কাশফুলের মেলা,পর্ব_১৫,১৬

কাশফুলের মেলা,পর্ব_১৫,১৬
Writer_Nusrat Jahan Sara
পর্ব_১৫

অনু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো।আবির এখনো উঠেনি, বোয়াও আসেনি।অনু নিজেই সকালের নাস্তা বানাতে শুরু করল।হাল্কা পাতলা নাস্তা।রান্না শেষ করে অনু আবিরের রুমের দিকে হাঁটা দিল।দরজায় কয়েকবার টোকা দিয়ে আবিরকে ডাকল।বেশ কিছুক্ষন পর আবির দরজা খুলে দিল।অনু কোনো দিকে না তাকিয়েই বলল,

নাস্তা হয়ে গেছে মুখ ধুয়ে খেতে আসুন।

অনু!!!!

আবিরের এমন শান্ত ভরা কন্ঠে অনুর বুক যেন ধক করে উঠল।সে আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে চোখটাও লাল হয়ে গেছে।আবিরের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখল রুমের হাল বেহাল।খাটের উপরে ওয়াইনের বোতল। অনু এটার নাম না জানলেও বোতল দেখে এটা বুঝতে পারল আবির মদ খেয়েছে।কিন্তু কেন?ওর কিসের এত অভাব?

ছিঃ আপনি মদ খান?আপনাকে তো ভালো ভেবে ছিলাম।

আবির একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

তো মদ খেলে কী মানুষ খারাপ হয়ে যায়?কোথায় শুনেছ এই কথা?কাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি।কেন জানিনা শুধু তোমাকে মনে পরে। মন চায় তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে,কাছে পেতে। কিন্তু তোমাকে কাছে আনলে,ছুঁলে আমার অনু আমার উপরে রাগ করবে। বড্ড দোটানায় পরে গেছি আমি।তাই এই দোটানা থেকে বেড়িয়ে আসতেই এসবের ব্যবস্থ। এখন আবার বলনা সাধারন একটা কারনে আমি মদপান করেছি।আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারবেনা।অনেকে আবার বলে মদ খেলে মানুষ নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা।কিন্তু দেখ আমও একদম ফিট।দিব্যি তোমার সাথে কথা বলে যাচ্ছি।মদ আমার উপরে এফেক্ট ফেলতে পারেনা।যাই হোক অনেক কথা বলে ফেললাম এখন বল কেন ডেকে ছিলে?

অনু কান্নাভড়া কন্ঠে বলল,

নাস্তা টেবিলে ঢেকে রেখে দিয়েছি।মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবেন।

কথাটি বলে সে একমুহূর্তও দাঁড়াল না রুমে চলে গেল।

আমার এখানে বেশিদিন থাকা ঠিক নয়।আবির ভালো ছেলে বিধায় সে আমাকে বাজে ভাবে ছুঁই না। কিন্তু মদপান করে সত্যি কথাটা বলেই দিল।বেচারা হয়ত নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে রেখেছে। আর তাছাড়াও একা একটা বাড়িতে দুজন প্রাপ্ত বয়সি ছেলে মেয়ে ব্যাপারটা কেউই স্বাভাবিক ভাবে নিবেনা।আবির নিজেরও ক্ষতি করছে মদপান করে। আমি এখান থেকে চলে যাব আর এক মুহুর্তও আমি এখানে থাকবনা।

আবির ঘুম থেকে উঠে দেখল বারোটা বাজে।কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে মাথা চেপে ধরে নিচে নামল সে।নিজেই লেবু দিয়ে শরবত বানালো।হঠাৎই মনে পরল অনুর কথা। ডাইনিংয়ে রাখা খাবার দেখে তো বুঝা যায়না অনু খেয়েছে?তাহলে কোথায় ও?আর না খেয়েই বা আছে কেন?
আবিরের এবার বেশ রাগ হলো।সে বড় বড় পা ফেলে আরুহির রুমের দিকে হাঁটা দিল।দরজা খুলাই আছে আবির সারা রুমে চোখ বুলাল কিন্তু কোথায়ও অনু নেই।সে চলে আসতে নিবে তখনি চোখ পরল টেবিলের দিকে।একটা সাদা কাগজ উড়ছে।আবির অনেক কিউরিওসিটি নিয়ে কাগজটা হাতে নিলো।সে যেটা ভাবছিলো সেটাই হয়েছে অনু চলে গেছে।যাওয়ার আগে আবার ভাঙা ভাঙা হাতে লিখেও গেছে,,,

