অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-১

অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-১
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

“ভাইয়া কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?আমাকে ছাড়ুন ভাইয়া প্লীজ ছাড়ুন! প্লীজ ছেড়ে দিন! দয়া করুন আমার উপর!”

বলতেই উনি সাদা রুমাল মুখের সামনে চেপে ধরলো। ধস্তাধস্তির এক পর্যায় মেয়েটি জ্ঞান হারালো । জ্ঞান ফিরলো যখন নিজেকে আবিষ্কার করলো হাত পা অবস্থায় চেয়ারে বাধা সে। আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কিছু পরিচিত মুখ।এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো৷সারা শরীরে বয়ে গেলো ভয়ের স্রোত। কাঁপন ধরলো গায়ে।

“আপনারা? প্লীজ আমাকে ছেঁড়ে দিন। দয়া করুন!আমি কাউকে কিছু বলবো না। ”

কান্না জড়িত করুন কন্ঠে বলে উঠলো মেয়েটি। বিশেষ লাভ হলো না এতে। উল্টো পলক ফেলার আগেই, লোকটি তার কাছে এসে পড়লো। মেয়েটি ভয়ে চোখ বুঝে ফেললো। কানে ভেসে আসলো লোকটির বিকৃতি কথা। আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি।

—“আমার দাদু মানুষের কলিজা ভুনা খুব পছন্দ করতেন!”

লোকটির কথায় সিটিয়ে গেলো মেয়েটি।কিছুটা পিছনে হেলে ভয় ভয় চোখে তাকালো লোকটির দিক। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

—“কি স…ব বলছেন? ”

লোকটি মৃদু হাসলো। চাপানো শক্ত চোয়াল তবুও স্টাইল করা দাঁড়ি আড়ালে মুখখানায় রয়ে গেল গম্ভীর, রাশ ভরা। লোকটি মেয়েটির কঁপাল থেকে গাল পর্যন্ত স্পর্শ করলো। লোকটি শ্বাস নিশ্বাস আছড়ে পড়লো মেয়েটির চোখে, মুখে, গালে।শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা মেয়েটির। মেয়েটির কঁপালের ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো লোকটি। ফিসফিস করে বলল,

—-“কিন্তু আমার মানুষের মাংস খেতে পছন্দ। লবন, ঝাল দিয়ে খেতে দারুন স্বাদ। জানো পৃথিবীতে মানুষের মাংসের স্বাদ সবচেয়ে বেশি!”

চোখ বড় বড় করে তাকালো মেয়েটি। তীব্র সুদর্শন এই যুবকটির বিকৃতি কথা বার্তা হজম হলো না। গা গুলিয়ে এলো মেয়েটির। মুখ ভর্তি করে বমি চলে আসচ্ছে। বহু কষ্টে ঠেলে দিচ্ছে ভিতরে। ভয়ে আধমরা মেয়েটি লোকটিকে অস্পষ্ট ভাঙ্গা স্বরে বলল,

“এ..স..ব কি.. ব…লছেন স্যার!”

লোকটি হো হো করে হেসে উঠলো। হাসির গুঞ্জনে কেঁপে উঠলো ঘরের ইট। কেঁপে উঠলো মেয়েটি। এই মুহুর্তে তার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু লোকটি তাকে বেঁধে রেখেছে। কি করবে সে? লোকটির কুৎসিত কথা বার্তায় নেতিয়ে পরছে ।

” তোমার মতো সুন্দরী, নরম তুলতুলে মসৃন শরীর আর নাদুসনুদুস শরীরের মাংস আরো সুস্বাদু হবে নিশ্চয়ই? আম সো এক্সাইটেড তোমার শরীরের মাংস খেতে!”

শেষের কথাটি ধীরে ধীরে হিসহিস করে বলল লোকটি। ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মেয়েটির মুখ। কঁপালে দেখা গেলো বিন্দু ঘাম।মুখ ভর্তি আতঙ্ক নিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটি,,

“না…! প্লীজ আমাকে ছেঁড়ে দিন স্যার। আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। দয়া করুন স্যার!”

লোকটি মৃদু হাসলো। মেয়েটির মুখে উপর ঝুকে এক হাতে মেয়েটির গাল টিপে অন্য হাতে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলল,

“যাবে তো সুন্দরী …খুব শীগ্রই তুমি.. তবে,কিন্তু আমার পেটে!”

