শুক্লাদ্বাদশী,৭ অন্তিম পর্ব
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
আরোশ স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গা কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। নিশ্বাস ফেলতেও ভারী কষ্ট লাগছে। ভয়ে পেটের ভেতরটা পাক দিচ্ছে৷ কাওছার ভাই কুদ্দুসের পেটে একটা লাথি মারলো। কুদ্দুস কুকিয়ে উঠে।
কাওছার এক গাদা থুথু ফেলে বলে, আরোশ দেরি করা যাবে না! আজকে শালার ব্যাটা গুলাকে জব্দ করতে হবে। এই গ্রাম থেকে জিন্দা ফেরত যেতে দিব না।
— মোট আটজন ওরা!সাথে রাইফেল,অস্ত্র সবই আছে। কিভাবে লড়াই করব আমরা?
কাওছার ভাই গম্ভীর গলায় বলে, ভুলে যাস কেন বারবার ? আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অস্ত্র না থাকলেও যুদ্ধে লড়াই করতে হবে৷
আরোশের চোখে মুখে বিষন্নতা গ্রাস করে ফেলেছে৷
কাওছার ভাই বলল, তুই যদি ভয় পাস তাইলে থাক! আমি একাই যাব৷
— ভয় পাচ্ছি একথা কে বলল? বাংলার ছেলে আমি! সহজে ভয় পাওয়া আমার স্বভাব না৷
কাওছার ভাই বলল, চল আগে দুর্গাদের বাসায় যাই। তুই পেছন দিক দিয়ে যা। আমি সামন দিয়ে যাচ্ছি।
— আচ্ছা।
— আমার কাছে রাইফেল নেই। একটা ডাব কাটা দা আছে। তোকে দিচ্ছে সঙ্গে রাখ৷
— আচ্ছা।
কাওছার ভাই ঘর থেকে দা বের করে দিলে আরোশ আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না।দৌড় লাগালো। হাত-পা ভীষণ রকমের কাঁপছে তার! দুর্গা ঠিক আছে তো! দুর্গা আর সুদীপ মল্লিকের কিছু হলে সে কিভাবে সহ্য করবে? এ’কটা দিনে তাদের প্রতি যে আরোশের মায়া জন্মে গেছে তা খুব করে টের পাচ্ছে সে। চোখের কার্ণিশে যে জল এসে চিকচিক করছে তা অনুভব করছে সে। দু সপ্তাহের কম তাদের সঙ্গে ছিল এতেই এতো মায়া জন্মে গেল?
আচ্ছা! মায়া জন্মানো সহজ নাকি মায়া কাটানো সহজ?
আরোশ এক নিশ্বাসে দৌড়ে দুর্গাদের বাসার পেছন দিকে এসে থামলো। হাঁপাচ্ছে সে।কলপাড়ের দিকটাই পেছনের দিক। এইদিকটায় কেবল আরোশের কোমড় সমান একটা দেয়াল দিয়ে বাঁধাই করা। যা সহজেই টপকে ওই পাড়ে নামা যায়। আরোশ বিড়ালের মতো পা ফেলে দেয়াল টপকালো।দেয়াল টপকে নিচে নেমেই কলপাড়ের এক ভাগের তিন অংশ তার নজরে এলো। সে ধীর পায়ে কলপাড়ে এগুতে লাগে। আশেপাশে অতিরিক্ত নিরবতা যে-টা কিনা আরোশের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দোয়া শুধু একটাই দুর্গা আর সুদীপ মল্লিক যেন সুরক্ষিত থাকে। দরকার হলে নিজের জান বাঁজি রেখে তাদের রক্ষা করবে আরোশ।
সুদীপ মল্লিকের মধ্যে নিজের বাবার ছায়া খুঁজে পেয়েছিল আরোশ। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, আরোশের বাবা সুশিক্ষিত একজন লোক ছিলো এদিকে সুদীপ মল্লিক অশিক্ষিত গ্রামের এক লোক। তাদের ধর্ম আলাদা।,বর্ণ আলাদা, পরিবেশ ভিন্ন, সবকিছুতেই অমিল তারপর ও আরোশ সুদীপের সঙ্গে বাবার মিল পেত?
আচ্ছা! ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে কি পিতা? অবশ্যই! পৃথিবীর সব বাবাই কি এক? তাদের ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিও কি একই রকম?
