অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-২

অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-২
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

“মিস রুফাইদাকে গন ধর্ষন করা হয়েছে! সারা শরীর জুড়ে টর্চারের আঘাত। স্পর্শকাতর জায়গা আর মুখ থেঁতলে দিয়েছে। এসিড মেরে মুখ ঝলসে গেছে, যার ফলে চেহারা বুঝা যাচ্ছে না । আর শরীরের জায়গা জায়গা থেকে মাংস তুলে নেয়া হয়েছে।”

বাড়ি ভর্তি করে উত্তেজনার ভাব। চারিদিকে পুলিশ আর মিডিয়ার লোক। শুধু থমথমে পরিবেশে সাইফ, নাজমা, জয়নব স্তব্ধ। আকাশে ঘন মেঘ গুড় গুড় করছে। সূর্যের দাম্ভিকতা দংশন করে দাপিয়ে আসছে অন্ধকার ।একঝলক বিদ্যুৎ নীলাভো আলো এসে পড়লো ঘর জুড়ে। নিঃশব্দ কিশোরী জয়নবের কর্ণপাত হচ্ছে পুলিশের কথাটি বাজ পড়ার মতো। ঘরের প্রতিটি মানুষের আদরের রুফাইদার মর্মান্তিক মৃত্যু কথা শুনে জ্ঞান হারিয়েছে নাজমা। সাইফ ভেঙ্গে পড়েছে। হু হু করে বাড়ছে বিপদ৷ বাহিরের বৃষ্টির বেগ আরো বাড়লো। গগনবিদারী চিৎকার করে বাজ পড়লো আবার। অন্ধকার ঘরটিতে দেখা মিলছে ক্ষনিকের নিয়ন আলো। সেই সামান্য আলোতে দেখা গেলো বিছানার উপর পা গুটিয়ে বসে থাকা কৃষ্ণাভ অথচ পেলব মসৃণ মুখ। ঘন কালো চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে পিঠ জুড়ে। সামান্য উঁচু কঁপালের ঠিক নিচে ঘন ভ্রু যুগল আর এক জোড়া ঝকঝকে চোখ দিয়ে পড়ছে নেত্রনীর। সুচালো ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। বিছনার উপর পরে থাকা এলো মেলো কিছু রক্তাক্ত কাপড়, ভাঙ্গা ঘড়ি, গলার লকেট আর একটি কানের দুল, এগুলে দেখেই ফুপিয়ে উঠছে জয়নব। বোনের মরার খবর কিশোরী জয়নবের ছোট মনটা কাতর। তার উপর ধর্ষণের খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে আত্মীয় স্বজন আর পাড়াপড়শিদের মাঝে। কেউ সান্ত্বনার বানী শোনাচ্ছে তো কেউ টিটকারি দিয়ে বলছে,

“মেয়ে হোস্টেল থাকতো একা। হয়তো কোথাও ফষ্টিনষ্টি করেছে ছেলেদের সাথে। তাই ছেলেরা খেয়ে দিয়েছে একদম। এদের সাথে এমন হওয়াই সাজে বৈকি। ”

কথা গুলো শক্তভাবে হজম করলেও দু চারটে কথার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি বিশেষ। উল্টো নাজমার অবস্থা নাজুক। মেয়ের শোকে শরীর ছেড়ে দিয়েছে বিছানায়। দিন যেতে লাগলো পরিস্থিতি অনুকূল নেই। ভেঙ্গে চুড়ে যাচ্ছে সব। এভাবেই কেঁটে গেলো ১৫ টা দিন। এখনো বোনের থেঁতলে আর এসিড পোড়া মুখটি মনে পড়লেই কামড় দেয় বুকে। এদিকে পুলিশ থেকেও কোনো তথ্য পাচ্ছে না তারা। সাইফ পুলিশ স্টেশন ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ কোনো তথ্য নেই! কারা করলো? কি দোষ ছিলো তার ছোট পরির? কেন তারা সাথেই এমন হলো?? সাইফ স্পষ্ট দেখতে পেলো তার ছোট পরি খিল খিল করে হেসে দৌড়ে আসচ্ছে কাছে। মুখে বাবার তার খোট বুলিতে বলছে, “আমার বাবা, আমার বাবা!”। সাইফ তার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন।