পিলে চমকে উঠলো মেয়েটির। ডর ভয় হুরহুর করে বাড়লো। হুহু করে কেঁদে উঠলো।

“আমি আপনার পায়ে পড়ি। আমাকে মারবেন না। ছেঁড়ে দিন। আমি..আমি কথা দিচ্ছি আমি চলে যাবো, দূরে..দূরে কোথাও চলে যাবো। আমাকে ছেড়ে দিন।আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচতে দিন।”

মেয়েটির কথার মাঝেই লোকটি ইঞ্জেকশন পুশ করলো।মেয়েটি ঢলে পড়লো আবার।আর লোকটি শক্ত চোয়ালে ভেসে উঠলো রহস্যময় হাসি।

“ডক্টর? এখন রুফাইদাকে কি করবেন?”

অস্বস্তি নিয়ে কয়েকহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গোল গাল চেহারার রোগাসোগা মেয়েটির দিকে তাকালো লোকটি। পরনে ফিনফিনে ক্রীম রঙ্গা জামা।মুখ ভর্তি প্রশ্নের রেশ। লোকটি এগিয়ে এলো। ঠোঁটে কোনে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রুফাইদার দিকে তাকালো। মেয়েটিকে দেখে যেন মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। লোকটি হাসি বহাল রেখে সামনের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,,

“বাকি সবার সাথে যা করি?”

যুবতী নিঃশব্দে ঢুক গিললো। চোখ টিপে দুষ্ট হাসি হেসে বলল,

“বিছানার সঙ্গী বানাবেন? ইউ রেপড হার?”

লোকটি রহস্যময় হাসি বহাল রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মেয়েটিও স্থীর চেয়ে রইলো। মনের কোনে কোথাও তার খুব খারাপ লাগছে। নিজের বান্ধবীকে নরপিশাচের হাতে তুলে দিয়েছে সে। মনে মনে অনুতপ্ত হলেও। ঠোঁটে হাসি ফুটলো। পথের কাঁটা তো দূর হচ্ছে? বাকি সব চুলোও যাক।মরে যাক। অথবা… ধর্ষিত হোক..।

———–

নিস্তরঙ্গ নৈঃশ্বদে চাদর গায়ে মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নগরী। ঘুম নেই শুধু এই জননীর। আজ তিন দিন যাবত সেই মায়ের হৃদয়ের টুকরো হারিয়ে গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেডিকেল কলেজ পড়াশোনো করতো তার মেয়ে রুফাইদা। রূপে গুনে ছিলো পঞ্চম মুখী। ছুটি বাসায় আসবে বলে কন্ঠে আমেদ নিয়ে ফোন দিয়ে ছিলো নাজমা তালুকদারকে। আর আজ তিন দিন চললো, মেয়ের ফোন বন্ধ, হোস্টেলে খবর নিয়ে জানতে পাড়লো, হোস্টেলেও নেই। এবার যেন বুক কেঁপে উঠছিলো নাজমার। ২৪ ঘন্টা পার হতেই মেয়ে নিখোঁজ রিপোর্ট করে এসেছেন তারা। আচ্ছা তার ছোট রুফাইদা ঠিক আছে তো? মেয়েটি খাওয়াদাওয়া করেছে তো? মুখে আঁচলের আড়ালে ঢুকরে উঠলেন তিনি।সেই মুহূর্তে নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ালো এক মাঝ বয়সি লোক। গায়ে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি । শরীরে বার্ধকের লক্ষ্মণ। চশমার আড়ালে চোখের জল লুকিয়ে হাত রাখলেন নাজমার কাঁধে। এক পলক তাকিয়ে নাজমা হাউমাউ করে কেঁদে মুখ লুকালেন তার বুকে।

” সাইফ! আমার মেয়ে কই বলো? ওকে এনে দাও। আমি সইতে পাড়ছি না আর। আমার মন বলছে আমার মেয়ে কষ্টে আছে। ওকে খুঁজে আনো…খুঁজে আনো ওকে…!”

