কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,১১তম_পর্ব,১২তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১১তম_পর্ব
ধারার উচ্ছলতা দেখে অনলের ও ভালো লাগছে। এখন তার মন ভালো থাকাটা অধিক দরকার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
– থাক আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।
বলে যেতে নিলেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে ভেসে আছে। শব্দের দিকে লক্ষ্য করে অনল এবং ধারার দরজার দিকে তাকাতেই দেখে সুরাইয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছেন ফলের প্লেট হাতে। বেশ ইতস্তত ভাবে সুরাইয়া বেগম বলেন,
– আসবো?
অনল হাসিমুখেই তাকে বললো,
– আরে মামী মা, আপনার মেয়ের ঘরে আপনি ঢুকবেন পারমিশনের কি আদৌ দরকার আছে? আসেন না। আচ্ছা আপনি কি তখন আমার কথায় রাগ করেছেন?
– না না রাগ করবো কেন?
বেশ অপ্রস্তুত ভাবেই সুরাইয়া বেগম বলেন। অনল তার ইতস্তত ভাব কাটাতেই বলে উঠে,
– আমার বেয়াদবির জন্য ক্ষমা করে দিবেন মামী মা, বুঝতে পারি নি।
– না না কি যে বলো, বেয়াদবী কোথায় করলে৷
– তাহলে ক্ষমা করেছেন তো
– আরে কি যে বলো তুমি
– তাহলে আমি আসি মামী মা, আসতে রাত হবে। ধারার দিকে খেয়াল রাখবেন প্লিজ আসি। ধারা আসলাম
বলেই বেড়িয়ে পড়ে অনল। ধারা অনলের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটাকে আজকাল আর অসহ্য লাগছে না, অসহ্য লাগছে না বললে ভুল হবে। লাগছে, তবে ভালো ও লাগছে। তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে সুরাইয়া বেগম বলে উঠেন,
– ফলগুলো খেয়ে নে, জানি তোর ফল পছন্দ না কিন্তু এ সময় ফল, দুধ, মধু এগুলো খেতে হয়।
সুরাইয়া বেগমের কথাটা যেন অমৃত এর মতো কাজ করলো। প্রায় দু সপ্তাহ পর তার মায়ের বুলি শুনছে। এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া হয়তো এ জীবনে তার আর হয় নি। সে কল্পনাও করে নি তার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক পুনরায় আগের মতো হবে। ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে ধারা। অনুভূতি গুলো সব গলায় আটকে আছে। কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ শুধু কেঁদে মন হালকা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই পিছ পা না হয়ে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। হু হু করে কাঁদতে শুরু করে সে। সুরাইয়া বেগম ও কাঁদছেন, মেয়েকে কতদিন এভাবে কাছে ডাকেন নি তিনি। কোনো কথা নেই শুধু অশ্রু দিয়েই নিজেদের মান অভিমান গুলোর সমাপ্তি করছে মা-মেয়ে। আসলে কিছু সম্পর্কে কথার প্রয়োজন হয় না। সম্পর্কটাই এমন হয় যে তাতে কিছু না বলেও অনুভুতির প্রকাশ করা যায়। মা-মেয়ে কতোক্ষণ এভাবে অশ্রুপাত করেছেন নিজেরাও জানে না। শুধু নিজেদের মাঝের অদৃশ্য দেয়াল ভাঙ্গতে ব্যস্ত তারা। আজ এই ঘটনা শুধু একজনের চেষ্টায় সম্ভব হয়েছে তা হলো অনল। অনলের প্রতি কৃতজ্ঞতাটা অন্য রুপ নিচ্ছে কিন্তু ধারা নিজেও সেটা বুঝতে পারছে না___
বিকেল ৪টা,
সুরাইয়া বেগম জলপাই এর আচার বানাচ্ছেন। ধারার এখন টক খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আর তার জলপাই এর আচারটা খুব ই পছন্দ। যেহেতু শীত কাল তাই সুরাইয়া বেগম ও জলপাই যোগাড় করে আচার বানাতোতে মেতে উঠেছেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে আচার বানাচ্ছেন আর পাশে ধারা কাঁচা জলপাই লবণ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। তখন হুট করেই সুরাইয়া বেগম বলে উঠলেন,
– অনল তোর অনেক যত্ন করে না রে?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
সুরাইয়া বেগমের কথায় বেশ অবাক হয়েই কথাটা বলে ধারা। সুরাইয়া বেগম তখন মুখে হাসি টেনে বলেন,
– চুল আমার হুতাশে পাকে নি। অনলকে ছোট কাল থেকে দেখে এসেছি। পাঁচ বছর আগে যা হয়েছিলো তার পড়ে সে যে বিয়ে করবে এটাই আমরা ভাবতে পারি নি। কিন্তু আমাদের অবাক করে সে তোকে বিয়ে করেছে। তার উপর তোর মাথায় একটা বট গাছের মতো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই এই প্রশ্নটা করলাম
– মা, একটা কথা বলি?
