুপির কাছে গেলাম

কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে উঠতে গেলেই পেটে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলো ধারা। হঠাৎ ব্যাথাটা অনুভব করায় পা দুটো ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে নিলে দুটো হাত তাকে আগলে ধরে। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারাও খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। যখন তার হুশ ফিরে যখন দেখে তাকে পেছন থেকে অনল আগলে রেখেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অনলের বজ্রকন্ঠ তার কানে আসে,
– আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতি। বুদ্ধিটা হাটুতে থাকে নাকি? এখন সাড়ে ছয় মাস চলছে তোর প্রেগন্যান্সির। সাবধান থাকবি তো। আমি তো ভাবতেই পারছি না আমি যদি না সামলাতাম কি হতে চলেছিলো? সারাক্ষন দৌড়াদৌড়ি, আমার কথাগুলো তো কানে যায় না তোর। শান্তি লাগে না খুব আমাকে জ্বালাতে। সারাটাক্ষণ তোদের নিয়ে চিন্তায় থাকি। ইচ্ছে করছে একটা ঠাটিয়ে লাগাই। পাগল ছাগল! একটু আসতে উঠলে কি হতো? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতে ছিলাম? চুপ করে আছিস কেন?
– কি…কিক করেছে

ধারা কথাটা কানে যেতেই অনল যেনো একদম শান্ত হয়ে যায়। ধারা তখন ও পেটে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, যেনো সেও একটা ঘোরে রয়েছে। অনলের এতো বকাঝকা কিছুই তার কানে যায় নি। অনল আবারো শিওর হবার জন্য শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে?
– তোমার প্রিন্সেস কিক করেছে
– তুই শি…শিওর?
– হ্যা, হাতটা দাও।

বলেই অনলের হাতটা টেনে নিজের পেটে ছোয়ায় ধারা। তার চোখ জোড়া চকচক করছে। অনল যেনো অধীর আগ্রহে ওয়েট করে রয়েছে তার মেয়ের লাথি অনুভব করার জন্য। হঠাৎ কিছু অনুভূতি হতেই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠে তার। নিমিষেই ধারার উপর যত রাগ ছিলো সব গলে পানি হয়ে যায়। চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলতে থাকে,
– সি কিকড, ধারা সি কিকড। আমার প্রিন্সেস ফার্স্ট টাইম কিক করেছে।

বলেই ধারাকে জড়িয়ে ধরে অনল। হঠাৎ অনলের এমন কাজে ধারা যেনো বরফ ঠান্ডা হয়ে যায়। এক অন্য রকম শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই চলে, শিরদাড়া বেয়ে যেন উষ্ণ রক্তের প্রবাহ বয়ে যায়। খুশির জোয়ারে অনলের মনেই নেই সে ধারাকে জড়িয়ে ধরে আছে। যখন হুশ আসে তখন তড়িৎ গতিতে তাকে ছেড়ে দেয়। ধারার গালে রক্ত জমতে থাকে। মূহুর্তে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ হালকা করতে অনল স্নেহের সাথে ধারার পেটে হাত দিয়ে বলে,
– মাই প্রিন্সেস শুনতে পাচ্ছো, বাবা আজকে অনেক হ্যাপি। আর মাত্র কিছুদিন তারপর তুমি বাবার কাছে চলে আসবে। বাবা আর মেয়ে মিলে তোমার মাম্মামকে জ্বালাবো। তোমার মাম্মামটা অনেক পাজি, সারাক্ষণ বাবাকে টেনসন দেয়। একটু আগেও পাগলামি করেছিলো। তুমি আসলে আমাদের টিমটা ভারী হবে।
– এটা কি হচ্ছে?

মাজায় হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে ধারা বলে উঠে। অনল বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,
– এটা বাবা-মেয়ের কথা। তুমি মাঝে আসবি না

ধারা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। এই লোকটার সাথে সত্যি সে পেরে উঠে না। তবে মনে একটা খুশির ফুলকারি জ্বলছে। অনলের মুখের আনন্দটা যেনো ধারা এই খুশির কারণ। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন, প্রিয় মানুষটাকে আনন্দে দেখলে নিজেও কখন খুশি হয়ে উঠে বুঝে উঠে না মানুষ। আজ যেমন অনলের উচ্ছ্বাসিত মুখটি দেখে ধারার হৃদয়েও শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারোর দরজায় কড়া পড়লে তাদের বাস্তবে পদর্পন হয়। পেছনে তাকাতেই দেখে মহুয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ইতস্তত ভাবেই মেয়েটা বলে উঠে,
– সরি, আমি বোধ হয় ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আসলে মামি মা ডাকছিলেন। আমরা ডাইনিং টেবিলে ওয়েট করছি খেতে আসো তোমরা।
– তোরা খাস নি?
– না, আসলে মা তোমার সাথে খেতে চাচ্ছিলো। আমি যাচ্ছি