কলপাড়ে যেতেই আরোশের চক্ষু কপালে উঠে আসলো। দুর্গা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আরোশ আস্তে করে ডাক দেয়, দুর্গা!
দুর্গা ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে নিয়ে জোড়ে বলে উঠে, কে?
আরোশ তার সামনে এসে দাড়ালো এবং ফিসফিস করে বলে, আস্তে কথা বলো।
দুর্গা মাস্টারমশাইকে যেন জানে প্রাণ ফিরে পেল। সে।হড়বড় করে বলে উঠে, বাসায় মিলিটারি বাহিনী এসেছে। বাবা আমাকে এদিকে লুকিয়ে রেখে দরজা আটকে দিয়েছে৷ আপনি আমার বাবাকে বাঁচান মাস্টারমশাই!
বলে আহাজারি করে কান্না ধরলো এবং তাকে জড়িয়ে ধরে। আরোশ আশেপাশে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, ওরা কতজন?
দুর্গা বলল,অনেকজন। মাস্টারমশাই দোহাই লাগে আমার বাবাকে বাঁচান।
তখনি বাসার ভেতর থেকে দুইবার গুলির শব্দ হলো। গুলির শব্দে কাকেরাও কাকা করে উঠে। গাছে বসে থাকা পাখিগুলোও কিচিরমিচির করে ডানা ঝাপ্টাতে লাগে৷
দুর্গার শরীর অবস হয়ে আসলো। সে বাবা বলে চিৎকার করতে গেলে আরোশ তার মুখ চেপে ধরে।
দুর্গার চোখ ভিজে উঠে। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো আরোশের কাছ থেকে। আরোশ তাকে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে। সে জানে, ছেড়ে দিলেই দুর্গা নিজের বাবার কাছে ছুটে যাবে আর তখনি পাক বাহিনী তাকে ধরে ফেলে হয় মেরে ফেলবে কিংবা ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করবে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।
ভেতর থেকে পরিচিত কন্ঠস্বরে গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসে। আরোশের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আরেকজন বাবা মারা গেল! কিন্তু সে অসহায়। কেন এতো অসহায় বাঙালী?কেন নিজের সঙ্গে অবিচার হওয়া সত্ত্বেও পালিয়ে যায়? কেন কিছু সংখ্যক মানুষ নিজের গাঁওয়ের মানুষকে হত্যা করার জন্য পাকদের রাস্তা চিনিয়ে আনছে? কিছু পরিমাণ টাকার জন্য? ছিঃ!
দুর্গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কানে বাবার গোঙ্গানী শোনা মাত্র তার সমস্ত ইন্দ্রীয় অচল হয়ে গেছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে এসে থেমে যাচ্ছে। অশ্রুরা বর্ষণের ন্যায় ঝড়তে পারছে না! চোখেই আটকা পড়ছে।
আরোশ তাকে এক ঝটকায় টেনে বাইরে নিয়ে এলো। দুর্গাকে নিয়ে দেয়াল টপকাতে তার বেগ পেতে হয়েছে তবুও অবশেষে ঝোড়-ঝাড়ে এসে থামলো সে।
দুর্গাকে ছাড়া মাত্র সে পাগলের ন্যায় কান্না জুড়ে দিলো। বাবা বলে দু’বার হাক ছেড়ে ডাকলো প্রতিউত্তরে কেউ ” কি রে মা” বলে আওয়াজ দিলো না।
দুর্গা হাটু গেড়ে বসে কান্না করতে লাগলো। সে মাটির ঘাস টেনে টেনে উপচে ফেলছে। প্রচন্ড কাঁপছে সে।
আচমকা আরোশ ডাব কাটা দা বের করলো। দুর্গা চমকে উঠে দূরে সরে যায়।
সে বলে উঠে, এখান থেকে কোথায় যাবে না। আমি আসছি দূর্গা। তোমার বাবা, আমার বাবার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েই আমি ফিরব।
দুর্গা অবিশ্বাস্য চাউনীতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? আপনার হাতে দা কেন? আপনি কুদ্দুস ভাইয়ের বাসার সামনে কি করছিলেন? আপনি কি রাজাকার?
আরোশ পিলে চমকে উঠে বলে, মায়ের সঙ্গে বেঈমানী করার মতো রুচিহীন না আমি৷
— তাহলে কে আপনি? আপনার পরিচয় কি?