– হু বল
– অনল ভাইয়ের কাছে তোমরা বেশি কিছু আশা করো না
– কেনো বলতো?
খুন্তিটা পাশে রেখে ধারার দিকে ফিরে সুরাইয়া বেগম কথাটা বলেন। তার প্রশ্নের উত্তর স্বরুপ ধারা বলে,
– অনল ভাই যা করছেন একটা ভালো মানুষ হিসেবে করছেন। আসলে কি বলোতো, জীবন তাকে এতোটা আশাহত করেছে যে সে এখন অন্যের জীবনের আশা হয়ে বাঁচতে চান। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, সে সত্যি খুব ভালো মানুষ। নয়তো আমার মতো পাপীকে এতো সম্মান দিতো না। কিন্তু এই জিনিসটার সুযোগ নিতে চাই না। আমি তার বোঝ হতে চাই না। ফুপির জন্য সে আমাকে সাহায্য করছেন, আমার বাচ্চাকে নাম দিচ্ছেন ব্যাপার গুলো আমার জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি তো মরে যেতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ফেরেস্তার মতো আমার জীবনে আসলেন। সত্যি মা, আমি চাইনা তিনি আর কিছু করুক। যা করেছেন বা করবেন তাই আলহামদুলিল্লাহ। আমার আর কিছু চাই না। তুমি হয়তো ভেবেছো সে আমাকে ভালোবাসে বিধায় এতোটা সাহায্য করছে। কিন্তু সত্যি বলতে সে এখনো অতীত থেকে বের হয় নি। আমি জানি না তার অতীতটা কি, বা কেমন, তবে সেই অতীতের জন্যই সে আজ নিজের ভেতরে কুড়ে কুড়ে আছে। তাই আমি শুধু এটুকু জানি আমি তার কাছে কখনো কিছু দাবি করবো না। সে যদি কোনোদিন আমাকে বলে তার পিছু ছেড়ে দিতে আমি হাসি মুখে তা করবো। আমি তার বোঝ হয়ে চাই না। না চাই আমার বাচ্চা সেটা হোক।
ধারার কথা শুনে সুরাইয়া বেগম মুখের কোনায় হাসি টেনে বলেন,
– একটা কথা বলি?
– হ্যা বলো
– কথাটা শোন তারপর বুঝার চেষ্টা করে কাজে লাগানোর চেষ্টা করিস। তোর জীবনে যেমন অনল ফেরেস্তা, অনলের জীবনেও তুই ঔষধির মতো। অনল অনেকটা পালটে গেছে। হয়তো তোর জন্য, বা বাচ্চাটার জন্য বা পরিস্থিতির জন্য। একটা সময় অনল কারোর সাথে ঠিক মুখে কথা বলতো না। বিশেষ করে, ওই ঘটনাটার পর। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা না শুধু বিছানায় সীমাবদ্ধ নয়। সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, বোঝাপোড়ার। একসাথে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়ার। অনল আজ তোকে যে সাপোর্ট টা দিচ্ছে সেটা প্রত্যেকটা স্বামীর ই করা উচিত। অনল এই বিয়েটা মানে কিন্তু স্বামী হিসেবে সকল দায়িত্ব সে পালন করে যাচ্ছে। তাই তোকেও বলবো, স্ত্রী হিসেবে তোর দায়িত্বগুলো পালন কর। দেখ তুই জীবনে অনেক ভুল করেছিস, কিন্তু ভুলআনুষের জীবন আটকে রাখে না। তাই অতীতকে ফেলে এগিয়ে যা। অনল যেহেতু তোর অতীত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, তাই আমি বলবো তুইও ওর অতীতের মাঝে ওকে ঢুবে থাকতে দিস না। স্ত্রী না বন্ধু হয়ে ওর পাশে দাঁড়া। তোরা দুজন অপূর্ণ মানুষই পারবি নিজেদের পূর্ণ করতে। ভেবে দেখিস আমার কথাটা। মা তো তোকে খারাপ বুদ্ধি কখনো দিবো না। অনলের জীবনে বোঝা না বরং বন্ধু হতে চেষ্টা কর। একটা আলো হিসেবে ওর বেরঙ জীবনকে আলোকিত কর। চেষ্টা করে দেখ। দেখবি ঠিক পারবি।
বলেই আবার আচার বানাতে মন দেন সুরাইয়া বেগম। তার কথাগুলো অনেকটাই সুভাসিনী বেগমের সাথে মিলে যাচ্ছে। প্রতিটি কথা ধারাকে মন দিয়ে ভাবাচ্ছে। সে আসলে পারবে অনলের জীবনে বোঝা না হয়ে বন্ধু হয়ে উঠতে! সে কি পারবে এই কাগজের সম্পর্কটা সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রীর রুপ দিতে!