প্রিয় আবির!
আমাকে স্বার্থপর ভাববেন না দয়া করে।তিনদিন আমাকে আপনি আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। আর তার জন্য আমি আপনার কাছে চির ঋনি আমি চাইলেই আপনার উপকারের কথা ভুলে যেতে পারবনা। আর আমার উপকার করার জন্যে আমি আপনাকে প্রতিদান স্বরুপ অনেক বড় একটা উপহার দিব।আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি আপনাকে না বলে চলে এসেছি।বিশ্বাস করুন আমি যাওয়ার আগে আপনাকে অনেক ডেকেছি কিন্তু আপনি দরজা খুলেননি।আমি এখন কোথায় যাব তা আমি নিজেও জানিনা।তবে বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে।আর একটা রিকুয়েষ্ট সবসময় নিজের খেয়াল রাখবেন,একদিন মদ খেয়েছেন খেয়েছেন আর খাবেননা। ভালো থাকবেন।আল্লাহ্ হাফেজ।
ইতি
অনু!!!!

আবির লেখাগুলো পড়ে কাগজটা কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলল।

কে হও তুমি আমার যে আমি তোমার কথা মানব? কেনো এরকম স্বার্থপরের মত চলে গেলে অনু বলো?আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তাহলে আমায় বলতে আমি শুধরে নিতাম।কিন্তু আমি ঘুমে থাকা অবস্থায় তুমি পালিয়ে গেলে এটা কী ঠিক করেছো তুমি?আর কী বললে প্রতিদান দিবে?তোমাদের মতো মেয়েদের কাছ থেকে প্রতিদান আশাই করা যায়না। যখন দেখলে তোমার স্বার্থ পুরিয়ে গেলো তখনই পালিয়ে গেলে।বাহ ভালোই করেছো।এই কদিন তোমার কাছে থেকে আমি আমার অনুর খুঁজও করিনি।আজ থেকে আবার ওকে খুঁজবে। ওলিতে গলিতে আনাচে-কানাচে সব জায়গায় ওকে খুঁজব।

মাটিতে কলম পরে আছে। আবির কলমটা তুলতে গিয়ে একটা জিনিস দেখা মাত্রই একেবারে থমকে গেলো।ওর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেড় হলো “না এটা হতে পারেনা”।

অনু পেটে হাত দিয়ে হাঁটছে।রাতে যে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছিলো আর কিছুই পেটে পরেনি। খিদেয় পেট ছুঁ ছুঁ করছে।এখন কোথায় যাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। আবিরের কাছ থেকে তো চলে এলো। সবাই তো আর আবিরের মতো ভালো নয়। যে ওকে বাসায় থাকতে দিবে।হঠাৎ অনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল।

আমার নিজের বাসায় গেলে কেমন হয়?মেয়ে হয়ে যাবনা কাজের মেয়ে হয়ে যাব।আপাতত মেয়ের পরিচয় না দেওয়াই ভালো হবে। তা নাহলে যা ভেবে রেখেছি সেটার উল্টোটা হয়ে যাবে।ভাগ্যিস আবির সেদিন উনাদের ঠিকানা বলেছিলো।

আবিরের কথা মনে হতেই অনুর মুখটা কালো হয়ে গেলো,

সত্যি আমি ওর সাৎে খুব বড় ভুল করেছি।আসার সময় ওকে দেখে আসা উচিৎ ছিল।কিন্তু আমিই বা কী করব?ওকে যদি বলেও আসতাম তাহলে ও আমায় আসতে দিতনা। এক কথায় হিতে বিপরীত হয়ে যেত।আবির এখন কী করছে কে জানে?