আরোশ কম্পন ধরানো স্বরে বলে উঠে,
আমার প্রথম পরিচয় আমি মানুষ।
আমার দ্বিতীয় পরিচয় আমি মুসলিম।
এবং আমার তৃতীয় পরিচয় আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
দুর্গার গা বেয়ে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। সে এতোই অবাক যে মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারলো না৷
আরোশ দৌঁড়াতে লাগলো এতোগুলো সেনার সঙ্গে তারা দুইজন সরাসরি পারবে না। কাওছার ভাইকে থামাতে হবে। নাহলে সর্বনাশ অপেক্ষা করছে তার জন্য।
___________________
— আসসালামু আলাইকুম জনাব৷
পাকিস্তানি আর্মির আটজন যখন সুদীপ মল্লিকের বাসায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে বের হলো তখনি কেউ তাদের সালাম দিয়ে উঠলো। তারা বেশ বিরক্ত। কথা ছিল কুদ্দুস সঙ্গে সঙ্গে থাকবে কিন্তু ব্যাটা লাপাত্তা।
তাদের মধ্যে কেউ একজন সালামের উত্তর দিয়ে বলে, তোম কওন হো ছোকড়া?
যুবকটা বলে উঠে, স্যার, আমি কুদ্দুসের ভাই। হুট করে ওর জ্বর এসেছে তাই আসতে পারেনি জন্য আমাকে পাঠিয়েছে৷
পাকিস্তানি আর্মির একজন বলে, তোম কুদ্দুসকে কে ভাই হো?
— জি জনাব।
পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকজন সামনে এলো। বেশ লম্বা সে। গটগট করে বাংলায় বলে।,কুদ্দুস ব্যাটা আসে নাই কেন?
— ও অসুস্থ। আমাকে পাঠিয়েছে৷
উনি সরু চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি কে? নাম কি তোমার?
— জি স্যার আমার নাম আরোশ।
— আরোশ?
— জি।
— আরোশ মানে কি?
— আল্লাহর সিংহাসন।
— মুসলিম?
আরোশ হেসে জবাব দিয়ে বলে, মুসলিম জন্য ই তো চাই পাকিস্তান যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ হোক।
পাকসেনার মুখে হাসি ফুটে উঠে। আরোশ জানত তারা এই জবাবে সন্তষ্ট হবে।
একজন বলে উঠে, চল,গ্রামের অন্যন্যা হিন্দুদের বাসায় নিয়ে চলো।
আরোশ বলে উঠে, জনাব একটা সমস্যা আছে৷
কি সমস্যা?
— আসলে আমাদের গ্রামের পুকুর ঘাটের দিকের আইলটা খুব সরু। দুইজন তিনজন ছাড়া যাওয়া যায় না। তার উপর আজকে কাদা কাদা।
— সমস্যা নাই চলো।
আরোশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল এবং বলল, একবারে এতো জন একসাথে গেলে গ্রামবাসী বুঝে গেলে আপনাদের জন্য বিপদ হবে। এরচেয়ে দুইজন করে আইল পার হোন।
— আচ্ছা যেমনটা তোমার ঠিক লাগে।
— আপনারা ছয়জন এখানে অপেক্ষা করুন। আমি প্রথমে দুইজনকে নিয়ে আইল পার করাচ্ছি।
আরোশ দুইজন পাকসেনা নিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো।
বেশ কিছুক্ষন হেঁটে হেঁটে সে পুকুরের সামনে এসে দাড়ালো। পুকুরের পাশেই ধান ক্ষেত এবং ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে চিকন সরু পথ যাকে আইল বলে। ধান ক্ষেত পাড় হলেই ওদিকে চারটা হিন্দু বাড়ি আছে এই বলে পাকসেনা দুটোকে আগে আগে যেতে দিয়ে নিজে পেছনে থাকলো আরোশ।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী ঠিক মাঝে গিয়ে কাওছার হামলা করবে সঙ্গে গ্রামের তিনজন ছেলেও আছে। আর পেছনে তো আরোশ দা হাতে দাঁড়িয়ে আছেই।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মাঝ বরাবর আসতেই কাওছার ভাই পাক বাহিনীর মাথায় আঘাত করে এবং দ্বিতীয় জন কিছু বোঝার আগেই আরোশ দা দিয়ে তার কাধে আঘাত করলো। দুইজনই রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷
আরোশ সময় নষ্ট না করে নিজের শরীর থেকে রক্ত মুছে আবারো উলটো পথে রওনা হলো। প্রচন্ড উত্তেজিত সে। প্রতিটা নার্ভেই শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার৷ তরতর করে।ঘামছে সে।
দুর্গার বাসার সামনে পৌঁছে আবারো দুইজন পাকসেনা নিয়ে বের হয়ে আইলের মাঝে আসলে ঠিক আগের মতোন হামলা করা হয় তাদের উপর। পরিকল্পনা অনুয়ায়ী সবকিছু হচ্ছে জন্য সবাই স্বস্তি পাচ্ছে।
কাওছার ভাইকে একদম ঠিক সময়ে গিয়ে থামিয়েছিল আরোশ। কাওছার দুর্গার বাসায় ঢুকতে যাবে তার আগেই আরোশ তাকে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে এনে এই পরিকল্পনা তৈরি করে।
তৃতীয়বার আর পরিকল্পনা মাফিক কিছু ই হলোনা। পাকিস্তানি বাহিনীর চারজনই একসাথে যাবে। তাদের নাকি অপেক্ষা করে সময় বরবাদ করার ইচ্ছা নেই আর।
আরোশ মহাবিপদে পড়ে গেল। দুরুদুরু বুকে হাঁটা ধরলো সে।
আইলের সামনে এসে এদিক-ওদিক তাকালো। কিভাবে বার্তা পাঠাবে কাওছার ভাইকে? সামনে ঘোর বিপদ! অন্য কোথায় নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এরচেয়ে আইলের মাঝে গিয়ে হামলা চালানোই শ্রেয়।
আইলের মাঝে আসতেই কাওছার ভাই জয় বাংলা বলে প্রথম জনকে আঘাত করে। আরোশ চতুর্থ জনকে পেছন দিয়ে আঘাত করে।
চারজন পাকসেনাকে দেখে কাওছার ঘাবড়ে গিয়ে মহা মূল্যবান সাত সেকেন্ড অপচয় করে যার জন্য তাকে ভর্তুকি পোহাতে হয়। দ্বিতীয়জন তাদের কিছু করতে না পারলেও তৃতীয় পাক সেনা বন্দুক বের করে আরোশের কাধে গুলি করে।
আরোশ সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাকি তিনজন গ্রামের ছেলের মধ্যে একজন শফিক ছিল। সে সুযোগ বুঝে পেছন থেকে তৃতীয় সেনা ও দ্বিতীয় সেনার মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করে।
এভাবেই বাংলার ছেলেরা নিজেদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে নিজের গ্রামের সরল মানুয়গুলোকে দানবদের হাত থেকে রক্ষা করে।
________________
গুলির আঘাতে প্রচন্ড জ্বর আসে আরোশের। তিন দিন সে প্রায় অজ্ঞান থাকে। যখন জ্ঞান ফিরলো তার, সে কাওছার ভাইয়ের বাসায় ছিলো।
আরোশ উঠে দাঁড়ায়। গুলি আঘাতের ক্ষত স্থান ব্যথায় টনটন করে উঠে৷ সে সমস্ত ব্যথা উপেক্ষা করে ছুটে যায় দুর্গার বাসায়৷
সুদীপ মল্লিকের বাড়ি শূন্যতায় খাঁখাঁ করছে। বুক শুকিয়ে যায় আরোশের। দুর্গা কোথায়?
আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখলো উঠানে পা ছড়িয়ে বসে আছে দুর্গা।
আরোশ সামনে গিয়ে ডাক দেয়, দুর্গা?
দুর্গার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। সে যেমন ভাবে চুপ ছিল সেভাবেই চুপ আছে৷
আরোশ জানে সুদীপ মল্লিক আর নেই কিন্তু বিশ্বাস হয় না তার। মৃত্যু কি আসলেই এতো সহজ?
সে পুনরায় ডাকে, দুর্গা।
দুর্গা ভরাট কন্ঠে বলে, আপনি সুস্থ হয়েছেন?
— হ্যাঁ। তুমি কেমন আছো দুর্গা?
দুর্গা সে জবাব না দিয়ে বলে উঠে, আমাকে বিয়ে করবেন মাস্টারমশাই?
আরোশ আতকে উঠে বলে, এইসব কি বলছো তুমি? তুমি জানো না আমি মুসলিম?
দুর্গা তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠে, আমরা সবসময় ভুল মানুষটাকেই কেন ভালোবাসি মাস্টারমশাই?
