মাতাল হাওয়া,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব

মাতাল হাওয়া,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব
তাসনিম জারিন
৭ম_পর্ব,

রাতে হোটেলে ফিরে এলো নিরব, তুলি, রায়না আর রাকিব। তুলি আর রায়না ওদের রুমে চলে গেল নিরব আর রাকিব ওদের রুমে। রায়না ফ্রেশ হয়ে তুলি, নিপা, সুমিকে বললো,
“তোদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই”।
সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে অধীর আগ্রহ নিয়ে রায়নার কথা সুনার জন্য।
“রাকিব আমাকে প্রপোজ করেছে। আমাকে অনেক ভালবাসে। আমি আজকে অনেক খুশি রে! তোদের আমি বলে বুঝাতে পারবোনা”।
লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে রায়নার কথা সুনে সবার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। নিপা বললো,
“আরে ব্যাস! কি বলিস! তোদের দুইজনের ভিতর এতকিছু হয়ে গেলো আর আমরা কেউ টেরই পেলাম না। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছিলো তাই না!”
“আচ্ছা রাকিব ভাইকে তো তুই সহ্যই করতে পারতি না সারক্ষন খিটখিট করতি আর এখন উনার প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছিস বাহ ব্রো! তোর জুড়ি নেই।” এই বলে হাসতে লাগলো সুমি।
“ইশ! তোরা থামবি! আমাদের রায়না প্রেমে পরেছে আর তোরা মজা নিচ্ছিস। আমি তো ভেবেছি এইমেয়ে সারাজীবন চিরকুমারী থাকবে যেই তেজ উনার কোনো ছেলে ধারের কাছে আসবে কিনা সন্দেহ ছিল। বেচারা রাকিব ভাই! ফেসে গেলো!” এই বলে তুলি শব্দ করে হাসতে লাগলো সাথে নিপা আর সুমিও যোগ দিলো।
রায়না রাগ করে মুখ ফুলিয়ে ওদের তিনটাকে বালিশ দিয়ে মারতে লাগলো।
“তোরা সবকটা শয়তানের হাড্ডি! আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি আর উনারা আমার মজা উরাচ্ছে”। মুখ উলটে বললো রায়না। হাসিঠাট্টা করে ওদের সবার রাত পার হল।

পরদিন সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সবার অনেক মন খারাপ এই দুইদিন অনেক বেশি আনন্দ করেছে যা ভুলার মতো না। আবার চলে যাচ্ছে সেই ব্যস্ত নগরীতে যেয়ে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পরবে।

“কিরে বেটা! তুলিকে প্রপোজ করলি নাকি দেবদাস হয়ে আছিস এখনো।”

“কি মনে হয় তোর?”

“ওরে সালা! বলে দিছিস নাকি?”

“হুম”।

মুচকি হেসে সব কাহিনী বললো নিরব। রাকিব তো আকাশ থেকে পরলো। ও জানতো নিরব ওর মনের কথা বলবে তুলিকে কিন্তু এতো তারাতারি বলবে তা বুঝেনি। নিরব একটু ইনট্রোভাট টাইপের ছেলে ও সহজে কাউকে ওর মনের কথা বুঝতে দেয়না কিন্তু সেই ছেলে কিনা প্রপোজ করে ফেললো তাও এত ফিল্মি রোমান্টিক স্টাইলে রাকিবের যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা এইকথা।

“দোস্ত আমারেও কিছু আইডিয়া দেনা! তোর প্রপোজাল এর কাহিনী শুইনা তো আমার হিংসা লাগতাছে। ইশ! তোর কাছ থিকা আগে কি লিগগা আইডিয়া নিলাম না।”

“কেন তুই আবার কারে প্রপোজ করবি? কেউ আছে নাকি যে আমি জানিনা?” নিরব ব্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

“আরে না! কি যে বলিস আমার কেউ থাকবে আর তুই জানবি না তা কি হয় বন্ধু। কিন্তু তাই বইলা যে কেউ আসবে না ভবিষ্যতে তার কোন ঠিক আছে। একটু আইডিয়া নিয়া রাখলে ভালো না? এইজন্য জিগাইলাম আর কি দোস্ত।” ঢোক গিলে রাকিব আমতা আমতা করে বললো।

“যাহ বাবা! বাইচা গেলাম বুঝে নাই। যদি কই মামা তোরে যে তোর বইনের প্রেমে হাবুডুবু খাইতাছি তুই আবার আমারে মাইরা না হসপিটালে পাঠাস! ভয় লাগে মামা তোমারে।” বুকে ফু দিয়ে মনে মনে ভাবলো রাকিব।

তুলি চুপচাপ করিডোরে দাঁড়িয়ে পাখিগুলোর সাথে খেলছিল। জাহাজের পিছনে কতগুলো পাখি উড়ছে। তুলি চিপস দিচ্ছিল ওদের। হুট করে নিরব পিছন থেকে তুলিকে জরিয়ে ধরে। আচমকা আক্রমণে তুলি চমকে উঠে কিন্তু যে পিছন থেকে ধরে আছে তার গায়ের মিষ্টিগন্ধটা তুলি খুব ভালভাবে চিনে এইটা যে ওর প্রিয় মানুষটা ছাড়া যে আর কেউ হতে পারেনা তা খুব ভালোভাবে জানে তুলি। লজ্জা পেয়ে বললো,

“এই ছাড়ুন কেউ দেখে ফেলবে!”

