চাঁহাত,পর্ব-১

চাঁহাত,পর্ব-১
আরশিয়া জান্নাত

ভোরের মৃদু আলোতে ঘুম ভাঙলো আয়াজ এর।ফ্রেশ হয়েই এক্সারসাইজ করা শুরু করলো।তাঁর পিএ মেরাজ এসে প্রোটিন শেক রেখে সারাদিনের রুটিন রিভাইজ দিলো।
:স্যার,সাতটায় আপনার ব্রেকফাস্ট,আটটায় বিউটিশিয়ান আসবে,এগারোটায় আপনার শট আছে।আজ বৃষ্টি হবার পসিবিলিটি আছে তাই দুপুরের শট পোস্টপন করা হয়েছে।সন্ধ্যায় একটা ইন্টারভিউ আছে।আর হ্যাঁ আপনার সাথে নতুন মুভির ডিল করার জন্য মিস্টার শহীদ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন।স্যার উনাকে কি দুপুরে আসতে বলবো?যেহেতু এই টাইম টা গ্যাপ হয়েছে…
:দুপুরে বৃষ্টি হলে আসতে বলো না।তাঁকে বরং রাতে আসতে বলো।
আয়াজ আহমেদ, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।অভিনয় এর পারদর্শিতায় অল্পকিছুদিনেই সবার মন জয় করে একের পর এক বাজিমাত করে চলেছে।নাম জোশ খ্যাতিতে সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।মেয়েরা ওর পিছে লাইন ধরে পড়ে থাকে।একশন হিরো হলেও রোমান্টিজমে দারুণ ক্যামিস্ট্রি ক্রিয়েট করার অভিনব প্রতিভা নিয়েই যেন জন্ম তাঁর।খুব বিনয়ী অথচ রাশভারি আয়াজকে দেখলে শুরুতে কেউ বুঝতেই পারবেনা সে কথা কম বলে।
চেহারায় সবসময় মুচকি হাসি লেগেই থাকে।এই পর্যন্ত তাঁর একটাও স্ক্যান্ডাল নেই।কত মেয়ে তাঁর কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছে,কত নায়িকা এক রাত কাছে পেতে আকুতি করেছে আয়াজ সেসব পাত্তাই দেয়নি।সেসব মেয়েদের কাছে আয়াজ “এংরি ইয়াং ম্যান” বলেই পরিচিত।
আয়াজ এর মা আয়েশা ইমরোজ ফ্রুট স্যালাড টা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
অজু দুপুরে বাসায় থাকবি?শুনলাম শুটিং নেই তখন।
:কেন মা কোনো কাজ আছে?
:না কোনো কাজ নেই।এমনি মা ছেলে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চেয়েছিলাম।খিচুড়ি আর ইলিশ ভাঁজা হবে…..
:মেডাম স্যার ডায়েট এ আছেন।এখন হেভি ফুড ইগ্নোর করলে হতো না (পাশ থেকে বললো মেরাজ)
:তোমাকে না কতবার বলেছি আমাদের মাঝে কথা বলবেনা? ডায়েট এর নাম করে করেই কিসব ছাইপাঁশ খাইয়ে মারছো ছেলেটাকে।
এই টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে যদি মনমতো খেতেই না পারে?লাস্ট কবে পেট ভরে খেয়েছে মনে আছে?
আয়াজ মুচকি হাসি দিয়ে মায়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো,
মা হাইপার হয়োনা।তোমার ছেলের শরীরটাই তো সব।এটাকে ফিট না রাখলে চলে?তুমি অযথাই মেরাজকে বকাবকি করছো।ও তো ওর দায়িত্ব পালন করছে কেবল।আজ দুপুরে আমি অবশ্যই খিচুড়ি খাবো।একদম পেট ভরে খাবো।তুমি আচার আর ডিম ভাজা রাখতে ভুলোনা।
