কাশফুলের মেলা,পর্ব_৯,১০
Writer_Nusrat Jahan Sara
পর্ব_৯
“লজ্জা শরম কী সব পানি দিয়ে ধুয়ে খেয়ে ফেলেছো নাকি?ছিঃ ছিঃ ভর দুপুরে দরজা খুলে কী কেউ এমন করে?এতোটুকুও ম্যানার্সও কী নেই তোমাদের?
চোখে হাত দিয়ে কথাটি বলল একটি মেয়ে।ইশান মুচকি হেঁসে বিছানা থেকে উঠে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,,,
“তা নক না করে কারও রুমে চলে আসা এটা কী ধরনের ম্যানার্স হুম?
“আব আমি জানি নাকি?
“আর কী যেন বলছিলি ভরদুপুরে এসব কেউ করে নাকি?তা কী এমন দেখলি যে এই কথাটি বললি? ওর শ্বাস আটকে গেছিলো তাই আমি ওর মুখে অক্সিজেন দিচ্ছিলাম তাতে খারাপ কোথায়।
ইশানের মিথ্যা কথা শুনে আরশি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।আরশিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশান একটু বাঁকা হেঁসে বলল,,,,
“ঐশী ও হচ্ছে তোর ভাবি আরশি। যা মিট করে আয়।
কথাটি বলে ইশান রুম ছেড়ে চলে গেলো। ঐশী আরশির কাছে এসে বসে বলল,,,
“‘আচ্ছা ইশান ভাই অবশেষে তাহলে তোমাকেই বিয়ে করলো? তা কেমন আছো?
“অনেক ভালো। তুমি?
“আমিও।আমাকে চিনেছো?
“না
“আমি ইশান ভাইয়ের খালাতো বোন।
“ওহ আচ্ছা।
রাত একটা বাজে।সবার খাওয়া শেষ এখন শুধু ইশান,ঐশী,আর আরশিই বাকি আছে। ইশান জেদ ধরেছে আজ মধ্যরাতে খাবে তাই তাদের দুজনকেও না খাইয়ে রেখেছে। আরশি ডাইনিংয়ে খাবার সার্ভ করছে।আর ইশান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো ঐশী দাঁড়িয়ে আছে।ইশান মুখে একটু হাসি টেনে বলল,,,
“তুই এতো রাতে?
“তুমি বিয়ে করেই নিলে?
“হুম
“তুমি পারোও বটে। যে মেয়েটা তোমাকে দিনের পর দিন অপমান করে গেছে চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে শেষে কী না তুমি তাকেই বিয়ে করলে। আর কতো সুন্দর ওকে ভালোবেসে যাচ্ছো?আই জাস্ট কান্ট বিলিভ দিস। কোথায় গেলো তোমার ইগু?
“তুই এট লিস্ট কী চাইছিস বল তো?আমি যে আরশিকে বিয়ে করেছি সেটা কী তুই মেনে নিতে পারছিস না?
“আমি মেনে নিলেই কী আর না নিলেই কী?
“তাহলে এসব কথা উঠছে কেনো?আমি আরশিকে ভালোবেসেছি তাই বিয়ে করেছি
“তুমি শুধু নিজের ভালোবাসাটাই দেখেছ আমার ভালোবাসা দেখনি?কথায় আছে তাকেই ভালোবাসো যে তোমায় ভালোবাসে কিন্তু তুমি তো এতদিন শুধু মরিচীকার পিছনে দৌড়াচ্ছিলো।
“দেখ ঐশী এই ব্যাপারে আমি তোর সাথে কোনো কথা বলতে চাইছিনা।বেড়াতে এসেছিস ভালো কথা। সবার সাথে আনন্দ ফুর্তি কর।এভাবে আমার পিছনে কেনো আইকার মতো লেগে আছিস?আর দেখ আমি এখন বিবাহিত যখন তখন নক না করে আমার রুমে আসিস না।আর কী বলছিলি আমি ওকে ভালোবেসে যাচ্ছি।তোর ধারনা সম্পুর্ন ভুল।আমি এখনো ওকে মেনে নেইনি।ভালোবেসে কাছে টানিনি। এখন যা আমার সামন থেকে।।
ইশানের কথা শুনে ঐশীর গলা ধরে গেলো। এই প্রথম ইশান ওর সাথে এভাবে কথা বলল।সে আরও কিছু বলতে গিয়েও পারলোনা।চোখের জল মুছতে মুছতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।আরশিও রুমে আসছিলো ঐশীকে এভাবে বেড়িয়ে যেতে দেখে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।ইশানের কাছে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“ঐশী এভাবে কেঁদে বেড়িয়ে গেলো কেনো?আপনি কী ওকে বকেছেন?
“তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি যাও এখান থেকে।
আরশি রেগে সব খাবার ঢেকে এসে শুয়ে পরলো। ইশান একবার আরশির দিকে তাকিয়ে খাওয়ার জন্য চলে গেলো ওকে একবারো বলল না।আরশি ভ্যাত করে কেঁদে দিলো।দুপুরে এক চামচ নুডলস খেয়েছিলো এখন বাজে একটা বিশ।এত সময়ের মধ্যে একটা খাবারের দানাও ওর পেটে পরেনি।খিদেয় পেট ছু ছু করছে।আরশি দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পরলো।ক্লান্ত থাকার কারনে খুব তারতাড়িই ঘুমিয়ে গেলো।
সকালে মাথায় কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো আরশির। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো ঐশী ওর দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে আর হাতে একটা প্লেট।
“তুমি? এতো সকালে?
“হুম।কাল ওতো কিছু খাওনি তাই আমিই নিয়ে আসলাম।
“খাবারে আবার বিষ টিষ মেশানো নেই তো?
ইশানের কথা শুনে আরশি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকালো।
“আমি এতোটাও খারাপ নই যে কাউকে খুন করে ফেলব।
ঐশী খাবারটা সেন্ট্রার টেবিলে রেখে হনহনিয়ে চলে গেলো।আরশি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো প্লেটে দুইটা ব্রেড একটা কলা আর কয়েক চামচের মতো জেলি রাখা। আরশি একবার ইশানের দিকে তাকালো তার মুখ তাজা লাগছে তাহলে তো সে খেয়ে নিয়েছে।আরশি ব্রেড দিয়ে জেলি টুকু খেয়ে টন করে প্লেটটা ইশানের সামনে রাখলো।ইশান একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দিলো।আরশি কাপড় গোছাচ্ছে আর ইশানকে বকছে।
“আমি নাহয় তাকে আগে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলামই এখন যে সে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে সেটা কিচ্ছু না।এর চাইতে তো তুর্বই অনেক ভালো ছিলো।
তুর্বর নাম শুনে ইশানের মাথায় দপ করে আগুন ধরে গেলো।প্রতিটা শিরায় শিরায়,রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ বয়ে চলছে।সে এক হাত দিয়ে চুল মুঠি করে নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল,
“কী যেন বলছিলে তুর্বই ভালো ছিলো তাই তো?।
ইশানের এমন ঠান্ডা কন্ঠস্বর আরশির মনে কাটার মতো বিধলো। ঝর আসার পূর্বাভাস পাচ্ছে সে। ঝরের আগে যে প্রকৃতি একদম নিরব, ঠান্ডা আর নিস্তব্ধ থাকে তেমন ইশানের কন্ঠস্বর জানান দিচ্ছে বিশাল এক ঝর আসবে।কথার তালে কী বলে ফেলেছে সেটা ভেবেই এখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।ইশান আবারও ঠান্ডা গলায় বলল,,,
“কী বলছিলো আবার বলো?