রাত ১০টা,
ডাইনিং টেবিলে বসে রয়েছে ধারা। সুরাইয়া বেগমের কথাগুলো শোনার পর থেকে ধারা বেশ চিন্তা করেছে। কৃতজ্ঞতার ক্ষাতিরে হলেও অনলের প্রতি সব দায়িত্ব সে পালন করবে। নয়তো কেবল মাত্র বোঝা ব্যাতীত অনলের জন্য কিছুই হবে না। অনল এখনো বাড়ি ফিরে নি, ফোন করতে চেয়েছিলো কিন্তু অনলের ঝাড়ির ভয়ে ফোন দেয় নি। সময়ের সাথে অপেক্ষার প্রহর টা বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে তার। দৌড়ে দরজা খুলতেই দেখে বিধ্বস্ত অবস্থায় অনল দাঁড়িয়ে আসে। লোকটা সেই সকালে গিয়েছে আর এখন এসেছে। লোকটার এই করুন মুখটা দেখে ধারার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজকের দিনটা ভালো যায় নি অনলের, হাতের উপর একটা রোগী মারা গেছে। চেষ্টা করেছিলো কিন্তু বাঁচাতে পারে নি। লোকটার বয়স চৌত্রিশের কাছাকাছি, অনলের থেকে বছর তিন বড়। অথচ যায়গায় হার্ট এট্যাক হয়ে মারা গেছে। অনলের হাতে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে অনেকটা ডিস্টার্ভড হয়ে যায় সে। তাই এক মিনিট দেরী না করে বাসায় চলে এসেছে সে। বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ির কলিংবেল টিপতেই ধারা দরজাটা খুলে। নীল শাড়িতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। কেনো যেনো সামনে থাকা রমনীকে দেখে অজান্তেই তার অগোছালো দিনের স্বস্তির পরশ বয়ে গেলো। কিন্তু পর মূহুর্তে কিছু ভেবে গট গট করে ভেতরে চলে গেলো সে। তোয়ালে এবং ট্রাওজার নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে নিলেই ধারা পেছন থেকে বলে উঠে,
– খাবার গরম করি?
কথাটা শুনে পিছনে না ফিরেই বলে,
– আমার খাওয়া নিয়ে তোর ভাবতে হবে না, আমি পরে খেয়ে নিবো।
বলে চলে যেতে নিয়েও আবার থেমে যায়, পেছন ফিরে বলে,
– তুই খেয়েছিস?