আয়েশা মমতাভরা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন।
🌿🌿🌿🌿
ফোনে লাস্ট এলার্ম বাজতেই আৎকে উঠলো চাঁহাত।”আজকেও লেট ওহ নো”
চটজলদি কোনোরকম মুখটা ধুয়ে শর্টকাট রেডি হয়ে মায়ের হাত থেকে রোল করা পরোটা ডিম হাতে নিয়েই দৌড়ে নীচে গেল।
তাঁর মা দিলারা আহমেদ মেয়ের এসব কর্মকান্ডে অভ্যস্ত।এতো বার ডাকা সত্ত্বেও কোনোদিন চাঁহাত কে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে তুলতে পারেননি তিনি।
চাঁহাত অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।পড়ছে অর্গানিক ক্যামিস্ট্রি নিয়ে। ওর সারাদিন কাটে রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ে।ক্লাস শেষে প্র্যাকটিক্যাল,লাইব্রেরি করে করে জীবন এ একবিন্দু অবসর নেই।
তাঁর মায়ের শখ ছিল মেয়েকে নাচ গান শেখাবেন।কবিতা আবৃত্তি করাবে বনলতা সেন কিংবা মাধবীলতা টাইপ মেয়ের মতোন গড়ে তুলবেন।
কিন্তু মেয়ের পছন্দ রসকসহীন রসায়ন!
বনলতা তো দূরে থাক সাধারণ মেয়ের কোনো বৈশিষ্ট্যই ওর মধ্যে নেই।কোনোদিন চোখে কাজল আঁকেনি,সুন্দর করে চুল বাঁধেনি।ম্যাচ করে কাপড়টা পর্যন্ত পড়েনা।ড্রেসিং সেন্স এতো জঘন্য যে মাঝেমধ্যে দিলারার মনে হয় এটা তাঁর মেয়ে না।একে হসপিটালে চেইঞ্জ করা হয়েছে।
গোছালো দিলারার মেয়ে এতো অগোছালো কিভাবে সম্ভব!!
ক্লাস শেষে চাঁহাত, ইরা,দিপু,নাতাশা,নীলয় বকুলতলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল।তখন নাতাশা বলল,
আমার অজু বেবির নতুন মুভি রিলিজ হয়েছে।।জানিস সেখানে ওকে কত হট লাগছিল!এই মুভির জন্য নাকি জিম করে ওয়েট লুজ করেছে…
ইরা:তোর এই অজু বেবিটার কাহিনী শোনাতে আসিস না তো।সারাক্ষণ তাঁর গল্প শুনে শুনে কান গেছে আমার।
নীলয়:একদম ঠিক বলেছিস।নুশু খালি অজু অজু করে মরে।ওদিকে দিপু যে ওর জন্য মরিয়া হয়ে ভ্যাবলাকান্ত বনে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
নীলয়ের কথায় দিপু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নাতাশা থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।নীলয়টা হাঁটে হাঁড়ি ভাঙতে ওস্তাদ।উফ!
চাঁহাত হাসতে হাসতে বললো,
তুই ও না নীল বেচারাকে যখন তখন লজ্জায় ফেলে দিস।কি মনোযোগ দিয়ে দেখছিল নুশুকে !
নাতাশা এবার বাজখাই গলায় বললো,তোরাও না কি সব বলিস।We are just friends.আমার স্বপ্নের নায়ক তো অজু।স্বপ্নে কতবার আমাদের বিয়ে হয়েছে জানিস! সেদিনও তো স্বপ্নে দেখলাম অজু আমায় লম্বা করে চুমু খাচ্ছে!! হায়ইইইই…