বলেই যেতে নিলে ধারা পেছন থেকে ডাক দেয় তাকে। নিজেকে ঠিক করে মহুয়াকে বলে,
– মহুয়া আপু, আমিও যাবো।

ধারার সাথে মহুয়ার তেমন কোনো কথাই হয় নি সারাদিনে। মহুয়া মেয়েটা খুবই চুপচাপ ধরনের মেয়ে। এবার ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে সে। ধারা খুবই অবাক হয় এটা ভেবে যে তার মাঝে সুমনা বেগমের কোনো প্রতিচ্ছিবি ই দেখা যায় না। এই সুযোগে যদি তার সাথে একটু খাতির হয় তো খারাপ হবে না হয়তো। তাই অনলের বাধন ছেড়ে তার সাথে চলে আসে। অনল ও বাধা দেয় না। যেতে যেতেই ধীর কন্ঠে মহুয়া বলে উঠে,
– ধন্যবাদ
– কেনো বলোতো মহুয়া আপু?
– না আসলে অনল ভাইকে অনেকদিন পর এতটা আনন্দিত দেখলাম। তাই, আরও একটা কারণ আছে। সেটা হলো মাকে সহ্য করার জন্য ও ধন্যবাদ। মা একটু এমন ই কিছু মনে করো না। আসলে মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো মামীর কাছে আমার আর অনল ভাই এর বিয়ের কথা বলার। সে আশায় তো পানি পড়লো তাই একটু খিচে আছে। তুমি চিন্তা করো না।
– আচ্ছা ফুপ্পি কি খেতে ভালোবাসে গো?
– রান্না দিয়ে মন জয় করবে?
– চেষ্টা করবো
– তাতে বেশি লাভ হবে না। তবে একটা কাজে লাভ হবে
– কি বলোতো?
– সময় হলে বলবো।

বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো মহুয়া। মেয়েটাকে খুব ভালো লেগেছে ধারার। নিজের সমবয়সী কাউকে পেলে কার না ভালো লাগে।

ডাইনিং টেবিলে,
অনল যখন খাবার খেতে ব্যাস্ত তখন ই সুমনা বেগম গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
– ভাবী, অনল আমার কিছু বলার আছে। যদি অনুমতি দেন তো বলি

সুমনা বেগমের এভাবে কথা বলার ধরনে বেশ অবাকই হন সুভাসিনী বেগম। সাধারণত এভাবে সুমনা বেগম কথা বলেন না। যা মুখে আসে তাই বলেন। কিন্তু এভাবে কথা বলার একটা মানে হতে পারে তিনি বেশ গুরুতর কিছু বলবেন হয়তো। অনল খাবার রেখে ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বলে,
– তোমার কথা বলার জন্য কখনো পারমিশন লেগেছে বলে আমার জানা ছিলো না। বলো না কি বলবে।
– কথাটা বেশ গুরুতর তাই এভাবে বলতে চাচ্ছি। আমাকে তোরা কেউ ভূল বুঝিস না। হুট করে ঢাকায় আসার কারন নিয়ে ভাবী বেশ কবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বলে উঠার সাহস হয়ে উঠে নি। কিন্তু না বলেও পারছি না। তাই আর কি পারমিশন চাচ্ছি।

সুমনা বেগমের কথা শুনে এবার একটু চিন্তিত হয়ে উঠেন সুভাসিনী। কি এমন কথা যা বলতে এতোটা ইতস্তত করছেন সুমনা বেগম। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই তিনি বলে উঠেন,
– সুমনা ভনিতা না করে বলো না কি কথা, কেনো হুট করে আসা তোমার ঢাকায়?

