আয়না,পর্ব:০২

আয়না,পর্ব:০২
শাপলা

রেইনবো কেক দেখে আমি সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।কেউ যেন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে দিয়েছিলো।আমি,শুভর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।শুভর বাবা বললো,কি হলো?এমন করছো কেন?কেকটা খাও। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। “আমাকে কেক খাওয়ানোর এতোই তাড়া?হবে নাই বা কেন?আমি যত তাড়াতাড়ি মরবো ততই তো তোমার লাভ।আমাকে বিষ মিশানো কেক খাইয়ে রিমিকে বিয়ে করবে?”
শুভর বাবা বললো,কি বলছো এসব পাগলের মত?আর রিমি এলো কোথা থেকে?আজকেই আমি রিমিকে জীবনে প্রথম দেখলাম।আর কেকে বিষ থাকবে কেন?
আমি শুভর বাবার কোনো কথাই বিশ্বাস করতে পারলাম না।রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, আমি এক্ষুনি পুলিশে কমপ্লিন করবো।
হয়তো আমি সেদিন সত্যিই থানায় ফোন করতাম। কিন্তু, তার আগেই সাদিক নিজেই আমার সামনে রেইনবো কেক টা খেয়ে ফেললো।বললো,কই বিষ? আমার কিছু হয়েছে কি?
তখন আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম।সাদিক তার বন্ধু আসাদকে ফোন করলো। বললো, রিমিকে দিতে। তখন রিমিকে সে খোলাখুলি সব বললো।এসব শুনে রিমি কান্না করে দিলো।আসাদও রাগারাগী করলো তার বউয়ের নামে এমন অপবাদ দেয়ার জন্য।সাদিক এবার আমাকে রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,কে বলেছে তোমাকে এসব?শুভ বাঁদর টা?
আমি অস্বীকার করলাম।কারন,এর আগেও শুভ এমন উদ্ভট কথা বলে সাদিকের কাছে শাস্তি পেয়েছে।তাই, আমি আর আজকে ওকে বিপদে ফেলতে চাইনা।যা শাস্তি দেয়ার আমিই পরে দিবো।আমি, সাদিকের কাছে ক্ষমা চাইলাম।কাঁদলাম।ব্যাপারটা বাড়তে দিলাম না।
পরদিন আমি শুভকে জেরা করার জন্য ওর রুমে গেলাম। দেখলাম দরজা বন্ধ।কান পেতে রইলাম ও রুমে কি করে… দেখলাম ও খুব কাঁদছে।বিলাপের মতো।আর,কি যেন বলছে।সব কথা বুঝতে না পারলেও খানিক যেটা আমি বুঝলাম তা হলো,ও কারো কাছে আরেকটা সুযোগ চাইছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে,আমাকে আরেকটা শেষ সুযোগ দিন।
কাকে বলছে এসব?ওর তো ফোনও নেই। আমি ওর রুমের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসে আস্তে দরজা খুললাম। দেখলাম ওর ঘরে থাকা বড় আয়নাটার সামনে ও ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গী করে বসে আছে আর কাঁদছে।আমি ওকে ডাকলাম,শুভ তুই এমন করছিস কেন?
শুভ আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
সেইদিনের পর থেকে ওর আয়না রোগ সেরে গেলো।আর, আয়নার সামনে বসে থাকেনা।রোজ স্কুল যায়।বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্ক করতে বসে।আর ৫ টা বাচ্চার মতোই।তবে খুবই বিষন্ন হয়ে থাকে সবসময়।
এভাবে মাস ছয়েক কাটার পরে আমি জোর করে ওকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম। খুবই নামকরা ডাক্তার উনি।গিয়ে দেখলাম আরো বেশ কিছু পেশেন্ট আমাদের মতোই অপেক্ষা করছে।ডাক্তার শুভর সাথে একা কথা বলতে চাইলেন।তাই, আমি ওয়েটিং জোনে বসলাম। আমার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলার সাথে টুকটাক গল্পও হলো।উনি জানালেন, উনার মেয়ের জন্য এসেছেন।মেয়েটার নাম সারিনা। মেয়েটা নাকি ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ খুব কান্নাকাটি করে। কিন্তু,কারন জিজ্ঞেস করলে বলে,জানিনা। খুব কান্না আসে কিন্তু কেন আসে জানিনা।কান্না করার কথা পরে অস্বীকার করে।
