চাঁহাত, ২য় পর্ব
আরশিয়া জান্নাত
সবুজ অরণ্যে বুনোফুল কুড়োচ্ছে এক কিশোরী মেয়ে।লতায় পাতায় কাঠগোলাপের মালা বানিয়ে মাথায় বেঁধেছে।রঙ বেরঙের প্রজাপতির পিছে ছুটছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে।হাসির শব্দের প্রতিধ্বনিতে ঝনঝন করছে যেন পুরো বনটা।পা পিছলে খাদে পড়তে যাবে অমনি কেউ একজন শক্ত করে হাত ধরে ফেললো।কিশোরীটি যেই না ছেলেটির মুখ দেখতে যাবে অমনি এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল চাঁহাতের।ঝিম খিচে বসে স্বপ্নটা রিমাইন্ড করলো।ইশ যদি আর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ফের স্বপ্নটা দেখা যেত!
আয়াজ আজ নেপাল যাবে শুটিং এর জন্য।তাঁর নতুন মুভি “মন পাঁজরে”-র রোমান্টিক সংটার শুটিং ওখানে হবে।এবারের মুভিতে তার সহঅভিনেত্রী হিসেবে কাজ করবে তাথৈ ভট্টাচার্য।গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে তাথৈ মডেলিং করেই তাঁক লাগিয়ে দিয়েছে।এটা তাঁর প্রথম মুভির শুটিং।আয়াজ এর মতো নামিদামি হিরোর সাথে কাজ করতে হবে ভেবেই কেমন হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তাঁর।তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।শুটিং শুরুর আগে রেহার্সেল এর সময় আয়াজ বললো,
“এই মুহূর্তে তুমি এটা ভেবোনা তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে।মনে করো সব ব্ল্যাঙ্ক শুধু তুমি আছ আর তোমার ভালোবাসার মানুষ।নার্ভাসনেস কে পাত্তা না দিয়ে শো ইউর বেস্ট শর্ট!”
তাথৈ ওর কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হলো এবং দুবার ট্রাই করেই বেস্ট শর্ট দিলো।সবাই যখন তাথৈ এর প্রশংসায় মত্ত তাথৈ মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো আয়াজকে।
টং দোকানে বসে চা এ বনরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে চাঁহাত।পাশেই দিপু গিটার বাজিয়ে গান গাইছে,
একটা গোপন কথা ছিল বলবার
বন্ধু সময় হবে কি তোমার
একবার শুনে ভুলে যেও বারবার
তবু ভুলেও কাউকে বলোনা আবার
মুখে ভালোবাসি না বলে মনেতে প্রেম নিয়ে চলে
আছে অনেকেই
এতোদিন ছিল সাধারণ তার মাঝে একজন যাকে
আজ বড় আলাদা লাগে……..
:তুই চাইলেই নুশুকে সরাসরি বলতে পারিস দিপু।
:ও আমাকে ফ্রেন্ড ভাবে।এর বাইরে কিছুই না।আমি আমার মনের কথা বলে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাইছি না।ওর মনে যদি কিছু থাকতো তোদের এতোবার বলার পরও ও কি বুঝতো না?
:শোন ও হয়তো সিরিয়াসলি নিচ্ছে না।ভাবছে ফান করছি।তুই তো কখনওই কিছু বলিসনি এই ব্যাপারে।তুই একবার সরাসরি কথা বলে দেখতে পারিস।হতে পারে তোর মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে?
:উল্টোটা হয় যদি?
:হলে হবে।ক্যামিস্ট্রির স্টুডেন্ট হয়ে এক্সপেরিমেন্টকে ভয় পাচ্ছিস?বিস্ফোরণের ভয়ে কি সায়েন্টিস্টরা বিক্রিয়া করা ছেড়ে দিয়েছে?বি ব্রেভো মাই ফ্রেন্ড!
দিপু মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললো,তোর খাওয়া হলে চল।
চাঁহাত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলো।
বাসায় ফেরার পর চাঁহাতের মা দিলারা মেয়ের কান টেনে বললেন,
ফাজিল মেয়ে তোর ফাজলামো বন্ধ হবেনা?
:আহ মা ব্যথা পাচ্ছি তো।ছাড়ো না
:ব্যথা পেতেই তো ধরেছি।
;কি করেছি আমি বলবা তো?
:ওলে সোনা বাবুতা জানোনা কি করেছ?ন্যাকা সাজা হচ্ছে?