এবার ধীর কন্ঠে সুমনা বেগম বলতে লাগলেন,
– আমাকে ভুল বুঝো না ভাবী। আসলে আমি ঢাকা এসেছি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। ভাইয়া দেশে ফিরেছেন।

সুমনা বেগমের কথাটা শোনামাত্র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অনলের। চোখগুলো মূহুর্তেই রাগের অগ্নিতে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। পৃথিবীতে সে যদি কাউকে ঘৃণা নামক জিনিসটা করে থাকে তাহলে সেটা এই লোকটা। সম্পর্কে যিনি তার বাবা হয়। ধারা অনলের মুখের পরিবর্তনটা যেনো আচ করতে পারছে। অনলের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ধারার বুঝতে বাকি রইলো না সে তার রাগ সংযম করছে। অনলের প্রতিটা কাজের সাথে সে খুব ভালো করেই পরিচিত। হঠাৎ সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা তার কানে এলো,
– তোমার ভাইয়া এসেছে, তুমি তার সাথে দেখা করবে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমার রাগ করার তো কিছু নেই সুমনা। এ ব্যাপারটা আমাদের না জানালেও হতো।
– আসলে ভাবী….ব্যাপারটা শুধু এটা নয়। ভাইয়া তোমার আর অনলের সাথে দেখা করতে চায়। সেকারণে

তার কথাটা শেষ হবার আগেই অনল চিৎকার করে বলে উঠে,
– আমরা চাই না তার সাথে দেখা করতে। এতোদিন তো ভালোই ছিলাম আবার কেনো আমাদের জীবনে এসেছে সে। সে তো নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলো অন্য কারোর কাছে। তখন বউ ছেলের কথা মনে ছিলো না? আমার মাকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিলো না?

বলেই খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেলো সে। সেখানে বসে থাকলে হয়তো মেজাজটা আরো বিগড়ে যেতো অনলের। এমন একটা পরিস্থিতি কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। মহুয়া তখন চোখ দিয়ে তাকে ইশারা করে বলে যাতে অনলের সাথে যায়। ধারাও অনলের পিছন রুমে গেলো। অনলের যে রাগ কি করবে তার ঠিক নেই। এদিকে সুভাসিনী বেগম এখনো সেভাবেই ভাবলেশহীন ভাবেই বসে রয়েছেন। বেশ ঠান্ডা গলায় বলেন,
– আমার কাছে কি চাই তার? যা চেয়েছিলেন আমি তো সব দিয়েছি তাকে। তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন স্বামীর দায়িত্ব থেকে, বাবার দায়িত্ব থেকে। আমি দিয়েছি। শুধু তাই নয় আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি। বাড়ির বউ এর, স্ত্রীর, মার, ভাবীর সব দায়িত্ব। বিনিময়ে কি পেয়েছি আমি সুমনা? এখন এতো বছর পর তার আমার কাছে কি চাওয়া আছে। আমি কি দিতে পারি তাকে নতুন করে?
– ক্ষমা

সুমনা বেগমের কথাটা কর্ণপাত হতেই তার দিকে তাকান সুভাসিনী বেগম। তার ঠোঁট জোড়া কাপছে। ছাব্বিশ বছরে ক্ষতটা যেনো তাজা হয়ে উঠেছে। এতো কাঠখড় পুড়িয়ে যা মনের গহীনে পুতে রেখেছিলেন সেটা আবার খুচিয়ে রক্তক্ষরণ করছে হৃদয়ে৷ এতো বছর পর ও মানুষটার কথা শুনলে বুকে কষ্ট আর শুন্যতাগুলো ঘিরে ধরছে। সুমনা বেগম বেশ ধীর গলায় বলেন,
– ভাইয়া বেশ অনুতাপ করছে ভাবী। শেষবারের মতো তোমাদের দেখতে চায়। আচ্ছা ভাবী লোকটা একটা সুযোগ দেওয়া যায় না। অনল না হয় জানে না কিন্তু তুমি তো জানো তোমাদের ছাড়াছাড়ি টা হয় নি। তোমরা এখনো স্বামী স্ত্রী। লোকটা একা একা আর পারছে না ভাবী। হ্যা মানছি তোমার সাথে সে কম অন্যায় করে নি। কিন্তু
– তুমি আমার জায়গায় থাকলে কি করতে সুমনা? শফিক ভাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে? আমি নিঃস্ব সুমনা। তাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। ক্ষমাও নেই। অনল যদি তার সাথে দেখা করতে চায় তো ভালো। আমি বাধা দিবো না। ছেলে হয় সে তার। কিন্তু আমি তার সামনে যাবো না। একটা কথা কি জানো, ক্ষমা হয়তো করতাম যদি লোকটা আমার থাকতো। সে তো আমার কখনো ছিলো না। আর সম্পর্কের কথা বলছো। সেটা তো খালি কাগজের। সেটা থাকা বা না থাকাতে আমার কিছুই যায় আসে না সুমনা। আমি আর তাকে মনে জায়গা দিতে পারবো না। তোমাকে আমি কখনো তার বোন মনে করি নি। আমার ছোট বোনের মতো দেখেছি। তাই একটা অনুরোধ করছি, আমার কাছে তাকে নিয়ে কোনো অনুরোধ করো না। রাখতে পারবো না।