— দুর্গা ঠিক আছো তুমি?
দুর্গা উত্তর না দিয়ে এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার পরনে কালো শাড়ি। চুল এলেমেলো হয়ে মুখের চারিপাশে ছড়িয়ে আছে৷ দুর্গাকে ঠিক যেন কালিমার মতো লাগছে। শুধু কপালে লাল টিপটার অভাব বুঝি!
আরোশ চমকে উঠে। তিনদিনেই মেয়েটা এমন বদলে কেন গেল? এ কোন দুর্গা? কোথায় হারিয়ে গেল দুষ্টু চঞ্চল দুর্গা? এই দুর্গা এমন লোহার মতো শক্ত কেন?
এরপর! এরপর আরো একমাস কেটে যায়। গ্রামের সবাই জেনে যায়, আরোশ আর কাওছার মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকে গ্রামে ছেড়ে আরো গহীন গ্রামে পালিয়ে যায়। রোজিনার পরিবার ও গ্রাম ছাড়লো। তাদের ইচ্ছা আছে বর্ডার অতিক্রম করে ভারত চলে যাওয়ার।
রোজিনা চলে যাওয়ার আগে দুর্গার হাত ধরে বলে, তুইও চল দুর্গা আমাদের সঙ্গে ।
দুর্গা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলে, বাবার শেষ স্মৃতি ছেড়ে কোথাও যাব না আমি৷
— এ বাসায় থেকে কি করবি একলা?
— জানি না। তুমি আমার চিন্তা করো না৷আমি ভালই থাকব।
রোজিনা দুর্গার কপালে চুমু খেল। সে জানে না এরপর আর কোন দিন দুগ্গার সঙ্গে দেখা হবে কিনা? আদৌ তারা বেঁচে থাকবে কিনা? আবারো নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে আসতে পারবে কিনা? সবকিছুতেই কেমন অনিশ্চয়তা!
এক মাসে গ্রামের কয়েকটা ছেলে মোটামুটি ট্রেনিং রপ্ত করে নেয়। আরোশকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। আপাতত চন্দনপুরে আর ভয় নেই। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী অন্যান্য বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে। ক্যাম্প তৈরি করছে।
চলে যাওয়ার আগের দিন দুপুরে সে দুর্গার বাসায় এসে দেখে দুর্গা ঘরে নেই। খবর পাওয়া গেল দুর্গা নাকি পুকুর ঘাটে বসে আছে৷
আরোশ পুকুর ঘাটে গিয়ে দুর্গার পাশে বসে বলে, দুর্গা আমাকে যেতে হবে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো৷
দুর্গা তার চোখে চোখ রাখলো। সে দিব্যি টের পাচ্ছে মাস্টারমশাইয়ের চোখে বিচ্ছেদের বেদনা। দুর্গা আস্তে করে বলে, আমরা কবে স্বাধীনতা জয় লাভ করব?
— খুব শীঘ্রই।
— দেশ স্বাধীন হলে আপনি ফিরবেন আমার কাছে?
আরোশ নিষ্পলকভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে হাতে হাত রেখে বলে, কেন এমন অন্যায় আবদার করছো?
— ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা রইল, পরের জন্মে
যেন এক তরফা ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে পাঠায় ।
মৃদ্যু হেসে বলল কথাটা দুর্গা।
আরোশ উঠে দাঁড়ায়। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে সে কেঁদে দিবে।
যাওয়ার আগে কাঁপা গলায় আরোশ বলে উঠে, ইনশাআল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো। তুমি নিজের খেয়াল রাখবে। মিলিয়ে নিও! আগামী পূজায় আবারো মেলা হবে। তুমি আলতা কিনতে যাবে। দেখিও সব ঠিক হয়ে যাবে। কারো ভয়ে রাত জাগতে হবে না তোমাকে।
দুর্গা স্বচ্ছ পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, প্রতি রাতে আমাদের আলিঙ্গায় এসে কেন দাঁড়িয়ে থাকেন?
