দৃষ্টির অগোচরে,সূচনা পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে,সূচনা পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

ডিভোর্স পেপার হাতে পেতেই কোনো চিন্তা না করেই ঝটপট সই করে দিলো নুশরাত। তার মুখের হাবভাব অত্যন্ত স্বাভাবিক। বোঝা যাচ্ছে না তার মনে কি চলছে। কারণ তার হাত কাঁপছে না, না চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক সে। মেয়েকে সূক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন পারভীন বেগম। বিয়ের ন’মাসের ভেতরেই তার মেয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে দিবে তা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। তিনি বাঁধা দেবার যে চেষ্টা করেন নি এমনটি নয়, কিন্তু মেয়ে যথেষ্ট বড়; নিজের সব সিদ্ধান্ত সে একা নিতেই পছন্দ করে। এমনটা নয় যে সে কোনো স্কুলে পরোয়া বাচ্চা, দু তিনখানা চড়, কিল মারলে জেদ ছেড়ে দিবে। নুশরাতের ঠিক বিপরীতে তার প্রাক্তন স্বামী মাহির বসে রয়েছে। মাহিরের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। একটু পর পর খালি ঠোঁট কামড়াচ্ছে, নখ কাঁটছে। সে বারবার কিছু বলতে যেয়েও বলে উঠতে পারছে না। তার দুপাশে তার বাবা-মা বসে রয়েছেন। মাহিরের বাবা মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা জাজ কোর্টের যুগ্ম জেলা জাজ। ঢাকা শহরে তার বেশ নামডাক রয়েছে, সবার কাছে তিনি ন্যায়ের প্রতিমূর্তি। অবশ্য আজকাল সরকারী কর্মকর্তা মানেই সম্মানের হকদার, তার উপরে যদি হয় বিচারক তাহলে তো কথাই নেই। মঈনুদ্দিন সাহেব তার গাম্ভীর্যকে অটুট রাখলেন। নুশরাতের এমন কয়েকদিনের নোটিসে ডিভোর্সের আবদার নিয়ে তার যেনো কোনো মাথাব্যাথাই নেই। অপরদিকে মাহিরের মা, হেনা বেগম চোখ মুখ খিঁচে বসে রয়েছেন। তিনি এই ছোটলোকঘরের মেয়েকে মোটেই পছন্দ করেন না। ছেলেটা কি দেখে এই অভদ্র মেয়েটিকে বিয়ে করেছে আল্লাহ ই জানে। এখন সমাজে কি তার কি মুখ থাকবে! স্বামীর বদৌলতে সমাজের উচ্চমানের মানুষ বর্গের সাথে তার উঠাবসা। নুশরাতের সই করা হয়ে গেলে মঈনুদ্দিন সাহেব ডিভোর্স পেপারটায় ভালো করে চোখ বুলান। কোথাও কোনো ত্রুটি হোক তার পছন্দ নয় সেটা। তখনই নুশরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
– আমার দেনমোহর এবং এ্যালিমনির টাকাটা কবে পাবো?
– কিসের এ্যালিমনি? ঠিক বুঝলাম না নুশরাত?

মঈনুদ্দিন সাহেব ডিভোর্সের পেপার থেকে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্নটি করেন। তিনি ভ্রু যুগল একত্রিত করে চোখজোড়া ছোট করে তীর্যক দৃষ্টিতে নুশরাতকে দেখছেন। তিনি নুশরাতের উত্তরের অপেক্ষা করছেন। নুশরাত ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি একে বললো,
– বাবা, আপনার পক্ষ থেকে এমন কিছু মোটেও আমি কল্পনা করি নি। ব্যাপার না আমি বুঝিয়ে বলছি, দ্যা ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯ অনুযায়ী যেকোনো নারীর এ্যালিমনি পাবার অধিকার রয়েছে।