সাইফ তালুকদার স্ত্রীকে বাহু ডোরে বন্ধ করে নিলেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,,

“কেঁদে না নাজমা। আল্লাহ উপর ভরসা করো। ঠিক দেখবে আমাদের মেয়ে চলে আসবে।”

নাজমা অবুঝের মতো কান্না করতেই লাগলেন। আজ সাইফ তালুকদার কাছে কোনো শান্তনা বানী নেই। অসহায় সে।

দরজার আড়াল থেকে মা-বাবার এই কান্না বুকে গিয়ে লাগচ্ছে জয়নবের। ছোট কিশোরী মন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বোনকে হারিয়ে আজ দুঃখে বুক ভাসিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। কই তার বোন। কই তার খেলার সাথী???কই তার পড়ার সাথী?? কই তার ঝগড়ার সাথী। কাঁজলা দিদি কবিতার মতো সেকি আড়ালে চলে গেলো! কিন্তু কেন?

——–

কিছু, কিছু রাত কারো কারো জন্য অত্যন্ত অভিজাত। আবার কিছু কিছু রাত কারো জন্য বন্য প্রকৃতির। সেখানে অারো আধাঁরি খেলা হয়ে থাকে। কিছু গোপন খেলা, বিপদজনক খেলা।কিছুটা প্রকাশ্য, কিছুটা অপ্রকাশ্য।সেখানে প্রমিকের অাদরের মতো রোমান্টিসিজম নেই। আছে শুধু আদিম রিংরিসার মতো অন্তর্দহন প্রণয় দগ্ধ হওয়া দাউ দাউ অগ্নি শিখা। সেখানে শব্দ আছে কারো বাঁচা জন্য আর্তনাদ আছে।এই রাত, এই অগ্নিশিখায় চুড়ান্ত দহনে পুড়িয়ে মারে।

ঠিক তেমনি কিছু আর্তনাদ,, “আমাকে বাঁচাও, আমি বাঁচতে চাই, ছেড়ে দাও আমায়!” বিশাল ব্যয়বহুল এই কামড়া থেকে ভেসে আসচ্ছে। নরম বিছানার উপর শুঁয়ে আছে শুভ্র এক পরি। হাত-পা দুটি খাটের হাতলে বাঁধা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে বাঁচার। ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো কেও। তার দিকে তাকাতেই চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেলো রুফাইদার। সামনের এই দুর্দান্ত সুদর্শন যুবকটি দৈত, নর পিশাচের ন্যায়। পড়নে কালো প্যান্ট , উদম বুক। ডান পাশের একটি ট্যাটু। বাম হাতে চাবুক। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসচ্ছে সে রুফাইদার দিকে। রুফাইদা লোকটি এ রূপ দেখে শিরা-উপশিরায় নিস্তেজ হতে লাগলো। ঘরের মোলায়েম আলোয় মানুষ রূপী দানবটির পিশে ফেলতে চাইছে তাকে। প্রতিটি স্পর্শ ঘা বসাচ্ছে গায়ে। রুফাইদার আর্তনাদ কেঁপে উঠছে জগৎ।

“আমাকে ছেঁড়ে দিন। আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন না। আমাকে ছেঁড়ে দিন!”

কিন্তু শেষ রক্ষে আর হলো না।নিশ্চুপ হলো চারিদিক, হরণ হলো সতীত্ব,মরন হলো মনের, নিথর হলো দেহোখানী। দেহের মাঝে লেগে গেলো ধর্ষিতার দাগ।

——–

রাতের বৃষ্টির পর সকালের রোদের রূপ উড়নচণ্ডী যেন। খা খা মাঠ ঘাট রাগে তপ্ত করছে । রোদের তেজে ঘরের মাঝে ভ্যাপসা গরম আর গুমাটে ভাবে হাপিয়ে উঠে ছিলো জয়নব। তিন রাত ঠিক ঠাক না ঘুমিয়ে, না খেয়ে বেহাল বাবা-মার জন্য চট করে ছোট কিশোরী সকালের নাস্তা করে ফেললো। টেবিল সাজিয়ে বাবা-মাকে জোর জবরদস্তি খাবারে নলা মুখে তুলে দিতেই খটখট শব্দ করে উঠলো দরজায়। বিরক্ত হয়ে জয়নব দরজা খুলতেই মুখখানা সাদা হয়ে গেলো।মুখ গগনবিদারী এক আর্তনাদের বেড়িয়ে এলো,

“ব..ড়..পু”

চলবে,

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here