ধারা কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উত্তর দেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল নিচু গলায় বলে,
– তুই খাবার নিয়ে আয়। টেবিলে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না।
বলেই ওয়াশরুমে চলে যায় অনল। সে রাতে অনল তেমন কোনো কথা বলে নি ধারার সাথে। ধারা একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করে নি। তার মনে হয়েছে অনলকে এখন একটু একাকিত্ব সময় দেওয়া উচিত। রাতটা নিশ্চুপ কাটে তাদের। রাতের নীরবতা তাদের সম্পর্কের মধ্যেও বিরাজমান। এখন সকালের অপেক্ষা।
সকাল ১১টা,
অনলদের বাড়িতে চলে এসেছে অনল-ধারা। সুরাইয়া বেগম এবং সেলিম সাহেব উভয়ের ই মন খারাপ লাগছিলো কিন্তু মা-বাবার তো মেনে নিতেই হবে। মেয়ে তো বড় হলে অন্যের বাড়িতে চলেই যায়। এটাই নিয়তি। অনলের বাড়ি আসার সাথে সাথে সুভাসিনী বেগম তাকে অনলের ঘরে পাঠিয়ে৷ দেন। ধারাও কোনো অমত পোষন করে নি। রুমে যেয়ে দেখে অনল নেই, হয়তো ওয়াশরুমে আছে। আজকেও তার ডিউটি আছে। তাই ধারাও আলমারি খুলে তার কাপড় বের করে দিতে থাকে। হঠাৎ একটি ছবি কাপড়ের ভেতর থেকে নিচে পড়ে যায়। ছবিটা হাতে নিয়ে পাল্টালে দেখে………..
চলবে
কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
১২তম_পর্ব
হঠাৎ একটি ছবি কাপড়ের ভেতর থেকে নিচে পড়ে যায়। ছবিটা হাতে নিয়ে পাল্টালে দেখে একটি হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মুখে চাঁদের মতো উজ্জ্বল হাসি। হরিণা চোখের শ্যামবর্ণের মেয়েটির কি মায়াবী না চেহারা! এই মায়াবী চেহেরায় যে কেনো নিজেকে ভাসিয়ে দিবে। ছবিটি বেশ যত্ন করে কাগজের ভাজে রাখা। ছবিটির নিচে একটি ডেট দেখা যাচ্ছ তাহলো ০৮.০৯.২০১৪. কে এই মেয়েটি? যার ছবি এতোটা যত্ন করে দেখে দিয়েছে অনল। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কটা খুব কাছের। কিন্তু মেয়েটি কে এবং সম্পর্কটা কি তাদের এটাই বুঝে উঠতে পারছে না।
– তোকে আমি বলছিলাম মায়ের ঘরে থাকতে? এখন তো কোন মেহমান নেই তাহলে আমার ঘরে কি করছিস?
শক্ত কন্ঠে অনলের বলা কথাটা কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকায় ধারা। ধারার হাতে ছবিটা দেখতেই চট করে মেজাজ হয়ে যায় অনলের। ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। সাধারণ মুখটায় একটা হিংস্রতায় ভরে উঠলো। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে কন্ঠে বলে,
– আমার আলমারিতে হাত দিয়েছিলি?
হঠাৎ করেই এক ঝাক ভয় মনে এসে ভিড়লো ধারার। অনলের খিটখিটে মেজাজ এবং ঠেস মেরে কথা বলার সাথে আগ থেকে পরিচিত হলেও কেনো জানে এই মূহুর্তে সামনে থাকা মানুষটি একদম ই অচেনা লাগছে ধারার কাছে। আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্ষিপ্র গতিতে তার কাছে এসে খপ করে ছবিটা হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় অনল। ধারা উপায়ন্তর না দেখে বলতে লাগে,
– আ…আসলে
– তোর সাহস কি করে হলো আমার জিনিসে হাত দেওয়ার? আমি তোকে পারমিশন দিয়েছি তোকে?
– না, আ…আমি
– তুই কি? লজ্জা লাগে না তোর? এক মিনিট, এক মিনিট। তুই কি এতোদিন আমার ভালো ব্যাবহারের কারণে ভাবছিস আমি তোকে মেনে নিয়েছি? আমার নিজের স্ত্রী হিসেবে মন থেকে মেনে নিয়েছি আমি? তুই কি গাধা? একটু ভালো ব্যাবহার করলেই গলে যাস? কি ভেবেছিস এই কদিন তোর সাথে একটু ভালো ব্যাবহার কি করেছি আমি তোকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি? এতো সোজা ভালোবাসা? কান খুলে শুনে নে, তুই শুধু এবং শুধু আমার বাড়িতে আমার বউ হয়ে এসেছিস আমার মা চেয়েছে বলে। আমার মনে কোনোদিন তোর কোনো জায়গা এক মূহুর্তের জন্য ও তৈরি হয় নি। আর কোনোদিন তৈরি ও হবে না।
-…….
