অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৩
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
বৃষ্টি মুখরিত বর্ষার রাত। রিমঝিম শব্দ করে বাহিরে প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়চ্ছে। বৃষ্টির শব্দে কিছুই যেন কর্ণপাত হচ্ছে না রুফাইদার। শুধু নিজের হৃৎস্পন্দনের ডিপডিপ আওয়াজ কানে আসছে। শরীরের প্রতিটা ধমনীর, শিরা-উপশিরায় রক্ত দ্রুত চলাচল টুকু সে উপলব্ধি করতে পারছে।যেন সমস্ত রক্তনালি কাঁপিয়ে, ঝনঝনিয়ে চলছে রক্তপ্রবাহ। প্রচন্ড উত্তেজনায় নিশ্বাসের তাল দ্রুত। মনে হচ্ছে, হৃদপিণ্ড বুঝি এখনি লাফিয়ে বের হয়ে যাবে। সমস্ত দেহ উত্তাপ ছাড়াছে। রুফাইদা শুকনো ঢুক গিললো। হাতরে হাতরে অন্ধকার ঘরটির দরজা খুঁজার বৃথা চেষ্টা করলো।চলতে চলতে বন্ধ দরজার কাছে এসে পড়লো রুফাইদা। এর পরের কাজ টুকু তার জন্য খুব একটা সহজ নয়? ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। অন্ধকার ভয়ের যেন আরেক নাম। সময় বিলম্ব না করে দরজা ধাক্কা দিলো এবার। কিন্তু হায় দরজা লাগানো। রুফাইদা এবার চিৎকার করে দরজায় বাড়ি দিতে লাগলো,
“খোলো! দরজাটা খোলো, কে আছো? আমাকে যেতে দাও! আমাকে যেতে দাও, আমার..আমার বাবা-মা আমার জন্য চিন্তা করছে। যেতে দাও আমায়! ছেঁড়ে দাও।দয়া করো আমার উপর.. প্লিজ ।”
পালটা কোনো শব্দই যেন এলো না বাহির থেকে ফিরে। রুফাইদা কাঁদতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে গেল খট করে। এক ফালি আলো খেলে গেলো ঘরটিতে। রুফাইদা পিছিয়ে গেলো দুই পা। এক পা দু পা করে প্রবেশ করলো রুমটিতে কয়েক জোড়া পা।সাথে সাথেই জ্বলে উঠলো তীব্র আলো। রুফাইদা ভীত, রিক্তশুন্য মুখে তাকিয়ে রইলো বিশাল দেহী দানব আকৃতির লোক গুলো দিক। চওড়া উদম বুক, মুখে বিশ্রী হাসি। গায়ে শুধু আছে তাদের প্যান্ট যা নাভির নিচ পর্যন্ত।হাতে ধারালো অস্ত্র,চাবুক, ধোঁয়া উঠা এক বোতল। রুফাইদা ভয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখছে অর্ধ উলঙ্গ এই লোকগুলোর দিকে। তারা এগিয়ে এলো, রুফাইদা পিছাতে লাগলো। কান্নামাখা কাতরস্বর কাঁপছে। অবাধ্য শিশুর মতো তোতলাতে লাগলো,
“প্লি…জ আ…মা…কে ছেঁ…ড়ে দি…ন!”
লোক গুলো শুনলো না। তাদের মাঝে কেও এক এক ঝাটকায় ফেলে দিলো বিছানায় রুফাইদাকে। কেউ টেনে নিলো বস্ত্র করে দিলো নগ্ন, কেউ বেঁধে ফেললো হাত। শুরু করে দিলো নির্যাতন। রুফাইদা গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগলো,
“বাবা! আমাকে বাঁচাও! বাঁচাও। বাবা..!”
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সাইফ বুকে মাঝে তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে। এ কেমন সপ্ন দেখলেন তিনি? তার মেয়েকে কতটা নির্যাতনের স্বীকার হতে হলো? সাইফে এভাবে উঠতে দেখে নাজমার ঘুম ছুটে গেলো। সাইফের শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে হাত দিয়ে চেঁপে আছেন। চোখ দুটি উল্টে যাচ্ছে । তিনি আতঙ্ক চিৎকার করে ডেকলেন,,
“জয়নব…! তোর বাবা কেমন জানি করছে!”