বরাবরের মতো আজও হতাশ হয়ে ফিরলেন সাইফ। বুকের ভিতর আর জোড় নেই। ঘামন্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর হেলিয়ে দিলো সোফায়। রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে দৌড়ে এলো জয়নব। বাবার বেহাল দেখে আতঙ্ক ভাবে বলে উঠলো,

” কি হয়েছে বাবা? এমন করছো কেন? ”

সাইফ হাঁপাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবিতে সুদর্শন এই বাধ্যর্কের মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে হাসফাস করছেন। এ কদিনে যেনো বয়স টা দিগুন বেড়েছে। ভয় হচ্ছে, তার কিছু হয়ে গেলে ছোট মেয়েটির কি হবে? সাইফ ছলছল নয়নে তাকালেন। বার কয়েক অস্থির কন্ঠে প্রশ্নে করতে থাকে জয়নব। অথচ সাইফ কি বলবেন? তার উত্তর খুঁজে পেলেন না। ছোট থেকে তার ছোট পরি বাবাকে বলতো,”আমার সুপারম্যান “অথচ আজ এই সুপারম্যান ব্যর্থ। নিজের মেয়েকে ন্যায় দিতে পারলো না? কেমন পিতা সে? ঢুকরে উঠলেন তিনি। জয়নবের মুখ অজানা এক ভয় সাদা হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটি এক অব্যক্ত ভয়ে অল্প অল্প কাঁপছে।

“বাবা বলো না? কি হয়েছে?তুমি এমন করছো কেন??

কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে সাইফের সুন্দর মুখখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বুলিতে কথা পড়লেন তিনি,

“আমি ব্যর্থ বাপ!.. মা। আমার মেয়ের জন্য কিছুই করতে পাড়লাম না। সব শেষ!”

বাবার চোখের পানিতে জয়নবের চোখের নেত্রধারা পড়তে লাগলো। বাবা বুকে মাথা রেখে বলল,

“না বাবা,, তুমি সুপার বাবা। তুমি আমাদের গর্ব বাবা!”

সাইফের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। মেয়েকে বুকে টেনে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

“আমি আমার ছোট পরিকে ন্যায় দিতে পাড়লাম না মা, পাড়লাম না।”

ছোট জয়নব কিছুই বুঝলো না। ছল ছল চোখে বারা দিকে তাকিয়ে রইলো। বিচলিত হয়ে বলল,

“কি বলছো বাবা?”

সাইফ মাথা নাড়লেন,

“তোর বোনের কেইস ক্লোজড করে দিয়েছে থানায়!”

মুহূর্তেই গর্জে উঠলো জয়নব,,

“কিন্তু, তারা তো খুনি পায়নি এখনো? কে আপুকে এ কাজ করেছে? কেন করছে, কিছু না জানিয়ে কিভাবে ক্লোজড করে দেয়!”

সাইফ নিশ্চুপ রইলেন। তার মনে হচ্ছে তার ছোট পরি কাঁদচ্ছেন আর বলছে,

“বাবা! তারা আমাকে অনেক অত্যচার করেছে বাবা।তাদের তুমি শাস্তি দাও নিজ হাতে দাও!”

——-

দুপরের কড়া রোদ। বাতাসের লেশ মাত্র নেই। গরমে চিটচিটে হচ্ছে শরীর। মাথার উপর ফ্যানটি গটগট শব্দে করেও গরম যেন দূর করতে পারছে না।এদিকে মেজাজ তুঙ্গে জয়নবের। তার উপর ভ্যাপসা গরমের মাঝে কনস্টেবলের ঘেন ঘেন। জয়নব এবার ধমকে উঠলো,

“আপনারা কেন আমার বোনে কেইস বন্ধ করলেন?বলেন? খুনি তো ধরা পড়ে নি তাহলে?”

কনস্টেবল ভাবলেশহীন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে পানের বক্স বের করে পান মুখে দিতে দিতে বললেন,

“এই কেইসের কোনো ভিত্তি নাই। তাই বন্ধ করা হইছে। এর বেশি কিছু কবার পামু না। বাহিরে বসেন গিয়ে বড় স্যার আইলে তাহরে জিগাইবেন। যান যান উঠেন বাহিরে যান!”

