মুগ্ধতায় মুগ্ধ♥️,Part_01
Labiba Islam Roja
আমি কোনো আশ্রিতাকে বিয়ে করতে পারবো না!শেষে কিনা একটা আশ্রিত মেয়ে হবে এই আদনান চৌধুরীর ওয়াইফ।নো ওয়ে!ওকে বিয়ে করলে লোক সমাজে আমি মুখ দেখাতে পারবো না। সরি, আমি এই বিয়ে করতে পারবো না বাবা!
.
এক নাগারে কথাগুলো বলে গেলো আদনান।একটাবারও আটকালো না।আজ নিজের দুই বছরের ভালোবাসার থেকে আশ্রিত পরিচয় টাই সব থেকে বড় তাঁর কাছে।আদনানের কথা শোনে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধতা।কিন্তু চোখ থেকে এক ফোঁটা চোখের জলও বের হচ্ছে না ওর।কেমন নিস্তব্ধ পাথর হয়ে রয়েছে।যেন আশেপাশের কিছুই স্পর্শ করতে পারছে না তাঁকে।সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গেছে।যাবেই তো দুই বছরের ভালোবাসা আজ ওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলো।বাস্তবতা কতটা নির্মম তা আবারও বুঝতে পারলো সে।বিয়ের আসর পর্যন্ত পৌঁছে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তার প্রিয়তম।যাকে ঘিরে একদিন বাঁচতে চেয়েছিলো সে।যাকে আকড়ে নতুন স্বপ্ন বুনেছিলো।একটা রঙিন আকাশে উড়ার স্বপ্ন ছিলো।কত শত রং বেরঙের তারারা খেলা করতো সেই আকাশে।সবই ধূসর হয়ে গেলো এক নিমিষেই। আদনান কখনও ওর পরিচয় নিয়ে এতটা রিয়াক্ট করবে কল্পনাতীত ছিলো মুগ্ধতার।যেখানে ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে সেখানে মুগ্ধতার পরিচয় এতবড় ইস্যু হবে বুঝতে পারেনি সে।
.
আদনানের বাবাঃআদনান কি সব বলছিস!এখন এটা হয় না।বিয়ের আসরে মুগ্ধতা কে এভাবে অপমান করতে পারিস না তুই।তোকে মুগ্ধতাকেই বিয়ে করতে হবে।এভাবে ওকে ঠকাতে পারিস না তুই।
.
আদনানের বাবার কথায় হু হা করে ভুবন কাঁপানো হাসি দিয়ে হেসে উঠলো আদনান।বাবা আমি ওকে ঠকাচ্ছি সিরিয়াসলি!!শোন বাবা আমি ওকে ঠকাই নি।ও আমায় ঠকিয়েছে।নিজের পরিচয় গোপন করে আমার সাথে সম্পর্ক তৈরী করে আমার সাথে মিথ্যাচার করেছে।ও একটা ঠকবাজ মিথ্যাবাদী মেয়ে।ওর মতো মিথ্যাবাদীকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।আজ যদি অন্যন্যা আমায় না বলতো তাহলে আজও জানতে পারতাম না আমি।অন্যন্যার কাছে এগিয়ে গিয়ে থ্যাংকস আমাকে সত্যিটা জানানোর জন্য।
.
ইট’স ওকে ইয়ার!!
.
ভালোবাসার মানুষটার এত অধঃপতন।নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না আমি।কত সহজে আমাকে ঠকবাজ মিথ্যাবাদীর উপাধি দিয়ে দিলো।অথচ ওকে কতবার সবকিছু খুলে বলতে চেয়েছি আমি।কিন্তু ও সবসময় একটাই কথা বলেছে তোমার অতীত জানতে চাই না আমি।আমি শুধু তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ হতে চাই।পেছনে কি আছে না আছে তা জানার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।তাই এসব কথা আর কখনও বলো না লিভ ইট।আর আজ সেই আদনান সবার সামনে এতগুলো কথা বললো আমাকে ঠকবাজ মেয়ে ভাবলো ছিঃ।
.
আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কি হলো মুগ্ধতা কথা বলছো না কেন…?নাকি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছো।নিশ্চয়ই ভেবেছিলে তোমার অতীত লুকিয়ে আমার মতো বড় বিজনেসম্যানের ছেলেকে ফাঁসিয়ে নিজের লাইফটাকে সেটেল্ড করার কিন্তু আফসোস তা আর হলো কই….তোমার সব খেলা খতম ব্যঙ্গ করে এবার কি হবে মুগ্ধ…..ঠাসস!!কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সজোরে আদনানের গালে থাপ্পড় বসালেন আঙ্কেল।যার আশ্রয়ে এই বাড়ীতে স্থান পেয়েছি আমি।নিজের মেয়ের মতোই আমাকে ভালোবাসেন উনি।গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদনান।
.
ছিঃ ছিঃ তুমি এতটা ছোটলোক জানা ছিলো না আমার।তোমার সাহস কি করে হয় আমার মুগ্ধতা মা সম্পর্কে এতগুলো খারাপ কথা বলার।এতক্ষণ ধরে সহ্য করছি যা নয় তাই বলে যাচ্ছ।কিচ্ছু বলছি না বলে সাহস বেড়ে গেছে।এখন নিজের গালে নিজের ঠাস ঠাস করে মারতে ইচ্ছে করছে। আমি তোমার মতো একটা অমানুষের সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।ভাগ্যিস আজ তোমার আসল রূপ দেখিয়ে দিলে নইলে অনেক দেরি হয়ে যেতো।আরে তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাবে আমি নিজেই তোমার মতো ছেলের হাতে ওকে তুলে দেব না।এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যাও।
.
মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে আদনান।মুখে কোনো কথা নেই।কুলু পেতে আছে…!!
.
একপাশে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আদনানের বাবা।আমার ব্যাপারে সবটাই জানেন তিনি।সবকিছু জেনেও বিয়েতে কোনো আপওি জানাননি উনি।শুধু ছেলেকে এখন জানাতে বারন করেছিলেন। সুযোগ বুঝে পরে জানাবেন বলেছিলেন কিন্তু আদনান এমনটা করবে বা পরিস্থিতি উনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে হয়তো ভাবতেও পারেন নি। ছেলের এমন সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানতে পারছেন না উনি।ভেবেছিলেন ছেলেটা অন্তত মেয়েটার পাশে দাঁড়াবে কিন্তু না ছেলে ডিরেক্ট বিয়ে ক্যানসেল করে দিলো এমন ঘটনায় হতাশ উনি।অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধতার দিকে।ধরা গলায় বললেন…..
.
আজ তোমার সাথে যা হলো তাঁর জন্য অনেকটা আমিই দায়ী।আমি জোর করে তোমাকে আমার বাড়ীর বউ করতেই পারি কিন্তু তাতে তুমি সুখী হবে না আমি জানি।সত্যি কথা বলতে আদনান কখনও তোমাকে ভালোই বাসে নি।হ্যাঁ ওর বাবা হয়ে এই কথাটা বলছি আমি।যদি তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে আজ তোমার হাত কিছুতেই ছাড়তো না।আর এই বাড়ী ভর্তি লোকের সামনে তোমায় অপমানিত হতেও দিতে পারতো না।তাই জোর করে কোনো সম্পর্কের মায়াজালে তোমাকে আটকাতে চাই না আমি।তবে দোয়া করি যাতে এমন কেউ তোমার লাইফে আসে যাঁর কাছে তোমার অতীত কোনো বাধাঁ হয়ে না দাঁড়ায়।জীবনে এগিয়ে যাও সুখী হও।ছলছল চোখে কথাগুলো বলে আঙ্কেলের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন উনারা।আদনান অধরাকে বিয়ে করতে চায় সেই মত পোষণ করলেও আঙ্কেল মানা করে তাড়িয়ে দিয়েছেন ওকে।আদনানের সাথে কোনোকথা বলিনি আমি।বলতে ইচ্ছে করেনি।এমন একটা মানুষ কে আমি ভালোবাসি ভাবলেই গাঁ ঘিনঘিন করে উঠছে আমার।রাগে সারা শরীর রিরি করছে। ওর সাথে কথা তো দূরে থাক ওর মতো মানুষের ছায়াও যেন কোনোদিন মাড়াতে না হয় আমায়।
.