আবিরের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা দুইটা বেজে গেলো।অনু এখন তারই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কথাটা ভাবতেই অনুর মনে খুশির বন্যা বয়ে গেলো।দরজার সাথে লাগানো সাইনবোর্ড। তার মাঝে সুন্দর করে লিখা
” ইশান খান”নামটা জ্বলজ্বল করছে। অনু একবার লিখাটাতে হাত বুলাল। এই প্রথম সে তার মা বাবা ভাইকে সামনাসামনি দেখতে পারবে।অনু আর দেরি না করে কলিংবেল চাপলো।মধ্য বয়সী একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিল। মহিলাকে দেখে সে থতমত খেয়ে গেল।মহিলাটি অনুকে বেশকিছুক্ষন স্ক্যান করে বলল,

তোমাকে জানি কোথায় দেখেছিলাম? হ্যাঁ মনে পরেছে।তেমাকে তো আমি আবিরদের বাড়িতে দেখেছিলাম। তুমি তো ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে রাইট?

হ্যাঁ।

তাহলে এখানে কী চাই?

অনু কেনো দিশা না পেয়ে বলল,

আসলে আমার কাজ চাই।আবির বাবু আমাকে বিদায় করে দিয়েছে।এখন যদি কোনো কাজ না পাই তাহলে যে আমায় না খেয়ে থাকতে হবে।দয়া করে আমাকে কাজে নিন।বেতর স্বরুপ দু’বেলা দুমুঠো ভাত হলেই চলবে।

আচ্ছা ভিতরে এসো আমি ভেবে দেখছি।।।

অনু বাসার ভিতরে গিয়ে একেবারে হা।এতবড় বাড়ির মেয়ো সে।চারিদিকে শুধু দামী আসবাবপত্র। অনুর চোখ পরল সেন্ট্রার টেবিলের উপরে রাখা ফুল ভ্যাসের ওপর। ভ্যাসটাতে প্লাস্টিকের অর্কিড ফুল।অনু ফুলগুলো হাতিয়ে দেখছে।

এই মেয়ে কে তুমি?আর এসবে হাতই বা দিচ্ছো কেন?

অনু মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল সেদিনের ছেলেটি।যাকে ও আবিরদের বাসায় দেখেছিলো।ওর নিজরই ছোট ভাই আদিল খান।

এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?আর এসব জিনিসে একদম হাত লাগাবেনা বলে দিলাম। এগুলো আমার প্রিয় ফুল।আমি কাউকে এসব ছুঁতে দিইনা।

অনু মাথা নাড়িয়ে না করল।সিড়ির দিকে চোখ পরতেই দেখল একজন মধ্য বয়স্ক লোক নিচে নামছেন।অনু লোকটাকে চিনতে পারলনা তাই আদিলকে বলল,

উনি কে?

উনি আমার বাবা ইশান খান।

অনু অবাক হয়ে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন আরশি বা ইয়ান কাউকেই অনু ভালো করে ফলো করেনি।আবিরের মাধ্যমে শুধু এটুকুই জেনে ছিলো যে ইশান খান এসেছিলো।মন চাচ্ছে গিয়ে বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু মা?মা কোথায়?

অনু আদিলকে আবারও জিজ্ঞেস করল

আপনার মা কোথায়?

আশ্চর্য একটু আগেই মা আপনার সাথে ছিলো।

কীহ এটা মা ছিলো আর আমি একবার সালাম পর্যন্ত করলাম না।

ইশান সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে অনুর সামনে দাঁড়াল। অনু মায়াবী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাল। কত ইচ্ছে ছিলো বাবার বুকে মাথা রেখে সুখ দুঃখ প্রকাশ করবে।কিন্তু আজ বাবাকে কাছে পেয়েও একবার ছুঁতে পারছেনা বুকে মাথা রাখতে পারছেনা। অনুর চোখে পানি টলমল করছে। এই মানুষ গুলো থেকে কী না এতদিন সে দূরে ছিলো।অনু ইশানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আদিলের দিকে তাকাল।আদিল সোফায় বসে পায়ের উপরে পা তুলে ফোন টিপছে।বুকে আবার সানগ্লাসও গেথে রেখেছে হয়তো কোথাও একটা যাবে। বাবার মতোই সুন্দর হয়েছে।অনুর খুব ইচ্ছপ করছে নিজের ভাইটাকে আদর করতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।আপাতত সে খুব কষ্টে নিজের ইমোশনটাকে কন্ট্রোল করে রেখেছে। ইশান বেশ গম্ভীর গলায় বলল,

চলবে,,,

কাশফুলের মেলা
পর্ব_১৬
Writer_Nusrat Jahan Sara

ইশান গম্ভীরমুখে বলল,

“তোমার মা বাবা কোথায়? আর উনারা কী করেন? ফুল ডিটেইলস চাই আমার।এমন একটা মেয়েকে কেউ কী করে কাজে পাঠাতে পারে?