ভদ্রমহিলা আমাকে হাতে ইশারা করে ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ১ কিশোরী কে দেখালো।আমি দেখলাম, আমার শুভর বয়সী মেয়েটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে।একদমই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।এর মধ্যে শুভ ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হলো। হঠাৎ,শুভ বারান্দার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে সারিনা নামক মেয়েটার দিকে ছুটে গেলো। আমি আর সারিনার মা-ও পিছন পিছন গেলাম। শুভ গিয়ে সারিনার হাত ধরে ফেলল।বললো,আমাকে চিনতে পারছো? সারিনা এমন আকস্মিক ঘটনায় ভয় পেয়ে গেল।সে বললো,না আমি তোমাকে চিনি না।হাত ছাড়ো। কিন্তু,শুভ বারবার চিৎকার করে একই কথা বলে যাচ্ছিল যে মেয়েটার তাকে চিনা উচিৎ। ততক্ষণে ক্লিনিকের ২ জন কর্মচারী এসে শুভর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু,২ টা প্রাপ্ত বয়স্ক লোক কিছুতেই ওর সাথে পেরে উঠছিল না।ও ধাক্কা দিয়ে লোকগুলোকে ফেলে দিল।এদিকে সারিনা ভয়ে কাঁদতে শুরু করল।এমন সময় ডক্টর ফাতেমা নিজে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে শুভকে বললো,শুভ তুমি ওর হাত ছাড়ো।ও তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা। তুমি আগে বলো তুমি ওকে কিভাবে চিনো? তোমার বন্ধু? তোমার ক্লাসে পড়ে? সারিনার মা বললো,না না আমার মেয়ে তো গার্লস স্কুলে পড়ে। শুভ বললো, আমি সত্যিই ওকে চিনি।
ড. ফাতেমা বললো, ‘আচ্ছা চিনলে প্রথমে বলো তো ওর নাম কি?’এবার শুভ চুপ করে রইলো। অসহায়ের মতো তাকালো।সারিনার হাত ছেড়ে বললো,চলো মা বাড়ি যাবো।সারিনার মা ইচ্ছে মতো শুভকে বকলো।
ড.ফাতেমা আমাকে ৫ মিনিটের জন্য তার কেবিনে ডাকলেন। বললেন, আপনি ঘাবড়াবেন না। নতুন নতুন টিনেজে পা দিয়েছে।এই বয়সে কাউকে ভালো লাগা স্বাভাবিক।এই মেয়ের চেহারার সাথে হয়তো ওর কোনো বান্ধবীর চেহারার মিল আছে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম,আমার ছেলে ১টা বাচ্চা।ও কোনো মেয়েদের দিকে তাকায় ও না। আপনি কি বলছেন এসব?
ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,১৪ বছরে কেউ বাচ্চা থাকে না। আপনি ওর দিকে আরো ভালো ভাবে খেয়াল করুন।
আমি আর শুভ রিকশায় করে বাড়ি ফিরছি।ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎই শুভ বললো, আচ্ছা মা তুমি কি তোমার স্বামীকে অনেক ভালোবাসো?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,কত তোমাকে শিখাবো শুভ নিজের বাবাকে এভাবে সম্বোধন করে না।
“উনি মারা গেলে কি তুমি খুব বেশি কষ্ট পাবে মা?”
আমার মন চাইলো শুভর গালে একটা চড় মারি। কিন্তু,মনকে বোঝালাম ও মানসিক ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।শুভ আবারো বলল,উনাকে তুমি ছেড়ে দাও মা। উনার চারিত্রিক সমস্যা আছে। আমি তোমাকে প্রমানও দিতে পারি।
আমি এবার আর সহ্য করতে পারলাম না।শুভর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।”চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে।”
…….
সারিনা নিজের ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুতেই সে আজকে দিনের ঘটনা টা ভুলতে পারছে।এই ছেলে নিশ্চয়ই পাগল। অবস্য ওটা তো পাগলদেরই জায়গা। কেন যে ওর মা ওকে নিয়ে গেল ওখানে। সারিনা মনে করার চেষ্টা করে ও নাকি মাঝে মাঝে খুব কাঁদে।কই ওর তো মনে পরে না।এসব ভাবতে ভাবতে সারিনা ঘুমিয়ে পরে। মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় টোকা দেয়ার আওয়াজ শুনে সারিনার ঘুম ভাঙে।ও ঘরের আলো জ্বালে।দেখে দরজা খোলাই।তাহলে এমন অদ্ভুত আওয়াজ আসছে কোত্থেকে?সারিনা খেয়াল করলো আওয়াজ টা কেউ কাঁচের উপর করছে।ওর রুমের জানলা কাঁচের।ও ভয় পেয়ে গেলো। ওদের বাসা সাত তলায়।আর, আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই।তাহলে?জানালায় কেউ কিভাবে আওয়াজ করবে?সারিনা রুম থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু,বের হওয়ার সময় ড্রেসিং মিররে চোখ পরায় সে অবাক হয়ে গেলো।সেই আয়নায় ১টা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে‌।সে ভিতর থেকে কিছু বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু,কোনো আওয়াজ আসছে না।তাই,সে জোরে জোরে আয়নায় নক করছে।এই ছেলেটিই হাসপাতালে সারিনার হাত ধরে টানাটানি করেছিলো। সারিনা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here