আরশি কিছু বলল না মাথা নিচু করে নিলো।ওর মাথা নিচু দেখে ইশানের ইচ্ছে করছে টাটিয়ে কতগুলো চড় বসিয়ে দিতে।আপাতত এই ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলো। ইশান আর কিছু বলল না রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।আরশি দুইবার ডাক দিয়েছিলো শুধু কিন্তু ইশান শুনেনি। ও চলে যাওয়ার সাথেসাথেই আরশি খাটে বসে কেঁদে দিলো।
“আমি বারবার ওকে কষ্ট দিয়ে ফেলি।যতো চাই ওকে কষ্ট দিবনা ততই কষ্ট দিয়ে ফেলি।অতীতেও তাকে কম কষ্ট দেইনি দিনের পর দিন।এখন যখন চাইলাম আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করবো,আর তার জন্য যা করার করবো ঠিক তখুনি সমস্যাটা পাকিয়ে গেলো।আমারি দোষ কেনো যে ওই লম্পটটার নাম মুখে আনছিলাম?এখন কোথায় গেছে সে কে জানে?
ইশানকে এভাবে রুম ছেড়ে চলে যেতে দেখে ঐশী ব্যাপারটা বুঝার জন্য আরশির কাছে এলো।আরশিকেও কাঁদতে দেখে সে একটু ঘাবড়ে গেলো। একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আরশি ভাবি তুমি কাঁদছো?আর এদিকে দেখলাম ইশান ভাই কেমন বিধ্বস্ত মুখে বেড়িয়ে গেলো।তোমাদের মধ্যে কী কোনো মনমালিন্য হয়েছে?
আরশি কিছু বলছেনা একাধারে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে।আরশিকে চুপ থাকতে দেখে ঐশী ওর হাত ধরে বলল,
“চিন্তা করোনা ভাবি।ইশান ভাই চলে আসবে।হয়তো কোনো কারনে রেগে গেছে কিন্তু দেখবে রাগ কমলে আপনাআপনি চলে আসবে।এতো সুন্দর একটা বউ বাসায় রেখে কী করে বেশিক্ষন বাইরে থাকবে বলোতো।
ঐশীর কথায় আরশি একটু মুচকি হাসলেও পরক্ষনে আবারো মুখ কালো করে নিলো।
ঐশী পেছনে দুইহাত দিয়ে মুখটা একটু উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“প্রেমিক কাকে বলে সেটা হয়তো ইশান ভাইকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।কতোটা ভালবাসলে একজন আরেকজনের পাওয়ার আশায় ছয়বছর তার জন্য কাটিয়ে দিতে পারে।জানো তো ভাবি একতরফা ভালোবাসার মতো কষ্ট আর কিছু নেই।একতরফা ভালোবেসে খুব কম মানুষই সাকসেস হতে পেরেছে।কিন্তু ইশান ভাইকে দেখো সে হাত ধুয়ে তোমার পিছনে পরে ছিলো মানে তার তোমাকে চাই মানে চাই।তুমি কেনো কাঁদছো সেটা আমি জানিনা তবে এটুকু জানি ইশান ভাই কখনো তোমায় ছাড়বে না।আগে যেভাবে ভালোবসাত এখনও ঠিক তেমনি ভালোবাসে।শুধু সময়ের বিবর্তনে সে প্রকাশ করতে পারছেনা হয়তো কোনো পরিস্থিতিতে স্বীকার।তবে চিন্তা করোনা খুব সহজেই সে তোমায় আবারো আগের মতো ভালবাসবে।ইশান আরশির ছিলো আরশিরই থাকবে।
ঐশীর কথা শুনে আরশি ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।কাল ওর আর ইশানের কথা শুনে আরশি এতটুকু বুঝে গিয়েছিল যে ঐশী ইশানকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু এই ঐশীই ওকে নির্লিপ্ত ভাবে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে।লোকে বলে ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে কিন্তু ঐশী তো এর বিপরীত। সে পারলেই আরশিকে নানান কটু কথা শুনাতে পারত কিন্তু ও সেটা করেনি।হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসে বলেই ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো থাকতে দেখতে চাইছে।যাকে মন দিয়ে ভালোবাসা যায় তার খারাপ কেউ কোনোদিনই চাইবেনা।