বলেই উঠে গেলেন সুভাসিনী বেগম। তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুমনা বেগম।

অপরদিকে,
নিজের সমস্ত রাগ ধোয়ায় উড়াতে লাগলো অনল। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। পাছে ধারার ক্ষতি হলে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই………

চলবে

কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
২০তম_পর্ব

নিজের সমস্ত রাগ ধোয়ায় উড়াতে লাগলো অনল। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। পাছে ধারার ক্ষতি হলে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই কারোর উপস্থিতি অনুভব হলে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে। পেছনে না ফিরেও ধারার উপস্থিতি খুব ভালো করেই অনল অনুভব করতে পারছে। থমথমে গলায় বলে,
– ধোয়ার মাঝে কেনো এসেছিস তুই? জানিস না এটা তোদের জন্য ক্ষতিকর। আর আমি একা থাকতে চাই

অনলের কথার মাঝেই ধারা বলে উঠে,
– আমি আসতে চাই নি, তোমার প্রিন্সেসই জোর করলো। তার বাবার মন মেজাজ খারাপ বিধায় তার ও মন খারাপ। কিন্তু এখন দেখছি এখানে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। থাক আমরা চলে যাই।

কথাটা বলার পরেও বেশ কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকে ধারা। ভেবেছিলো হয়তো অনল থেকে কোনো রেসপন্স পাবে। কিন্তু অনলের কোনো রেসপন্স না পেয়ে রুমের দিকে হাটা দিতে নিলে অনল বলে উঠে,
– একটু এখানে বসবি ধারা?

অনলের শান্ত গলায় বলা কথাটা সরাসরি বুকে যেয়ে লাগে ধারার। কথাটায় যেনো একগুচ্ছ বেদনা ছিলো যা চোখে দেখা না গেলেও খুব ভালো করে অনুভব করছে ধারা। ধীর পায়ে এগিয়ে ধীরে অনলের পাশে মেঝেতে বসে সে। আকাশে থালার ন্যায় বড় চাঁদ উঠেছে। বর্ষার আগাম জানাচ্ছে প্রকৃতি। থেমে থেমে ঝড়ো বাতাস বইছে, কিন্তু একটা বিকট থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারপাশে। ঝড়ের পূর্বাভাস হয়তো। অনলের হৃদয়ের ভেতরেও ক্ষণে ক্ষণে ঝড় উঠছে। কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করতে পারছে না। চোখ মুখ খিচে বাহিরে নজর স্থির করেছে অনল। ধারার নজর অনলের দিকে স্থির। অনলের চোখ পড়তে একটু ভুল হচ্ছে না ধারার। অনলের হৃদয়ের অব্যক্ত কষ্টগুলো যেনো খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারছে সে। দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে রয়েছে কিন্তু কারো মাঝে কোনো কথা নেই। শেষমেশ নীরবতা ভেঙ্গে ধীর কন্ঠে বলে,
– কেনো নিজের সাথে যুদ্ধ করছো অনল ভাই?
– নিজের সাথে তো যুদ্ধ করার কিছু নেই, এতোদিন যেহেতু তার অস্তিত্ব আমার জীবনে ছিলো না সেহেতু নতুন করে তাকে জীবনে প্রবেশ করানোর তো কোনো মানে নেই। আমি তার সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করবো না।
– তাহলে এতোটা অস্থির হয়ে আছো কেনো? তোমার চোখের ভাষা আর মুখের ভাষা মিলছে না কেনো? আমি বলি কারণটা? তুমি তার সাথে দেখা করতে চাইছো। ফুপির প্রতি, তোমার প্রতি করা প্রতিটা অন্যায়ের উত্তর চাইছো। কিন্তু তার মুখোমুখি হতে একটা ভয় হচ্ছে তোমার, পাছে তাকে ক্ষমা করার ইচ্ছে জাগলে? তাই না অনল ভাই? আমি কি ভুল বলেছি?

