আয়না,পর্ব:০৩
শাপলা
সারিনা বসে আছে ড. ফাতেমার সামনে।সারিনার মায়ের কাছ থেকে ড.ফাতেমা গতরাতের ঘটনা সবটাই শুনেছে।তিনি সারিনা কে বললো, তুমি দেখেছো তোমার ঘরের আয়নার ভিতরে ১টা ছেলে
ছিল?ঐ ছেলেটা যে তোমাকে ডিস্টার্ব করেছিল?
সারিনা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।ড. হেসে বললো,শোনো কাল যে ঐ ছেলে হুট করে তোমার হাত ধরেছিল তাই তুমি ভয় পেয়েছিলে।আর, অতিরিক্ত ভয় পেলে আমাদের মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।সে ভুলভাল জিনিস দেখে।তুমিও তাই দেখেছো।পর্যাপ্ত ঘুম আর বিশ্রাম নিলে এই হ্যালুসিনেশন কেটে যাবে। সারিনা আবারো হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
সারিনা-কে নিয়ে ওর মা বাড়িতে ফিরে এলো।মা আজকে অনেক মজার মজার সব খাবার রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।বাবাও খুব হাসিখুশি।মা জানালেন তোর বড় ভাই আসবে কালকে ফ্লোরিডা থেকে।তাই,এখন থেকেই বাড়িতে সাজসাজ রব।
সারিনা অবাক হয়ে শুনছে কারন তার যে বড় ভাই আছে এটা সে আজকেই প্রথম শুনলো।কই তার স্মৃতিতে তো কিছুই নেই।
…………
শুভ বসে আছে ওর বাবার সামনে।আমি শুভর বাবাকে অনেক বার বললাম যে , তুমি অফিসে যাও।আমি ছেলে কে বকবো। কিন্তু আমার কথা সাদিক শুনলোই না।সাদিক আজকে শুভর সব খাতা চেক করেছে। সেখানে কোনো অংক,বাংলা এসব লেখা নেই।কি সব অদ্ভুত আঁকিবুঁকি করা।সব খাতায়।শুভ বরাবরই খারাপ ছাত্র। কিন্তু,এমনটা যে ও করে আমার ধারনাতেই ছিল না।শুভর বাবা রাগী চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে।শুভও ওর বাবার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।এতে সাদিক বারবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।কারন,শুভর চোখের দিকে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।ওর বাবা বললো, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক।এতো টাকা খরচ করে আমি তোমাকে বই-খাতা কিনে দিই কি এসব ছাতার মাথা আঁকার জন্য।
সাদিক প্রায় আধাঘণ্টার মতো শুভকে ধমকালো। কিন্তু,শুভ নিরুত্তর।এতে সাদিক আরো ক্ষিপ্ত হলো। শুভর খাতা গুলো পুড়ে ফেললো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার ছেলে হয়ে সে এমন বেয়াদব হয়েছে কেন বলোতো।
শুভ ঠান্ডা গলায় বললো, আমি আগেও বলেছি , আবার বলছি আমি আপনার ছেলে নই।আর,এটা আমি রাগ করে বলিনা।এটা সত্যি।তাই, আপনি বারবার নিজেকে আমার বাবা দাবি করবেন না এতে আমার রাগ হয়।
কথাগুলো বলে শুভ নিজের ঘরে চলে গেল।সাদিক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,তোমাকে তো মা-ই ডাকে তাহলে আমাকে বাবা ডাকে না কেন? আমি সাদিকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কি আমাকে সন্দেহ করছে?
……..
সারিনার বড় ভাইয়ের নাম সাদমান।অবাক করা ব্যাপার হলো,সাদমানও সারিনা কে জিজ্ঞেস করল,’ওহ.. তাহলে তুমিই সারিনা।’ সারিনা অবাক হয়েছে কারন, তার নাহয় কিছু মনে থাকে না তাই বলে তার ভাইও তাকে চিনবে না।এ কেমন কথা?সারিনার বারবার মনে হচ্ছে,নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল আছে।তার,ভাই তার সাথে গল্প করছে নিজের এক্স গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। তার গার্লফ্রেন্ড নাকি সারিনার মতো দেখতে ছিল।এ কেমন কথা? বারবার কথাচ্ছলে সারিনার গায়ে হাত দিচ্ছে।সারিনার খুবই অস্বস্তি হচ্ছে।চরম অস্বস্তির ঘটনা টা ঘটলো সেদিন রাতে। সারিনা দরজা খুলেই ঘুমায় ভয়ের কারনে। মাঝরাতে হঠাৎ সে কারো উপস্থিতি টের পেলো ঘরে। তাকিয়ে দেখলো আর কেউ নয়,সাদমান।সে খুবই অশ্লীল ভাবে কথা বলছিলো সারিনার সাথে।সারিনা চিৎকার করে ওর মাকে ডাকার সময়ই সাদমান ওর মুখ চেপে ধরলো।সারিনা বুঝতে পারলো আজকে ওর কপালে খারাপ কিছু আছে।তবুও,নিজেকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা করলো সে।আর,অবাক করা বিষয় হলো, ও সাদমানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলো। সাদমানের গালে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলো সারিনা।ওর থাপ্পরের চোটে ফ্লোরে পরে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোতে লাগলো সাদমানের।সারিনা অবাক হয়ে গেল,এতো শক্তি ওর!