সকাল পেরিয়ে দুপুর চলে এলো ইশানের কোনো খুঁজ নেই।আরশি কেনো কাজেই মন বসাতে পারছেনা। ইশানের মা অনেকবার এসে আরশিকে জিজ্ঞেস করে গেছেন ইশান কোথায়।আরশির উত্তর দেওয়ার মতো কোনো অবস্থায় নেই তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে ঐশী উনাকে কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিলো।
আরশি নুইয়ে নুইয়ে রুম ঝাড়ু দিচ্ছিলো হঠাৎ ইশানকে ওর দিকে হতদন্ত হয়ে আসতে দেখে আরশির মুখে হাসি ফুটে উঠলেও বেশিক্ষণ থাকলো না যখন দেখলো ইশান ওর দিকে একটা সাদা পেপার এগিয়ে দিলো।আরশি নিজের কৌতুহল মেটানোর জন্য তারাতাড়ি পেপারটা খুলে দেখলো এটা ডিভোর্স পেপার। আরশির চোখ দিয়ে না চাইতেও এক ফুটা জল গরিয়ে পরলো।তুর্বর নাম মুখে নিয়ে ছিলো বলে ইশান তাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে।কিন্তু ডিভোর্স পেপার বানাতে তো চার পাঁচদিন লেগে যায় ইশান কয়েক ঘন্টায় কী করে বানিয়ে নিয়ে এলো।
ইশান বেশ শান্ত গলাই বলল,,
“কী করে এত তারতাড়ি ডিভোর্স পেপার বানিয়ে নিলাম সেটাই তো ভাবছো? তাহলে বলছি।আমি জানতাম এমন এক দিন আসবে যে তুমি হয়তো আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে নয়তো আমি তোমাকে দিতে চাইব তাই আমি আগেভাগেই ডিভোর্স পেপার বানিয়ে রেখে দিয়েছি।যদিও জানি বিয়ের ছয়মাসের আগে ডিভোর্স বৈধ না।কিন্তু আমাদের বিয়ের তো একমাসও হয়নি।তাতে সমস্যা কী তুমি এই পেপারে সাইন করে দাও।সাইন করার পর তুমি একদম ফ্রি জীবনযাপন করতে পারবে।শুধু তুর্ব কেনো তু্র্বর মতো আরও হাজার ছেলে পাবে।আমি আর তোমাকে বন্দীদশায় রাখতে চাইছিনা
আরশি এবার ইশানের হাত ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। সে ভাবতেও পারেনি ইশান ওকে সামান্য কথার উপরে ভিত্তি করে এতোবড় শাস্তি দিবে।আরশি হাত ধরাতে ইশান রেগে ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে ছাঁদে চলে গেলো।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি পরছে।ইশানের চুলে বৃষ্টির বিন্দু আটকে আছে।প্রতিটা বিন্দুকে এই মুহুর্তে মুক্তোর ন্যায় লাগছে।আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বেড়ে যেতে লাগল। তাতে ইশানের বিন্দু মাত্রও হেরফের নেই। সে একদৃষ্টিতে আাকাশে তাকিয়ে আছে আর গভীর ভাবে কী যেন ভাবছে,
“আমার সাথে কী এমনটা নাহলেই নয়।আরশি তোমাকে আমি যতবার কাছে টানতে চাই ঠিক ততবারই তুমি আমায় কষ্ট দিয়ে ফেলো। হোক জেনে হোক অজান্তে।ভেবেছিলাম সব কিছু মন থেকে দূর করে আবারো তোমায় আগের মতো ভালবাসব কিন্তু তুমি তো তুর্বকে নিয়েই পরে আছো। তুমি বুঝতে পারবেনা আরশি এই তুর্ব নামটা তোমার মুখে শুনলে আমার কতটা কষ্ট লাগে।যদিও জানি তুমি আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্যই এমন করো।আজ তোমাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার দরকার তাই নকল ডিভোর্স পেপার বানিয়ে এনেছি। শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তোমার পরিক্ষাও নেওয়া যাবে যে তুমি এক্সাক্টলি কাকে চাও আমাকে নাকি তুর্বকে।