– সেদিন তোর বাবা-মার সামনে বড় গলায় তোকে নিজের বউ আর তোর বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চা বলে দাবী করেছি বলে তুই তো দেখি আকাশে উড়ছিস। কি ভেবেছিস আমি তোকে ভালোবাসতে লেগেছে। তোর সত্যি বুদ্ধিজ্ঞানটাও নেই। তোর মত মেয়েকে আমি ভালোবাসতে পারি আদৌ? সেটাকি মানাবে? এখন ই বেড়িয়ে যা আমার রুপ থেকে। নিজের জায়গাটা ভুলে যাস না। তুই মায়ের জন্য এ বাড়ির বউ হতে পারিস। আমার জন্য শুধুমাত্র একজন আশ্রিতা।
অনলের কথা শেষ হবার আগেই মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো ধারা। আর এক মূহুর্ত সেই রুমে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো। অনলের কথাগুলো মোটেই ভুল নয়, এটা বারবার মানতে চেয়ে নিজেকে বুঝাচ্ছে ধারা। কিন্তু তবু ও মনে হচ্ছে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চোখ গুলো ভিজে আসছে। সত্যি সে বেহায়া কেনো যেচে সেই কাজগুলো করতে গিয়েছিলো। অনলের প্রতিটি শব্দ বিষধার তীরের মতো ধারার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অবশ্য এটাই তো প্রাপ্য ছিলো তার। তাহলে কেনো এতো খারাপ লাগছে। সে নিজেও জানে না। খুব খারাপ লাগছে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। ফুপুর রুমে এসেই গা এলিয়ে দেয় সে। চোখের অশ্রুতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় নিজেও জানে না।
ধারা রুম থেকে চলে যাবার পর হুশ আছে অনলের। রাগের মাথায় মাত্রাছাড়া কথা বলে ফেলেছে সে। হয়তো এতো কড়া কথা না বললেও হতো তার। পাশ ফিরতেই দেখলো খাটের উপর কাপড় বের করা। ধারা হয়তো তার হাসপাতালের যাবার জন্য কাপড় করে দিচ্ছিলো। ছবিটা হয়তো কাপড়ের ভেতর থেকেই বেরিয়ে যায় এসেছে। এই সামান্য কাজের জন্য না জানি কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো তাকে অনল। এতোগুলো কথা কথা বলার কি আদৌ দরকার ছিলো নাকি সেটা উচিত ছিলো। এই রাগটা অনলের বড্ডবেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না। সজোরে আলমারিতে আঘাত করে খাটে বসে পড়লো সে। নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে। মেয়েটাকে না জানি কতোটা বেশি কথা শুনিয়ে দিলো সে। অনন্যার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাঙাস্বরে বলতে লাগলো,
– ভুল করে ফেলেছি অনন্যা, ভুলটা বেশি হয়ে গিয়েছে। ধারাকে বিনা দোষে এতোগুলো কথা বলাটা একদম উচিত হয় নি। কি করবো বলো, ধীরে ধীরে ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। আর কালকের সেই একই ঘটনা আমার চোখের সামনে আবারো ঘটায় আমি যেনো নিজের মাঝেই ছিলাম না। নিজের অপারগতার সকাল রাগ ধারার উপর ঝেড়ে দিয়েছি। বিশাল বড় ভুল হয়ে গেছে। ওকে আশ্রিতা অবধি বলে দিয়েছি। কিভাবে ওর সামনে দাঁড়াবো অনন্যা। কিভাবে!!
রাত ১০টা,
সারাদিনের খাটাখাটুনির পর বাসায় এসেছে অনল। সারাদিনে একটা কথাই তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, ধারার কাছে ক্ষমা কোন মুখে চাবে। বাসায় কলিংবেল দিতেই সুভাসিনী বেগম দরজা খুলেন। অনল ভেবেছিলো ধারা দরজা খুলবে। কিন্তু সুভাসিনী বেগম দরজা খোলায় তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। সুভাসিনী বেগম তাকে দেখেই বলেন,
– ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
– মা
– কি হয়েছে?