সাদমান দেখলো সারিনার চোখের মনি দুটো আর কালো নেই,গাঢ় সবুজ রঙা।সে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ততক্ষণে বাবা-মা চলে এসেছে এখানে।তারা বাইরে থেকে দরজা নক করছে ,সারিনা দরজা খুললো। মা-বাবাকে সে সাদমানের খারাপ উদ্দেশ্যের কথা জানালো। কিন্তু, অবাক ব্যাপার হলো বাবা-মা ওকে বিশ্বাস না করে সাদমানের পক্ষে কথা বলছে।উল্টা ওকে বকাবকি করছে। তাদের ভাষ্যমতে তাদের ছেলে নির্দোষ।সারিনাই দোষী।এক পর্যায়ে সারিনার মা বললো,”এই মেয়েকে ঘরে জায়গা দেয়াই উচিত হয় নি।হতে পারে কোনো খারাপ মেয়ে। সেদিন রাতে মায়া না দেখালেই হতো।আজ আর আমার ছেলেকে এতো বড় অপবাদ সহ্য করতে হতো না।” হঠাৎ,সারিনার অনেক কিছু মনে পরতে লাগলো। একদিন রাতে চোখ খুলে সারিনা দেখেছিল এই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা কে।তারা সারিনাকে নাম-ঠিকানা এসব জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু,সারিনা কিছুই বলতে পারলো না।তারপর থেকে মাস ছয়েক হলো সারিনা এখানেই আছে। নিজের মেয়ের মতোই দেখে ওরা সারিনাকে।সারিনা নামটাও ওরাই দিয়েছে।সারিনার চারপাশটা কেমন ঘোলাটে লাগতে লাগলো।ছয় মাস আগে সে কোথায় ছিল?সেই স্মৃতি ওর মনে নেই।এখন ও কি করবে তাও ওর মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ ও দেখলো ওর সামনে থাকা আয়না টা কেমন দুলছে।যেন এটা আয়না নয় স্বচ্ছ কোনো সরোবরের পানি।সারিনা ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগিয়ে গেল,তার হাত আয়নায় রাখলো। খেয়াল করলো হাতটা আয়নার ভিতরে ঢুকে গেছে।সারিনাও পানিতে নামার মতোই আয়নায় চলে গেলো।পিছন থেকে চিৎকার আসতে লাগলো।সবাই ভূত…ভূত বলে চেঁচামেচি করছে।সারিনা বেশিক্ষণ শুনলো না।সে এখন অন্য ১টা জগতে।এখানে সবই আগের জগতের মতো। কিন্তু,কোনো লোকজন নেই। কোথায় যাবে সারিনা জানেনা।কার যেন পায়ের ছাপ মাটিতে।সারিনা সেই ছাপ ফলো করতে লাগলো।
পায়ের ছাপ গুলো আসলে শুভর।শুভও এই পথ দিয়েই সারিনার আয়নায় দৃশ্যমান হয়েছিল।
সারিনা ধীরে ধীরে পায়ের ছাপ এর শেষ প্রান্তে চলে এলো।এখানে আর যাওয়ার পথ নেই।সামনে সে দেখতে পেলো শুভকে। বিছানায় বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। হঠাৎ,সারিনাকে দেখে সে বললো ,তুমি?আমার মন বলছিল তুমি আসবে।শুভ হাত বাড়িয়ে দেয়।সারিনা আছে ১টা ঘোরের মধ্যে।সে নিজের অজান্তেই শুভর হাত ধরে। বেরিয়ে আসে আয়না থেকে।এই আয়নাটাতে ছোট থেকেই শুভ ১টা মেয়েকে দেখতো। মেয়েটাকে নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলতো, আমাদের কোনো নাম হয়না। সারাক্ষন শুভ ওর সাথে কথা বলতো।বড় হওয়ার পর বুঝলো আয়নাতে এই মেয়েটাকে তার মা দেখে না সেই শুধু একা দেখে।সেই মেয়েটার এখন একটা নাম আছে,”সারিনা”….কিভাবে সারিনা নাম পেলো মেয়েটা শুভ জানেনা। কিভাবেই বা আয়না জগতের বাইরে এলো তাও জানেনা। তবে আজ নিশ্চয়ই জানবে।
………
শুভকে সাদিক আজকে এতোটা বকেছে যে শুভ রাতে ভাত খায়নি।অবশ্য শুভরও দোষ আছে।সে কিভাবে নিজের বাবাকে অস্বীকার করতে পারে।আমি ভাবলাম,আজ ওর সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলবো।ও এমন কেন করে?সাদিক ঘুমানোর পরে আমি শুভর ঘরে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।এতো রাতে ওর ঘরে ১টা মেয়ে। আচ্ছা,এই মেয়েটা তো সারিনা।আমি দরজা আটকে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কি?এতো রাতে তুমি এই বাড়িতে কিভাবে এসছো?আর কেনই বা এসেছো?এতো রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছো তোমার মা জানেন? তোমার যদি রাস্তায় বিপদ হতো তবে?
শুভ বললো,মা…আমি তোমাকে ১ টা কথা বলি তুমি মন দিয়ে শোনো।এটা তোমাকে আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,কি কথা?
শুভ বললো,আমি মানুষ নই মা।
– কিহ?কোন ধরনের মজা এইগুলো?
-মজা না মা সত্যিই।
-আচ্ছা সত্যি? তাহলে তুই কি?বল শুনি।
-আমি জ্বীন।তাই, সাধারন মানুষের থেকে আমার শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি।কারন,আমি মানুষের মতো মাটির তৈরী নই।
চলবে……