হঠাৎ হাতে কারও স্পর্শ পেয়ে ইশান চকিতে পাশে তাকিয়ে দেখলো আরশি ওর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।ইশান একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
“সাধারন একটা বিষয় নিয়ে আপনি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন।
আরশির কন্ঠ জরিয়ে আসছে। কান্না করার ফলে ভালো করে কথা বলতে পারছেনা। ইশান ওর হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে আরেকদিকে ফিরে গেলো।আরশিও ইশানে পিছন পিছন তার কাছে গেলো।
“আমার কাছে কেনো আসছো যাও দূরে সরো।
ইশান কথাটা বলে আরেকটু পিছিয়ে গেলো।ছাদের ওই জায়গাটিতে রেলিঙ নেই।সে আরেকটু সাইডে যেতেই ছাদ থেকে পরে গেলো।আরশি ইশান বলে চিৎকার করে উঠলো।চোখের সামনে ওর স্বামী পরে গেলো চেয়েও আটকাতে পারলোনা।
চলবে…..
কাশফুলের মেলা
পর্ব_১০
Writer_Nusrat Jahan Sara
দেখতে দেখতে জীবন থেকে কী করে এক বছর ফুরিয়ে গেলো বুঝাই গেলোনা।আরশি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে।বাতাসে তার চুল এলোমেলো ভাবে উড়ছে।চোখের নিচে কালোদাগও পরে গেছে।এই বারো মাসে একবারো ভালো করে চোখের পাতা এক করে দেখেনি আরশি সব সময় ইশানের কাছে কাছে থেকেছে।বিছানায় শুয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মেয়ের তিনমাস হতে চলল অথচ এখন পর্যন্ত তার বাবার স্পর্শটুকুও পেয়ে দেখেনি।আরশি আবারো মনে করতে লাগল এক বছর আগের কথা,,,
সেদিন ইশান ছাদ থেকে পরে ওর বা হাত আর ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে গিয়েছিলো।মাথায়ও খুব চোট পেয়েছিলো ডক্টর তো বলেই দিয়ে ছিলো ইশানকে বাঁচানো সম্ভব না তবুও উনারা শেষ চেষ্টা করে দেখবেন বাকিটুকু আল্লাহর হাতে।সেদিন হয়তো ইশানের মা বাবা আর আরশির দোয়ায় ইশান বেঁচে গিয়ে ছিলো কিন্তু এখন সে বেঁচেও মরার মতো। একবছর ধরে ইশান কোমায় আছে। যেদিন আরশি জানতে পারল ও প্রেগন্যান্ট তখনি ওর দুনিয়া অন্ধকারে ছেয়ে গেছিলো। খুশি হওয়ার চাইতে উল্টো আরও কষ্ট পেয়েছিলো।শুধু এটাই ভাবত ইশান নিজের মেয়েকে মেনে নিতে পারবে তো।
ছোট্ট মেয়েটার কান্নার আওয়াজে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো আরশি।তারাতাড়ি মেয়েটাকে এক হাত দিয়ে ধরে কোলে তুলে নিলো।ঠিক তখুনি ওর চোখ পরলো ইশানের আঙুলের দিকে।ওর আঙুল নড়ছে। আরশি আবেগে আপ্লুত হয়ে তারাতাড়ি ইশানের হাত ধরে কেঁদে দিলো।কিছুক্ষণ ওর হাত ধরে রেখে তারাতাড়ি ইশানের মা বাবাকে ডেকে আনলো।
ইশানের মা হতদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করেই প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন
“আমার ছেলের কী হয়েছে আরশি?