আগত বাহিরে বেড়িয়ে আসতে হলো জয়নবের। বাহিরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডাক পড়লো তার। ভিতরে গিয়ে অতি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করতেই বড় স্যার বললেন,

” আমাদের হাতে কিছু নেই। উপর থেকে পেশার এসেছে বিধায় বন্ধ করতে হয়েছে। তবে তুমি চাইলে আমি কেইসটা রিওপেন করতে পারি। কিন্তু..!

মুহূর্তেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে ঠোঁটে ফুটেলো হাসি। আরেকটু ঝুকে এসে কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,

“কিন্তু কি স্যার!”

“আমার কিছু চাই!”

জয়নব খুশি খুশি কন্ঠে বলল,

“টাকা চিন্তা করবেন না স্যার। যত টাকা লাগে আমি দিবো। তবু একবার ওই নির্লজ্জ, বেহায়াকে শাস্তি দিন!”

স্যার হালকা কেশে উঠলেন। জয়নবের হাতের উপর হাত রেখে হালকা চাপ দিলেন। কামুকতা নজরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

“আজ রাতটা তোমার আমাকে দাও অাদরে-সোহাগে ভরিয়ে দিবো। আই প্রোমিস রাতে খুশি করতে পারলেই কেইস রিওপেন করে দিবো!”

ঘৃনায় গা গুলিয়ে এলো জয়নবের এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে ডান গাল বরাবর চর লাগালো জয়নব। বড় স্যার হতভম্ব। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারছে না। জয়নব এবার গলা ছাড়লো। রাগে গা কাঁপছে। চেঁচিয়ে বলল,

“জনগণ তোদের বিশ্বাস করে তোদের কাছে আসে। আর তোরা এসব বলিস ছিঃ। মানবতা বলতে কিছু নেই তোদের? তোদের উপর থুতু দেই। ”

বড় স্যারের নামটি এবার দেখে নিলো জয়নব। াবার বলল,

“মিঃ রাসেল আপনার নাম রাস্কেল হওয়া উচিত ছিলো। যতসব! আমি আমার কেশ রিওপেন করাবো, দরকার পড়রে কোটে যাবো।”

অফিসার রাসেল ভরকে গেলেন। কিশোরী মেয়ের এত তেজ হজম হলো না। এক ঝটকা মেরে ফেলে দিলো টেবিলে। স্পর্শকাতর জায়গায় চেপে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠলো জয়নব। রাসেল এবার দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল,

” নে ডাক কোন বাপেরে ডাকবি।”

বলেই এগিয়ে নিলো ঠোঁট জোড়া। জয়নব যথাসাধ্য চেষ্টা করে এক লাথী লাগালো রাসেলের গোপনাঙ্গে কুকিয়ে উঠে ছিটকে পড়লো রাসেল। জয়নব সেই সুযোগে পালিয়ে বের হলো। থানা থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো। ছোট কিশোরী নেত্রধারা বইতে লাগলো। এতটুকু বয়সের এই বিচ্ছিরি অনুভূতি দাগ কেটে গেলো মনে ভয়ানক। সমাজের এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য ধংস করতে দিতে ইচ্ছে হলো। পৃথিবীতে কি দেহটাই সব?

বসায় এসে সোজা ওয়াশরুমে ঠুকে গেলো জয়নব। রাসেলের বিচ্ছিরি স্পর্শ করা জায়গা গুলো সাবান দিয়ে ঢলতে লাগলো জয়নব। পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো হাউ মাউ করে। শরীরে এই অদৃশ্য দাগ গুলো কেন যাচ্ছে না? কেনো? সে মুছে দিতে চায়। আয়নায় নিজের প্রতিছবি দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো বিধ্বস্ত অবস্থায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো বোনের সুন্দর মুখটি, আচ্ছা তার বোনের ও তো এমনি লেগেছিলো এমন পরিস্থিতিতে? সেতো পালাতে চেয়েছে? গলাকাটা মুরগির ধাপ্রি ছিলো। বাচার জন্য কতই না চেষ্টা করেছিলো? কত কষ্টই না পেয়েছে কুলাঙ্গারদের কাছ থেকে? জয়নব এবার স্থীর হয়ে গেলো। মনে মনে ঠিক করলো,তার বোনের খুনিকে সে শাস্তি দিয়েই ছাড়বে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here