অনু এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলো।এখন কী করবে সে?তার মা বাবা যে স্বয়ং তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।তারপরও অনু কোনোরকমে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,

“আমার বাবা মা কেউ নেই,যাওয়ার মতোও কোনো জায়গা নেই। তাই তো মানুষের বাড়িতে কাজের জন্য ঘুরাফেরা করি।তাতে যদি দুমুঠো অন্য আর থাকার জন্য একটু আশ্রয় পাই।

“কিন্তু আমাদের বাসায় আপাতত কাজের জন্য কোনো মানুষের দরকার নেই।তারপরও তুমি যখন এত করে বলছ তাহলে ঘর মুছার কাজ নাহয় তোমায় দেওয়া হল।আশা করি কাজে কোনো রকম ফাঁকিবাজি করবে না।

“জ্বী অবশ্যই!!!

আবির জোড়ে ড্রাইভ করছে আর অনুকে খুঁজে যাচ্ছে।ঠিক যেখান থেকে সে অনুকে এনেছিল সেখান থেকেই ওকে খুঁজে আসছে।এখন গাড়িটা একটা নির্জন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তাতে হেলান দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস টানছে।পকেটে রাখা ফোনটা বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তবোধ করল সে।ফোনটা পকেট থেকে বেড় করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে তারাতাড়ি কল রিসিভ করল।

“হ্যাঁ বলো আদিল।

“আবির ভাই বাবা কাল তোমায় আমাদের বাসায় আসতে বলেছে।আমার মনে ছিলনা।এখন মনে হল আর ফোন করে বলে দিলাম।কাল সময় করে চলে এসো কেমন?

“ওকে।

সকালে অনু ড্রয়িংরুম মুছছে।আদিল অনুকে গিয়ে বলল আজ আমাদের বাসায় গেস্ট আসবে গিয়ে চা নাস্তার ব্যবস্থা করো।

অনু মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।কলিংবেল বেজে উঠতেই আদিল গিয়ে দরজা খুলে দিল।আবির এসেছে।সে আবিরকে এনে ড্রয়িংরুমে বসালো।আদিল আসাম করে সোফায় বসে আছে।আর আবির নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।আবিরকে এমন চুপচাপ দেখে আদিল ওর কাঁধে হাত রাখল।

“কী হয়েছে আবির ভাই?আসার পর থেকে দেখছি তোমাকে কেমন চিন্তিত লাগছে?

“আংকেল কে ডাকো উনাকেই বলব।

আদিল গিয়ে আরশি আর ইশানকে ডেকে আনল। ইশান গম্ভীরমুখ করে পাশে রাখা সিঙ্গেল সোফায় বসল।

“আংকেল আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

“হ্যাঁ বলো।

“আসলে আমি অনুর খুঁজ পেয়ে গেছি।ইভেন সে আমার বাসায়ই ছিল,কিন্তু ওকে আমি চিনতে পারিনি।জাস্ট একটু আধটু ডাউট হত।

আবিরের কথা শুনে আরশি আর ইশান ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।অনু চা হাতে ড্রয়িংরুমে ঢুকছিলো।ওর নজর আবিরের দিকে যেতেই সে একেবারে থমকে গেল।তারপরও কোনো রকমে টে টা টি-টেবিলের উপরে রেখে চলে আসতে নিবে তার আগেই আবির ওর হাত খপ করে ধরে ফেলল।এতে ইশান আর আরশি অবাকের আরও চরম পর্যায়ে।

“আর কত লুকোচুরি খেলবে অনু?কী পাচ্ছো এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে?তোমার মা কষ্ট পাচ্ছে, বাবা কষ্ট পাচ্ছে, ভাই কষ্ট পাচ্ছে, ইভেন আমিও কষ্ট পাচ্ছি,।বলো আর কত কষ্ট দিবে সবাইকে?কিসের এত অভিমান তোমার উনাদের প্রতি যে নিজের বাসায় কাজের মেয়ে সেজে এসেছো?