:মা আমি এখন কান্না করবো কিন্তু
:তুই আমার ফরেন পারফিউমটা নিয়ে তোর দাদীর রুমে ভাঙলি ক্যান বল আমারে?তুই জানিস না উনি পারফিউম এর স্মেল পেলেই বকাঝকা করে আমাকে?
:ঠিকই তো করে।তুমি পারফিউম ইউজ করবা কেন।শাশুড়ির নিষেধাজ্ঞা মানোনা আবার আমার কান মলে দিচ্ছ!
:আহা আমার আদর্শ কন্যা নীতিকথার ফুলের ঝুলি!তোর আর তোর দাদীর শখ আহ্লাদ নেই বলে কি আর কারো থাকবেনা?
:অবশ্যই থাকবে।তোমার যেমন পারফিউম এর শখ আমার তেমন সেসব ধ্বংস করার শখ আর দাদুন এর তা নিয়ে বকাঝকা করার শখ ।সিম্পল সিকুয়েন্স!
দিলারা অতিশোকে পাথর হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।চাঁহাত সেই সুযোগে কেটে পড়লো।
ছোট চাচ্চু সিয়ামের ঘরের পাশ দিয়ে যেতেই চাঁহাত কান্নার শব্দ পেল।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে ছোট চাচ্চু বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে।
:কি হয়েছে চাচ্চু কাঁদছ কেন?
সিয়াম কান্না বন্ধ না করেই বললো,
লাস্ট এক সপ্তাহ ধরে আমি একটা স্ক্যাচ আঁকছিলাম।আজ দুপুরে দেখি স্ক্যাচ টাতে রঙ পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
:এজন্য তুমি এভাবে কাঁদবে ওহো!দেখো প্রথমবার কিছু করতে গেলে আমাদের যতোটা কষ্ট হয় পরেরবার কিন্তু ততোটা হয়না।তুমি ট্রাই করো আবার দেখবে আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।
:হবেনারে।এটা অনেক ইউনিক স্ক্যাচ ছিল।কালকেই জমা দিতে হবে।ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড ইউথ ক্রিয়েটিভিটি আর্ট কম্পিটিশনের জন্য এটা এঁকেছিলাম।তুই তো জানিস আমার কত স্বপ্ন এই কম্পিটিশন কে ঘিরে!
:আহা চাচ্চু তুমি শুরু করে তো দেখে!আমার তোমার উপর অগাধ বিশ্বাস তুমি এটা তুড়ি বাজিয়ে করতে পারবে তোমার কাছে এখনো চব্বিশ ঘন্টা সময় আছে।এক মিনিটেও অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।দেখি চোখ মুছে কাজে লাগো।
সিয়াম কান্না থামিয়ে উঠে বললো,
সত্যি বলছিস চেরী? আমি পারবো?(চাঁহাতকে সিয়াম আদর করে চেরী ডাকে)
:অবশ্যই পারবে।কোনো সন্দেহ নেই।
জানলার গ্রিলে দু পা তুলে ফ্লোরে শুয়ে আছে চাঁহাত।পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই খাতা কলম কফির মগ ক্যালকুলেটর।সে চোখ বন্ধ করে গুনগুন একটা গান গাইবার চেষ্টা করছে।কিন্তু লিরিক মনে আসছেনা।চাঁহাত গানের লিরিক একদম মনে রাখতে পারেনা তাই গানের সুর ঠিক রেখে নিজেই লাইন মিলিয়ে গায়।তবে আজকে দুপুরে একটা গান শুনে ওর মনে হলো এটার লিরিকটা মুখস্থ করতেই হবে।কার গান সেটাও জানা দরকার।গুগলে সার্চ দিতেই দেখলো আয়াজ আহমেদ এর “Broker”- মুভির গান এটা।
মুভির নামটা দেখেই চাঁহাত ভ্রু কুচকে বললো দালাল! এটা কোনো মুভির নাম হলো? কি সব নাম দিয়ে যে এরা সিনেমা বানায়!