জয়নব সজাগ ছিলো৷ মায়ের চিৎকারে ছুটে এলো রুম থেকে। ততখনে যেন বেশিই দেড়ি হয়ে গেলো। সাইফের প্রাণ পাখি উড়াল দিলো। নিথর দেহ ঢলে পড়ে রইলো নাজমার বুকে। নাজমাও নিস্তেজ হয়ে গেলেন। জয়নব “বাবা” বলে ডাকতে লাগলো সাড়া নেই। মাকে ডাকতে লাগলো তারো হুঁশ নেই। অতল সাগরে তলিয়ে যেতে লাগলো জয়নব। বাবার পিতৃ ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেলো জয়নবের। নাজমাও জীবন্ত লাশ হয়ে গেলেন। বাবা-মা ছাড়া কিশোরী জয়নব লড়াই করতে লাগলো আবারো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে।
—————-
মেডিকেল কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে জয়নব। চারপাশে সবুজ ঘেরা গাছ পালার সাথে দাঁড়িয়ে আছে দাম্ভিকতা নিয়ে শির উচু করে বড় বড় ভবন।ঠিক যেই মেডিকেল কলেজে তার বোন পড়তো? সেই মেডিকেলেই পড়তে এসেছে সে। বছর খানিক কেঁটে গেছে। জয়নবের পৃথিবী এখন বিছানায় শয্যাশায়ী তার মা নাজমা ছাড়া কেউ নেই। কিশোরী জয়নব শক্ত এবার, বোনের মতো সেও মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। কাকতালীয় ভাবে বোনের রুমটিতে সীট পেয়েছে। সে চাইছিলো-ও তাই। বোনের বিছনায় বসে অনুভব করতে পাড়ছে তার বোনকে। এই যেন গালে স্পর্শ করে বলছে,
“তোর লড়াইয়ে আমি সাথে আছি জান!”
জয়নব ছোখ বুঁজে হাসলো। তার বড়পু সব সময় “জান” নামটি সম্বোধন করতে। মাঝে মাঝে আদরে আপ্লুত হয়ে প্রশ্ন করতো,
“বড়পু তুমি আমাকে কেন জান ডাকো?”
রুফাইদা হাসতো। শুভ্রমুখে হৃদয়স্পর্শকর হাসি। একে বারে বুকে গিয়ে লাগতো সেই হাসি। জয়নব ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতো। রুফাইদা চোখে মুখে সব সময় থাকতো জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। স্বল্প ভাষী মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে বলত,
“তুই আমার প্রতিছবি, জান। দু টো মানুষ হলেও আমাদের দুজনের মাঝে আছে অনেক মিল। আর ছোট বেলায় তোর জন্যই আমার প্রাণ বেঁচে ছিলো। তাই তুই আমার জান!”
জয়নব হাসতো। বোনকে জড়িয়ে ধরতো খুশিতে গদগদ হয়ে। কিন্তু? আজ তার বোনটি নেই। সপ্তপর্ণ শ্বাস গিলে ফেললো জয়নব।
বছর খানিক আগের ঘটনা মেডিকেল পড়ার ইচ্ছে ছিলো না জয়নবের। কিন্তু সব পাল্টে গেলো। বোনের হোস্টেল থেকে আসা ব্যাগপত্রর মাঝে পাওয়া এক টুকরো কাগজ বদলে দিলো জয়নবের মতামত। সেই কাগজের টুকরোটা ছিল একটি চিঠির টুকরো। যেখানে লিখা ছিলো গোটা গোটা অক্ষরে,
” তারা ভালো না। তারা হাসপাতালে অনৈতিক কাজ করছে। তাদের শাস্তি পেতেই হবে। সবার মুখোশ উন্মোচন করে ছাড়বো। তাদের মাঝে ডাঃ…..”
এরপর আর কিছুই লেখা নেই। এটুকু পড়েই জয়নবের কিশোরী মাথায় খেলে গেলো। বোনের মরার পিছনে হয়তো তারাই দায়ী???
———
ডং ডং করে ঘরির ঘন্টা বাজতে লাগলো। সকালের মিষ্টি হাওয়া পুলকিত করলো চারিদিক। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়লো জয়নব। রেডি হয়ে চলতে লাগলো নতুন জীবনের সূচনায়..। ডাক্তারদের সাদা এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে।
কলেজ গেট ক্রশ করতেই পিছন থেকে ভেসে এলো এক কর্ককর্কশ কন্ঠ। জয়নব পিছনে ঘুরে আগুন্তকে দেখতে চাইলো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সব স্টাফ মাথা নত করে। লোকটি ধমকাচ্ছে তাদের। কৌতূহল জাগল কিশোরী জয়নবের। পায়ের বুড়ো আঙুলে উপর ভর দিয়ে উঁচু হয় বৃধা চেষ্টা করলো লোকটিকে দেখতে। কিন্তু ব্যর্থ। মুখ দিয়ে বিরক্তি “চ” শব্দ করে সে স্থান ত্যাগ করতে চাইলো। ঠিক সেই মুহুর্তে ভেসে উঠলো
আগন্তুকের মুখখানি। হা হয়ে গেলো জয়নব। এ কি মানুষ? না অপূর্ব কোনো সুন্দর জ্বিন??