দিপু খুকখুক করে কেশে উঠলো।নীলয় দিপুর পিঠ চাপড়ে বললো,সামলা দোস্ত, এমন সেলিব্রিটি লাভার মেয়ে কে পছন্দ করলে অনেক কিছুই হজম করতে হবে।

চাঁহাত:মিডিয়াতে কাজ করা ছেলেদের ক্যারেকটার ঠিক হয় নাকি?কতশত মেয়ের সাথে কাজ করে।একে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।ওতো সুন্দরীর ভীড়ে থেকে থেকে বিশেষ একজনকে ভালোবাসতে পারে নাকি?তুই ও না কিভাবে এমন কারো উপর এতো ফিদা হতে পারিস বুঝিনা আমি।
ইরা:একদম ঠিক বলেছিস।
নাতাশা: বলবিই তো তোরা।সারাদিন তো বইয়ে মুখ গুঁজে থাকিস।বুঝবি কিভাবে অজু কি চিজ।ওর পার্সোনালিটি দেখেছিস?
ওর ইন্টারভিউ গুলো দেখিস,স্যোশ্যাল ওয়ার্ক সম্পর্কে খবর নিস।He is pure Gem…
চাঁহাত হেসে উড়িয়ে দেয়।
🍁🍁🍁
আয়াজ বেলকনীতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে।সচরাচর সে বৃষ্টি দেখে না।বৃষ্টি পড়তে দেখলেই অতীতের সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে।যাকে এখনও খুঁজে ফিরছে রোজ।অথচ কোনো হদিস ই মিলছেনা।পৃথিবী নাকি কমলালেবুর মতো গোল।এই ছোট্ট পৃথিবীতে তবে কেন সে তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেনা?
বৃষ্টি ছুঁয়ে দোআ করলে নাকি দোআ কবুল হয়।সে তো কতবার দোআ করেছে কবুল হলোনা তো।তবে কি ওর দোআ তে আল্লাহর রহমত নেই?

চাঁহাত তাঁর জুতো জোড়া হাতে ঝুলিয়ে মনের আনন্দে ভিজতে ভিজতে বাসায় এলো।রাস্তায় ওর জুতো ছিঁড়ে গেছে।ভার্সিটির বাস থেকে নেমে চাইলেই রিকশা নিতে পারতো কিন্তু ভেজার সুযোগ পেয়ে লোভ সামলাতে পারেনি।সকালে তাড়াহুড়োতে মায়ের কেনা লেডিস জুতো পড়াতেই এই সমস্যা হয়েছে।এজন্যই সে সবসময় ক্যাডস পড়ে।”লেডিস থিং মানেই প্যারা” মনে মনে বললো চাঁহাত।
চাঁহাত এর বাবা ওমর ফারুক মেয়েকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন,
হেই বিউটিফুল লেডি! সিনড্রেলা কি এখন জুতো হাতে করে নিয়ে আসে? পাছে রাজকুমার না তাড়া করে ?
:কি করবে বল সিনড্রেলার এসব পড়ে অভ্যেস নেই তো।যতবার পড়ে ততোবার ছিঁড়ে।তাই হাতে তুলেই নিয়ে আসে।
:রাস্তায় ফেলে দিলেই তো পারো।নিয়ে আসার কি দরকার?
:এগুলো তোমার মহারাণীর রিমাইন্ডার এলার্ট, রেকে দেখে যদি এইসব ছাইপাঁশ আমার জন্য না কেনে তাই আর কি!
:হাহাহা লাভ নেই।সে তারপরও তোমার জন্য এসব ই কিনবে।যাই হোক যাও চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নাও।


:সুগার কয় কিউব নিবে?
:একটা।
:মুভি তো রিলিজ হয়ে গেছে।এখনো ডায়েটে?
:ফিগারটা ডিরেক্টরের পছন্দ হয়েছে।আরো দুটো মুভি সাইন করেছি।
:বাহ! অবশ্য তোমাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে।গালের টোলটা আগের চেয়ে ডেবে গেছে মনে হচ্ছে।
আয়াজ মুচকি হেসে তাঁকালো তিয়াশার দিকে।
লম্বা ছিপছিপে গড়নের পুতুলের মতো মেয়েটা কি না ফিজিক্স এর প্রফেসর! সিঙ্গাপুরে এই কঠিন সাব্জেক্ট এ ছাত্র পড়ায়।
তিয়াশা আয়াজের কলেজ ফ্রেন্ড।সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেই আয়াজের সাথে দেখা করতে চলে এসেছে।
তিয়াশা কফি মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
তোমার সেই সিনড্রেলাকে পেয়েছ?
:নাহ।
:কত বছর হয়ে গেছে।এখনো তাঁর আশায় বসে আছ?
আয়াজ কিছু বললোনা।
তিয়াশা খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে চেয়ে রইলো।এতো বছর একসঙ্গে থেকেও যাঁর মন পেলো না, তাঁর মন কি না দখলে রেখেছে ক্ষণিকের কেউ!!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here