“মা ও রেসপন্স করছে।এই দেখো আঙুল নড়ছে।
ইশানের বাবা তারতাড়ি ডক্টরকে ফোন করে আসতে বললেন,
ডক্টর কিছুক্ষন চেকআপ করে বলল ইশান আবারো আগের মতো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।তবে আরও চার পাঁচদিন লেগে যাবে ওকে ঠিক হতে।সবেমাত্র রেসপন্স করেছে।
ডক্টরের কথা শুনে পরিবারে খুশির জোয়ার বয়ে গেলো।পিচ্চি মেয়েটি কী বুঝেছে কে জানে সেও খিলখিল করে হেঁসে দিলো।
পাঁচদিন এভাবেই কেটে গেলো ইশান শুধু এই কদিন হাতই নাড়িয়েছে কিন্তু চোখ মেলে তাকায়নি।সবেমাত্র চোখ লেগে আসছিলো আরশির হঠাৎ মাথায় কারও আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল সে।এই স্পর্শটা যে তার খুব চেনা।মুখ তুলে উপরে তাকিয়ে দেখলো ইশান ওর দিকে মুচকি হেঁসে তাকিয়ে আছে।ইশানকে সুস্থ দেখে আরশি আবেগে কেঁদে দিলো।দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ওর বুকের সাথে লেপ্টে গেলো।ইশান আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।ইশানের নজর বিছানার এক সাইডে যেতেই সে আরশিকে টেলে ওর বুক থেকে তুলে নিলো।
“কী হয়েছে?
“এই বাচ্চাটা কে?আর কোথা থেকে এলো?
আরশি জানত ইশান এমন প্রশ্নই করবে তাই সে কিছুক্ষন নিরব থেকে বলল,
“এটা আমার বাচ্চা মানে আমাদের বাচ্চা।
“তুমি কী পাগল?আমাদের বাচ্চা আসবে কোথা থেকে? আর এই কদিনে বাচ্চাই বা কী করে এলো?
“এ কদিন মানে?
“কয়েকদিন আগেই তো আমি ছাঁদ থেকে পরেছিলাম।
“বারোমাস হয়েছে আপনি বিছানায় পরে আছেন আর আপনি বলছেন কদিন?
“কীহ একবছর?
“হ্যাঁ একবছর। বিশ্বাস না হলে ক্যালেন্ডার দেখেন।
“ওয়েট ওয়েট বারোমাস যদি হয় তাহলে এই বাচ্চার বয়স কতো?
“তিন মাস।
“কিন্তু আমরা তো এমন কোনো সম্পর্কে যাইনি।
“আমি জানতাম আপনি এমন কুয়েশ্চন করবেন ওয়েট
আরশি হাতে করে একটা কাগজ এনে ইশানের হাতে দিলো।ইশান ভালো করে কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে দেখলো এটা ডিএনএ রিপোর্ট। আর ডিএনএ রিপোর্ট এটাই বলছে এই বাচ্চাটা আর কারও নয় ইশানের। ইশান একটু খুশি হলেও পরক্ষনে মুখ কালো করে বলল,
“এই রিপোর্টটা যে নকল নয় সে গ্যারান্টি কে দিবে
“আপনার বাবা মা।আপনার বাবা নিজে ডিএনএ রিপোর্ট এনে আমার হাতে দিয়েছেন।
“কিন্তু কীভাবে কী?