“ও ভাবে গিলো না উনা। উনি ওল রেডি ম্যারেড। যদিও তার ওয়াইফকে কেউ দেখননি”
পাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলী কন্ঠো। ভ্রু কুটি কুচকে তাকালো জয়নব। মোটোশোটা গোলগাল একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার সামনে। মুখে যেন এক রাশ মায়া মায়া ভাব। মেয়েটির কথা ধরতে না পেরে জয়নব গলা ছাড়লো।
“এক্সকিউজ মি। ”
মেয়েটি এবার হেসে দিলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“হাই আমি কুয়াশা। নিউ স্টুডেন্ট। ”
জয়নব-ও হাত বাড়িয়ে দিলো।
“আমি জয়নব। নিউ স্টুডেন্ট! ”
কুয়াশার মুখ চকচক করে উঠলো। হুট করে ঝাপটে ধরে ফেললো জয়নবকে।জয়নব বেকুব বনে গেলো।
কুয়াশা খুশি খুশি কন্ঠে বলল,
“আমরা আজ থেকে বন্ধু!”
জয়নব মাথা নাড়লো,
“হে হে আমরা বন্ধু আমাকে ছাড়ো!”
কুয়াশা ছেড়ে দিলো।এবার জয়নব কিছু একটা ভেবে বলল,
” তোমরা কথা বুঝতে পারি নি আমি। তখন কি বললে?”
কুয়াশা ফিক করে হেসে দিলো।বলল,
“তুমিও স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো তাই না! ”
জয়নব থতমত খেয়ে গেলো। বলল,
“তুমি যা ভাবছো তা না!”
মেয়েটি হাওয়ায় মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলল,
“জানি জানি সব জানি। কলেজের সবাই তাদের দুজনের উপর ক্রাশাহীত।”
“তাদের মানে?”
“তাদের মানে তারা দু জনের উপর। আদর স্যার আর অভিনব স্যারের উপর। এই মাত্র যাকে দেখেছো উনি অভিনব স্যার। আদর স্যার আরো সুন্দর।”
জয়নব দাঁড়িয়ে গেলো। এমন সুন্দর মানুষ কি এ পৃথিবীতে হয় নাকি বুঝতে পাড়লো না সে। কিন্তু স্বচোখে ডাঃ আদরকে দেখার জন্য কিশোরী জয়নবের মনে আকুলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু কেন?
ওরা নানান কথার মাঝে ডুবে গেলো। কুয়াশা মেটা মিশুক খুব জয়নবের এমন এক বন্ধু হয়ে ভালোই লাগলো। তারা কথা বলতে বলতে ক্লাসের দিকে অগ্রসর হলো। বড় হল ঘরটি “শ” খানেক স্টুডেন্ট । মাঝামাঝি এক সারিতে বসলো তারা। তখনি কিছু কিছু স্টুডেন্টের কথোপকথন কানে ভেসে এলো তাদের। ফিসফিস করে বলছে,
“জানিস আবার লাশ পাওয়া গেছে।আমাদের কলেজের সিনিয়র এক ভাইয়ার। ছেলেটির চোখ, কলিজা, গুর্দা, ফুসফুস, কিডনি কিছুই নেই। বুক ফেঁড়েছে। শরীরে মারে চিন্হ। অনেক টর্চার করেছো হয়তো। তার উপর এসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দিয়েছে। লাশ এনেছে মর্গে। আমার তো দেখেই ভয়ে গা গুলিয়ে গেছে। কি মর্মান্তিক দেখতে ইশশ।”
সহপাঠীদের কথা শিউরে উঠলো জয়নব। শরীরের রোমশ দাঁড়িয়ে গেলো তার। রুফাইদার ঝলসে যাওয়া মুখ ভেসে উঠলো তার চোখে। ছল ছল করে উঠলো নয়নজোড়া। আচ্ছা এরাই সে খুনি না তো? যারা তার বোনকে মেরেছে??? তাহলে কি তার ধারণা ঠিক? এই হাসপাতাল ঘিরেই রয়েছে যত রহস্য??
চলবে,