মুগ্ধতা আরমান হকের বাসায় থাকে।ছোটবেলায় তিনি ওকে কুড়িয়ে পেয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন।নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন কিন্তু উনার স্ত্রী তাঁকে সহ্য করতে পারতেন না। বাসায় কাজের লোকের মতোই থাকতে দিয়েছেন সেটা দেখেও কিছু বলতে পারেন না।কারণ অনেক বুঝিয়ে মেয়েটাকে যে থাকতে দিয়েছেন এটাই অনেক।নইলে ওই দশ বছরের মেয়েটা কোথায় যেতো।আরমান হকের দুই ছেলে দুই মেয়ে।আফিফ আর আয়ান।ছোট ছেলে আয়ান লেখাপড়ার জন্য দেশের বাইরে আছে।আর বড় ছেলে আফিফ বাবার সাথে অফিস সামলাচ্ছে। এবার ছেলের বউ দেখতে চান মিস্টার হক।অন্যন্যা আর অধরা দুই বোন।অন্যন্যা বড় আর অধরা ছোট।ছোট থেকেই অন্যন্যা মুগ্ধতা কে পছন্দ করে না আর আদনানের উপর ক্রাশড তাই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছে সে।অন্যন্যা আর অন্যন্যার মা ছাড়া বাকি সবাই নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে ওকে।
.
মুগ্ধতা বাসার কাজকর্ম করার পাশাপাশি লেখাপড়াও করছে।আরমান হকের স্ত্রী কড়া হলেও অতটা কড়া নন।পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ সেনসেটিভ উনি।মুগ্ধতা এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে।আদনানকে বিয়ের জন্য বাসা থেকে চাপ দেওয়ায় বিয়েটা দিতে রাজি হয়েছিলেন মিস্টার হক।কিন্তু বিয়ের দিন একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এতটা জলঘোলা হবে ভাবতে পারেন নি উনি।জানলে এমনটা কখনও করতেন না উনি।এখন এসবের জন্য আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই উনার।অন্যন্যার উপরও বেশ ক্ষেপেছিলেন কিন্তু মুগ্ধতার কথায় কিছু বলতে পারেন নি।মুগ্ধতার ভাষ্যমতে অন্যন্যার জন্যই আজ নতুন করে কুৎসিত মনের মানুষ আদনানকে চিনতে পেরেছে সে।তাই তাঁকে এরজন্য শুধু থ্যাংকসই জানানো যায় আর কিছু নয়।
🍁
রাত বারোটা বা তার কাছাকাছি।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।কালো মেঘে চেয়ে গেছে পুরো আকাশটা।ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে একবার চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে তো আবারও এক টুকরো কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে।বাতাশেও আজ কেমন যেন বিষাক্ততার ঘ্রাণ।অন্ধকারে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিলো মুগ্ধতা।চোখ বন্ধ করে পুরো দিনের ঘটনাটা আবারও প্রথম থেকে মনে করতে লাগলো।আদনান আর মুগ্ধতার বিয়ে শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে অন্যন্যা……
.