মাহির এবার মুখ খুললো। নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের চেষ্টায় সে ধমকের সুরে বলে উঠে,
– সহ্যের একটা সীমা থাকে নুশরাত। তুমি বাবার সাথেও বেয়াদবি করছো, তুমি বাবাকে আইন শেখাচ্ছো?
– আহ, থামো মাহির। আচ্ছা নুশরাত তোমার যদি মনে হয় তুমি এ্যালিমনি পাবে তাহলে কোর্টে সেটা পেস করো।

মঈনুদ্দিন সাহেব মাহিরকে থামিয়ে কথাটা বলেন। কিন্তু তাতে নুশরাত অবিচল থাকে। সে পুনরায় ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বলে,
– সরি বাবা, বেয়াদবী করলাম বুঝি! এক মিনিট,

বলেই ব্যাগ থেকে পাঁচ-ছ’খানা ছবি বের করে টেবিলের উপর রাখে নুশরাত। ছবিগুলোকে হাতে নিতেই মুখখানা আরোও ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। মঈনুদ্দিন সাহেবের চোখ বিস্ফোরিত রুপ ন্যায়। কারণ ছবিগুলোয় স্পষ্ট তার ছেলে একটি মেয়ের সাথে আদিম খেলায় মত্ত।

শ্রাবণের ১৪,
দিনটি অজানা কারণে বেশ পছন্দের নুসরাতের। তার ধারণা প্রতি বছর এই দিনে বছরের প্রথম দীর্ঘকালীন বর্ষণ হয়। আরোও একটি কারণ রয়েছে, সেটি হলো এই দিনটিতে বিগত দু বছর পূর্বে মাহিরের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো। লোকটির সাথে বিয়ের সাত মাস হতে চললো। লোকটার চেহারা আহামরি নয়, তবুও অজানা এক কারণে তাকে ভালোবাসে নুশরাত। তাদের সম্পর্কটা প্রেমের নয়। তবুও প্রেমের দাবি দিয়ে মাহির তাকে বিয়ে রয়েছে। মাহিরের কথা ভাবতেই মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠে নুশরাতের। চেম্বারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে করতে মাহিরকে ক্রমাগত ফোন করে নুশরাত। মাহির ফোনটা ধরছে না। কারণটা বুঝতে পারছে না নুশরাত। পর পর তিনবার ফোন করার পর হাত ছেড়ে দিলো সে। আজ ক্লাইন্টের সাথে হোটেলে দেখাও করতে হবে তাকে। ফোস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেম্বারের ভেতরে আসে সে। তার কলিগ এবং উকিল বন্ধু রবিন ফাইলের উপর কাটাকাটি করতে করতে বলে,
– বাহিরে সেই বৃষ্টি হচ্ছে রে নুশু, যাবি কিভাবে? এখান থেকে বনানী কিন্তু কম দূর না!
– উবার কল করেছি, চলে আসবে।
– মিটিং কি রেস্টুরেন্টে হবে! বুঝলাম না এখানে আসতে মহিলার কি সমস্যা?
– তাই তো বললেন তিনি। আমার কাছে এতোটাও সমস্যা নয়। মাহিরের সাথে আসার পথে দেখা হয়ে যাবে। ওর অফিস তো ওখানেই। আচ্ছা থাক, আমার বিকেল পাঁচটার মধ্যে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। উবারটা চলে আসবে! আমি নামতে লাগি

বলেই ব্যাগটা কাঁধে এবং ছাতাখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নুশরাত। বিল্ডিংটা চৌদ্দ তালা, নুশরাত লিফটের সিরিয়াল পেলো মিনিট পনেরো পর। ততক্ষণে উবার এসে দাঁড়িয়েছে বিল্ডিং এর পার্কিং এ। নুশরাত বিল্ডিং থেকে উবারে উঠলো। গাড়িটা চলছে, বৃষ্টির ঝাপটা জানালায় হানা দিচ্ছে। নুশরাতের চোখ একবার জানালার বাহিরে, একবার মোবাইল স্ক্রিন দেখে যাচ্ছে। মাহিন ফোন করে নি। নুশরাত বুঝ দিলো হয়তো ব্যাস্ত রয়েছে। একজন ৯ টা ৫ টা কর্পোরেট অফিস কর্মীর জন্য এই সময়টা অনেক জরুরী। নুশরাত ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো। তারপর এক নজরে বৃষ্টিতে ভেজা ঢাকা শহর দেখলে লাগলো সে, আহা! কি স্নিগ্ধ! কি মনোরোম এই শহর!!