“দেখুক”।

“ইশ! এমনভাবে বলছেন যেনো আমি আপনার বিয়ে করা বউ! কেউ দেখলে খুব লজ্জা পাবো। প্লিজ ছাড়ুন।”

“ছাড়বোনা! তুই আমার বউই তো। মন থেকে তোকে বউ মেনে নিয়েছি শুধু তিন কবুল বলা বাকি। আর বাকি মানুষের কথা তুইতো জানিসই আমি কারো ধার ধারি না। আমি যেমন ওইভাবেই থাকতে পছন্দ করি। বাসায় যেয়েই মাকে তোর কথা জানাবো। তারপর শুধু তিন কবুল বলার অপেক্ষা।”

তুলি প্রচন্ড পরিমানে লজ্জা পেল কিন্তু অদ্ভূত এক শান্তি পেলো নিরবের কথায়। ওর মতো অনাথ মেয়েকেও যে কেউ এতোটা ভালবাসতে পারে, নিজের বউ করতে চায় তা যেন তুলির সপ্ন ছিলো। নিরব তার সপ্নদুত হয়ে যেনো ওর সপ্ন পূরণ করতে এসেছে। তুলি নিরবকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। নিরব তুলির চুলের মাতাল করা ঘ্রাণ নিয়ে কাধে চুমু খেল। তুলি শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে নিল।

রাত ১০টায় সবাই বাসায় পৌছালো। রাকিবও বাস থেকে নেমে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার আগে রায়নাকে ইশারা করে বলে গেল রাতে ফ্রী হয়ে ফোন দিতে রায়না ও ইশারায় বললো ঠিকাছে। সালেহা বেগম নিজের বাচ্চাদের পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল।

“এতদিন ঘরটা ফাকা ফাকা লাগত এখন ঘরে প্রাণ ফিরে এলো। এই অধমের কথা যেন সবাই ভুলেই গেছিলি।” মুখ ফুলিয়ে সালেহা বেগম বলে উঠলো।

“ছোট মা” বলে নিপা, সুমি, রায়না জরিয়ে ধরলো সালেহা বেগমকে।

“খালামনি” বলে তুলিও জরিয়ে ধরলো সালেহা বেগমকে।

“এইটা কেমন কথা মা! মেয়েদেরকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলে গেলে!” মন খারাপ করে নিরব বললো।

“ওরে আমার বাদড় ছেলে তোকে কি নিমন্ত্রণ করতে হবে নাকি!”

“মা!” বলে জরিয়ে ধরলো নিরব সালেহা বেগমকে।

চলবে…………….

মাতাল হাওয়া
৮ম_পর্ব
তাসনিম জারিন

বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। মেঘের গর্জন শুনা যাচ্ছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। নিস্তব্ধ রাত চারিদিকে সুনসান নিরবতা। আকাশে কালো মেঘ করেছে তার সাথে কালো মেঘ জমেছে নিরব তুলির মনেও। নিরব বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজেকে পুরাচ্ছে। তুলিও বারান্দায় বসে বসে কান্না করে চোখ ফুলাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাত কারো জন্য খুব সুখকর আবার কারো জন্য যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুনা। রাতের এই অন্ধকারে দুজন মানুষের মনেও অন্ধকার নেমেছে। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে দুটি মন। কিছুক্ষন আগের কথা…………

সেন্টমার্টিন থেকে ফিরেছে আজ পনেরো দিন হয়ে গেছে তাই নিরব ভাবলো এইবার মা বাবা কে জানানো উচিৎ তুলি আর ওর বিয়ের বেপারে। সন্ধায় অফিস থেকে ফিরে নিরব বাবা মা কে ড্রয়িংরুমে ডাকলো।

“মা-বাবা তোমাদের সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।”
“হ্যাঁ বাবা বল” সালেহা বেগম বললো।
“আমি একজনকে খুব পছন্দ করি। ভালোও বাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই যদি তোমাদের কোনো আপত্তি না থাকে।”
“এইটা তো খুব ভালো কথা, আমার ছেলে শেষমেষ বিয়ে করতে রাজী হয়েছে আমার আর কি চাই। তো মেয়েটা কে শুনি।” উৎসুক হয়ে সালেহা বেগম বললো।
“বিয়ে করবে ভালো কথা। কিন্তু আমাদের জানতে তো হবে মেয়ে কে, কোথায় থাকে, মেয়ের পরিবার কেমন, বংশগত যোগ্যতা কেমন। সব যদি ঠিক থাকে তো আমাদের আর আপত্তি কেন থাকবে।” রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বলে উঠলো।
“বাবা—-মা—- আস—লে মেয়েটাকে তোমরা খুব ভালো ভাবে চিনো। আর ও এই বাড়িরই মেয়ে।”
সালেহা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“বাড়ির মেয়ে! কে বল শুনি তো বাবা।”
“তুলি”
“নিরব” রহমান সাহেব চিতকার করে উঠল।
“তোমার সাহস হয় কি করে একটা অনাথ মেয়েকে এই বাড়ির বউ করতে চাও! ওই মেয়ের কোনো যোগ্যতা নেই এই বাড়ির বউ হবার। তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমার এই প্রস্তাবে রাজী হব।”
“আহা থামোনা! ছেলেটাকে তো কথাটা শেষ করতে দাও।”
“তুমি থামো সালেহা! তোমার আস্কারা পেয়ে এই ছেলে মাথায় উঠেছে।।পরিবারের মান মারিয়াদা সব ভুলে গেছে। আমি কখনো এই সম্পর্ক মানবোনা। মরে গেলেও না।”
“বাবা! কি বলছো তুমি এসব! তুলিকে আমি ভালোবাসি আর ও এই পরিবারেরই মেয়ে ছোটো থেকে তোমারাই ওকে বড়ো করেছো। আর এখন অনাথ নামটা ওর মাথায় মেরে দিলে। তুলির চেয়ে বেশি যোগ্য মেয়ে আমার জন্য কেউ হতে পারবেনা। আমি তুলিকেই বিয়ে করতে চাই। আর না হলে আজীবন চিরকুমার হয়ে থাকতে রাজি আমি।” নিরব শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো।
“সালেহা! তোমার ছেলেকে বলে দাও আমি কখনো এই সম্পর্ক এই বিয়ে মানবোনা তারপরো যদি ও তুলিকে বিয়ে করতে চায় তো আমার বাড়ি থেকে যেনো বের হয়ে যায়। এইবাড়ির দিকে যেনো কখনো ফিরে না তাকায়।”
“আমার কথাটা তো শুনো।” আকুল কন্ঠে বলে উঠে সালেহা বেগম। কিন্তু তার আগেই রহমান সাহেব চলে যায়।
“বাবা! আমার কথা শুন। বাবার কথা শুনে রাগ করিসনা। আর রাগের মাথায় কোনো ডিসিশনও নিসনা। আমি উনাকে বুঝাবো। বুঝালে উনি ঠিক বুঝবে দেখিস। আমাকে একটু সময় দে বাবা।”

নিরব চুপচাপ চলে যেতে নিলে তুলিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। তুলির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। নিরব এর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। তুলি যে সবকথা শুনে নিয়েছে তা আর বুঝার বাকী নেই নিরবের। তুলিকে কিছু বলার আগেই তুলি এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে কান্না করতে করতে নিচে বসে পরল। ওর আগেই ভাবা উচিত ছিল ওর মতো অনাথ কে কেউ নিজের ঘরে জায়গা দিতে পারে কিন্তু আপন কারো জায়গা দিতে পারেনা। কান্না করতে করতে নিচে শুয়ে পরলো তুলি। আজ মা বাবার কথা খুব মনে পরছে। কেন নিয়ে গেলনা উনারা আমাকে নিজের সাথে তাহলে আজ এইদিন দেখতে হতোনা। তুলি মনে মনে ঠিক করে নিল চলে যাবে এই বাড়ি থেকে নিরব এর মন থেকেও। ওর জন্য বাবা ছেলের মাঝে দেয়াল সৃষ্টি করতে দিবেনা। ওর জন্য নিরব এর প্রেম আদার বেপারির মতো যা কখনও ওর হবেনা। চোখ গুলো ব্যাথা করছে তুলির অনবরত কান্না করার কারণে। কিন্তু এই ব্যাথার থেকে বেশী রক্তক্ষরণ হচ্ছে তুলির বুকে যেই ব্যাথা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে ওর প্রতিটি ভাবনাকে।

নিরব ভাবতে পারছে না কিছু। বাবা এইটা কি বললো! কিভাবে বলতে পারলো! ভেবে পাচ্ছেনা নিরব। না ও বাবা মাকে ছাড়তে পারবে না তুলিকে। ওরা তিনজন ওর অস্তিত্বে মিশে আছে। একজনকে ছাড়া আরেকজনকে নিয়ে বাচতে পারবেনা।এদের মধ্যে কাউকে ছাড়ার সাহস নেই ওর। কিন্তু কিভাবে কি মেনেজ করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এইরকম দোটানায় জীবনে কখনো পড়েনি নিরব। এক গভীর নিঃস্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো। কাল কি হবে তার জানা নেই।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here