দুর্গার কথায় ভড়কে যায় আরোশ। সে মিনমিন সুরে বলে, জানি না।
এরপর? এরপর আর কথা হয়নি তাদের। আরোশ সত্যি সত্যি পরদিন দুপুরে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে দুর্গার বাসার সামনে গিয়ে দাড়ায়। বুকটা তার হুহু করে উঠে। কাকতালীয় ভাবে আজো দুর্গা ভিজা কাপড়ে তার সামনে তথা উঠানে এসে দাঁড়ায়। অনুভূতিহীন শূন্য চোখে দুর্গা তার দিকে তাকালো এবং স্মিত হাসলো। সেই হাসিটা যেন আরোশের বুকে শূলের ন্যায় বিধলো।
আরোশ বলে উঠে, যাচ্ছি দুর্গা।
— যান। বিজয়ী বীর হয়ে ফিরে আসুন এই প্রার্থনা রইল।
— নিজের যত্ন নিবে।
দুর্গা চোখ মুছে বলে উঠে, পরের জন্ম সত্য হলে, আমি আপনাকে অভিশাপ দিব আপনি যেন আমার হোন ।
আরোশ কিছু বললো না। দুর্গাকে দেখে নিয়ে বের হলো। হাঁটা ধরলো সে। হেঁটে হেঁটে দুর্গার বাসার সামনে গিয়ে গরুর গাড়িতে উঠে পড়ে।
গরুর গাড়ি চলা শুরু করে দিলো। আরোশ পকেট থেকে দুর্গার কাঁচা হাতের চিঠিটা বের করে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
আমি জীবনে তিনজনকে সবচেয়ে ভালোবাসি। প্রথম জন হলো আমার রব। দ্বিতীয়জন হলো আমার দুই মা। একজন যে আমাকে গর্ভে রেখেছে আর দ্বিতীয় মা হলো আমার বাংলা মা — যার বুকে আমি শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি। এবং আমার তৃতীয় ও সবচেয়ে মহামূল্যবান ভালোবাসা হলে তুমি দুর্গা।
আরোশের পেছনে দুটো চোখ থাকলে সে দেখতে পেত, আঠারোতে পা দেওয়া এক তরুণী তার জন্য ইতিমধ্যে অপেক্ষা করা শুরু করে দিয়েছে । তার ফেরার প্রহর গুনছে! অথচ যার জন্য অপেক্ষারত সে, তার ফেরবার কোন প্রতিশ্রুতি নেই।
দুর্গা উঠান পেরিয়ে বাসার সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু নয়ন দিয়ে টলমল চোখে আরোশের প্রস্তান দেখছে।
তার চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে,
“তোমাকে অন্য কেউ আলিঙ্গন করার আগে যেন ঈশ্বর আমার আয়ুরেখার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।”
আচমকা লেলুয়া হাওয়া বয়ে গেল। দুদিন ধরে প্রচন্ড গরম। আরোশ দুর্গার চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলে সে ঘরে ফিরে আসে এবং চমকে যায়, কি আশ্চর্য! মাস্টারমশাইয়ের নাম জানা হলো না তো!
পরক্ষনে সে মনে মনে বলে উঠে, থাক না একটা নামহীন সম্পর্ক!
আজকে দুর্গার মাথার উপর দুটো শালিক পাখি কিচিরমিচির করে গান গেয়ে উড়াউড়ি করছে।
আচ্ছা, আদৌ কোন একদিন এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নটি শেষ হবে? দুর্গা কি আবারো সাদা ও লাল পাড়ের শাড়ি পড়ে আরতি হাতে পূজায় যেতে পারবে কোন দিন? রোজিনা আপা কি আবারো ফিরে আসবেন? আবার আগের মতোন তাকে গ্রামের খবর দিতে দৌঁড়ে আসবেন আপা কোন একদিন? আচ্ছা! কোন একদিন কি মাস্টারমশাই এসে তার সিঁথীতে সিদুর দিবে? আদৌ কি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কোন একদিন? আবারো কি বৃষ্টি নামলে গ্রামের মেয়েরা ভিজতে বের হবে কোন একদিন ?
আদৌ কি বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে জয় বাংলা ধ্বনি উউচ্চারিত হবে? কবে শেষ হবে এই ” কোন একদিনের” অপেক্ষা? কবে অবসান ঘটবে দুর্গার এই মনণ যন্ত্রণার ন্যায় অপেক্ষার?
দুর্গা দু কদম এগিয়ে এসে গম্ভীর দৃষ্টিতে মাথা উচিয়ে শালিকজোড়াকে দেখতে লাগে। সূর্যের তাপে তার মুখ লাল হয়ে এলো।
দুর্গার চোখ বেয়ে প্রায় একমাস পর দু’ফুটো অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
সমাপ্ত।