নুশরাত উবার থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের লবিতে এসে দাঁড়ায়। ক্লাইন্টের অবস্থান জানার জন্য সে ফোনটি বের করে। ফোনের থেকে চোখটা হোটেলের লিফটের দিকে যেতেই যা দেখতে পেলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না নুশরাত৷ হোটেলের লিফট থেকে একটি মেয়েকে আলিঙ্গন করে বের হচ্ছে মাহির। তার শার্টের কলারটা কুচকানো। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। নুশরাত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, নিজের স্বামীকে আজকের দিনে অন্য নারীর বাহুতে দেখতে হবে এটা যে তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। নুশরাত বুঝতে পারলো তার বুকের বা- পাশে চিনচিনে ব্যাথা করছে। কি অসহ্য যন্ত্রণা! তার চোখজোড়া জ্বলছে। রাগ, অভিমান, কষ্টে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

বর্তমান,
মঈনুদ্দিন সাহেবের রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। কিন্তু তবুও নিজেকে শান্ত রেখেছেন তিনি। নুশরাত পুনরায় তার ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললো,
– বাবা আপনাকে বলবো না, যেহেতু আপনার আর আমার সম্পর্ক প্রফেশনাল। তো স্যার, আমি কি কোর্টে এ্যালিমনির জন্য আপিল করবো। আমার মনে হয় আমার কাছে যা কল রেকর্ডিং, ভিডিও রেকর্ডিং এবং ফটো রয়েছে তাতে আমি ভালো এ্যালিমনি পেয়ে যাবো।
– কি চাই তোমার?
– বেশি কিছু না। আমাদের উত্তরা ১৪ নম্বরের ফ্লাটটা ৬\সি, ওটা পুরোপুরি আমার নামে চাই। ওইটা এখন যৌথ ভাবে আমাদের নামে রয়েছে। ওই টাই যথেষ্ট।

নুশরাতের আবদার শুনে হেনা বেগম দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
– লোভী মেয়ে কোথাকার! আমার ছেলেকে ফাসিয়েছে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য।

নুশরাত উত্তর দিলো না। শুধু মুখের অমায়িক হাসি একে বসে রইলো।

মাহিরদের বাসা থেকে বের হয়ে সি.এন.জি তে উঠলো নুশরাত এবং পারভীন বেগম। পারভীন বেগম আক্ষেপের কন্ঠে বললেন,
– আমাকে বললি না কেনো?
– কি লাভ হতো মা! খামোখা কথা নষ্ট হতো!
– তুই ব্যাপারটা এভাবে ছেড়ে দিবি!
– ছাড়ি নি তো! যার যেটা প্রিয় তাকে সেটা হারাবার ভয় নিয়ে কার্যসিদ্ধি করলাম৷ তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি ফ্লাটে যাবো।
– একা একা থাকবি? আমি ও আসি
– উহু, ইশরা অপেক্ষা করছে বাসায়। তুমি বাড়ি যাও। আমি একা থাকতে চাই।

নুশরাত আর কথা বাড়ালো না। তার কন্ঠে বেদনার ছাপ নেই। বরং সে আজ খুব আনন্দিত। তার মতে শয়তান মানুষের মাঝেই লুকায়িত। তার মানুষের বেশ ধরে অমানুষের কাজগুলো করে। মাহির তাকে দিনের পর দিন ছলনা করেছে, ঠকিয়েছে। কিন্তু সে তার ছলনায় অশ্রুসিক্ত হয়ে, বিলাপ করার থেকে তাকে ভেতর থেকে উইপোকার ন্যায় গিলে ফেলাটা বেশি জরুরী মনে করলো৷ লুকিয়ে লুকিয়ে মাহিরের বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ বের করলো যা দিনে মঈনুদ্দিন সাহেবের ন্যায় ভঙ্গ ধরা বিচারককেও কাঁপিয়ে দেওয়া সম্ভব। নুশরাতের মতে এটাই নিজেকে ন্যায় দেবার একমাত্র উপায়___________