ধারার কথাটা শুনেই চুপ হয়ে যায় অনল। ছলছল নয়নে ধারার দিকে তাকায় সে। ধারার চোখেও আজ অশ্রু। এই অশ্রুটা খুব ছোয়াচে, সেটা সুখের হোক বা দুঃখের; কাউকে অশ্রুসিক্ত দেখলেই আপনাকে অশ্রুপাত করতে বাধ্য করবেই। আপনি তখন অপর মানুষটির অনুভূতিগুলো হৃদয় থেকে উপলদ্ধি করতে পারবেন। ধারার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। অনলের চোখের ধারাগুলো তাকেও কাবু করে ফেলেছে। হুট করেই ধারার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকালো অনল৷ নিজের কষ্টের জোয়ারটাকে বাধ ছেড়ে দিলো। জড়ানো গলায় বলতে থাকে,
– কোনো বাবা এতোটা স্বার্থপর হয় ধারা? আমার বয়সটা কত তখন বল সাত থেকে আট হবে। সেই বয়সটাতে আমাকে বাবা ছাড়া কাটাতে হয়েছে। জানিস ধারা, ক্লাস শেষে যখন বন্ধুদের তাদের বাবারা নিতে আসতো আমিও বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম। মাকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারতাম না, কারণ প্রায় রাতে তাকে কাঁদতে দেখেছি। একদিন মা আমাকে ডেকে বললো, আমাকে তার আর বাবাকে একজনকে বেছ নিতে হবে। বাবা আর মার নাকি ডিভোর্স হচ্ছে। ডিভোর্স মানেটাও বুঝতাম না তখন। শুধু একটা কথা বুঝেছি, হয় মা নয় বাবা। আচ্ছা তুই বলতো ধারা আমার সাথে এমন কেনো হয়। তুই কল্পনাও করতে পারবি না কতটা খারাপ লাগতো। খুব কাঁদতাম আড়ালে যাতে মা না দেখে। তুই বিয়ের আগে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলি কেনো তোর সাথে আমার জীবনটা জড়াচ্ছি। কেনো তোর অবৈধ বাচ্চাকে আমার নাম দিতে চাচ্ছি। আজ তোকে তার উত্তর দিচ্ছি, আমি চোখের সামনে আরেকটা অনল দেখতে চাই নি। বাবা ব্যতীত কোনো বাচ্চার অবস্থা কেমন হয় আমি খুব ভালো করে জানি। দেখিস আমি মোটেও ওই লোকটার মতো হবো না, আমার প্রিন্সেস্কে খুব আগলে রাখবো। আমি যা পাই নি সব কিছু ওকে দিবো। দেখিস।

ধারার কাপড় ভিজে এসেছে অনলের অশ্রুতে। তবুও ধারা কিছুই বলে নি। চুপচাপ শুধু অনলের অভিযোগ গুলো শুনে গেছে। নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো সে। প্রলাপ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো অনল তা নিজেও জানে না। ধারা সেখানে ঠায় বসা। তার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে অনল। চোখের পানিগুলো এখনো শুকায় নিয়ে। চাঁদের আলোতে মারাত্মক সুন্দর লাগছে অনলকে। জ্যোৎস্নার আলোতে যেনো কোনো স্বর্গীয় দেবদূতের দেয় লাগছে তাকে। শ্যামবর্ণটাও ধারার কাছে সব থেকে পছন্দের হয়ে উঠেছে। কপালে চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। ভারী প্ললবের চোখগুলো যেনো নিপুন হাতের কোন শিল্প। লোকটার প্রতিটা কণায় যেনো মাদকতা, মায়ার মাদকতা। ইশশ ধারার ভাবতেও লজ্জা লাগছে চোরের মতো নিজের বরকে দেখছে। সময়টা যদি এভাবেই থেমে যেতো খুব খারাপ হতো কি! হয়তো হয়তো না______

নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুভাসিনী বেগম। দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির। ভেবেছিলেন মনটা অস্থির হবে, কিন্তু অস্বাভাবিক রকম স্থির তার মন। চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। কাঁচাপাকা চুলগুলো বাতাসের তালে উড়ছে। একটা সময় এই চুলে কত না বেলী ফুলের মালা বেধেছিলেন ওই লোকটার জন্য। কিন্তু সে সব কিছুই অতীত। মনটা যে এখনো সেই লোকটার প্রতি বেহায়া নয় তা নয়, কিন্তু আত্নসম্মানের দোহাই দিয়ে মনটাকে আটকে রেখেছেন তিনি। আচ্ছা সেই ভুলগুলো আমরা করি কেনো যে ভুলগুলোকে চাইলেও ক্ষমা করা যায় না। কি দোষ ছিলো সুভাসিনী বেগমের! এটাই যে সে সবকিছু উজার করে রাজ্জাক সাহেবকে ভালোবেসেছিলেন। সেটার প্রতিদান তাকে পেতে হয়েছে। এখন কি চাইলেও সেই ক্ষত ভরা যাবে? ক্ষমা, সেটাতো তার উপর করা যায় যার উপর রাগ থাকে, অভিমান থাকে। আফসোস আজ রাজ্জাক সাহেবের প্রতি তার মনে নেই কোনো মান নেই কোনো অভিমান। আজ রাতটা নির্ঘুম ই কাটবে যেমনটা কেটেছিলো ছাব্বিশ বছর আগে____________

সকাল ৭টা,
কড়া রোদের কিরণ চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেলো অনলের। চোখ পিটপিট করে খুলে দেখলো বারান্দার মেঝেতে শুয়ে আছে সে। মাথাটা হালকা নাড়াতেই বুঝতে পারলো তার মাথাটা ধারার কোলে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে। এবার লক্ষ্য করলো, ধারা ঠায় মেঝেতে বসে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটা সারাটারাত এখানেই বসে ছিলো। পরণে সাদা ম্যাক্সি আর লাল ওড়না। পেটটা অসম্ভব বড় হওয়াতে বাসায় সালোয়ার কামিজ আর পড়া হয় না তার। সূর্যমামার বেহায়া রশ্নি তখন ধারা পুতুলের মতো মুখ আর হাতে খেলে যাচ্ছে। কবিরা বলেন ঘুমন্ত নারী নাকি সবথেকে সুন্দরী হয়। সেটার প্রমাণ অনল পাচ্ছে। ধারার ঘুমন্ত মুখটি যেনো তার খরা হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায়। গোলাপের পাঁপড়ির মতো পাতলা ঠোঁটজোড়া যেকোনো পুরুষকে কাবু করে দিতে পারবে। আর ঠিক তার উপরে নজরকাটার মতো তিলটা। নজরকাটা কম নজরকাঁড়া বেশি বলা যায়। অজান্তেই অনলের ওষ্ঠজোড়া ধারা ঠোঁটের কাছে চলে গেলো। যেনো এক ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছে সে। হঠাৎ কি মনে করে কপালে টুপ করে উষ্ণছোয়া দিয়ে দিলো অনল। ঠোটে একটা প্রশান্তির হাসি একে চট করেই কোলে তুলে নিলো ধারাকে। মেয়েটা তখন বিড়ালছানার মতো কারো অনলের বুকে মিশে গেলো। অনল খুব ধীরে ধারাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আজ অনেক বড় কাজ আছে তার। অনেক প্রশ্নের উত্তর খোজা বাকি যে।

বিকেল ৪টা,
আজ অনল ডিউটি নেই, তবুও সেই যে সকালে বেরিয়েছেন এখনো ফিরে নি সে। ধারাকেও বলে বের হয় নি। যখন ধারার ঘুম ভেঙ্গেছে তখন অলরেডি অনল বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে একটা চিরকুট টেবিলে রেখে গিয়েছিলো সে। সেখানে লিখা,
” আমার জন্য খবরদার ওয়েট করবি না। আমার কাজ আছে, কখন আসবো ঠিক নেই। তোর ডায়েট লিষ্ট মার কাছে দেওয়া। যদি এসে শুনি দুধ আর ফল খাবার ব্যাপারে ক্যাত ক্যাত করছিস তো ঠাডায় থাপড়া খাবি। মা যখন যে খেতে দিবে খাবি৷ আর কোনো লাফালাফি করবি না। মহুয়াকে রাখছি তোর নজরদারিতে। যদি শুনছি ট্যা টু করছোস তো খবর আছে। আর শোন না থাক এসে বলবো নে, প্রিন্সেস আর তার মাম্মামের খেয়াল রাখিস।”