আরশি,ইশান,আদিল সবাই আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।কিন্তু অনু অবাক হয়নি।সে জানত এটা হওয়ারই ছিল।
ইশান অবাক হওয়ার ভঙিতে আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“এসব কী বলছো তুমি আবির?কী প্রমানের ভিত্তিতে তুমি বলছ ওই হল আমাদের অনু?

আবির ফার্স্ট টু লাস্ট সব খুলে বলল ইশানকে।কোথায় থেকে নিয়ে এসেছিল?সব খুলে বলল।

“শুধু তাই নয় আংকেল আরেকটা বিশেষ প্রমাণ আছে যার উপরে ভিত্তি করে আমি সিওর যে ওই অনু।

“কী প্রমাণ আবির?

আবির ওর পকেট থেকে লকেটটা বেড় করল।লকেট দেখে অনু চমকে ওর গলায় হাত দিয়ে দেখল সত্যিই গলায় ওর লকেটটি নেই।আবির আরশির সামনে লকেটটি ধরে বলল,

“আন্টি দেখেন তো এই লকেটটি চিনতে পারছেন কী না?

আরশি কিছুক্ষন লকেটটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

“হ্যাঁ এটাতো আমার মেয়ে অনুর।ইশান নিজে ওর জন্য ডিজাইন করে লকেটটি বানিয়ে এনেছিল।কিন্তু তুমি এটা কোথায় পেলে?

“সব প্রশ্নের উত্তর তো অনু দিবে।তাই না অনু?

“দেখুন আবির,আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি দয়া করে অযথা আমাকে সন্দেহ করবেননা। অনু নামের মানুষ কী আমি একাই নাকি?

“না তুমি একা নও।কিন্তু এই লকেটটি শুধু একজনেরই আছে।এত এত প্রমাণ চারিপাশে তারপরও তুমি অস্বীকার করছো যে তুমি অনু নও।কিন্তু কেন অস্বীকার করছো?স্বাভাবিক ছেলে মেয়েরা তার বাবা মাকে বহুদিন পর দেখলে তাদের বুকে ঝাপিয়ে পরে আর তুমি কী না এত শান্ত হয়ে আছো?স্ট্রেঞ্জ!!

“কারণ আমি আপনাদের অনু নই তাই আমি শান্ত।

“অনু এবার বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

“ওয়েট ওয়েট।আমার জানামতে অনুর গলায় জন্মদাগ আছে।যদি এরও থাকে তাহলে তো এমনি প্রমাণ হয়ে যাবে।অনু দেখি তোমার গলাটা।

আরশি কথাটা বলেই অনুর ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল।অনু গলায় জন্ম দাগটা চিকচিক করছে। আরশি মুখে হাত দিয়ে দুকদম পিছিয়ে গেলো।

আবিরঃ”কী অনু এখনো কী মিথ্যা বলবে যে তুমি অনু নও?

“হ্যাঁ!!আমিই অনু।এখন কী হয়েছে?কী করবেন আপনারা?নিজেদের সাথে বেঁধে রাখবেন?দেখাশোনা করবেন? আদর যত্ন করবেন?কী হবে আর এসব কী করে?কী হবে?

“অনু তুমি উনাদের সাথে এভাবে কথা বলছে কেন?

“আপনি চুপ করুন।উনারা আমার বাবা মা নন।যদি হতেনই তাহলে আমাকে একা এত কম বয়সে আরেকজন মহিলার হাতে দিয়ে আসতেননা। উনি যদি সেদিন আমায় না বলতেন সব সত্যিটা তাহলে তো আমি আমার আসল মা বাবা কে সেটা জানতেই পারতাম না। উনার মুখে সত্যিটা জানার পর সেদিন রাতেই রওনা দেই উনাদেরকে খুঁজতে।কিন্তু যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনের ভিতরে অভিমানটা চাড়া দিয়ে উঠছিল।আবিরের সাথে দেখা হওয়ার পর ওর বাড়িতেই থাকি।তারপর চলে আসলাম ওদের বাড়ি ছেড়েও।কিন্তু যখন কিছুটা দীর্ঘপথ অতিক্রম করলাম তখন মনে হল ওর কাছ থেকে চলে এসে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।এখন কোথায় যাব আমি?কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা।তাই আপনাদের বাসায় এলাম। আর এসে মনে হল এক কাজ ভালোই করেছি।আমার বাবা মায়ের তাদের মেয়ের প্রতি কতটা টান সেটা দেখতে পেয়েছি।এতটাই টান যে বিশ বছর আগে আমায় রেখে এসেছিলো তারপর আর একদিনও দেখতে যায়নি, আমার খুঁজ করতে চায়নি।হয়ত আমি উনাদের বুঝা হয়ে গেছিলাম তাই উনারা আমায় ত্যাগ করে দিয়েছিলেন।