রাত ৯টা,
রবিনের ফোনে কাগজের স্তুপের থেকে চোখ তোলার বাহানা পায় নুশরাত। চোখ থেকে মোটা চশমাখানা নামিয়ে জানালার কাছে যায় সে। তার বিল্ডিংটি এই রোডের সবথেকে উঁচু বিল্ডিং। আর তাদের ফ্লাটটি ছয় তালায়। তার জানালা দিয়ে আশেপাশের সকল বিল্ডিং এর ছাঁদ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বাহিরের দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে বললো,
– বল, কি হয়েছে?
– ডিভোর্সের কাজ মিটেছে?
– হু, খুব ভালোভাবে মিটেছে। আমার প্রাক্তন শ্বশুরের মুখখানা দেখার মতো ছিলো। শালার এতোদিনের জমানো কালো টাকার খনিতে আমি ঢিল ছুড়েছি বলে কথা।
– তুই পারিস ও বটে, তোর মতো যদি আমাদের দেশের ৩০ শতাংশ মেয়ে হতো না তাহলে এ দেশের অনেক মেয়েদের যন্ত্রণা সহ্য করার পরেও হয়তো মাটি কামড়ে এরুপ শ্বশুরবাড়ি নামক নরকে থাকতে হতো না।
– সবাই তো আমি নই, তা বল এতো রাতে ফোন?
– সালেহা থানায় গিয়েছিলো। কিন্তু বরাবরের মতো বদমাইস সাব-ইন্সপেক্টর হাবীব রিপোর্ট লিখতে দেয় নি।
– তুই টেনশন নিস না, ও লিখবে না ওর ঘাড়ে রিপোর্ট লেখাবে। আমি রাখছি, গলাটা শুকিয়ে গেছে। কোক খেতে পারলে ভালো হতো।
– এই রাতে তুই বাহিরে যাবি?

রবিনের প্রশ্নে হেসে নুশরাত বলে,
– কারণ আমি সিঙ্গেল। একা একাই আমাকে জীবন কাটাতে হবে।

বলে ফোনটা রেখে দিলো নুশরাত। ব্যাগটা নিয়ে দরজায় লক করলো সে৷ বিল্ডিং এর থেকে পাঁচমিনিট দূরত্বে একটি মুদি দোকান, নাম “রাসেল স্টোর”। নুশরাত সেখানেই যেতে ধরে তখন ই তার রোডের ইলেক্ট্রিসিটি ধুম করেই চলে যায়। এমন ব্লাকআউট সাধারণত উত্তরায় খুব অসাধারণ ব্যাপার। এখানে বিদ্যুৎ যায় না বললেই হয়। কোক কিনে মিনিট পনেরোর মাঝেই বিল্ডিং এ ফিরে নুশরাত। মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উঠে নুশরাত। বাসার কাছে পৌছাতেই দেখলো তার ফ্লাটের দরজা হাট করে খোলা। তার জানা মনে সে দরজাটি লক করে বেরিয়েছিলো। নুশরাতের বুকে কামড় পরে। হার্টবিট বেড়ে যায় তার। ঘরে কি চোর ঢুকলো! আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দেয় সে। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। তার বিল্ডিং এ জেনারেটর নেই, তার নিজের ও আইপিএস নেই। সুতরাং মোবাইলের লাইটটি তার একমাত্র ভরসা। গলা শুকিয়ে আসছে নুশরাতের। কাঁপা কন্ঠে বলে,
– কে? বাসায় কে?

কিন্তু কোনো সারা নেই। বসার ঘরটা পার হতেই পা এর একটি ভারী জিনিস বাধে নুশরাতের। অন্ধকারে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। হাতের মোবাইলটা খানা হাত থেকে পড়ে যায়। কোনো মতে হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেঝেতে আলো মারতে দেখে……….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here