চিরকুটটা পড়ে কি সুখের আপ্লুত হওয়া উচিত নাকি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলা উচিত বুঝে উঠতে পারে নি ধারা। কারোর প্রতি এতোটা মিশ্র ফিলিং হওয়া সম্ভব এটা অনলের তার জীবনে প্রবেশের আগে জানা ছিলো না ধারার। সোফাতে বসে মহুয়ার সাথে গল্পে মশগুল ধারা। আজ অবশ্য সুমনা বেগম তার কোনো খুত ধরে নি। ব্যাপারটায় খানিকটা অবাক ও হয়েছে ধারা। কৌতুহল মেটাতেই মহুয়াকে বলে উঠে,
– আচ্ছা, ফুপ্পি কি হয়েছে গো?
– কেনো বলতো?
– আজ আমার সাথে কোনো খোটাখোটি বাধে নি তার। তাই জিজ্ঞেস করলাম
– হাহা, বলেছিলাম না মাকে অন্যভাবে পটাতে হবে।
– মানে?
– মানে হলো, আমার মা বরাবর ই রাজ্জাক মামার প্রতি দূর্বল। সেকারণে অনল ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসাটা মারাত্নক। তিনি মামা-মামীর ছাড়াছাড়ি টা কখনো মেনে নেন নি। আজ যখন অনল ভাই সকালে মামার নাম্বার চেয়েছিলো তখন মা যেনো মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পেয়েছিলেন। অনলভাইকে যখন তার মনোভাব বদলের কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে তখন অনল ভাই কি বলেছে জানো?
– কি?
– ধারার জন্য আমি এ কাজ করছি
– কিহ?
– হ্যা! তুমি সাহস না দিলে নাকি সে কখনোই মামার সাথে দেখা করতো না। যদিও এটা ও বলেছে যে সে মামাকে ক্ষমা করবে না। শুধু শেষবারের মতো দেখা করা।

মহুয়ার কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায় ধারা। অবাক হয়ে বলে,
– ফুপি জানে? অনল ভাই ফুপার সাথে দেখা করতে গেছে?
– মামী মার সামনেই কথা হয়েছে। মামী মার রিয়েকশন খুব স্বাভাবিক।
– মহুয়া আপু যা বল তা বল, ফুপাকে ক্ষমা করা যায় না। উনি যা করেছেন। আর যেহেতু ডিভোর্স হয়ে গেছে।
– আরেকটা সিক্রেট শুনবা?

ধারার কথার মাঝেই মহুয়া বলে কথাটা। কৌতুহলে চকচক করে উঠে ধারার চোখ। অধীর হয়ে বলে,
– কি সিক্রেট?
– মামা আর মামীমার ডিভোর্স হয় নি। আর মামাও ওই মহিলাকে বিয়ে টিয়ে করেন নি। এটা অবশ্য মামী মা জানেন না। আসলে মা কথাটা বলতেই পারে নি। এখন মা তোমাকে নিজের দলে ভিড়াতে চান। আসলে মার দোষ ও নেই। মামার শরীরের অবস্থা ভালো নেই। গ্লানির বোঝায় এতোদিন মামী আর অনল ভাই এর কাছ থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু জীবনের প্রদীপটা নিভতে বসেছে তার। তাই শেষবার এই পরিবার নামক মরীচিকাকে আগলে ধরতে চান তিনি। তাই মা তাকে সাপোর্ট করছেন। আচ্ছা ধারা তোমারও মনে হয় একটা সুযোগ তার প্রাপ্য নয়?
– জানি না মহুয়া আপু, এই সুযোগ পাওয়া উচিত কিংবা অনুচিত এর মাঝে না একটা খুব পাতলা দেয়াল আছে। আমি সত্যি জানি না। আমার মনে হয় ডিসিশনটা অনল ভাই আর ফুপির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এতে আমাদের না পড়াই ভালো।

মহুয়া আর কথা বাড়ালো না। ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে তাদের ধ্যান ভাঙ্গে। মহুয়া উঠে দরজাটা খুলে। এদিকে নিজের রুম থেকে উঠে আসেন সুভাসিনী বেগম। মনটা কেনো যেনো অস্থির লাগছিলো তার। দরজার কাছে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো তার। দরজার ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ তার কানে আসলো,
– সুভা…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here