আরশি মেয়ের কথা শুনে নির্জনে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।কিছু বলছেনা।ইশানের চোখেও পানি চিকচিক করছে।অনু নিজের চোখের জল মুছে নাক টেনে আবারো বলল,

“আমায় কেউ ভালোবাসেনি শুধু একজন ছাড়া।আর সে হল আবির। আবির আমায় সব সময় খুঁজ করেছে যা আমার মা বাবাও করেনি।স্বার্থহীন ভাবে ভালোবেসে গেছেন উনি।পৃথিবীতে এখনও সত্যিকারের ভালোবাসা বেঁচে আছে সেটা উনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।

আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আর আমরা তোমাকে ভালোবাসি না তাই-না? তুমি জানো তোমাকে রেখে আসার একমাস পর যখন আমরা বুঝতে পারলাম পারলাম আমরা বিপদমুক্ত তখনি আমরা তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়ে পরি।কিন্তু দুর্ভাগ্য তোমাকে যার কাছে রেখে এসেছিলাম উনি নাকি সেখান থেকে অন্য কোথাও একটা চলে গেছেন। প্রথমদিনের মত ফিরে আসি তারপর তোমাকে আবারো একি জায়গায় খুঁজ করি।বাই এনি চান্স যদি তোমায় পেয়ে যাই।কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হলোনা, পাইনি তোমায় খুঁজে।বিলিভ মি আমরা একটা রাতও ভাবিনি তোমাকে নিয়ে সেটা হয়নি।প্রতি রাতে তোমার জন্য চোখের জল বিসর্জন দিয়েছি।আমাদের প্রথম সন্তান তুমি।শুধু তাই নয়।আমাদের প্রথম ভালোবাসা,অনুভূতি সব মিলিয়ে তোমার জন্ম।তোমার জন্মের আগে আমি চেকআপ পর্যন্ত করিনি।ছেলে হোক বা মেয়ে সেটা জেনে লাভ কী?আল্লাহ খুশি হয়ে যে বাচ্চা দান করবে তাকে নিয়েই আমি সন্তুষ্ট।তবে তোমার বাবা তার পরিবার সবাই তোমায় নিয়ে খুব এক্সাইটেড ছিল।

আরশিকে অনু হাত দিয়ে থামিয়ে দিল।কারণ আরশি কথা বলার মধ্যে হাঁপাচ্ছে। অনু আবারো ভাঙা গলায় বলল,

“আমার শুধু একটা কথাই জানার আছে।তোমরা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে কী করে?সেদিন যদি তোমরা তোমাদের সাথে আমাকেও নিয়ে যেতে তাহলে হয়তো এতদিন আমি মা বাবার ভালোবাসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতাম না।বাঁচলে একসাথে বাঁচতাম আর মরলে একসাথে মরতাম।

ইশান অনুর মাথায় হাত রেখে বলল,

“সবই তো জানো দেখছি।তখন আমাদের প্রাণ সংকটে ছিল।আমরা বাঁচব এই আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম।কিন্তু পথে ওই ঘরটা দেখে তোমাকে বাচাঁনোর কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম।তাই তোমাকে বাঁচানোর জন্য রেখে এসেছিলাম এখনো তুমি কী বলবে আমরা স্বার্থপর?কোনো বাবা মাি চাইনা তার সন্তানের ক্ষতি হোক।

অনু কিছু বলল না মাথা নিচু করে নিলো।সত্যি আর তার কিছু বলার নেই।অযথাই নিজের বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছে।অনুর নজর আদিলের দিকে যেতেই দেখল আদিল কাঁদছে।

“একি আদিল তুমি কাঁদছো?

আদিল এসে অনুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি সত্যি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

“তুমি বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। তবে হ্যাঁ আর কাজের লোকদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবেনা কেমন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here