নীলছে রঙের পাঁয়তারা তে ঘুম লেগেছে চোখে
স্বপ্ন টানে মন বিহানে খুঁজছে তোমার স্মৃতি
ছন্নছাড়া এই আমি টা তোমার পাড়ার মুখে
তোমায় দেখার নেশায় পড়ে বাড়ছে হৃদের গতি
ভালোবাসি কি না জানি না
কিছুই আমি বুঝি না
আমি শুধু জানি তোমাকেই চাই ও গো বিদেশিনী
(লেখিকা:আরশিয়া জান্নাত)
ভালোবাসি কি না জানি
কিছুই আমি বুঝি না
আমি শুধু বুঝি তোমাকেই খুঁজি
এ মন পাগলপাড়া তুমি ছাড়া ।।।।।।।
__________
: হ্যালো স্যার।
: হ্যাঁ পিন্টু বলো।
: স্যার আপনার জন্য গুড নিউজ আছে।আমাদের সোর্স সেই মেয়ের সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করতে পেরেছে।
:কি বললে!! দ্যাটস গ্রেট।আমি দুপুরের ফ্লাইটে দেশে ফিরবো তুমি রাতে মিট করো আমার সাথে।
:ওকে স্যার।
আয়াজের মনটা অদ্ভুত শিহরণে বারবার কেঁপে উঠছে।সত্যিই কি এবার দেখা মিলবে তাঁর? যার জন্য এতোগুলো বছর অপেক্ষা করে যাচ্ছে।
“”একবার তোমায় পেয়ে নেই।এবার আর হারাতে দেবো না।একদম বুকের পিঞ্জরে আটকে রাখবো।এতে লোক আমায় জালেম বলুক আর যাই বলুক।তোমাকে আমি হাতছাড়া করছি না মিস অপরিচিতা!! “”
ইরা আর নীলয় একে অপরকে অনেক ভালোবাসে।ভার্সিটির শুরুর দিকে ইরাকে কিছু সিনিয়ার ভাইয়েরা প্রপোজাল দেওয়া শুরু করতেই নীলয় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।সেই রাগের চোটেই একদিন ইরাকে টেনে নিয়ে যায় করিডরের শেষ মাথায়।তারপর দেয়ালে চেপে ধরে বলে,
তোর দিকে ওরা তাকাবে কেন? এতো সেজেগুজে ক্যাম্পাসে আসবি ক্যান তুই বল আমারে?
:আমি কই সেজেগুজে আসলাম? লাস্ট কবে লিপস্টিক দিয়েছি নিজের ই তো মনে নেই।শুধু কাজল দেই চোখে তাতেই বেশি সাজগোজ??
:তোর লিপস্টিক লাগে নাকি তোর ঠোঁট এমনিতেই তো গাঢ় গোলাপী।আর কাজল কে তোর সামান্য মনে হয়?? তুই জানিস চোখে কাজল দিলে কত বড় সাইক্লোন আসতে পারে ছেলেদের মনে?
:তুই পাগল হয়ে গেছিস।ছাড় এখন ক্লাস আছে।
এই বলে ইরা সরে যেতে নিলেই নীলয় হেঁচকা টানে ইরাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে ইরার মুখটা দুহাতে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে,
হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি।তোর জন্য পাগল হয়ে গেছি।তোকে অন্য কেউ ভালোবাসলে সহ্য হয়না আমার।তোকে শুধু আমি দেখবো,আর কেউ না।
তুই শুধু আমার।
ইরা অবাক চোখে নীলয়ের কথাগুলো শুনছে,অজানা মোহে হারিয়ে যাচ্ছে যেন।
কপালে নরম স্পর্শ পেতেই হুশ ফিরলো ইরার নীলয় ততক্ষণে ওকে ছেড়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।
সেই থেকেই শুরু হয় তাঁদের প্রেমের পথচলা।অন্য আর পাঁচটা কাপলদের মতো এরা লুতুপুতু প্রেমালাপ করেনা ।আগের মতো বন্ধুসুলভ সম্পর্ক।যা হবে বিয়ের পর হবে।এখনই প্রেম করে সেই অনুভূতি শেষ করতে চায় না ওরা।নীলয়ের এক কথা বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করবো।এখন পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে ফোকাস দিতে হবে।
ইরা অবশ্য মাঝেমধ্যে পাগলামি করে।টুপ করে গিয়ে নীলয়কে জড়িয়ে ধরে,চুমু খায়।এভাবেই চলছে তাঁদের ভালোবাসা।
দিপু বেচারা নুশুকে দেখে দেখেই জীবন পার করে দিবে মনে হচ্ছে।চাঁহাত তার কাপল বন্ধুদের দেখে আর আনমনে হাসে।ওর এসবে তেমন ইন্টারেস্ট নেই তবে অন্যের ভালোবাসা দেখতে খুব ভালো লাগে।যেমন তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যকার ভালোবাসা ভালো লাগে।
“ভালোবাসা ভালো নয় এই কথা টা তো সত্যি নয়
ভালোবাসা জয় করেছে বিশ্ব বিস্ময়!!”
আচ্ছা গানটার শেষের শব্দটি ঠিক আছে তো??মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো চাঁহাত।
আয়াজ এর হাতে সেই মেয়েটির ছবি।সে একমনে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে।এটাই কি তবে ওর সিনড্রেলা???
চলবে……