আদনান তুমি কি জানো তোমার হবু বউ আমাদের কেউ হয় না।আমাদের সাথে ওর রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।ও আমাদের বাসার একজন আশ্রিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।এই কথাটা শোনা মাএই পিলে চমকে উঠে আদনান।সাথে সাথে বিয়ের আসর ছেড়ে অন্যন্যার কাছ থেকে ডিটেইলসে সবকিছু জেনে নেয়।আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় আদনান।চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে আমার।নিজের দুই বছরের ভালোবাসা কি করে ভুলে গেলো আদনান।আজ আমার থেকে আমার পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠলো ওর কাছে।বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সাথে ভালোই দিন কাটছিলো আমার।তারপর মা এক্সিডেন্টে মারা যায়।মা চলে যাওয়ার পর চাচী বাসা থেকে বের করে দেয় তখনই আঙ্কেল এই বাসায় নিয়ে আসেন আমায়।আন্টি আর অন্যন্যা ছাড়া কেউই বুঝতে দেয়নি এই বাসায় আশ্রিত আমি।এখানে থাকতে থাকতে কখন যে এই বাড়িটাকে নিজের বাড়ি ভেবে নিয়েছি টেরই পাই নি।আদনানকে ভালোবাতাম কিন্তু কখনও ওর সাথে খারাপ কিছু করিনি।ওই মাঝেমধ্যে পার্কে বসে গল্প গুজব নয়তো রাস্তায় হাঁটাহাটি।আমার হাত বেশ কয়েকবার ও ধরলেও ওর হাত কখনও নিজে থেকে স্পর্শ করিনি আমি।বেশ ভদ্রলোকই ওকে মনে হতো আমার।যে আমার একটু চোখের জল সহ্য করতে পারতো না সেই আজ আমার সামনে আমাকে কাঁদিয়ে অপমানিত করে চলে গেলো।সবটাই কেমন যেন লাগছে আমার।আমার ভালোবাসাটা ভুল ছিলো না। ভুল সময়ে ভুল মানুষ নির্বাচন করেছি আমি যার খেসারত এখন দিচ্ছি।
.
সকালে পাখির কিচিরমিচির কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার।চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ফোন হাতে নিয়ে অবাক দশটা বেজে যাচ্ছে।আজকে সকালে কোনো কাজকর্ম করিনি।তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিচে নামলাম আমি।যাক আমাকে কিছু করতে হবে না কাজের লোকই সব করে ফেলেছে।খেয়েই কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম আমি।আমাকে বেরুতে দেখে আন্টি আপওি করলেও আঙ্কেল তাকে থামিয়ে দিলো।ভাবছে হয়তো কলেজ গেলে মনটা যদি ভালো হয় আমার।আমিও সেই আশায় বাড়ী থেকে বেড়িয়েছি।রিকশায় উঠে বসে ভেবে চলেছি।হঠাৎ একটা বাইক এসে আমাদের রাস্তা আটকে রিকশার সামনে দাঁড়ালো।আচমকা রিকশা থামায় হুশ ফিরলো আমার।সামনে তাকাতেই বাইকটা চোখে পড়লো আমার।বাইকে দুজন ছেলে বসে আছে।হেলমেট থাকার কারণে কারোর মুখ দেখা যাচ্ছে না।তবে ইয়াং বয়সের ছেলে সেটা বেশ বুঝতে পারছি।কিন্তু এরা আমার পথ আটকালো কেন ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছি না আমি।এরা কি মাফিয়া,মেয়ে পাচারকারী নাকি ছিনতাইকারী কোনটা।নাকি মেয়েদের একা পেয়ে অসভ্যতা করে তাঁরা।এখন আমি কি করবো চেঁচাবো কিন্তু এই রাস্তায় তো লোকসমাগম নেই বললেই চলে তাহলে চেঁচিয়ে করবো টা কি….!!ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।ছেলেটা আস্তে আস্তে আমার সামনে এগিয়ে আসছে।জড়সড় হয়ে বসে আছি আমি।গলা শুকিয়ে গেছে।কথা বলার শক্তিও পাচ্ছি না।বার কয়েক শুকনো ঢুক গিলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে এক টুকরো সাহস জোগাড় করে খোপা থেকে কাটা খুলে হাতে নিলাম আমি।ছেলেটা যেই আমার কাছে দাঁড়ালো অমনি কাটা ঢুকিয়ে দিলাম ছেলেটার গলার নিচে।আহ!!শব্দ করে ক্ষতস্থান ধরে চেঁচিয়ে উঠলো ছেলেটি…….!!
.
.
চলবে…….