আরশি রিসোর্টে ঘটে যাওয়া মুহুর্তগুলো সব ইশানকে খুলে বলল।ইশানের চোখে পানি চিকচিক করছে।সে খুশিতে আরশিকে দুইহাত দিয়ে জরিয়ে ধরে চুমোয় ভরিয়ে দিলো।
“আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য এতো ছটপট করতাম আর তুমি কী না আমার বাচ্চার মা হয়ে বসে আছো।
আরশি কিছু না বলে মুচকি হেঁসে ওর মেয়েকে ইশানের কোলে তুলে দিলো।মেয়েটা একেবারে বাবার মতো হয়েছে।চোখ নাক ঠোঁট সব ইশানের।ইশানের মনে যে সন্দেহ ছিলো সেটা এখন আর নেই।সে আলতো করে মেয়েটির কপালে চুমো খেলো।
ইশানের সুস্থ হওয়ার খবর শুনে সবাই এসে ওকে দেখো গেলো।বাড়িতে একরকম খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ইশানের মা সকাল থেকে ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করে যাচ্ছেন।আর ওর বাবা মিষ্টি বিতরন করছেন।ইশান নিজের মেয়েকে নিয়ে বসে আছে।মেয়েটিও এক দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝেমধ্যে ফোকলা দাঁতে হাসছে।আরশি মেহমানদের যত্নআত্তি করায় ব্যস্থ।
রাতে ইশান রুমে এসে দেখলো পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।কোনো এক অজানা কারনে ওর বুক কেঁপে উঠল।চারদিকে একবার চোখ বুলালো কিন্তু আরশি কোথাও নেই।হঠাৎই পিছন থেকে কেউ এসে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।ইশান ব্যাক্তিটির হাত ধরে সামনে আনলো।এটা তো আরশি।আরশি নতুন শাড়ি পরে সাজুগুজ করেছে।ইশান ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো যেন কত বছর ধরে ওকে দেখেনি। ক্রমস আরশিকে কাছে পাওয়ার কামনা ওকে গ্রাস করতে লাগল। হয়তো আরশিও সেটাই চায় তাই সেও ইশানকে করে জড়িয়ে ধরলো।
“অনু, অনু তোর পড়া শেষ?
মায়ের ডাক শুনে থেমে গেলো অনু।এতক্ষন দুজন মানুষের প্রেমকাহিনী পড়ে ও চোখ বেয়ে পানি পরেছে।কিন্তু ডায়েরির পরের পাতা তো সব সাদা আর কিছুই লিখা নেই ডায়েরিতে।তাহলে কী উনাদের কোনো বিপদ হয়েছে।অজানা এক আশংকায় বুক কেঁপে উঠলো অনুর।ডায়েরিতে কোনদিনের কোন ঘটনা সব লিখা আছে।অনুর হিসাব মতে এটা আরও বিশ বছর আগের ডায়েরি।
তাহলে তো সেই পিচ্চি মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে।হয়তো আমার সমান হয়ে গেছে এটা ভেবে আলতো করে হাসলো অনু।আচমকাই কেউ ওর হাত থেকে ডায়েরিটা কেড়ে নিলো।অনু তাকিয়ে দেখলো ওর মা।উনার চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে চুলও উষ্কখুষ্ক পরনে মলিন পোষাক।
“কী হয়েছে মা?
“সকাল থেকে রান্না করার মতো যে কিছু নেই সেদিকে কোনো খেয়াল আছে তোমার।সারাদিন এই ডায়েরি নিয়ে পরে থাকো।বলি সামনে যে পু্ুকুরটি আছে সেখান থেকে তো বরশি দিয়ে কয়েকটা মাছ মেরে নিয়ে আসতে পারো।সারাদিন মানুষের বাড়িতে খাটাখাটুনি করে আমার আর ভালো লাগেনা এসব চিন্তা করতে।
অনুর কানে যেন কথাগুলো গেলই না। সে এক ধ্যানে ওর মায়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
“আচ্ছা মা এই ডায়েরিটা তুমি কোথায় পেয়েছো?
অনুর এমন প্রশ্ন উনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।উনি সে দিকে কর্নপাত না করে বললেন,,,,
“পেয়েছি এক জায়গায় তোমার এত কিছু না জানলেও চলবে।কেন যে থ্রী পর্যন্তই লেখা পড়া করিয়েছিলাম কে জানে?যদি না পড়াতাম তাহলে হয়তো এই ডায়েরিটা নিয়ে পরে থাকতেনা আর এটা নিয়ে এত চিন্তাও করতেনা।
অনু মন খারাপ করে নিলো।ওর যে আরও জানতো ইচ্ছে করছে কী হয়েছিলো ওদের জীবনে যে ডায়েরির অর্ধেক অংশই সাদা রয়ে গেলো।
চলবে…..