আশেপাশে ভালোভাবে দেখে সে বলে,
– ধারা কোথায়?
– সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?
সুভাসিনী বেগমের কাটকাট কথায় বুঝতে বাকি রইলো না তিনি সব জেনে গেছেন। ধারা কি তাকে বলে দিয়েছে। কিন্তু সে তো এমন মেয়ে না, হাজারো আঘাত করলেও টু শব্দ করে না মেয়েটা। তাহলে!
– ধারা আমাকে কিছুই বলে নি, কিন্তু আমার কান নামক একটা জিনিস আছে। যা দিয়ে আমি বেশ ভালো করেই শুনতে পাই। আর তুমি যখন তাকে চেঁচিয়ে আশ্রিতা বলছিলে আমি খুব ভালো করেই শুনেছি। যাক গে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
সুভাসিনী বেগমের কড়া কথায় বেশ বড় সড় ঢোক গিয়ে অনল বলে,
– মা, ধারা কি খেয়েছে?
– হুম, সে এখন ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরটা ভালো নেই। জ্বর এসেছে। আমি ঔষধ দিয়েছি। সো তোমার ওকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
বলেই সুভাসিনী বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। অনলের নিজের মাঝে একটা গ্লানি অনুভব করছে। সে চাইলেও তার ধারে কাছেও ভিড়তে পারবে না। কারণ এখন সুভাসিনী বেগম আছেন। আর তিনি কতটা কড়া ব্যাপারবগুলো অনলের খুব ভালো করেই জানা আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে হাটা দেয় অনল।
এক মাস পর,
ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে অনল-ধারা। এই এক মাসে ধারা যতটা পেরেছে অনলের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করেছে। অনল কোনোভাবেই সেদিনের পর থেকে ধারার সাথে কথা বলতে পারে নি। ধারা সেই সুযোগটাই দেয় নি। সামনাসামনি বসা অবস্থায় ধারা একটা কথা ও বলছে না অনলের সাথে। মাথা নিচু করে কোনোভাবে খাওয়াটা সারছে। অপরদিকে অনল বারংবার ধারার আশেপাশে ভিড়তে চাইছে। কোথাও না কোথাও ফাকা ফাকা লাগছে। ধারার সাথে খুনসুটি গুলো বেশ মনে পড়ছে তার।
– আজ ধারার চেকাপ, অনল তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাও।
– না না, ফুপি অনল ভাইয়ের যাবার প্রয়োজন নেই আমি একাই পারবো
সুভাসিনী বেগমের কথা শোনা মাত্র ধারা তাতে ভেটু দেয়। ধারা কথাটা বলামাত্রই অনল বলে উঠে,
– মা, পনেরো মিনিটের মধ্যে ওকে রেডি হতে বলো। আমার ডিউটি আছে, ওকে চেকাপ করিয়ে দেন আমি যাবো।
বলেই গটগট করে নিজের রুমে চলে যায় অনল। অগত্যা আর কথা বাড়াতে পারলো না ধারা।
রেডি হয়ে যখন বাসা থেকে বের হলো অনল তখন সি.এন.জি ডাকতে ব্যস্ত। ধারাকে আসতে দেখেই সে থেমে গেলো। এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলেই ধারা নিচুস্বরে বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো অনল ভাই, কষ্ট করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ফুপি জানবেন ও না
কথাটা শুনেই অনলের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
– তুই কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?
– এড়িয়ে যাবো কেনো? এখানে এড়িয়ে যাবার কিছুই নেই। সত্যি বলতে, আমি চাই না তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে। সত্যি নিজের জায়গা ভুলতে বসেছিলাম। একটু ভালো ব্যাবহার করেছো তাই ভাবতে লেগেছিলাম… যাক গে, একজন আশ্রিতাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছো, আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়েছো। তাকে নিজের নাম দিয়েছো। সেই উছিলায় তোমার ঘাড়ে চেপে বসাটা আমার উচিত হবে না। তুমি যা করেছো এর চেয়ে বেশি কিছু তোমার কাছে চাওয়াটা উচিত নয়। এতোটা লোভী হওয়াটা আমার উচিত হয় নি। তাই আশ্রিতা হয়ে তোমার উপর আমি বা আমার বাচ্চা বোঝা হতে চাই না।
ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি