মাতাল হাওয়া,পর্ব-৩,৪
তাসনিম জারিন
৩য়_পর্ব
“আচ্ছা এতগুলো পথ একসাথে যাব আমরা, তো একসাথে একটু হাসি ঠাট্টা করে যাইনা নাকি” রাকিব বললো রায়না কে। “তো” ছোটো করে বললো রায়না। দেখুন এমনিই আমার আপনার পাশে বসতে হলো মেজাজ অনেক খারাপ আর আপনি ফালতু কথা বলে আর মেজাজ খারাপ করবেন না প্লিজ। ওরে বাবা এই মেয়ে দেখি ধানিলংকা আমি বললাম আরও ভালোর জন্য আর এই মেয়ে দেখি পারেনা আমাকে খেয়ে ফেলে, মনে মনে বললো রাকিব। “আচ্ছা তুমিকি সবসময়ই এমন”? “কেমন?” জিজ্ঞেস করলো রায়না। না মানে সবসময়ই এমন ধানিলংকা হয়ে থাক? কিহ আমাকে আপনি কি বললেন আমি ধানিলংকা আপনার সাহস তো কম না, রেগে বললো রায়না। না না আমি ওইরকম ভাবে মিন করে বলি নাই, আর ধানিলংকা কিন্তু খারাপ কোন ওয়ার্ড না আমি কিন্তু একহিসাব এ তোমার সুনাম ই করলাম। হয়েছে আমার আর সুনাম করতে হবেনা আপনার, প্লিজ দয়া করে একটু মুখটা ওফ রাখেন আপনার তাহলেই আমি শান্তি। রাকিব ও আর কথা বারালো না যেই মেয়ে বাপরে কখন আবার কি করে বসে তার নাই ঠিক, কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে সিট এ হেলান দিয়ে বসলো। রায়না মনে মনে হাসলো আর বললো, আপনাকে এতটাও খারাপ লাগে না রাকিব, আপনার আমাকে ভয় পাওয়া, আপনার দুষ্টমি, আপনার হাসি, আপনার কথা বলা, আপনার সবকিছু আমার অনেক ভালো লাগে, মনের কোণে কবে যে জায়গা করে নিয়েছেন নিজে ও জানিনা। সময় হলে আমি আপনার কাছে ধরা দিব।
“নিরব ভাই আপনি কেন এতো বকেন আমাকে? আপনি জানেননা আমার কতো খারাপ লাগে, আমার কারো কোনো কথায় যায় আসেনা কিন্তু আপনি কিছু বললে খুব অভিমান হয়, মনে হয় আমার মনের আকাশে মেঘ জমেছে কিন্তু কেন এমন মনে হয় নিজে ও জানিনা” ঘুমুঘুমু কন্ঠে বললো তুলি। নিরব এর সবচেয়ে পছন্দ তুলির এই ঘুমুঘুমু কন্ঠ যেটা ওকে মাতাল করে তুলে, একটা নেশার মতো কাজ করে ওর মধ্যে যেটার নেশা মাদক এর চেয়েও অনেক বেশি, কিন্তু তুলির কথা সুনে নিরব থমকে গেল কারণ তুলি বলেছে নিরব এর বকা শুনলে ওর অভিমান হয় ওর মনের আকাশে মেঘ জমে তাহলে কি তুলি ও নিরব কে চায়! এইটা ভেবেই নিরব মুচকি হেসে মনে মনে ভাবে যে সময় চলে এসেছে তুলিকে ওর মনের কথা জানানোর। বাস এর ব্রেক টাইম এ কুমিল্লা একটা রেস্তোরাঁয় থামিয়েছে। নিরব আস্তে করে তুলিকে ডাক দিলো তুলি চোখ পিটপিট করে মেলে দেখে যে বাস থামানো আর বাস এ কেউ নেই, আমরা কি চলে আসছি নিরব ভাই? না আমরা কুমিল্লা আসছি বাস সবাইকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ত্রিশ মিনিট সময় দিয়েছে, আর তোকে কতবার বলবো যে আমাকে ভাই ডাকবি না কথা কানে যায়না তোর! যা ফ্রেশ হয়ে নে। তুলি চুপচাপ বাস থেকে নেমে মনে মনে ভাবে, বেটা আস্তো একটা খাটাস বলে কিনা ভাই ডাকবি না তাহলে ডাকব টা কি? এখন কি নাম ধরে ডাকবো উনাকে! আজিব লোক একটা! ভেংচি কেটে বললো তুলি। রেস্তরাঁয় যেয়ে সবাইকে পেল তুলি রাগ করে যেয়ে বললো, কিরে তোরা আমাকে রেখে চলে আসছিস কেন তাও তোর খাটাশ ভাই টার কাছে? ইস এখন আসছে আমার ভাইকে খাটাশ বলতে, ভাই এর বুক এ যখন ঘুমাচ্ছিলি তখন কই ছিল এই কথা? ভাইয়ের সাথে লেপ্টে ঘুমাচ্ছিলি তুই, তো ডাকতাম কিভাবে? সুমি বলে উঠলো। তুলি লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে গেলো। সবাই তুলির অবস্থা দেখে হেসে দিল আর বললো, থাক আর লজ্জা পেতে হবেনা চল ফ্রেশ হয়ে নেই সবাই। নিরব দূর থেকে দারিয়ে তুলির লজ্জা রাংঙা মুখ দেখে মুচকি হাসলো।
সবাই ফ্রেশ হয়ে হালকা পাতলা খাবার খেয়ে বাস এ যেয়ে উঠলো। বাস এ উঠে সবাই ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে গেলো। ভোর ৬ টায় বাস গন্তব্যে পৌঁছালো। এইখান থেকে জাহাজ এ করে সেন্ট মার্টিন এর উদ্দেশ্যে রওনা হবে। জাহাজ এ উঠতে নিয়ে তুলি পা পিছলে পরতে নিলে নিরব এসে ধরে ফেলে, ” গায়ে জোর নেই নাকি তোর যেখানে সেখানে পরে যাস, এখন পরলে কি হতো”? ‘সরি’ ছোট করে বললো তুলি। নিরব আর কিছু না বলে কোলে তুলে নিল তুলিকে আর যেয়ে সিট এ বসিয়ে দিল। তুলির তো লজ্জায় জান যায় অবস্থা। সবাই মুচকি মুচকি হাসছে ওদের দেখে। রাকিব যেয়ে রায়না কে বলে, দেখো ওদের কেমিস্ট্রি টা অনেক ইউনিক না? কি সুন্দর একজন আর একজনকে সাপোর্ট করে, খেয়াল রাখে, ওদের দেখলে যে কেউই মনে করবে ওরা কাপল তাই না? “হুম” ছোট করে বললো রায়না। রাকিব আস্তে করে বললো, আমিও তো চাই তোমার খেয়াল রাখতে, তোমাকে ভালবাসতে কিন্তু তুমি তো কিছুই বুঝোনা। রায়না রাকিব এর ফিসফিসানি সুনে বললো, আমাকে কিছু বলছেন? না তো আমি তো এমনিই বলছি নিজের সাথে কথা, ভেবলাকান্তের মতো বললো রাকিব।
চলবে…….
মাতাল হাওয়া
৪র্থ_পর্ব
তাসনিম জারিন
দুপুর ১২ টার সময় সেন্ট মার্টিন পৌছালো সবাই। “দোস্ত আমার অনেক খিদা লাগছে রে, চল তারাতারি ফ্রেশ হয়ে খাইতে যাই” রাকিব বললো। “পেটুক কোথাকার” ভেংচি মেরে বললো রায়না। নিরব মুচকি হাসলো ওদের খুনসুটি দেখে। হোটেল এ পৌছে মেয়েরা ওদের রুম এ ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর নিরব আর রাকিব ওদের রুম এ। দোস্ত, আর কত লুকাবি তুলির কাছে নিজের মনের কথা, বলে কেন দিস না এখন ও? আর এখন টাইমিং টাও পারফেক্ট, সমুদ্রের ধারে প্রপোজ করা টা খুবই সুন্দর হবে রে। বলবো রাকিব কিন্তু জানিস ভয় হয় ও যদি আমাকে ভুল বুঝে তখন কি করব আমি! ও যদি আমার ভালবাসা না বুঝে তখন কি করব আমি! আরে কি যে বলিস তুলির চোখ দেখলেই বুঝা যায় ও তোকে অনেক ভালবাসে, যে কেউ দেখলেই বুজবে সালা! তুই বুঝিস না। নিরব মুচকি হাসলো কেন জানি ওর নিজের ও মনে হয় তুলি ও ওকে ভালবাসে কিন্তু পরক্ষনে মনে হয় তুলি ওর থেকে অনেক ছোট এই ভেবেও ও ওর ভয় হয়, যাই হোক তুলিকে কখন ও নিজের থেকে আলাদা হতে দিবেনা যা কিছুই হক না কেন, মনে মনে পণ করে নিলো নিরব।
তুলি গোসল করে নিল এখন অনেক টা ফ্রেশ লাগছে। নীল কালার এর একটা কামিজ পরেছে, চোখ এ কাজল দিয়েছে, আর ঠোঁট এ হাল্কা লিপস্টিক দিয়েছে, তেমন একটা মেকাপ করতে পছন্দ করে না তুলি, তাই হালকা সাজ দিয়েছে, অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে, যে কেউ দেখলে চোখ ফিরানো দায় হয়ে যাবে। সুমি, নিপা, রায়না তুলিকে দেখে বললো, আয়হায়! আমাদের ভাই টা তো আজকে চোখই ফিরাতে পারবে না, হাহাহা, ওরা হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো। হয়েছে থামবি তোরা, এমন ভাবে বলছিস যেন আমি উনার বিয়ে করা বউ, ভেংচি কেটে বললো তুলি। “না” তার থেকেও আরো বেশি কিছু, এই বলে চোখ টিপ মেরে হাসতে লাগলো তিনজন। তুলি লজ্জা পেয়ে আর কিছু বললো না কারণ জানে ওদের সাথে কথায় পারবে না। আচ্ছা চল এখন যাওয়া যাক না হয় ভাইয়া রাগ করবে, রায়না বললো। সবাই রুম থেকে বের হয়ে নিচে গেলো যেয়ে দেখে নিরব আর রাকিব আগে থেকেই দাড়ানো। নিরব ফোন এ কাজ করছিল হঠাৎ তুলির দিক এ চোখ পড়লো ওর, তুলিকে দেখে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য ওর মাথা হ্যাং হয়ে গেল, তুলিকে যেনো কোনো নীল গোলাপ এর মতো লাগছে, এত পবিত্র এত স্নিগ্ধ লাগছে যে চোখ ফিরানো দায় হয়ে যাচ্ছে নিরব এর। নিরব কে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। আর ওইদিকে রাকিব রায়নাকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। রায়না একটা গোলাপি রঙের কামিজ পরেছে যা ওর ফর্সা গায়ে খুব ভালো মানিয়েছে, রায়না দেখতেও খুব সুন্দর, হাসলে গাল এ টোল পড়ে যা খুব সুন্দর মানায় ওকে। রাকিব কে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রায়না ব্রু কুচকায় আর ইশারায় বলে “কি মিস্টার”! রাকিব ঢোক গিলে না বোধক চিহ্ন দেখায়।
সবাই দুপুর এর লাঞ্চ শেষ করে সমুদ্র বিচ এ যায়। তারপর সবাই দারুচিনি দ্বীপ, হুমায়ুন আহমেদ এর বাড়ি সমুদ্র বিলাস, শুটকি আর আচার এর বাজার ঘুরে হোটেল এ ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয়। রাত এর খাবার শেষ করে সবাই হোটেল এর সামনে বিচ এ যায়। রাতের ঠান্ডা বাতাস আর সমুদ্রের গর্জন এই দুটো মিলিয়ে প্রকৃতিকে অসম্ভব সুন্দর বানিয়ে দিয়েছে। নিরব আর তুলি একসাথে হাটছে আর রায়না আর রাকিব একসাথে হাটছে। নিপা আর সুমি হোটেল এ রেস্ট নিচ্ছে ওরা আসে নাই। ” তুলি, আমাকে কি তোর অনেক খারাপ মনে হয়? যে তোকে সবসময় বকে, শাষণ করে, তোর সবকিছুতে অধিকার খাটায়, আসলে কি জানিস তোকে আগলে রাখতে চাই, এই দুনিয়া অনেক খারাপ তাই তোকে প্রটেক্ট করতে চাই, যাতে তোর উপর খারাপ কোন কিছুর আচ না আসে”। নাহ আমি এমন কিছুই মনে করিনা, তুমি আমার ভাল চাও তাই আমাকে শাসন করো, আর একটা কথা আছেনা “যে আদর করে সে শাসন ও করে” এইটা বলে জিহবায় কামড় দিল তুলি যে এইটা কি বললাম। নিরব তুলির কথা সুনে শব্দ করে হেসে দিল। ও আমি তোকে বকতাম এইটা জানি কিন্তু আদর ও যে করি তা তো জানতাম না! দুষ্টমি করে বললো নিরব। তুলি লজ্জা পেয়ে চলে যেতে নিলে নিরব ওর হাত ধরে হেচকা টান মারে আর তুলি নিরব এর বুকে যেয়ে পরে, দুজন দুজন এর দিক এ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে, নিরব হালকা করে ফু দিতেই তুলি কেপে উঠে চোখ বন্ধ করে নেয়। নিরব তুলির কাপাকাপা ঠোঁট এ হাত বুলায় তুলির নিঃস্বাস যেন আটকে যায় যায় অবস্থা । নিরব আলতো করে তুলির কপাল এ ঠোঁট ছোয়ায়। তুলি কাপাকাপা কন্ঠে বলে, চলো অনেক রাত হয়ে গেছে হোটেলে ফিরে যাই। নিরব বুঝতে পেরেছে যে তুলি লজ্জা পাচ্ছে তাই বললো, চল যাওয়া যাক রাকিব আর রায়নাকে ও খুজি। হুম চলো। “রায়না আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই জানিনা তুমি কিভাবে রিয়েক্ট করবে কিন্তু আমি আর না বলে থাকতে পারছিনা, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসতে চাই, তোমার পথ চলার সঙ্গী হতে চাই, তোমাকে নিজের বুকের মাঝে আটকে রাখতে চাই, হবে কি আমার সঙ্গী”? রায়না পিছনে ফিরে দেখে রাকিব হাটু গেড়ে বসে ওকে প্রপোজ করছে। রায়না অনেক বেশি অবাক হলো কারণ ও কখনও ভাবেই নাই যে রাকিব ওকে এইভাবে প্রপোজ করবে। মুচকি হেসে রায়না বলে উঠে ” আমি তো সেইকবেই আপনাকে মন দিয়ে বসে আছি, সেই কবেই ভালবেসে বসে আছি শুধু অপেক্ষায় ছিলাম যে কবে আপনি আপনার মনের কথা বলেন”। রাকিব খুশিতে রায়না কে জরিয়ে ধরে পাগল এর মতো চিতকার দিয়ে বলে ” ভালবাসি”। “আমিও”
চলবে……….